ভালোবাসা এখন ‘ভার্চুয়াল’, আবেগেও পড়েছে টান : তবুও বসন্ত জেগেছে বনে

আগের সংবাদ

সংস্কৃতির চর্চা জোরদারের তাগিদ > বাঙালির প্রাণের মেলার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী : হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ অনেক

পরের সংবাদ

ভাষা আন্দোলন ও জাতীয় সংহতি

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একুশে ফেব্রুয়ারি- ক্যালেন্ডারের পাতায় একটি দিন মাত্র নয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের রক্তঝরা দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে আমাদের ভাষার ইতিহাসে। বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালিকে জাগিয়ে দিয়েছে; কানে দিয়েছে মুক্তির মন্ত্র, বুকে এনে দিয়েছে শক্তি ও সাহস। একুশের প্রধান প্রেরণা ছিল এই ভূখণ্ডের মানুষের মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫) পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্রের আবির্ভাব হয়েছে। এসব দেশ স্ব-শাসনের অধিকার পেলেও প্রকৃত-মুক্তি অনেক দেশেরই আসেনি। বাঙালিও ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশের কবল থেকে স্বাধীনতা পেয়ে দেশীয় শোষকের জাঁতাকলে যেন নতুন করে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। শুরু হয় আরেক ধরনের শোষণ। পাকিস্তান নামক দেশটির পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মাঝে দেখা যায় স্পষ্ট বিভক্তি। শুধু ভৌগোলিক বিভক্তি নয়, এর শক্তিশালী অংশের শাসককুল শোষণের হাত বাড়িয়ে দেয় দুর্বল অংশের দিকে; অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের দিকে, বাঙালির দিকে। তারা মায়ের মুখের ভাষায় আমাদের কথা বলা অধিকার কেড়ে নিতে চায়। মাতৃভাষার প্রশ্নে একত্রিত হলো বাঙালিরা। এমন জাতীয় সংহতি ও জনগণের সম্মিলিত কণ্ঠের প্রতিবাদ অকল্পনীয় ছিল পশ্চিমা শাসকদের কাছে। এই ‘জাতীয় সংহতি’ গড়ে তোলা কেনো সম্ভব হয়েছিল সেইদিন? অবিশ্বাস্য রকম সত্য যে, এই অঞ্চলের সব মানুষের কণ্ঠ যেন এক কণ্ঠ হয়ে গর্জে উঠেছিল।
আত্মপরিচয়ে বাঙালিরা সেদিন অনড় এবং মুখের ভাষার মর্যাদা আদায়ে সবাই সংকল্পবদ্ধ। তৎকালীন নতুন দেশ পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ গণপরিষদের ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজিকে মর্যাদা দিলেন; আর পুরোপুরি অবজ্ঞা করলেন বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভাষা- বাংলাকে। সেই থেকেই বিভক্তির সূচনা। তারা কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিলেন। বাংলা ভাষার দাবি তুললো এই অঞ্চলের জনগণ। গণপরিষদের সেই অধিবেশনেই কুমিল্লার শ্রীধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, আর পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে পূর্ববাংলা সর্বত্র ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। এর প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। প্রতিবাদের এই যে বীজ রোপিত হয়েছিলো সেদিন- তা দিনে দিনে পুঞ্জীভূত হতে হতে নানা ত্যাগের মধ্য দিয়ে আসে বাঙালির পূর্ণ স্বাধীনতা। বাঙালির সেই সংহতি ছিল জাতীয় চেতনায় সকল প্রকার সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। জাতির সেই ঐক্যের ফল সম্মিলিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন।
