কাল থেকে শুরু কুরবানির পশুর ডিজিটাল হাট

আগের সংবাদ

স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অনীহা

পরের সংবাদ

পরিস্থিতি নাজুক প্রস্তুতির ঘাটতি

প্রকাশিত: জুলাই ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষিত ** গুরুত্ব পায়নি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও ** স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যর্থতা প্রকট **

সেবিকা দেবনাথ : দেশে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়বে এমন পূর্বাভাস আগেই দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিতের পরামর্শও দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু তা যে খুব একটা আমলে নেয়া হয়নি তার প্রমাণও দৃশ্যমান। সংক্রমণ বাড়ছে, বাড়ছে মৃত্যু। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় আইসিইউ, অক্সিজেন, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলাসহ অনান্য বিষয়গুলো এখনো নিশ্চিত হয়নি দেশের সব জায়গায়। এছাড়া দক্ষ জনবলেরও অভাব রয়েছে। করোনা রোগীদের সেবায় এর প্রভাবও কম নয়।
বাংলাদেশ কমো মডেলিং গ্রুপের আওতায় একদল জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ করোনা সংক্রমণের পূর্বাভাস নিয়ে কাজ করছেন। গত ঈদে মানুষের চলাচল এবং ভারতীয় ‘ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট’ শনাক্ত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এই বিশেষজ্ঞরা দেশে করোনা সংক্রমণের পূর্বাভাস নিয়ে একটি সম্ভাব্য চিত্র নির্ধারণ করেছেন। গাণিতিক বিশ্লেষণ করে তারা যে পূর্বাভাস দিয়েছেন সে অনুযায়ী, চলতি জুলাই মাসে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ আরেকটি চূড়ায় উঠতে পারে। এ সময় প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার করে শনাক্ত এবং শতাধিক মানুষের মৃত্যু হতে পারে। পরিস্থিতি সেদিকে গেলে ঢাকার অবস্থা আবারো নাজুক হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা। এই পূর্বাভাসের বিস্তারিত তথ্য তারা গত ৩০ মার্চ সরকারের কাছে জমা দেয়। বিশেষজ্ঞরা জুলাইয়ে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও দেখা যায়, জুনের মাঝামাঝি থেকেই শনাক্ত ও মৃত্যু বেড়েছে।
সংক্রমণের মাত্রা যেভাবে বাড়ছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তা কতটা সামাল দিতে পারবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথায়ও ফুটে উঠেছে অসহায়ত্বের সুর। সম্প্রতি তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশে যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলমও সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, যে হারে রোগী বাড়ছে, সেই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি সামাল দেয়া স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে সম্ভব হবে না। অন্য দেশে যেমন বিপর্যস্ত অবস্থা হয়েছে এখানেও তা-ই দেখতে হতে পারে।

