ফখরুলের অভিযোগ : টিকা নিয়ে সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করছে

আগের সংবাদ

পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস : সারা বছর নিষ্ক্রিয় প্রশাসন টনক নড়ে বর্ষা এলে

পরের সংবাদ

পিছিয়ে কেন চামড়াশিল্প!

প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৩০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার আলাদা করতে না পারায় খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের চামড়াশিল্পকে। যে কারণে আশি বছরের পুরনো এ খাতে কোনো শৃঙ্খলা আসেনি। পরিবেশ মানদণ্ডে উন্নীত না হওয়ায় বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশি চামড়ার তেমন ব্র্যান্ড ভ্যালুও তৈরি হয়নি। এ জন্য রপ্তানিমুখী চামড়াজাত পণ্যের জন্য চামড়া আমদানি করতে হয় প্রতিবছর। অথচ প্রতিবছরই দেশে চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ নিয়ে চলে হযবরল অবস্থা। প্রতি বছরই নষ্ট হয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী মূল্যবান এ সম্পদ। এজন্য রপ্তানিমুখী চামড়াশিল্পকে সরকারের বিশেষ সুবিধা দেয়া ও এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী চামড়াশিল্পনগরী পুরোপুরি প্রস্তুতের পাশাপাশি জাতীয় চামড়া নীতিমালা বাস্তবায়নেরও তাগিদ দিলেন তারা।
চামড়াশিল্প পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ বড় ও নতুন উদ্যোক্তার অভাব বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, এ খাতে এখনো তেমন কোনো উদ্যোক্তা আগ্রহী নন। হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান শিল্পটাকে ধরে রেখেছে। গার্মেন্টসের মতো যদি একত্রে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান আসতে পারত, তাহলে চামড়াশিল্প বিশ্বে আরো ভালো অবস্থানে থাকত। এ বিশেষজ্ঞ বলেন, বিসিকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে এ শিল্পের দায়িত্ব দেয়া ছিল সরকারের একটি ভুল সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, ১০ বছরেও চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলতে পারেনি। আমার মতে, ইপিজেড কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে দেয়া হলে এ শিল্প আরো ভালো করতে পারবে। ড. মনসুর বলেন, দেশীয় চামড়া আমরা প্রসেস করতে পারছি না, সঠিকভাবে কমপ্লায়েন্স করতে পারছি না। যে কারণে এ চামড়া দিয়ে পণ্য তৈরি করে তা রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি বড় বড় বিনিয়োগকারীদের এ খাতে বিনিয়োগ করার জন্য আকৃষ্ট করে তুলতে হবে। আমাদের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সার্টিফিকেট নেই। এটা না হলে এ খাতকে আমরা কোনোভাবেই এগিয়ে নিতে পারব না। এ খাতে বিনিয়োগ করতে নতুন নতুন বিনিয়োগেও কেউ আগ্রহী হবে না।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য দেশীয় কাঁচামালভিত্তিক একটি রপ্তানিমুখীশিল্প। জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি, রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়, কর্মসংস্থান এবং মূল্য সংযোজনের নিরিখে এটি একটি অপার সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের পর সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় হয় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে। যার পরিমাণ বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলার। এর অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় দুইশ কোটি

