ডিএনসিসি মেয়র আতিক : ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন করতে পারছি না

আগের সংবাদ

বেহাল রেলের মেগা প্রকল্প : খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পের কাজ কবে শেষ হবে কেউ জানে না

পরের সংবাদ

হুটহাট সিদ্ধান্ত কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে, ভাবা দরকার

প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হুটহাট সিদ্ধান্ত : এক
৩০ জুলাই হ্যামিলনের বাঁশি বেজে উঠল। হুরহুর করে শ্রমিকের দল ছুটে যাচ্ছে সেই বাঁশির টানে। না, সুর-মূর্ছনায় নয়, পেটের ক্ষুধা নিবারণে ছুটে যাওয়া। ৩১ জুলাই দেখা গেল ঝাঁকে ঝাঁকে শ্রমিক ছুটে যাচ্ছে। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে। পোশাক শিল্পসহ ও অন্যান্য উৎপাদনমুখী কলকারখানা খুলে দেয়া হয়েছে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই। চাকরি বাঁচাতে, বেঁচে থাকতে তাই শ্রমিকের দল দলাদলি করে ফিরতে শুরু করেছেন। যারা কলকারখানা হুট করে খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা কিন্তু এই সিদ্ধান্তটা পূর্বে নিলেন না যে, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে তাদের রক্ষা পাওয়ার জন্য গণপরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। করা দরকার। কীভাবে তারা কর্মস্থলে ফিরবে, এই চিন্তাটা কারোর মাথাই এলো না! নাকি এই শ্রেণি ও এই ফেরাটা করোনামুক্ত বলেই ভেবে নিয়েছেন! সত্যিই দুঃখজনক। এমন একটা সিদ্ধান্ত এমন একটা সময়ে নেয়া হলো যখন করোনায় মৃত্যু ও শনাক্তের হার প্রতিদিন আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। স্বজন হারানোর কান্নায় বাতাস ভারি হচ্ছে। অক্সিজেন, আইসিইউর অভাব প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে। গ্রামেগঞ্জে সংক্রমণ ছড়িয়ে গেছে। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে এবং প্রতিদিন স্বাস্থ্যবিধি না মানাদের জরিমানা করছে। এমন একটা সিদ্ধান্ত এমনভাবে নেয়া হলো যে, যখন আমদানিনির্ভর অক্সিজেনের ওপর করোনা মোকাবিলা হচ্ছে। সম্প্রতি একটি স্থানীয় টিভি সংবাদে বলা হলো যে, দেশে অক্সিজেন সিলিন্ডার মাত্র ২৭ হাজার। সরকারি হাসপাতালগুলোর সেন্ট্রাল এসির সংখ্যাও অপ্রতুল। ১৭ কোটি মানুষের জন্য এই অপ্রতুল অক্সিজেন ব্যবস্থা কতটা রক্ষা করতে পারে জীবন।
ব্যবসায়ীদের যদি এতই অর্থনৈতিক চাহিদা ছিল তাহলে কেন এই শ্রমিকদের সুরক্ষিতভাবে আনার কথা ভাবা হলো না? শ্রমিকরা কাজ করলে মালিকদের টাকা হয়, সহজ হিসাব। আর কাজ করে শ্রমিকরা জীবন বাঁচান। কোনটা দামি ও জরুরি, শ্রমিকের জীবন নাকি মালিকের টাকা? উত্তরটা কিন্তু খুব সহজভাবেই দেয়া যায়, শ্রমিকের জীবন সুরক্ষিত না হলে কে কাজ করবে আর কাজ না হলে মালিকেরই টাকা কী করে হবে। মালিক তো আর মেশিন চালান না। তাছাড়া এমন সিদ্ধান্তে কী শুধু এই শ্রমিকরাই করোনায় ঝুঁকিতে পড়ল, নাকি এদের মাধ্যমে সবাইর ঝুঁকি বাড়ল? এই সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোনো জবাবদিহিতা নেয়া হবে কিনা জানি না, যেমন করে পথেঘাটে, রাস্তায় সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি না মানার জবাবদিহিতা নেয়া হয়। জরিমানা করা হয়। একদিকে কঠোর লকডাউনের ঘোষণা, অন্যদিকে শ্রমিকদের জীবন নিয়ে ব্যবসায়ীদের সাপলুডু খেলাটা সত্যিই আতঙ্কের বিষয়। আমাদের স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতার প্রতি গুরুত্ব দেয়া দরকার। আমার মনে হয়, ব্যবসায়ীরা সেদিকে দৃষ্টিপাত করেন না। করোনার মতো একটা অতিমারির সঙ্গে লড়ে যাওয়াটা এমনভাবে চললে পরিণতি খারাপ হবে বৈকি। এমন সিদ্ধান্ত করোনার ভয়াবহতা বাড়ায়, কমায় না। শ্রমিকদের ক্ষোভ দেখা গেল টিভিতে। ৩১ জুলাই যখন লেখাটা লিখছি তখন রাত ১১টায় টিভির স্ক্রলবারে লেখা যাচ্ছে- শ্রমিকদের ঢাকায় ফেরার সুবিধায় ১ আগস্ট দুপুর ১২টা পর্যন্ত গণপরিবহন ও নৌযান চলবে। এমন একটা সিদ্ধান্ত কেন শিল্পকলকারখানা খোলার ঘোষণার সঙ্গে দেয়া হলো।

