মাইনুল হোসেন খান নিখিল : রেশনিং সিস্টেমে বিনামূল্যে খাবার দেবে যুবলীগ

আগের সংবাদ

বিশ্ব মিডিয়ার চোখে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’

পরের সংবাদ

মহামারিতেও এগিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো

প্রকাশিত: জুলাই ১১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নজিরবিহীন বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, যা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। তবে শুরু থেকেই বাংলাদেশ সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে চলেছে। করোনা মহামারির নানা ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে ২০২১ সালের অর্ধ বছর গত ৩০ জুন শেষ হয়েছে। করোনা মহামারিতেও চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ সময়ে অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। করোনার কারণে বেসরকারি ঋণে গতি না ফিরলেও প্রণোদনানির্ভর ঋণ বিতরণ বাড়ায় ব্যাংকের সুদ আয় বেড়েছে। আমানতের সুদ কমায় তহবিল সংগ্রহের খরচ কমেছে। আবার করোনার মধ্যেই আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা এবার ভালো হয়েছে। এবার কিছু ব্যয়ের খাত কমাতে পেরেছে ব্যাংকগুলো। আবার আমানতের সুদ কমায় তহবিল খরচ কমেছে। করোনার মধ্যেও নন-ফান্ডেড ব্যবসা তথা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য থেকে ভালো আয় হয়েছে, যা গতবার অনেক কমে গিয়েছিল। এছাড়া পলিসিগত কারণ খেলাপি কম হওয়ার কারণেও আয় বেড়েছে। সব মিলে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা ও মহামারি করোনার কারণে গত বছরের প্রথম ছয় মাসে বেসরকারি ব্যাংকের আয়ে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছিল। তবে এই প্রভাবের মধ্যেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছিল। তবে এবার বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মুনাফায় ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কয়েকটি ভালো মুনাফা করেছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিধিনিষেধের কারণে অনিরীক্ষিত পরিচালন মুনাফা প্রকাশ করতে পারে না ব্যাংকগুলো। তবে ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, এই ছয় মাসে প্রায় সব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। তবে পরিচালন মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। পরিচালন মুনাফা থেকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) এবং করপোরেট কর পরিশোধের পর যে অংশটুকু থাকে, সেটাই প্রকৃত মুনাফা। করোনা ভাইরাসের কারণে ব্যাংক খাতের মুনাফায় ধস নামবে বলে অনেকে দ্বিধাদ্ব›েদ্ব ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে করোনা মহামারির মধ্যেও ব্যাংকের সুদ গণনা কিন্তু থেমে নেই। আর এটাই ব্যাংকের মুনাফার প্রধান উৎস। তাই মুনাফায় পতন হয়নি। যে কারণে এবারো আগের ন্যায় ভালো মুনাফা হয়েছে। গত ৬ মাসে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় ব্যাংক খাতে আপাতত স্বস্তি ও সন্তুষ্টির ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে দেশের ব্যাংকিং খাতের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকিং খাত নিজেই ধুঁকছে। যার নেতিবাচক প্রভাব সামগ্রিক আর্থিক খাতের ওপরেই পড়েছে। এর মধ্যে দেশের অর্থনীতির জন্য বড়সড় ধাক্কা হয়ে আসে করোনা মহামারির প্রকোপ। গত এক-দেড় বছরে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার ওঠানামা করছে। করোনা এই এক-দেড় বছরেও বিদায় নেয়নি পৃথিবী থেকে। কিন্তু তারপরও একে মোকাবিলা করেই আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তেমন পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যাংকিং খাতকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে সামনের দিকে। অদৃশ্য এক ভাইরাস রাতারাতি বদলে দিয়েছে সারা বিশ্বের চেহারা। করোনা দুনিয়াজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, সমাজনীতি কিংবা লাইফস্টাইল সবকিছুই বেমালুম পাল্টে দিয়েছে কিংবা দিচ্ছে এখনো। করোনাকালীন সময়ে সবখানেই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত ও সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত নির্ধারিত সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সেবা গ্রহণের এবং প্রদানের বিষয়টি পথে-ঘাটে, দোকানে, হাসপাতালে, গাড়িতে, অফিস-আদালতে, ব্যাংকসহ সবখানে প্রযোজ্য হলেও আজকাল তাতে অনেকটা শিথিলতা চলে এসেছে। ফলে আবার সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে।
