দেশবাসীকে লকডাউন মেনে চলার অনুরোধ তথ্যমন্ত্রীর

আগের সংবাদ

পরিস্থিতি নাজুক প্রস্তুতির ঘাটতি

পরের সংবাদ

৪৫ লাখ গ্রাহকের কী হবে

প্রকাশিত: জুলাই ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** নয় বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি এমএলএম প্রতারক ‘ডেসটিনি’র দুই মামলা **
এস এম মিজান : দেশের আর্থিক খাতের ইতিহাসে অন্যতম কেলেঙ্কারির নাম ডেসটিনি। প্রতারণামূলক এমএলএম পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেয়। এ ঘটনায় দুদকের মামলা দায়েরের পর নয় বছর অতিবাহিত হলেও বিষয়টি এখনো নিষ্পত্তিহীন। এ অবস্থায় অর্থ ফেরত পেতে রায়ের অপেক্ষায় রয়েছেন ডেসটিনির প্রায় ৪৫ লাখ গ্রাহক। তারা আশা করছেন, রায়ে তাদের অর্থ ফেরত পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়ই কোনো দিকনির্দেশনা থাকবে। এর মধ্য দিয়ে তাদের দীর্ঘ অপক্ষো আর বঞ্চনার অবসান হবে। কিন্তু বিদ্যমান মামলার প্রক্রিয়ায় গ্রাহকরা আদৌ তাদের টাকা ফেরত পাবেন কিনা, তাই নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন একজন আইনজ্ঞ।
মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে ২০১২ সালে দায়ের করা দুই মামলায় তদন্ত শেষে ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট হারুন-অর-রশিদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনসহ প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ ৪৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৪ মে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। দুই মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ৫৯৬ জনকে। ২০১৬ সালে মামলা দুটিতে অভিযোগ গঠিত হয়। বর্তমানে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ৫-এ মামলা দুটি বিচারাধীন। সর্বশেষ গত বছরের ২০ আগস্ট হাইকোর্ট এক আদেশে ছয় মাসের মধ্যে দুটি মামলা নিষ্পত্তি করতে বিচারিক আদালতকে নির্দেশ দেন। ইতোমধ্যে ছয় মাস পেরিয়ে ১০ মাস অতিক্রান্ত হলেও দুই মামলার একটিও নিষ্পত্তি হয়নি।
জানা গেছে, ডেসটিনির দুই মামলার মধ্যে একটি মামলায় ২৯৩ সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র সাতজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়া সম্পন্ন হয়েছে। আরেকটি মামলায় ৩০৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৮৫ জনের সাক্ষ্য নেয়া শেষে বর্তমানে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার (আইও) সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান রয়েছে। তবে শেষের মামলাটি স্বাভাবিকভাবে আদালতের কার্যক্রম চললে খুব শিগগিরই নিষ্পত্তি হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। এ বিষয়ে দুদকের প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, যে আদালতে বিচার চলছে, সেখানে কেবল ওই মামলাগুলোর বিচারই করছে না, অন্যান্য মামলার বিচারও চলছে। তাই মামলাগুলোর সাক্ষ্য

