সীমিত লকডাউনে নগরবাসীর দুর্ভোগ

আগের সংবাদ

অকারণে বের হলেই জেল

পরের সংবাদ

চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেশম ছিনতাই

প্রকাশিত: জুন ৩০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৩০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কয়েকটি জাতীয় দৈনিক (১৮-৬-২১) থেকে জানা গেল, ‘রাজশাহী সিল্ক’ জাতীয় ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ওই পত্রিকার মাধ্যমে আরো জানা যায়, একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের বা সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাহলে সেটিকেই সেই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। যখন কোনো দেশের কোনো পণ্য জিআই হিসেবে স্বীকৃতি পায় তখন ওই পণ্য ওই দেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়।
আমরা নিঃসন্দেহে আনন্দিত যে, দেশের বিভিন্ন স্থানের পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করছে এবং এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে আরো অনেক পণ্য অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমার ও আমার মতো অনেকের কাছে একটা বিষয় খুব চিন্তায় ফেলেছে, জিআই পণ্য নির্ধারণের নীতিমালা কী? কী কী বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়? গুরুত্ব বিশ্লেষণ বা বিচার করার সময় ভৌগোলিক অবস্থান, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, উৎপাদিত পণ্য উপকরণের সহজলভ্যতা, গণমানুষের সম্পৃক্ততা ইত্যাদি এর মধ্যে পড়ে কিনা। কেননা রাজশাহী সিল্কের নামে জেলা ব্র্যান্ডিং আমাদের বিস্মিত ও মর্মাহত করেছে। সে কারণে এসব প্রশ্ন বারবার উদিত হচ্ছে, জিআই পণ্য বাছাইয়ের প্রক্রিয়া কী?
কথায় বলে, বড় গাছের নিচে ছোট গাছ জন্মাতে পারে না। কথাটা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ক্ষেত্রে বহুলাংশে প্রমাণিত এবং এ প্রক্রিয়া চলমান। কেননা তার প্রতিফলন হলো রাজশাহী সিল্কের ব্র্যান্ডিং। রাজশাহীর অন্যতম মহকুমা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হিসেবে উন্নীত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও এ স্থানের আদি ও প্রসিদ্ধ বিভিন্ন জাতের আম, রেশম, বিভিন্ন মিষ্টান্ন দ্রব্য এবং আলকাপ, গম্ভীরা এসব কিছুই রাজশাহী হিসেবে পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এসব কিছু হলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে।
বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকে রেশম উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। দেশভাগের আগে এ জেলা মালদার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। কুটির শিল্প হিসেবে রেশম শিল্প অতি প্রাচীনকাল থেকেই বহুল সমাদৃত এবং ঐতিহ্যবাহী। ইতিহাস পূর্ব যুগ থেকে এখানে ও আশপাশে রেশমের সূচনা হয়েছিল। বাংলার সুলতানি আমলে গৌড় লখনৌ থেকে রেশমবস্ত্র রাজধানী দিল্লিতে পাঠানো হতো। ইউরোপের বাজারে প্রথম ঢাকার মসলিন এবং পরে রেশম রপ্তানি করা হতো। গঙ্গা-পাগলা-মহানন্দাবিধৌত মালদার আবহাওয়া অনায়াসে রেশম তৈরির প্রধান কাঁচামাল তুঁত গাছের প্রাচুর্যতা ছিল।
