হৃত মর্যাদা ফেরত! : কাশ্মিরের নেতাদের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক নরেন্দ্র মোদির

আগের সংবাদ

বাদলা দিন আসছে!

পরের সংবাদ

জোড়াতালির বাঁধে উৎকণ্ঠা ** বর্ষার শুরুতেই নদীভাঙন ** দ্রুত বাঁধ মেরামতের দাবি ** সোচ্চার হচ্ছেন এমপিরা **

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বর্ষার শুরুতেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ভাঙনের তীব্রতা। এ নিয়ে শুধু নদী পাড়ের মানুষ নয়, চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছেন নিকটবর্তী লোকালয়ের বাসিন্দারাও। কারণ মৌসুমের শেষদিকে মাইলের পর মাইল এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার ভয়াবহ দৃশ্যপট তাদের স্মৃতিতে রয়েছে। এবার দেশের অন্তত ১৩টি জেলা ব্যাপকভাবে নদীভাঙনের কবলে পড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে নদী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)। কিন্তু ভাঙনরোধে সরকারের আগাম পদক্ষেপ এখনো তেমন দেখা যায়নি। অনেক প্রকল্প ঝুলে আছে অনুমোদনের অপেক্ষায়। ব্যাপক ভাঙন শুরু হলে জিও ব্যাগ ফেলে আর বাঁধে জোড়াতালি দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিইজিআইএস গত মে মাসে ২০২১ সালের নদীভাঙন সংক্রান্ত একটি পূর্বাভাস তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটির হার্ডকপি জমা দেয়া হয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়েও। পূর্বাভাস অনুযায়ী, এবার বর্ষায় পদ্মা, গঙ্গা ও যমুনা পাড়ের ১৩ জেলায় ভয়াবহ নদীভাঙন দেখা দিতে পারে। এতে প্রায় ২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিলীন হতে পারে। যার মধ্যে পৌনে ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ২৪১ মিটার মহাসড়ক, সাড়ে তিন কিলোমিটার জেলা পরিষদের সড়ক, দেড় কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক, দোকানপাট, বসতবাড়ি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, হাসপাতাল প্রভৃতি স্থাপনা রয়েছে। নদীভাঙনের কারণে বাস্তুহারা হতে পারেন প্রায় ২৮ হাজার মানুষ। এর আগে গত বছর প্রায় ২৪ কিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করেছিল সিইজিআইএস। বাস্তবে সে ভাঙন হয়েছিল প্রায় ৩৪ কিলোমিটার।
গবেষকরা জানিয়েছেন, সিইজিআইএস মূলত প্রধান তিনটি নদীকে ঘিরে পূর্বাভাস দিয়ে থাকে। এর বাইরেও মেঘনা, কুশিয়ারাসহ অনেক নদীতে প্রতি বছর ভাঙন দেখা দেয়। বর্ষা বা বন্যার শেষদিকে পানি দ্রুত নামতে থাকলে চাঁদপুরের ভাটি ও দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, ল²ীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন তীব্র হয়, যা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। সিইজিআইএসের সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশের ১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা নদীতে বিলীন হয়েছে। এতে প্রায় ১৭ লাখ ১৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নদীভাঙন ও বন্যা পরিস্থিতির ওপর সার্বিক নজরদারি করতে গত বুধবার একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম গঠন করা হয়েছে। যেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবি) মাঠ পর্যায়ের নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিব যুক্ত রয়েছেন। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে বাঁধ