গত বছর করোনাকালীন সময়ে দেশের বিভিন্ন অফিস-আদালত, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, শপিংমল, মার্কেট দীর্ঘ ৬৫ দিন সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বন্ধ থাকলেও ব্যাংকিং কার্যক্রম সীমিত আকারে শুরু করে পুরোপুরিভাবে শুরু হয়ে গিয়েছিল ১৫ দিনের মধ্যে। ওই সময়ে রাস্তায় যানবাহন, লোকজনের চলাচল নিয়ন্ত্রিত ছিল কঠোরভাবে। কিন্তু তার মধ্যেও মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংক কর্মীরা তাদের কর্মস্থলে গেছেন এবং ব্যাংকে আগত গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করেছেন। এভাবে ব্যাংকিং সেবা অব্যাহত রাখতে গিয়ে প্রচুর ব্যাংক কর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। যদিও করোনাকালীন সময়ে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলে সেবা দিতে আসা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ব্যাংকগুলো বিশেষ প্রণোদনা ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেছে।
করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি দেশীয় অর্থনীতিতে চরম স্থবিরতা নেমে এসেছে। এর ফলে আমাদের ব্যাংকিং খাত অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনার ক্ষতি পুষিয়ে শক্তভাবে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছে অবিরাম। ব্যাংকগুলো সুষ্ঠু নীতি প্রণয়ন ও গ্রাহকবান্ধব হওয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিতে করোনার আঁচড়কে অবশ্যই দ্রুত উপশম করতে পারবে বলে আশা করি। করোনার অপ্রত্যাশিত ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে এর মধ্যে আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থা অনেক নতুন কলাকৌশল আয়ত্ত করে নিয়েছে। বাস্তবতার মোকাবিলা করে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ উতরে সামনে এগিয়ে যেতে যে দক্ষতা ও সক্ষমতা অর্জন করেছে, সেটাও কিন্তু কোনোভাবেই কম অর্জন নয়। কোভিড-১৯-এর নেতিবাচক প্রভাব বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনীতিতে প্রকট ও দীর্ঘস্থায়ী হবে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তেমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নিজেদের ভূমিকাকে আরো গতিশীল করে তুলতে হবে। কোভিড-১৯-এর ক্ষতি কাটিয়ে আমাদের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ধারাকে টেকসই করতে চাইলে প্রয়োজন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রচেষ্টা আরো জোরদার করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী গতানুগতিকতার বাইরে যাওয়া, তথা উদ্ভাবনীমূলক চিন্তাভাবনার বিকাশ সাধন। টেকসই ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে পরিস্থিতি আমাদের গোটা অর্থনীতির জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে- এটা আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে।
ব্যাংক ব্যবস্থার মুনাফা প্রবৃদ্ধির যে ঊর্ধ্বমুখী ধারার সূচনা হয়েছে তা আরো বেগবান করতে হবে, আমরা সবাই প্রত্যাশা করি। ব্যাংকগুলো এই দুর্যোগকালীন অতিমারি সময়ে যাতে কোনোভাবে বিতর্কিত ঋণ প্রদান না করে, ঋণ খেলাপিদের অপতৎপরতা এড়াতে ঋণ আদায় যাতে কঠোরতা অবলম্বন করে, ব্যাংকিং তহবিল যাতে লুটপাট না হয় সে ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সচেতন থাকতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা এক্ষেত্রে সব ব্যাংকের অভিভাবকের মতো। কোথাও কোনো অনিয়ম হচ্ছে কিনা তা তদারক করে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনে তদন্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়াই মূল দায়িত্ব। সব প্রতিকূলতা, অব্যবস্থাপনা, ত্রæটি-বিচ্যুতি, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, স্বেচ্ছাচারিতা এড়িয়ে আমাদের ব্যাংকগুলোতে মুনাফা বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে আমরা সবাই প্রত্যাশা করি। ব্যাংক খাত হলো দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন। এ খাতে বিপর্যয় নেমে এলে গোটা অর্থনীতিই অনিশ্চয়তা ও ধ্বংসের মুখোমুখি হবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। অতএব আমাদের উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা সমুন্নত রেখে ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ অবস্থানের দিকে এগিয়ে যেতে হলে সামগ্রিক অর্থনীতির শক্ত অবস্থান সৃষ্টি একান্ত জরুরি। আর এজন্য ব্যাংক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদাচরণের মাত্রা দ্রুত সহনশীল পর্যায়ে নামিয়ে আনা প্রয়োজন।
রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়