আজ বাঙালির জাতীয় সংহতির বড় দুর্দিন, মধ্যাকাশের প্লেনের মতোই আমরা যেন পার করছি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া! এই দুর্যোগ বাঙালিকে ধৈর্য ধরে কাটিয়ে উঠতে হবে। নইলে আমাদের একুশের প্রেরণা, আমাদের জাতীয় সংহতি মুখ থুবড়ে পড়বে ধুলায়। যেই ঐক্য বাঙালিকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রতিবাদ মুখর করে তুলেছিল, যে ঐক্য বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল, সেই বোধে উজ্জীবিত হতে হবে এখনো। আমরা বাঙালি, ‘বাংলা’ আমাদের ভাষা। ধর্মীয় বিশ্বাসে ভিন্নতা থাকলেও ভ্রাতৃত্ববোধে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ। সেই ব্রিটিশ ভারতের উপনিবেশ আমলেও এই অঞ্চলের মানুষের ছিল ইস্পাত-কঠিন ঐক্য- যা ব্রিটিশ-ভারতের ভিত কাঁপিয়ে দিতে পেরেছিল সেদিন। তবে কোনো কোনো কুচক্রীমহল বাঙালির ধর্মীয় বোধে আঘাত এনে ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টির পাঁয়তারা করেছে বিভিন্ন সময়ে, কোনো ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত। কিন্তু বিভেদ সৃষ্টিকারীরা সফল হয় না কোনো কালে। কারণ সে চিন্তা- হীন চিন্তা! মুক্তপ্রাণ বাঙালির ঐক্য সকল ষড়যন্ত্রকে উড়িয়ে দিতে পেরেছে নিমেষেই।
১৯৪৭-এ দেশ ভাগ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ভাষার প্রশ্নে সব সময় বাঙালিদের মধ্যে ঐক্য ছিল। ভাষার প্রশ্নে যখন আঘাত এসেছে, তখনই সচেতন হয়েছে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বাঙালিরা, হয়ে উঠেছে প্রতিবাদী। তখন বাঙালির জাতীয় সংহতি আরো দৃঢ় হয়েছে। স্ব স্ব ধর্মে বিশ্বাসী থেকেও বাঙালিরা এক সঙ্গে বসবাস করে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ও সাম্প্রদায়িক উসকানিতে কখনো কখনো শান্তি বিনষ্ট হলেও- বাংলাদেশের মানুষ ভ্রাতৃত্ববোধে সবসময় ঐক্যবদ্ধ। আমাদের বড় পরিচয় আমরা বাঙালি; আমাদের ভাষা বাংলা, আমাদের সংস্কৃতি, সাহিত্যচিন্তা ও বোধ এক। মানুষ হিসেবে অহংকার করার মতো আমাদের রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। আমাদের গর্বিত পরিচয়- মাতৃভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। আমরা একুশের উত্তরাধিকার। এখানে এটাও বলা দরকার যে, ধর্মীয় বোধের দিক থেকে এ অঞ্চলের মানুষ ধর্মপ্রাণ। নিজ নিজ ধর্ম পালন করে সহাবস্থানে থেকে আমরা শান্তিকামী জাতি। কোনো কোনো সুবিধাবাদীমহল ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা নিতে চাইলেও তা সফল হয় না। তারপরও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জাতি হিসেবে আমাদের অহংকারের বহু বিষয় রয়েছে। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ- আমাদের অহংকার। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে তুলতে হবে এই দেশকে। এই দেশে জন্মগ্রহণ করে আগামী প্রজন্ম যেন গর্ববোধ করতে পারে। সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় কল্যাণে তারাও যেন নিজেকে নিবেদন করতে পারে দেশমাতৃকার সেবায়।
একুশে ফেব্রুয়ারির যে-আন্দোলন তা দৃশ্যত ভাষার আন্দোলন হলেও মূলত ছিল বাঙালির মুক্তির আন্দোলন। আর এটিই ছিল আমাদের জাতীয় ইতিহাসে প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এই আন্দোলন রূপলাভ করে ১৯৪৮ সালে, সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদ-ই-আজম যখন ঢাকায় এসে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছিলেন! ২১ মার্চ তারিখে রেসকোর্স ময়দানে ও ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সঙ্গে সঙ্গেই নির্ভীক যুবকণ্ঠে উচ্চারণরিত হয়েছিল ‘না’ ‘না’ ধ্বনি। এ যেন ছিল বাঙালির সম্মিলিত ধ্বনি। এর মধ্য দিয়েই দৃঢ় হয় আমাদের জাতীয় সংহতি। ভাষার দাবিতে শুরু হয়ে যায় বাঙালির মরণপণ সংগ্রাম। সেদিন প্রত্যেক বাঙালির কাছে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ছিল বীজমন্ত্র স্বরূপ। দেশের সাধারণ মানুষও বুঝে গিয়েছিল- পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। বাঙালিদের কাছে ‘মা’ ও মায়ের মুখের ভাষা ‘বাংলা’ দুই-ই সমান পবিত্র। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সত্তায় পূর্ববাংলার সমগ্র বাঙালি অভিন্ন চেতনায় ও অভিন্ন অনুভূতিতে একাত্ম। সে রকম জাতীয় ঐক্যে বাংলাদেশে আজো বড় প্রয়োজন। আজ আমাদের সামনে একটাই দাবি হওয়া উচিত- কোনো রাজনৈতিক হানাহানি বা বিভেদ নয়, সুষ্ঠু গণতন্ত্রচর্চার মধ্য দিয়ে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হবে। আমাদের লক্ষ্য হবে- মানুষের কল্যাণ ও দেশের সমৃদ্ধি অর্জন করা; শিক্ষায়, অর্থনীতিতে এবং সমাজগঠনে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাওয়া। যাতে এদেশ পৃথিবীর বুকে মর্যাদাবান রাষ্ট্র হিসেবে স্থান করে নিতে পারে। সমাজের সকল স্তরের মানুষের বোধোদয় হোক- যাতে কোনো অশুভ মহল আমাদের একুশের চেতনাকে মুছে দিতে না পারে।
আমরা কখনো ভুলতে পারি না ১৯৫২ সালের সেই দিন। সময়ের আবর্তে খাজা নাজিমউদ্দিন হয়ে গেলেন সে সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। নুরুল আমিন হলেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন আসেন পূর্ব পাকিস্তান সফরে। ক্ষমতালোভী নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসে সব ভুলে গেলেন, তিনি ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টনের এক জনসভায় পুনর্ব্যক্ত করলেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই বক্তব্য পূর্ববাংলার জনগণের মনে অসন্তোষ আরো সংহত হলো, প্রদেশজুড়ে উঠলো প্রতিবাদ। অথচ এই খাজা নাজিমউদ্দিন ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর সঙ্গে ভাষার দাবির শর্ত মেনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। ক্ষমতার এমনই মোহ- প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি তার প্রতিশ্রæতি ভাঙলেন, বিশ্বাসঘাতকতা করলেন বাঙালিদের সঙ্গে, বাংলা ভাষার সঙ্গে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আরো বেগবান হলো। বাংলার ছাত্রজনতা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে হাতে নেয় ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি। সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯৫২ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পালিত হয় ছাত্র ধর্মঘট।
বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটি ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের অধিবেশন বসার দিন। আর সেই একুশে ফেব্রুয়ারিতেই সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ও বিক্ষোভ মিছিল পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তে সকল পর্যায়ের ছাত্রজনতা ছিল ঐক্যবদ্ধ; যেন জীবনপণ সংগ্রামে লিপ্ত। সেদিনের সেই তারুণ্য দেশের ভবিষ্যৎ আলোকবর্তিকা হয়ে প্রতিভাত হয়েছিল। আর সেই হরতাল বানচাল করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে জারি করে ১৪৪ ধারা। এই ঘটনা সকলকে স্তম্ভিত করে দিলেও ছাত্রজনতার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গতিকে শ্লথ করতে পারেনি। সমগ্র জাতির প্রত্যাশাদীপ্ত এই প্রতিবাদ যেন আরো বেগবান হয়ে বাঙালিকে ধাবিত করলো মরণপণ সংগ্রামের দিকে। সেদিন ১৪৪ ধারা জারি করেও প্রতিবাদী ও সংঘবদ্ধ জনতাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি পাকিস্তান সরকার।
