ভূমিহীনদের ঘর পুনর্নির্মাণের দাবি বিএনপির

আগের সংবাদ

ঈদ ঘিরে লকডাউন শিথিল : ১৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত ৮ দিন সারাদেশে বিধিনিষেধ শিথিল, আজ প্রজ্ঞাপন

পরের সংবাদ

আগুনে পুড়ে ৫২ শ্রমিকের মৃত্যু আমরা কী কম দায়ী?

প্রকাশিত: জুলাই ১২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

নারায়ণগঞ্জের একটি কারখানায় আগুনে পুড়ে প্রায় ছাই হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ৫২ জন জ্বলজ্যান্ত মানুষ। নারায়ণগঞ্জের আকাশে-বাতাসে আগুনের ধেঁাঁয়াটে কুণ্ডলীর সঙ্গে মানুষের পোড়া গন্ধ যেন আমার নাকে এসে লাগছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে করে আনা লাশের প্যাকেটগুলো যখন গাড়ি থেকে মর্গে নামানো হচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল এগুলো কোনো মানুষের মৃতদেহ নয়; বরং আগুনে পুড়ে ঝলসে যাওয়া মানুষের দলামোচড়া করা মাংসপিণ্ড। এ দৃশ্য আমি চোখে দেখতে পারছিলাম না। বুকের ভেতরটা কেমন জানি তীব্র কষ্টে চিন চিন করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, এ পোড়া এবং অর্ধ পোড়া মৃত মানুষগুলো বাংলাদেশের জীবিত মানুষগুলোকে বলে যাচ্ছে, তোমরা আর কত নির্বিকার থাকবে? লাশের সারি আর কত দীর্ঘ হলে তোমাদের বিকার হবে? নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজ ফুডস ফ্যাক্টরিতে আগুনে পুড়ে ৫২ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পর আমার বারবার এ কথাটি মনে হচ্ছে। প্রতিবার ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আমরা বিরাট পাণ্ডিত্য নিয়ে তুমুল বিশ্লেষণ করি : এটা ছিল না, ওটা ছিল না, এটা থাকলে ভালো হতো, কিংবা এটা করলে ওটা হতো না জাতীয় নানান আবিষ্কার আমরা দেখছি ৫২ জন জ্বলজ্যান্ত মানুষ পুড়ে প্রায় ছাই হয়ে যাওয়ার পর। প্রায় ২২ ঘণ্টা আগুন জ্বলার পর যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হলো, তখন আমরা জানতে পারলাম যে, এ কারখানাটি তৈরি করার সময় কারখানা তৈরির কোনো নিয়ম-নীতি মানা হয়নি। বাংলাদেশে যে কোনো ভবন নির্মাণের বিধিবদ্ধ নিয়মানুযায়ী প্রতিটি ভবন নির্মাণের আগে তার নকশা প্রণয়ন করতে হয় এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নকশা পাস করে অনুমোদনের পর ভবন নির্মাণ করা হয়। কিন্তু হাসেম ফুড কারখানার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ভবন আগে নির্মাণ করা হয়েছে আর নকশা পরে জমা দেয়া হয়েছে। এবং বিবিসির খবরে একটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানানো হচ্ছে, এখনো পর্যন্ত এ ভবনের নামে জমাকৃত নকশা অনুমোদনই হয়নি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, যে ভবন নির্মাণের এখনো নকশাই অনুমোদন হয়নি, সে ভবন কীভাবে তৈরি হলো? আর সে অবৈধভাবে নির্মিত ভবনে কীভাবে কারখানা পরিচালনার অনুমতি প্রদান করা হলো? প্রতিটি ক্ষেত্রে এভাবে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে কীভাবে একটি কারখানা পরিচালিত হয়? এসব প্রশ্ন এতদিন কেউ তোলেনি। ৫২ জন মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই আমাদের সামনে এসব প্রশ্ন এসে হাজির হয়েছে। তার অর্থ দাঁড়ায়, এভাবে জীবন্ত মানুষ পুড়ে ছাই হলেই কেবল আমরা বুঝতে পারব যে, এসব কারখানা নির্মাণের কোনো নিয়মনীতি অনুসরণ করেনি। আজকে হাসেম ফুড কারখানায় আগুন লাগার কারণে এবং ৫২ জন মানুষের মৃত্যুর কারণে আমরা জানতে পারলাম যে, এটি একটি অবৈধ কারখানা। তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে, এভাবে আবার নতুন করে আগুন না লাগলে এবং নতুন করে কোনো জীবন্ত মানুষ পুড়ে ছাই না হলে বাংলাদেশের অন্য সব কারখানা বৈধ? নতুন কোনো কারখানায় জীবন্ত মানুষের পুড়ে ছাই হওয়ার পর আমরা আবিষ্কার করব যে, সে কারখানাটি নির্মাণে ত্রæটি ছিল, বৈধ অনুমোদন নেই এবং কারখানা নির্মাণের নিয়মনীতি অনুসরণ করেনি। কিন্তু এভাবে আর কত?
সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী এ কারখানায় প্রায় ৪শ শ্রমিক কাজ করে। এবং এই ৪শ শ্রমিকের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে শিশুশ্রমিক। আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুযায়ী শিশুশ্রম নিষিদ্ধ এবং বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের একটি অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র (২০০১ সালের মার্চের ১২ তারিখ বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে)। ফলে এখানে আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের বিধি লঙ্ঘন করে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, এটাও আমরা জানতাম না। এসব শিশুশ্রমিকের কেউ কেউ আগুনে পুড়ে মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়ে আমাদের জানিয়ে গেছে যে, হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজ ফুডসে শিশুশ্রমিকরাও অবৈধভাবে কাজ করে। কেননা যে ৫২ জন শ্রমিক পুড়ে অঙ্গার হয়েছে তার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শিশু। এছাড়া কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই যে এ কারখানা তৈরি করা হয়েছে তার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে, এ কারখানা থেকে বের হওয়ার বিকল্প কোনো সিঁড়ির ব্যবস্থা নেই। যেহেতু কলাপসিবল গেটে তালা দেয়া ছিল, সেহেতু কারখানায় আগুন লাগলেও বিকল্প কোনো পথ না থাকায় শ্রমিকরা কারখানা থেকে বের হওয়ার কোনো পথ পাইনি। আবার আপৎকালীন সময়ে কলাপসিবল গেটের তালা খোলার ব্যবস্থা থাকা জরুরি হলে, সেটার কোনো প্রস্তুতি কারখানায় ছিল না। তাই মৃত শ্রমিকের অনেকেই ২২ ঘণ্টা ধরে জ্বলা আগুনের লেলিহান আঘাত সহ্য করতে করতে অমানবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। তাই এটা দুর্ঘটনায় ঘটা কোনো তাৎক্ষণিক মৃত্যু নয়; এটা এক ধরনের হত্যাকাণ্ড। এখানে অপরিকল্পিতভাবে কারখানা তৈরি করে বিকল্প কোনো নির্গমন পথের ব্যবস্থা না রেখে শ্রমিকদের সদা মৃত্যুর ঝুঁকিতে রাখা এবং আগুন লাগার ঘটনা ঘটার পর তাকে পুড়িয়ে মারার শামিল। এছাড়া কারখানা নির্মাণের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ভবনের ভেতর পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রাখা। কিন্তু এ কারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে আগুন লাগার পর সেটাকে নেভাতে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ ফায়ার ব্রিগেডের ১৭টি ইউনিটের প্রায় ২২ ঘণ্টা সময়ে লেগেছে। যদি ভবনের ভেতরে কাঠামোগতভাবে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকত, তাহলে হয়তো এতগুলো তাজা এবং জীবন্ত প্রাণ আগুনে