শিগগিরই প্রয়োগ শুরু : আরো ৭ লাখ ৮১ হাজার টিকা এলো জাপান থেকে

আগের সংবাদ

বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গুলিবিদ্ধ ২ : সশস্ত্র আরসা ও আরএসও আধিপত্যের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

পরের সংবাদ

শ্রমিকরা কেন সবসময় ‘এক্সপেরিমেন্টের’ গিনিপিগ?

প্রকাশিত: আগস্ট ২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গিনিপিগ হচ্ছে ইঁদুর জাতীয় এক ধরনের প্রাণী। আকারে ইঁদুরের চেয়ে একটু বড়। আন্দেস পর্বতমালা হচ্ছে গিনিপিগের আদি জন্মভূমি। জীববিজ্ঞানের গবেষণায় মানুষের শরীরে কোনো কিছু পরীক্ষা করার আগে গিনিপিগের ওপর এসব পরীক্ষা করা হয় এবং তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিচার-বিশ্লেষণ করে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত অনুমান করা হয়। ইতিহাসের সাক্ষ্যমতে জীবনবিজ্ঞানীরা সপ্তদশশত থেকে গিনিপিগের ওপর এক্সিপেরিমেন্ট শুরু করেন। প্রথম এ এক্সপেরিমেন্ট হয় ইতালিতে। পরবর্তীতে সারা দুনিয়ায় গিনিপিগ এক্সপেরিমেন্টের একটা আইটেম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। জীববিজ্ঞানের নানান ঐতিহাসিক অর্জনের পেছনে কতশত হাজার গিনিপিগের জীবন উৎসর্গিত হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। মানুষের কল্যাণে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে ও বিস্তারে কত গিনিপিগের অবদান আছে তার কোনো ইতিহাস নেই। একইভাবে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের মৃত্যু এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যতবারই লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, বরাবরই তৈরি পোশাকশিল্পকে খোলা রাখা হয়েছে। জীবন ও জীবিকার সমন্বয়ের নামে কিংবা বিজ্ঞান ও অর্থনীতির বোঝাপড়ার নামে বরবারই মৃত্যুঝুঁকিতে ঠেলে এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ বানানো হয়েছে এসব শ্রমজীবী মানুষকে। এমনকি গত ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে যখন বাংলাদেশে লকডাউন শুরু হয়, তখনো সবকিছু বন্ধ থাকলেও খোলা ছিল পোশাক কারখানা। এরপর থেকে যতবারই কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, শ্রমিকদের এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ বানিয়ে পোশাক কারখানাকে খোলা রাখা হয়েছে। এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা সর্বশেষ নজির হচ্ছে কারখানার মালিকদের চাপে ১ আগস্ট থেকে কারখানা খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত।
চলমান কঠোর লকডাউনের মধ্যে ১ আগস্ট থেকে পোশাকশিল্পসহ রপ্তানিমুখী সব শিল্পকারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। মোটাদাগে ‘রপ্তানিমুখী কারখানা’ লেবেল দেয়া হলেও মূলদাগে ‘পোশাক কারখানাগুলো’ই খুলে দেয়া হয়েছে। ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠিন লকডাউনের নামে ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ আরোপ করা হলেও পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেয়ার জন্য অনেক চেষ্টা-তদবির হয়েছে। কিন্তু সরকার এ যাত্রায় কোনোভাবেই রাজি হয়নি। আমরাও আশার আলো দেখেছিলাম এটা ভেবে যে, এবার অন্তত জীবিকা রক্ষার নামে, আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর আহাজারি দিয়ে এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখার নামে পোশাক কারখানার শ্রমিককে আর মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলা হবে না। কিন্তু বিধি