সে সময় তুঁত বাগান জমির দাম ছিল বেশি। ১৯১৮ সালে ধানি জমির দাম ছিল বিঘাপ্রতি ১০ আনা থেকে এক রুপি, বোরো জমি ৮-১০ আনা, আম বাগান ৮-১৩ আনা, তুঁত বাগান ১-৪ রুপি (সূত্র : বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, মালদা ১৯১৮)। উল্লেখ্য, বঙ্গদেশে নীলকুঠির আগে রেশমকুঠি স্থাপিত হয়। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নায়ক মজনু শাহ ১৭৮৩ সালে মালদার আশপাশে ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করে ইংরেজ ও অন্যদের নীল কুঠির সঙ্গে অনেক রেশম কুঠি ধ্বংস করেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বপ্রথম ১৬৭৬ সালে মালদায় আগমন ঘটে এবং রেশম ব্যবসা শুরু করে, তার আগে তারা ভাসমান ছিল। তাদের আসার বহু আগে থেকে ওলন্দাজ এবং পরে ফরাসি বণিকরা এসে রেশম ব্যবসা ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত হয়। মালদার বস্ত্র ব্যবসা সেসময় ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। আগ্রা, গুজরাট কাশ্মিরের বণিকরা প্রতি বছর বাণিজ্য করতে আসত। ব্রিটিশ বণিক ও পর্যটক স্ট্রেন শ্যাম মাস্টারের ডায়েরি থেকে জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৭৬ সালে মালদায় রেশম ব্যবসা শুরু করে। কর ফাঁকি দেয়ার অভিযোগে নবাব শায়েস্তা খাঁর সঙ্গে কোম্পানির বিরোধ চরমে ওঠে? এবং তাদের মালদা থেকে বিতাড়িত করা হয়। পরে কোম্পানি পুরনো মালদা থেকে ইংরেজ বাজারে রেশম কুঠি স্থানান্তর করে (অ ংঃধঃরংঃরপধষ ধপপড়ঁহঃ ড়ভ ইবহমধষ, াড়ষঁসব ঠওও, গধষফধ, ১৮৭৬: ইু ডড ঐঁহঃবৎ ৎবঢ়ড়ৎঃ থেকে এর সত্যতা আঁচ করা যায়)। হান্টার রিপোর্ট থেকে আরো জানা যায়, ফরাসি কোম্পানি গগ খড়ঁরং চড়ুবহ ধহফ ঈরব ভোলাহাটে (বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপজেলা) একটি রেশম কারখানায় গরম বাষ্প দ্বারা সুতা শুকানো যন্ত্র প্রতিস্থাপন করে। এ যন্ত্রটি কালের সাক্ষী হিসেবে এখনো ভোলাহাটের রেশম বোর্ডের অফিসে অযতেœ ও অবহেলায় খোলা আকাশের নিচে পড়ে রয়েছে, যদিও শত শত বর্ষীয় পুরনো অবকাঠামোর অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান।
ইবহমধষ উরংঃৎরপঃ এধুবঃঃববৎং গধষফধ,
১৮১৯ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভোলাহাট ও বারঘরিয়ায় রেশম চাষিদের কাছ থেকে ককুন সংগ্রহ করে দেশি ব্যবসায়ী ও বিদেশি বণিকরা সুতা তৈরি করত। ভোলাহাটের আশপাশে লোকজনদের এক বড় অংশ চাষিদের কাছ থেকে ককুন সংগ্রহ করে সুতা তৈরি করত। মালদার পাশেই সাহাপুর এবং বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ও ভোলাহাট রেশম বস্ত্র তৈরির জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন কেন্দ্র ছিল। এসব স্থানের উৎপাদিত রেশম বস্ত্র মালদায় বাজারজাত করা হতো। উৎপাদিত রেশম বস্ত্র প্রধানত থান, শাড়ি, ধুতি, রুমাল, কোট, টাই ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। প্রতিচ্যের বড় বড় শহর লন্ডন, আমস্টারডাম, প্যারিসের ললনাদের আকর্ষণীয় পরিধেয় বস্ত্র ছিল রেশম। মালদায় ১৯০৮ সালের দিকে অজ্ঞাত কারণে ভোলাহাট, শিবগঞ্জ ও বারঘরিয়া ব্যতীত অন্যান্য স্থানের অধিকাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।
দেশ বিভাগের পর প্রাথমিক বিপর্যয় মোকাবিলা করে শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, বারঘরিয়া প্রভৃতি স্থানে পুনরায় রেশম বস্ত্র উৎপাদন শুরু হয় এবং হৃতগৌরব প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ঢাকা ও করাচির মতো শহরে বাজারজাত করা হতো। শত শত বছর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমার অধিকাংশ গ্রামের মহিলারা ঘরে ঘরে পলু চাষ করে রেশম গুটি তৈরি করত এবং যেখানে সেখানে তুঁত গাছ ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেক গ্রামে বিভিন্ন ধরনের রেশম বস্ত্র তৈরি হতো। গ্রাম বা এলাকায় শত শত হস্তচালিত তাঁতের খুটখাট আওয়াজে মুখরিত থাকত। হাজার হাজার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান বা জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা বিদ্যমান ছিল। সে তুলনায় রাজশাহী ও আশপাশে পলু চাষের প্রচলন সেভাবে ছিল না এবং রেশম উৎপাদনের ইতিহাস পুরনো বলা যায় না। তবে যৎসামান্য উৎপাদন হলেও ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না।