একুশে ফেব্রুয়ারির সেইদিন সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রজনতা দলে দলে এসে সমবেত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুপুরে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রসভা। সেই সভায় মাতৃভাষার মুক্তির লক্ষ্যে দীপ্ত তারুণ্য এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয় ১৪৪ ধারা ভেঙে ভাষার দাবিকে সমুন্নত রেখে এগিয়ে চলার। সভাশেষে ছাত্রদের মধ্য থেকে প্রতি দশজনের এক একটি দল সেøাগান দিতে দিতে রাস্তায় নামে এবং গ্রেপ্তার বরণ করতে থাকে। বেলা গড়িয়ে যায়- এক পর্যায়ে বিকালের দিকে পুলিশ ও ছাত্রজনতার সংঘাত বাধে। দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে ছাত্রদের উপর। ঘটনাস্থলেই মারা যায় রফিকউদ্দিন ও আবদুল জব্বার, আহত হয় অনেকেই। আহতদের মধ্যে আবুল বরকত মারা হন হাসপাতালে। এই হলো ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি- আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সেই মহান দিন। আজ যা মর্যাদার সঙ্গে সারা পৃথিবীতে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এই আমাদের একুশ, আমাদের গৌরবগাথার নাম।
আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক। আমাদের রয়েছে হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের একুশ, আমাদের ভাষার অধিকার ও আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি। আমাদের সংস্কৃতিও একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। প্রতি বছর একুশের বইমেলার আয়োজন আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারিজুড়ে এই মেলা। আমরা লেখকরাও আজ অনেকটা সিজনাল লেখক হয়ে পড়েছি। এ কথা সর্বাংশে না হলেও অনেকাংশে সত্যি। সারা বছর আমরা লিখি বটে, কিন্তু অপেক্ষা করে থাকি একুশের বইমেলার সময়ে প্রকাশের জন্য। শুধুই কি লেখক- বাঙালি পাঠকও হয়ে পড়েছে একুশনির্ভর! একুশের বইমেলা লেখক-পাঠকের মহামিলনমেলা। এই মেলাকে ঘিরে জমে ওঠে নবীন-প্রবীণ লেখকের আসর অর্থাৎ লেখক আড্ডা। তরুণ লেখক-কবিদের মৌসুম এই একুশ, একুশের বইমেলা। শুধু তরুণরা নয়, পাশাপাশি প্রবীণরাও পসরা সাজিয়ে বসেছেন নিজেদের সম্পাদিত-প্রকাশিত লিটন ম্যাগাজিন নিয়ে। এটাও একুশের বইমেলার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এখন।
এই একুশে ফেব্রুয়ারির হাত ধরে আমরা পেয়েছি আমাদের জাতিসত্তার পরিচয়। একুশ, বাঙালি জাতি আর বাংলাদেশ- যেন একই সূত্রে গাথা। একুশের চেতনা বাঙালির আত্মমর্যাদার ঐতিহাসিক স্মারক চিহ্ন- আলাদা এক বোধ। আমরা একুশের উত্তরাধিকারী, ঐক্যবদ্ধ চেতনার গর্বিত বাঙালি। একুশ- বাঙালি জাতির চিরজাগ্রত সত্তা, জাতীয় সংহতির প্রধান স্তম্ভ। একুশের রক্ত শপথের দৃঢ় প্রত্যয় বাঙালিকে আত্ম-পরিচয়ে, আত্মমর্যাদায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। মাতৃভাষার প্রতি পরম মমত্ববোধ, জাতীয়তাবোধ ও আত্মপরিচয়ের তাগিদ থেকে উৎসারিত এই চেতনা। একুশের এই বোধে আজ আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময়। দেশের স্বার্থে আমরা কি সেই ঐক্যে উজ্জীবিত হতে পারি না আর একবার। পারি না- সমবেতভাবে সকল বিভেদ ভুলে অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে; যেতে পারি না- দেশ জনগণের স্বার্থে সুস্থধারার রাজনীতির দিকে! পারি- আমাদের তরুণসমাজকে জেগে উঠতে হবে একুশের চেতনায় আর একবার। শিক্ষার পাশাপাশি সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখতে হবে। একুশের সেই চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। একুশের চেতনাই হোক আজকের দিনে আমাদের জাতীয় সংহতির অনুপ্রেরণা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়