ডলারের। সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিবেচনা করে ২০১৭ সালে চামড়াকে ‘বার্ষিক পণ্য’ ঘোষণা করেছিল সরকার। এ মুহূর্তে চামড়া খাতের সঙ্গে কাজ করছেন প্রায় ছয় লাখ মানুষ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতের বিশাল সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরাও। এ খাতে চীনের রপ্তানি আয় বছরে চার হাজার ৬০০ কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সুযোগ বাংলাদেশের রয়েছে। এজন্য আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী চামড়াশিল্পনগরী পুরোপুরি প্রস্তুতের পাশাপাশি জাতীয় চামড়া নীতিমালা বাস্তবায়নের তাগিদ দিলেন তারা। এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি দক্ষ জনবল, আন্তর্জাতিক বিবেচনায় পরিবেশের মানদণ্ড ও সরকারের নীতি সহায়তা নিশ্চিত করা যায় তাহলে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাত থেকে বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোরের কাগজকে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, সঠিক পলিসি, ট্রান্সফার, কমপ্লায়েন্স- এসবের অভাবেই চামড়াশিল্প এখনো পিছিয়ে আছে। তিনি বলেন, আমাদের এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন লেবার ইনস্টিটিউট আছে; কিন্তু তাদের কারিকুলাম পুরনো। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে লিংক করে কারিকুলাম ঠিক করে চালাবে, তার কোনো ব্যবস্থা নেই। সেই মান্ধাতা আমলের ট্রেনিং পলিসি নিয়েই আছে। ফলে চামড়াজাত পণ্য ডাইভারসিফাই করতে পারিনি। আমাদের টেকনিক্যাল ‘নো হাউ’ যথেষ্ট এগোয়নি। শাহীন আহমেদ আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের এখানে একটা রিসার্চ সেন্টার নেই, ভারতে যেমন রিসার্চ সেন্টার আছে। এখানে নামে মাত্র একটি রিসার্চ সেন্টার আছে, কিন্তু সেটা অকার্যকর। তারা লেদার নিয়ে কোনো রিসার্চ করে না। এ ট্যানারি মালিক সংগঠনের সভাপতি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত কমপ্লায়েন্স হতে পারিনি। সরকার যে শোধনাগারটি তৈরি করে দিয়েছে সেখানে আমাদের ২০ শতাংশ শেয়ার আছে। সেটা পুরনো মান্ধাতা আমলের অকার্যকর একটা সিইটিপি তৈরি করেছে। এগুলো আমাদের অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এ কারণেই আমরা রপ্তানিতে পিছিয়ে আছি। যে পর্যন্ত কমপ্লায়েন্সে না আসতে পারব সে পর্যন্ত আমরা ব্র্যান্ড বায়ারদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারব না। এছাড়া এখানে রিসার্চ সেন্টার অবশ্যই জরুরি বলে জানান তিনি। বিভিন্ন সময়ে শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে বারবার বলা হচ্ছে জানিয়ে শাহীন বলেন, কমপ্লায়েন্স করার দায়িত্ব হচ্ছে বিসিকের। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত সুতরাং ব্যর্থতার দায় আমাদের উপরে চাপানো ঠিক হবে না।
দেখা গেছে, বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে ব্যবসা হিসাবে দেশে চামড়া খাতের যাত্রা শুরু হয়। দেশীয় ব্যবহার ও রপ্তানিতে চামড়ার উপস্থিতি এবং অবস্থান ক্রমে বাড়তে থাকে। এ দেশ মুসলমান প্রধান হওয়ায় পবিত্র ঈদুল আজহার সময় প্রচুর গরু, ছাগল কুরবানি হয়। এছাড়া সারা বছরই এসব পশুর মাংস ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে। ফলে দেশে চামড়ার উৎপাদন ও সরবরাহ ক্রমেই বাড়ছে। ১৯৪০ সালে ব্যবসায়ী রণদা প্রসাদ সাহা (আরপি সাহা) নারায়ণগঞ্জের কাছে সর্বপ্রথম একটি ট্যানারি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫১ সালের অক্টোবরে তৎকালীন সরকার ঘোষিত এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ঢাকার হাজারীবাগে ট্যানারিশিল্প স্থাপিত হয়। ১৯৬৫ সালে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০-এ এবং ১৯৭১ সালে তা হয় ৩৫। কিন্তু এ ৩৫টি ট্যানারির মধ্যে ৩০টিরই মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। ১৯৭২ সালে ট্যানারিগুলোকে সরকারিকরণ করা হয়েছিল; কিন্তু অনবরত লোকসানের মুখে পড়ায় ’৭০-এর দশকের শেষ দিকে এগুলোকে ব্যক্তি মালিকানায় দিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে ট্যানারির সংখ্যা ২৩০ ছাড়িয়ে গেছে, তবে অত্যাধুনিক ট্যানারির সংখ্যা ৩০-এর বেশি নয়। ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে ওয়েট ব্লæ উৎপাদনের সীমিত পরিসর পেরিয়ে ক্রাস্ড ও ফিনিস্ড লেদার, জুতা, ব্যাগ ও অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে চামড়া খাতের রপ্তানিতে পণ্যবৈচিত্র্য এসেছে।