মেরামতের কাজ চলছে। এছাড়া জরুরি প্রয়োজনে জিও ব্যাগ ফেলার প্রস্তুতিও নিয়ে রাখা হয়েছে।
টেকসই বাঁধের দাবিতে একাট্টা হচ্ছেন মানুষ : পাউবির এসব প্রস্তুতিতে সন্তুষ্ট নন নদীপাড়ের মানুষ। অনেক জনপ্রতিনিধিই বিষয়টি সরকারের নজরে আনার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি পটুয়াখালী-৩ আসনের সংসদ সদস্য এ এম শাহজাদা গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে টেকসই বাঁধের দাবি তুলে আলোচনায় আসেন। গত ১৬ জুন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে তিনি প্ল্যাকার্ডে লেখেন, ‘আর কোনো দাবি নাই, ত্রাণ চাই না বাঁধ চাই’। টেকসই বাঁধের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে দক্ষিণাঞ্চলের সব সংসদ সদস্যও এক হচ্ছেন। ২৭ জুন রবিবার খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, পটুয়াখালীসহ কয়েকটি অঞ্চলের সংসদ সদস্যরা ঢাকার খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে ভাঙন আশঙ্কায় থাকা কয়েকশ জনপ্রতিনিধি দ্রুত বাঁধ মেরামতের দাবিতে পাউবিতে চিঠি দিয়েছেন। এর আগে গত ১ জুন কয়রা এলাকায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ নির্মাণ দেখতে গিয়ে জনগণের তাড়া খান খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান। এলাকার জনগণকে নিয়ে টেকসই বাঁধের দাবিতে তিনিও এখন সোচ্চার। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলা উপজেলায় নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তরা গত ১৯ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করেন।
ভাঙন শুরু যেসব অঞ্চলে : জিইজিআইএসের পূর্বাভাসে এবার গাইবান্ধায় সবচেয়ে বেশি জমি বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। এরই মধ্যে সেখানে এ পূর্বাভাস বাস্তবে রূপ নিতেও শুরু করেছে। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, বর্ষার শুরুতেই গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে তিস্তা নদীতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন ঠেকাতে জরুরিভিত্তিতে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় জিও ব্যাগ ও বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে। বিশেষ করে উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়নের উজান বোচাগাড়ি, পাঁচপীর খেয়াঘাট, তারাপুর ইউনিয়নের খোদ্দা, লাঠশালা ও হরিপুর ইউনিয়নের কাশিম বাজার খেয়াঘাটসহ কাপাসিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন চরে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে।
সিরাজগঞ্জে এরই মধ্যে ৩০০ ভিটেমাটি ও বিস্তীর্ণ ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বলে জানা গেছে। যমুনা নদীর পানি বাড়ায় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, চৌহালী ও এনায়েতপুরে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। ভাঙন আতঙ্কে বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন মানুষ। এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ থেকে শাহজাদপুরের কৈজুরি পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার নদীতীরবর্তী এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। তীব্র স্রোতে হাটাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পশ্চিম হাটাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে চলে গেছে।
পদ্মার প্রবল স্রোতে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার দীঘিরপাড়, হাসাইল-বানারী, কামারখাড়া ও পাঁচগাঁও ইউনিয়নে ফের ভাঙন শুরু হয়েছে। গত বছর নদীর তীরে ফেলা জিও ব্যাগগুলোও ভাঙনের কবলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়রা বাঁশ পুঁতে ও বিভিন্ন স্থানীয় উপায়ে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছেন। মেঘনায় পানি ও ¯্রােত বেড়ে যাওয়ায় চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধ নিয়ে উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা। গত সোমবার পুরানবাজার হরিসভা এলাকার প্রায় ৪০ মিটার বাঁধ দেবে যায়। এতে পানি প্রবেশ করে বাঁধের বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শহর রক্ষা বাঁধের মোডহেলসহ কয়েকটি এলাকাও ঝুঁকিতে রয়েছে। বালুর বস্তা ও বøক ফেলে তা সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে পাউবি। গত আগস্টে এসব এলাকায় ভাঙন তীব্র হয়েছিল। পটুয়াখালীর পানপট্টি, বোয়ালিয়া, বন্যাতলীসহ আশপাশের চরাঞ্চলেও নদীভাঙন দেখা দিয়েছে।
এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায় প্রকল্প : যমুনার ভাঙন ঠেকাতে প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প এখনো একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এনায়েতপুর থেকে কৈজুরি পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের ওই প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পেলে কাজ শুরু হতে সময় লাগবে আরো কয়েক মাস। সাতক্ষীরা অঞ্চলের পোল্ডার ১৪/১ ও পোল্ডার ১৫ প্রকল্পটি গত বছর একনেকে তোলা হলেও সেটি এখনো যাচাই-বাছাই পর্যায়ে রয়েছে। সম্প্রতি ল²ীপুরের কমলনগরে ৩ হাজার ৮৯ কোটি টাকা ব্যায়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে। সেটির টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে। গাইবান্ধা সদর ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় নদীভাঙন রোধে ৪০০ কোটির টাকার একটি প্রকল্পের কাজ চললেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে ধীরগতিতে। এ পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র ১০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আরেক ভাঙনপ্রবণ এলাকা ভুসিরভিটা পয়েন্টের জন্য সম্প্রতি টেন্ডার আহŸান করা হয়েছে গত মাসে। সারাদেশে স্থানীয় পর্যায়ে এমন অনেক প্রকল্প রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে তড়িঘড়ি করে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মানহীন কাজ করা হয় বলে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।
ভাঙন তীব্র হলে ঠেকানো কঠিন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এন্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, নদীভাঙন যখন তীব্র হয়, তখন সেটা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই নদীর গতিপ্রকৃতি স্টাডি করে আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে হয়। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে দেশে নদীভাঙন কমেছিল। এমনকি বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, চাঁদপুর থেকে শরীয়তপুরের মতো এলাকায়ও অনেকটা ভাঙন কমে আসে। এর মূল কারণ ছিল, ভাঙনকবলিত এলাকায় আগে থাকতেই নতুন বাঁধ নির্মাণ, মেরামতসহ বিভিন্ন ধরনে অবকাঠামো নির্মাণ করেছিল সরকার। আর ওই তিন বছর দেশে তীব্র বন্যাও হয়নি। তিনি বলেন, যখন দুর্যোগের স্থায়িত্ব বেশি হয়, অর্থাৎ ঝড়, জলোচ্ছ¡াস, বন্যা প্রভৃতি বেশি হয়Ñ তখন ক্ষতির পরিমাণও বাড়ে। এজন্য টেকসই বাঁধ ও সঠিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ। নইলে কয়েক বছরের দুর্যোগেই সেগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে। আমরা প্রতিবারই দেশের অনেক স্থানে তেমনটি হতে দেখি। এতে শুধু অর্থের অপচয় হয় না। অনেক মানুষ সর্বস্বান্তও হন। ব্যাপক ভাঙন শুরু হলে জিও ব্যাগ ফেলে আর বাঁধে জোড়াতালি দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়