নেয়ার দিনও বেশ কিছুদিন পর পর হয়। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে জানালে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত নিষ্পত্তির। তবে করোনার কারণে দীর্ঘ সময় বিচারই বন্ধ ছিল। এছাড়া বর্তমানে বিচার কার্যক্রম চললেও আসামিদের হাজির করা ও সাক্ষীদের আদালতের উপস্থিতির বিষয়ে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। ফলে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। কারণ আসামিদের উপস্থিতিতেই সাক্ষ্য নেয়ার বিধান রয়েছে।
এদিকে, ২০০০ সাল থেকে এই ব্যবসা চালিয়ে ২০১২ সালে মামলার কবলে পড়ে কোম্পানিটির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এরপর অর্থ ফেরত পাওয়ার দাবিতে বিভিন্ন সময় মানববন্ধন ও অবস্থান ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে এর গ্রাহকরা। তবে, প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন স্কিমে অর্থলগ্নীকারী ‘ক্ষতিগ্রস্তদের’ কেউ কোনো টাকা বুঝে পাননি। কতদিনে পাবেন বা আদৌ পাবেন কিনা মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। চার বছর আগে গ্রাহকদের বিনিয়োগ ও পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য আদালত একটি উপায় বের করলেও তাও কার্যকর কোনো ফল এনে দিতে পারেনি। কোম্পানিটির হিসাব মতে, ক্রেতা-পরিবেশক ও বিনিয়োগকারী মিলে তাদের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় অর্ধকোটি (৪৫ লাখ)।
বিভিন্ন জেলার ডেসটিনির কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এক দশক অপেক্ষা করেও কোনো টাকা ফেরত পাননি। এ অবস্থায় রায়ের অপেক্ষায় থাকা এই মানুষগুলো বলছেন, মামলার রায়ে তাদের পাওনার বিষয়টি নিশ্চয়ই উঠে আসবে। হয়তো বা রায়ের পর্যবেক্ষণে থাকবে কোনো দিকনির্দেশনা। এরকমই একজন চাঁদপুর জেলার নাসিমা আক্তার বলেন, আমরা গরিব মানুষ। এলাকার একজনের পাল্লায় পড়ে লাভের আশায় আমার অনেক পরিশ্রমের টাকা ডেসটিনিতে জমা দিয়েছি। বর্তমানে লাভ তো দূরের কথা, মূল টাকা ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। আরেকজন নোয়াখালীর কামরুল হাসান বলেন, ডেসটিনির কর্মী হিসেবে কাজ করে লাভের আশা দেখিয়ে আত্মীয়স্বজনসহ অনেক কাছের মানুষকে বুঝিয়ে এখানে টাকা জমা দিয়েছি। অথচ এখন আমি সবার কাছে একটা ‘চিটার’ হিসেবে প্রমাণিত। এলাকায় গেলেই টাকা জমা দেয়া ব্যক্তিরা বিভিন্ন কথা শোনায়। বর্তমানে রায়ের অপেক্ষায় থাকা কামরুল বলেন, এখন আমাদের শেষ ভরসা আদালতের রায়। আমরা সেই অপেক্ষায় আছি। তবে কবে হবে সেই রায়? আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে? দ্রুত রায় প্রত্যাশা করে শাহানা শেলী, মনিকা মণ্ডল, মো. আসলাম ও রতœা আহমেদসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ডেসটিনির অন্তত দেড় ডজন গ্রাহক বলেন, তাদের এই কষ্টের টাকা যেন সরকার ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করে। তাদের লাভের প্রয়োজন নেই। বরং আসল টাকাটা তুলে দিলেই তারা খুশি।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ৩১ জুলাই ঢাকার কলাবাগান থানায় ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশীদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন এবং ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইনসহ ৫৩ জনের বিরুদ্ধে দুটি আলাদা মামলা করে দুদক। ওই মামলায় এখনো কারাগারে আছেন রফিকুল আমীন এবং মোহাম্মদ হোসাইন। এর আগে দুদকের দায়ের করা মামলায় তাদের জামিন আবেদন উচ্চ ও নি¤œ আদালতে কয়েকবার খারিজ হয়েছে। তবে ডেসটিনির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের শর্তে ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে জামিনে আছেন ওই মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশীদ।