পুড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত না। আরো একটি বিষয় বিভিন্নভাবে সামনে আসছে কিন্তু কেউ এটার কোনো সদুত্তর দিতে পারছে না। এ রকম একটি জুস বানানোর কারখানায় এবং বিভিন্ন ধরনের শিশুখাদ্য যেমন নানান ধরনের কোমল পানীয়, নসিলা, লিচু, সেমাই, চানাচুর, বিস্কুট প্রভৃতি উৎপাদনের কারখানায় প্রচুর পরিমাণ দাহ্য পদার্থ মজুত ছিল কেন? এবং এ দাহ্য পদার্থের কারণে আগুন আরো দ্বিগুণ মাত্রায় জ্বলেছে, যা ৫২ জন শ্রমিকের মৃত্যুর আরেকটি অন্যতম কারণ। কিন্তু এসব কারখানা শ্রম আইন ঠিকমতো মানছে কিনা, এসব কারখানার খাদ্যের গুণগতমান ঠিক আছে কিনা, শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ যথাযথভাবে রক্ষা করা হচ্ছে কিনা কিংবা কারখানায় শ্রমিক সুরক্ষার প্রয়োজনী ব্যবস্থা আছে কিনা প্রভৃতি বিষয় দেখার দায়িত্ব যাদের, এ ৫২ জন শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য কী তারাও কম দায়ী? নকশা অনুমোদনের আগে ভবন তৈরি হয়েছে; তার মানে ভবন অবৈধ! অবৈধ ভবনে কারখানার পরিচালনার কোনো ধরনের নিয়মনীতি মানা হয়নি; তার মানে কারখানা অবৈধ! পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই; তার মানে কারখানার ব্যবস্থাপনা অবৈধ! শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও, শিশুশ্রমিকদের ব্যবহার করা হয়েছে; তার মানে শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া অবৈধ! শিশুখাদ্য উৎপাদনকারী কারখানায় কোনো দাহ্য পদার্থ থাকার কথা নয়; তার মানে কাঁচামাল কিংবা মালমাল সংক্রান্ত মজুতও অবৈধ! এভাবে সবকিছুতেই একটা অবৈধ পদ্ধতি অবলম্বন করে দিনের পর দিন ৪শ শ্রমিকের একটা কারখানা পরিচালনা করছে সবার নাকের ডগায়, তাহলে কি আমাদের নাকও অবৈধ! এসব বিষয় গভীর মনোযোগের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া জরুরি।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এসব জীবন্ত মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে আমাদের চোখের সামনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, আমরা কী অদ্ভুতভাবে নির্বিকার। আর আমরা প্রজন্ম পরস্পরায় নির্বিকার বলেই এসব মর্মান্তিক মৃত্যু, যা রীতিমতো হত্যাকাণ্ড, ঘটনার কোনো সুষ্ঠু বিচার হয় না। জনতার চাপ, মিডিয়ার চাপ ও কেন্দ্রের চাপে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রথম প্রথম বেশ তৎপর থাকে। অভিযুক্তদের দ্রুততার সঙ্গে গ্রেপ্তার করে। আদালতে হাজির করা হয়। রিমান্ডে নেয়া হয়। মিডিয়া গরম গরম খবর ছাপে। টেলিভিশনের টকশোতে বিস্তর বিশ্লেষণ চলে। তারপর অভিযুক্তরা আইনের ফাঁক দিয়ে একদিন জামিনে বেরিয়ে যায়। তারপর অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে সমাজের আর দশটা মানুুষের মতো নির্ভার এবং নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করে। আর এদিকে মানুষের ‘স্মৃতির ব্যাক-বেঞ্চে’ চলে যায় সব সেনসেশনাল ঘটনা। তাজরিন গার্মেন্টস, স্মার্ট গার্মেন্টস, রানা প্লাজা প্রভৃতির ঘটনার কথা আমরা জানি। হয়তো আমাদের অজান্তেই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আমাদের এ অদ্ভুত নির্বিকার ভূমিকা এভাবেই অন্য কোনো কারখানার অন্য কোনো শ্রমিকের নতুন করে পুড়ে ছাই হওয়ার পাটাতন তৈরি করছে। আফসোস!
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়