১৯৬২ সালে রাজশাহীতে সরকারি উদ্যোগে একটি রেশম কারখানাসহ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখানে ১৯৭৭ সালে রেশম বোর্ড গঠন করা হয়। কিন্তু উভয়ই কাগজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এই কারখানায় উৎপাদন ছিল সীমিত এবং রেশম বস্ত্র গুণে ও মানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সমকক্ষ ছিল না। উপরন্তু কাক্সিক্ষত উৎপাদনে কোনো সফলতা বা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। কিন্তু বিরাট ক্ষতি ও সুনাম ক্ষুণ্ন করে সে সময়ের মহকুমা চাঁপাইনবাবগঞ্জের। ‘রাজশাহী সিল্ক’ নামে শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, হরিনগর, লাহারপুর প্রভৃতি স্থানের রেশম বস্ত্র বাজারজাত করা হয়। গভীর পরিতাপের বিষয় হলো, বিগত মধ্য সত্তর দশকের অব্যবহিত পর সামরিক সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কুটির শিল্প হিসেবে রেশম বস্ত্র ধীরে ধীরে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য হয়। সরকার ঢালাওভাবে কৃত্রিম রেশম সুতা আমদানির অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করে। ফল যা হওয়ার তাই হলো। অনুন্নত-মানহীন কৃত্রিম রেশম সুতায় সয়লাব হয়ে পড়ে। ফড়িয়া রেশম সুতা ব্যবসায়ীদের রমরমা উপস্থিতির কারণে হাজার বছরের কায়িকশ্রমলব্ধ রেশম অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। তারপর থেকে শুরু হয় বিশ্ববাজার অর্থনীতির ছোবল। মুখ থুবড়ে পড়ে কুটির শিল্প রেশম। এ সময় জেলার তুঁত বাগানগুলো আম বাগানে রূপান্তর ঘটে। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় বেশকিছু তাঁতে রেশম বস্ত্র উৎপাদিত হলেও সেই রমরমা অবস্থা নেই। আমদানিকৃত কৃত্রিম রেশম সুতা অত্যন্ত নিম্নমানের। আয়ুষ্কাল ক্ষণস্থায়ী, একবার ধৌত করার পর আর ব্যবহার উপযোগী থাকে না। কিন্তু আদি রেশম বারবার ধৌত করা যেত এবং প্রতিবার রেশমের উজ্জ্বল রং ঠিকরে পড়ত, অনায়াসে কয়েক বছর ব্যবহার যেত।
বর্তমানে স্বল্প পরিমাণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে উন্নতমানের রেশম বস্ত্র উৎপাদন করে পুরনো আভিজাত্য ধরে রেখেছে এবং বাতিটা এখনো টিমটিম করে হলেও জ্বলছে। বংশপরম্পরায় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শত শত তাঁতির এখনো জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন তাঁত। তবে সুতা সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে রেশম বোর্ডের কোনো প্রভাব আগেও ছিল না, বর্তমানেও নেই। প্রকৃত ইতিহাস দেশবাসীর জানা প্রয়োজন এবং উপরোক্ত নিরীক্ষে এটাও জানা প্রয়োজন যে, কীভাবে রেশমের জিআই পণ্যস্বত্ব অন্য জেলার নামে ছিনতাই হয়ে গেল। ফলে একদিকে ছিনতাই অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার হাজার হাজার বছরের প্রবহমান সংস্কৃতির ওপর নিষ্ঠুর বজ্রাঘাত।
জাহাঙ্গীর সেলিম : গবেষক ও লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়