পরবর্তীতে রফিকুল আমীন ও মোহাম্মদ হোসাইনের জামিন চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আড়াই হাজার কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দেয়ার শর্তজুড়ে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। ২০১৬ সালের ১৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশে বলা হয়েছিল, যদি ছয় সপ্তাহের মধ্যে ৩৫ লাখ গাছ বিক্রি করে দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা অথবা নগদ আড়াই হাজার কোটি টাকা সরকারের কাছে জমা দেয়া হয় তাহলে তারা জামিন পাবেন। ওই আদেশ এখনো বহাল থাকলেও কোনো টাকা সরকারের কোষাগারে জমা পড়েনি বলে জানা গেছে। আর এজন্য তাদের জামিনও মিলছে না। এছাড়া ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদ হোসাইনের জামিন শুনানিকালে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্বের বিষয়টি লক্ষ্য করে অসন্তোষ প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেছেন, এভাবে চললে তো দশ বছরেও বিচার শেষ হবে কিনা তা নিয়ে আমরা সন্দিহান। এছাড়া চলতি বছরের ২৫ মে মামলার আরেক আসামি ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের পরিচালক লে. কর্নেল (অব.) দিদারুল আলমের জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, এই মামলার সঙ্গে বিশাল অঙ্কের (এক হাজার ৯৩৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা) অর্থ জড়িত। তাই আসামিকে জামিন দেয়া হলে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রভাবিত করবে। এমনকি আসামি দেশ থেকে পালাতেও পারেন।
রাজধানীর কলাবাগান থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের নামে ৮১ লাখ গাছ লাগানোর কথা বলে মোট দুই হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা গাছের বিপরীতে সংগ্রহ করেছে। বাকি দুই হাজার ৩৭ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে গাছ না লাগিয়েই। গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ চুক্তি অনুযায়ী, ট্রি প্ল্যান্টেশনের কমিশন বাবদ এক হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের (ডিএমসিএসএল) মোট সম্পদের পরিমাণ তিন হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। গ্রাহকদের কাছ থেকে এক হাজার ৯০১ কোটি টাকা সংগ্রহ করে সেখান থেকে এক হাজার ৮৬১ কোটি টাকা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। লভ্যাংশ, সম্মানী ও বেতনভাতার নামে এ টাকা সরানো হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, ঢাকাসহ দেশের ২২টি জেলায় ডেসটিনির সম্পদ রয়েছে। এ সম্পদ দুই ভাগে বিভক্ত, প্রতিষ্ঠানের নামে ও পরিচালকদের নামে। ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, ডেসটিনি ট্রি প্ল্যানটেশন এবং ডেসটিনি গ্রুপের এমডি মো. রফিকুল আমীন, ডেসটিনি ২০০০-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইনসহ পরিচালকদের নামে এগুলো কেনা। রাজধানীর বাইরে মুন্সীগঞ্জ জেলায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি সম্পদ। ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমীনেরই ২৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে। রফিকুল আমীনের স্ত্রী ফারাহ দীবার নামে রয়েছে প্লট-ফ্ল্যাটসহ অঢেল সম্পদ।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, কয়েক বছরেও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়াটা বিচারকাজের দীর্ঘসূত্রতা। তবে তিনি এই দীর্ঘসূত্রতাকে স্বাভাবিক উল্লেখ করে বলেন, দেশে পর্যাপ্ত বিচারক নেই। আইন অঙ্গনের যথেষ্ট লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব রয়েছে। দীর্ঘসূত্রতার প্রধান কারণ হলো, বিচারের জন্য সরকার পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করে না। অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য আইনজীবী, বিচারক জনগণ কেউ দাবিও করে না। ফাঁকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ডেসটিনির গ্রাহকরাও এর বাইরে নয়। তবে তিনি এই মামলার রায়ের সঙ্গে গ্রাহকদের টাকা ফেরতের কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে বলেন, মানিলন্ডারিং মামলায় আসামিদের শাস্তি হবে হয়তো! কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা তো লাভবান হবে না। কারণ এখানে (মানিলন্ডারিং আইন) যে ধারায় শাস্তি দেয়া আছে, এর বাইরে তো বিচারক যেতে পারবেন না। আর সম্পদ বাজেয়াপ্তের রায় হলেও সেটি সরকারের অনুকূলে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়