ইতোমধ্যেই রাজশাহী, খুলনা, সাতক্ষীরা, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আইসিইউ ও অক্সিজেনের অভাবে রোগীরা মারা যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক এলাকায় পর্যাপ্ত হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা না থাকার বিষয়টিও জানা গেছে। গতকাল বগুড়ার মোহাম্মদ আলি হাসপাতালে অক্সিজেন না পেয়ে সাতজনের মৃত্যুর ঘটনাটি গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে তাদের মাত্র দুটি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা থাকায় দুজনের বেশি রোগীকে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি আদালতে ওঠার পর গতকাল শনিবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের একক ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চকে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানান রবিবারের মধ্যে ১০ থেকে ১৫টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা সরকারিভাবে ওই হাসপাতালে পৌঁছে দেয়া হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সংক্রমণ ও মৃত্যুর যে চিত্র আমরা দেখছি সেটি আগের প্রভাবের ফল। সাধারণত মৃত্যুর ওপর প্রভাব দেখতে ২১ দিন এবং সংক্রমণের ওপর প্রভাব দেখতে হলে ১৪ দিন সময় লাগে। তাই এখনকার যে লকডাউন ও বিধি-নিষেধ দেয়া হচ্ছে তার প্রভাব দেখতে হলে আমাদের সামনে অপেক্ষা করতে হবে।
মৃত্যু কেনো বাড়ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তারা বলছেন, সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যু বাড়বেই। অনেকে এমন সময় হাসপাতালে আসছেন, যখন আর কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করেও শেষরক্ষা হয় না। আবার কোথাও রোগীর চাপ বেশি থাকায় তাৎক্ষণিক হয়তো কিছু কারিগরি সমস্যাও হচ্ছে। তা মেটাতে মেটাতে হয়তো অনেকে মারা যাচ্ছে।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, সংক্রমণের এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও স্বাস্থ্যসেবার পরিস্থির খুব একটা উন্নতি হয়নি। আইসিইউ ও অক্সিজেন সংকট কাটাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বাস্তবায়নও আমরা দেখছি না। কেনো হচ্ছে না এমন প্রশ্ন করা হলে বলা হচ্ছে রাতারাতি পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। কথা সত্য। কিন্তু দৃশ্যমান উদ্যোগওতো চোখে পড়ছে না। যে হারে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে এক্ষেত্রে সরকারের সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ। একটি, চলমান লকডাউন কার্যকর করে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা। আর অন্যটি হলো, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। দুই চ্যালেঞ্জের একটিও এখন পর্যন্ত সফলভাবে করা সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সামনে ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে।
সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি মনে করেন, সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সময় পেয়েও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা কাজে লাগাতে পারেনি। তিনি বলেন, সম্প্রতি হাসপাতালে অক্সিজেন সংকটের কারণে কয়েকজন রোগীর মৃত্যুর খবর জানতে পারলাম। রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে হয়তো সামনে অক্সিজেন, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা আইসিইউর চাহিদা আরো বাড়বে। কিন্তু অপ্রতুলতার কারণে মানুষ সেবা পাবে না। অনেকের মৃত্যুও হতে পারে। যা কারোরই কাম্য নয়। অন্যদিকে প্রতিদিন ১০ হাজারের বেশি রোগী করোনায় আক্রান্ত হলে এবং তাদের মধ্যে দুই হাজার মানুষকেও যদি হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় তখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়বে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের কাজ পরামর্শ দেয়া, আমরা তা দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু যারা তা বাস্তবায়ন করবেন তাদের আগ্রহ ও আন্তরিকতা কতটা তা দেখতে হবে। সরকার আমাদের কথা কতটা শুনেছে আর কতটা আমলাদের কথা শুনেছে? আমলা দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আমলানির্ভর সিদ্ধান্ত বলেই দেড় বছর পরও দেখা যাচ্ছে বিনা চিকিৎসায়, অক্সিজেন না পেয়ে করোনা আক্রান্ত রোগী মারা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যর্থতার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৩ হাজার ৯৮৬টি সাধারণ বেড, এক হাজার ১৯৫টি আইসিইউ বেড, অক্সিজেন সিলিন্ডার ২৭ হাজার ৮৩টি, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা এক হাজার ৫৪৬টি, অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর আছে এক হাজার ৬২৩টি। এছাড়া কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সিএমএসডি) জমা আছে ১১০টি আইসিইউ বেড, ৭’শ অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর, পাঁচ হাজার সিলিন্ডার। প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় দেয়া হবে। তবে সিএমএসডিতে এখন হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ও ভেন্টিলেটর নেই। এ সপ্তাহের মধ্যেই সেগুলো কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিগগিরই তা পাওয়া যাবে বলে জানা যায়।
করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালনকারীদের দুই সপ্তাহ করে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়। আইসিইউর জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও ঘাটতি আছে। এছাড়া নানা জটিলতায় বারবার আটকে যাচ্ছে কিছু কিছু নিয়োগ। এমনকি সর্বশেষ বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক চিকিৎসক যোগদানই করেননি। সব মিলিয়ে জনবল সংকটও একটি বড় প্রভাব ফেলছে। এ সংকট কাটতেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়