হুটহাট সিদ্ধান্ত : দুই
এক বছর চার মাস বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি আরো এক মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অজুহাত হলো, করোনা। অন্যদিকে কঠোর লকডাউনের মাঝেই পোশাক ও শিল্পকলকারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। করোনাকালীন অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে সচল রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা সম্ভব হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা ভাবা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত সংশ্লিষ্টরা ভাবতে পারেননি। মৃদু, মাঝারি, কঠোর, চরম কঠোর নানা ধরনের লকডাউনের ভেতর ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীদের চাপে মোটামুটি সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কখনো বন্ধ, কখনো খোলা রাখা হয়েছে। ব্যবসায়ী মহলের চাপে এখানে জীবন-জীবিকা এবং রপ্তানি আয়ের দোহাই দেয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কখনোই কোনো অজুহাতে খোলার কথা উচ্চারিত হয়নি। প্রয়োজনবোধ করেননি কর্তৃপক্ষ। বরং করোনা সংক্রমণ রোধের অজুহাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা দাবি জানিয়েছে। কিন্তু তাদের হয়ে কথিত বিজ্ঞ শ্রেণি শিক্ষার নিয়মিত যৌক্তিকতায় দাবি জানিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো টাকা তৈরি করে না ঠিকই, কিন্তু যা তৈরি করে সেটাই দেশের মূল ভবিষ্যৎ। শিক্ষা একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষিত জাতি তৈরি করার বড় কারখানা। এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করাটা বড় ক্ষতি এনে দিতে পারে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে পড়াশোনার প্রতি নিরুৎসাহিত হওয়ার চান্স থাকে। ভিন্ন দিকে কৌতূহল সৃষ্টি হতে পারে, যা সুস্থ মনমানসিকতায় বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। হচ্ছেও তাই। বিশেষ করে শিশু, কিশোর ও তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলাফলটা তাৎক্ষণিকভাবে বুঝা না গেলেও আগামীতে দৃশ্যমান হবে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যেত কিনা। পালাক্রমে রুটিন করে শ্রেণিভেদে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে আনার ব্যবস্থার কথা সংশ্লিষ্টরা ভাবতে পারতেন। সংক্রমণের ভয়ে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয় শুরু থেকে, তাহলে এখন কেন, কী কারণে সংক্রমণ বৃদ্ধি হলো। অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম চলছে। কিন্তু কতজন শিক্ষার্থীর প্রযুক্তির সামর্থ্য আছে, সেটা কিন্তু সংশ্লিষ্টরা জানেন না। একটা সিদ্ধান্ত হুট করে নিয়ে ফেলেই দায়িত্ব শেষ। কিন্তু সিদ্ধান্তটা কতদূর পর্যন্ত কার্যকর হয়ে উঠবে তার কোনো বাস্তব হিসাব কেউ করেন না। আমার বাসার গৃহকর্মীর কাছে জানতে চাইলাম, নাটোরে তার ছেলে কীভাবে পড়াশোনা করছে? জবাব তার, ছেলের পড়াশোনা বন্ধ। কারণ যাদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল বা কম্পিউটার আছে তারাই অনলাইনে ক্লাস করতে পারে। তাদের তো এসব নেই। পরিষ্কার যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্ত সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য হতে পারেনি। আবার ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠিত স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর কাছে জানতে চাইলাম, অ্যাসাইনমেন্ট সম্পর্কে অভিমত কী? হতাশ হয়ে জানাল যে, অনলাইনে অ্যাসাইনমেন্টের গুণগতমান থাকে না। মেধার সঠিক ফল এতে পাওয়া যায় না। কারণ বই দেখে এখানে কপি পেস্ট করে অ্যাসাইনমেন্টের কাজ করা হয়। এসব বাজারজাত করা হয় অনেকটা নোটের মতো। একটা অ্যাসাইনমেন্টে যে জায়গায় ভুল পরিলক্ষিত হয় দেখা যায় অন্যগুলোতে একই জায়গায় ভুল। এতে পরিষ্কার হয় যে, পেপারটা বিক্রি হয়ে গেছে। এখানে শিক্ষার্থীকে কীভাবে সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব! দেশের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করতে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, শিক্ষক সমাজ, নীতিনির্ধারকদের শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে একটা কৌশলপত্র তৈরি করতে পারেন। করোনা কবে যাবে, কোন ভ্যারিয়েন্ট কখন আরো ভয়াবহ হয়ে দেখা দেবে, মৃত্যুর হার কখন সীমা ছাড়িয়ে যাবে, কেউ তা বলতে পারেন না। করোনার মতো এতটি অদৃশ্য অণুজীবের কাছে গোটা মানবজাতি আজ বিপন্ন। চিকিৎসাবিজ্ঞান তটস্থ। করোনার মধ্য দিয়েই জীবনযাপন চলবে। চলতে মানুষকে অভ্যস্ত হতে হবে। ৩১ আগস্টের পরই যে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, এটা বলা যায় না। আবার বন্ধের ঘোষণা এলে তা শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙে দিতে পারে। সুতরাং শিক্ষা কার্যক্রম কীভাবে এগিয়ে নেয়া যায়, সচল রাখা যায় এবং সর্বস্তরের শিক্ষার্থীকে একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনার আওতায় কীভাবে আনা যায় তার একটি সঠিক রূপরেখা ও সিদ্ধান্ত অভিজ্ঞদের পরামর্শ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের বিশেষ অনুরোধ করব। হুটহাট সিদ্ধান্ত নয়, সঠিক সিদ্ধান্ত দরকার।
পরিশেষে বলব হুটহাট সিদ্ধান্ত নয়। এমন সিদ্ধান্ত নিন যেন করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি না পায় এবং শিক্ষার মতো সবচেয়ে মূল্যবান অধ্যায় বিপর্যস্ত হয়।
স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়