ধীরে ধীরে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিদেশেও পরিচিতি পায় এবং দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি পণ্য হিসাবে পরিগণিত হয়। তবে দেশের চামড়া ব্যবসায়ীদের মুনাফাখোরি এবং প্রক্রিয়াকরণ ও পণ্য উৎপাদনে পরিবেশসম্মত কমপ্লায়েন্স না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কখনো আশানুরূপ হয়নি। ৮০ বছরেরও পুরনো এ শিল্প এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত হতে পারেনি। ফলে আমাদের দেশে ভালোমানের চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করা হলেও তার জন্য ব্যবহৃত চামড়া আমদানি করতে হয়। চামড়াশিল্পকে আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলতে হাজারিবাগ থেকে হেমায়েতপুরে ট্যানারি স্থানান্তর করেছিল সরকার। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এ শিল্পনগরী আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী না হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা চামড়া কিনছেন না। দেশে প্রতিবছর উৎপাদিত ৩০ কোটি স্কয়ার ফিট চামড়ার যথাযথ ব্যবহারও হচ্ছে না। প্রক্রিয়াজাত চামড়া, জুতা ও চামড়াজাত অন্যান্য পণ্য, এ তিন শিল্পের মধ্যে চামড়াজাত অন্যান্য পণ্য ও প্রক্রিয়াজাত চামড়া শিল্পের গতি ক্রমেই নি¤œমুখী হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে জুতা তৈরি শিল্প। এ শিল্পে প্রবৃদ্ধির বর্তমান হার পাঁচ দশমিক নয় শতাংশ। আর, বিশ্ববাজারে জুতা রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অষ্টম। তবে জানা গেছে রপ্তানিকৃত এসব জুতা তৈরি হয় বিদেশ থেকে আমদানি করা চামড়া দিয়ে। ২০১৯ সালে ১১০ মিলিয়ন ডলারের চামড়া আমদানি করতে হয়েছে বলে জানা গেছে।
রপ্তানিকারকরা সীমিত আকারে দেশের চামড়া ও চামড়াজাতসামগ্রী রপ্তানি চালিয়ে গেলেও ‘লেবার ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (এলডব্লিউজি) সনদের অভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক এলডব্লিউজি চামড়াজাত দ্রব্য পরিবেশসম্মত উপায়ে উৎপাদিত হয় কিনা এ ব্যাপারে সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের ট্যানারি ও চামড়াজাত দ্রব্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করে সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করার যোগ্যতা অর্জন করে না। ফলে দেশে উন্নতমানের চামড়া থাকা সত্ত্বেও কমপ্লায়েন্সের শর্তপূরণের জন্য বড় উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে চামড়া আমদানি করে চামড়ার জুতা, ব্যাগ ও অন্যান্য দ্রব্য তৈরি করে রপ্তানি করে থাকে। কিছু বড় উদ্যোক্তা দেশে তৈরি উন্নতমানের জুতা, ব্যাগ ইত্যাদি আমদানি করলেও ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লিখতে না দিয়ে ‘কান্ট্রি অব অরিজিন’ গোপন রাখে।
ট্যানারি ও চামড়াজাত দ্রব্যের প্রস্তুতকারী শিল্প মালিকদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো কমপ্লায়েন্স। ইএসকিউ (এনভায়রনমেন্ট, সোশ্যাল এন্ড কোয়ালিটি), আইএসও এবং অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা সম্ভব হলেই আন্তর্জাতিক ক্রেতা আকৃষ্ট হবে এবং তা এলডব্লিউজি সনদ অর্জনে সহায়ক হবে বলে জানা গেছে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ সালে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয় ১২৫৮ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলার। পরবর্তী তিন অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি আয় ছিল যথাক্রমে ১১৩০, ১১৬১ ও ১২৩৪ মিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি আয় ছিল ১০১৯ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন ডলার।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়