বাম! শেষ পর্যন্ত সন্দেজভাজন মানুষের সন্দেহই সত্যে পরিণত হলো আর আশাবাদীরা হতাশায় নিমজ্জিত হলো। সরকার ১ আগস্ট থেকে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নিল। এটা সহজেই বোধগম্য যে, প্রাইভেট সেক্টরের প্রতি সরকারের একটা দায়িত্ব আছে, রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রতি একটা কমিটমেন্ট আছে, বিভিন্ন প্রাপ্ত অর্ডারের সরবরাহ তারিখ ধরে রাখার একটা ওয়াদা আছে এবং তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখার একটা তাগিদ আছে। এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইএ ও ঢাকা চেম্বারের নেতাদের সঙ্গে সচিবালয়ে এক বৈঠকের পর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কারখানার শ্রমিকরা কীভাবে ১ আগস্টের মধ্যে ঢাকায় ফিরে আসবে, সে চিন্তা সামনে চলে আসে। তখন মালিকপক্ষ সরকারের কাছে প্রতিশ্রæতি দেয় যে, ঢাকায় অবস্থানরত কারখানার আশপাশে যেসব শ্রমিক বাস করে তাদের দিয়ে কারখানা চালু রাখা হবে। আর যারা ঢাকার বাইরে আছে, তারা ৫ আগস্টের পরে অর্থাৎ কঠোর লকডাউন উঠে গেলেই কাজে যোগ দিতে পারবে। দেরিতে কাজে যোগ দেয়ার জন্য কারো চাকরি যাবে না। সঙ্গে এও প্রতিশ্রæতি দেয়া হয় যে, যদি ৫ আগস্টের পরও কঠোর বিধিনিষেধ চলতে থাকে তবে মালিকপক্ষ নিজ দায়িত্বে পরিবহনে ব্যবস্থা করে শ্রমিকদের ঢাকার আনার ব্যবস্থা করবেন। মালিকপক্ষ থেকে এসব প্রতিশ্রæতি আদায় করে নেয়াটা সরকারের কৃতিত্ব বটে কিন্তু মালিকপক্ষ দেয়া প্রতিশ্রæতি রাখছে কিনা সেটা তদারকি করাও জরুরি। আমরা আশ্বস্ত হলাম এটা ভেবে যে, অর্থনীতির স্বার্থে বিজ্ঞানের সঙ্গে খানিকটা কম্প্রোমাইজ করা হলেও শ্রমিককে সুবিধা-অসুবিধার কথাও মালিকপক্ষ সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। কিন্তু আমরা দেখলাম ঠিক তার উল্টো। ৩০ জুলাই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ১ আগস্ট থেকে কারখানা খুলে দেয়া হবে, আর ৩১ জুলাই ঢাকার পথে মানুষের ঢল নেমেছে। লাখ লাখ শ্রমিক জীবিকা রক্ষার স্বার্থে জীবনের ঝুঁকিকে তুচ্ছজ্ঞান করে ঢাকার পথে রওনা দেয়। স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই নেই! সত্যিকার অর্থে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো সুযোগও নেই। ফেরি পার হওয়ার সময় অপেক্ষারত কিছু মানুষের ছবি সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। সেখানে মাস্ক নেই, সামাজিক দূরত্ব নেই এবং স্যানিটাইজারের কোনো ব্যবহার ও ব্যবস্থা নেই। সেখানে আছে কেবল যে কোনো মূল্যে ১ আগস্টের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছানোর তীব্র তাড়া এবং ‘পেট’ বাঁচানোর অপ্রতিরোধ্য তাড়না। এ মানুষগুলোর চোখেমুখে অন্তহীন উদ্বিগ্নতা, তুমুল অনিশ্চয়তা, অশেষ অস্থিরতা আর ঢাকা পৌঁছানোর তীব্র তাগিদ। সেখানে ‘করোনার’ ভয়-ডরের জন্য কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে লাখ লাখ মানুষকে করোনার ক্রমবর্ধমান মৃত্যু এবং সংক্রমণের সংখ্যার সময়ে তীব্র মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কেন আমরা রাস্তায় নামিয়ে দিলাম? এসব শ্রমিক যেমন চরম সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়ছে, তেমনি অন্যকে সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলছে। পাশাপাশি সমাজ এবং দেশকে সংক্রমণ ও মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলছে। সরকার যেখানে করোনা নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। মৃত্যু ও সংক্রমণের সংখ্যা এবং হার কমাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সব শক্তি দিয়ে সবধরনের চেষ্টা করছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা দেড় বছর ধরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাখ লাখ করোনা রোগীকে চিকিৎসা দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। রোগীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যার কারণে যখন গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার জোগাড়! তখন সবধরনের গণপরিবহন বন্ধ রেখে লাখ লাখ শ্রমিককে রাস্তায় নামিয়ে নতুন সংক্রমণের সম্ভাবনা তৈরি করার কী অর্থ দাঁড়ায়? ভারতের অবস্থা ভয়াবহ হওয়ার কারণে করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে যখন সংকট দেখা দেয়, তখন আমরা দেখেছি সরকার সবধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখে সারা দুনিয়াতে চষে বেড়িয়েছে ভ্যাকসিনের জন্য। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা যে খানিকটা সফল হয়েছে সেটা আমরা দেখছি যে, দেশে বিভিন্ন সোর্স থেকে ভ্যাকসিন আসতে শুরু করেছে। ফলে দেশে নতুন করে গণটিকা কর্মসূচি শুরু হয়েছে। ৭ আগস্ট থেকে বয়স সীমা ১৮তে নামিয়ে সপ্তাহে কীভাবে ১ কোটি টিকা দেয়া যায় তার পরিকল্পনা করছে। এভাবে সরকারের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ এবং ক্রমান্বয়ে বন্ধ করার জন্য তখন এ ধরনের আত্মঘাতী কাজ কারা করছে, সেটা জানা জরুরি।
সরকারের সঙ্গে প্রতিশ্রæতি দেয়ার পরও কারা শ্রমিকদের ১ আগস্টের মধ্যে কারখানায় আসতে বাধ্য করেছে, সেটা খুঁজে বের করা জরুরি। কারখানার মালিকরা মিডিয়ায় সামনে বলছে, ১ তারিখ যোগদান না করলে কারো চাকরি যাবে না। কিন্তু শ্রমিকরা মিডিয়াতে প্রকাশ্যে বলছে, তাদের কারখানা থেকে ফোন করা হয়েছে যাতে তারা ১ আগস্ট কাজে যোগ দেয়। সুতরাং সরকারের কাছে মিথ্যা প্রতিশ্রæতি দিয়ে কিংবা সরকারের কাছে দেয়া প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করে লাখ লাখ শ্রমিককে জীবনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলা, সরকারকে বেকায়দায় ফেলে ৩১ জুলাই রাত থেকে ১ আগস্ট কেবল শ্রমিক পরিবহনের জন্য বাস এবং লঞ্চ চালু করতে বাধ্য করা এবং লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে ক্রমবর্ধমান মৃত্যু এবং সংক্রমণের মাত্রাকে আরো বাড়ানোর ঝুঁকির মধ্যে ফেলার দায় এবং দায়িত্ব কার, সেটা খোঁজে বের করা দরকার। ব্যবসায়ী নেতাদেরও একটা নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে, সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করার সময় দেয়া প্রতিশ্রæতি কোনো কোনো কারখানার মালিক ভঙ্গ করে ঢাকার বাইরের শ্রমিকদের ১ আগস্টের মধ্যে কারখানায় যোগ দিতে বাধ্য করছে, সেটা খোঁজে বের করা। অন্যদিকে এসব শ্রমজীবী মানুষ কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামে এবং কেন করোনার ভয়কে তুচ্ছ করে ঢাকায় ফেরে, সেজন্য এসব শ্রমজীবী মানুষকে দায়ী করার একটা সংস্কৃতি সমাজে জারি আছে। মনে রাখতে হবে, এসব শ্রমিক হচ্ছে ব্যবস্থা এবং সিদ্ধান্তের শিকার। তারা সবসময় এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এভাবে আর কত? শ্রমিকের ঘামে এবং রক্তে গড়ে-বেড়ে ওঠা এদেশের অর্থনীতি। তাই তাদের জীবনের মূল্যও আমাদের সমান গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করা জরুরি। আমাদের মনে রাখা উচিত যে, এসব শ্রমিক কেবল বৈদেশিক মুদ্রা বানানোর মেশিন নয়; এরাও মানুষ!
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়