গাজীপুরে কেমিক্যাল কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

আগের সংবাদ

বাজার অস্থির দিশাহারা মানুষ : নিত্যপণ্যের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় আরেক দফা বাড়বে

পরের সংবাদ

বাল্যবিয়ে নামক কুপ্রথার স্থায়ী অবসান ঘটাতে হবে

প্রকাশিত: নভেম্বর ৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের সমাজে বাল্যবিয়ের সমস্যা তথা অভিশাপ আজকের নয়। বিষয়টি সমাজ-সচেতন বোদ্ধাদের নজরে আসে ১৯ শতকে বঙ্গীয় নবজাগরণের সময় রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীর। রক্ষণশীল সনাতনী হিন্দুসমাজে এ অভিশাপ ধর্মীয় আচার তথা অনাচারের নামে সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল আট বছরের কন্যাশিশুর বিয়ে তথা গৌরিদান নামে। এর কুফল কারো নজরে আসেনি। আর রক্ষণশীল সমাজপতিরা তো এ কুপ্রথার সুফলভোগী, সুবিধাভোগী। সেটা হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় নির্বিশেষে। এমন অনুমান বোধহয় মিথ্যা হবে না। যে ধর্মীয় আচার-আচরণে হিন্দু-মুসলমান সমাজে যথেষ্ট পার্থক্য থাকলেও এ কুপ্রথাটি অর্থ-বিত্তে অগ্রসর হিন্দুসমাজ থেকে ঠিকই সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবেশি মুসলমান সমাজে প্রবেশ করেছে। এ ক্ষেত্রে কোনো বাধাবিরোধ সৃষ্টি হয়নি। আমার ব্যক্তিগত অনুসন্ধান বলে, আমাদের বৃহত্তর পরিবারে গ্রামীণ পরিবেশে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে ৮-৯ বছরের কন্যাশিশুর বিয়ে ছিল সচরাচর ঘটনা। মৌলভী সাহেব বা গ্রামীণ সমাজপতিরা এ ব্যাপারে এটিকে হিন্দু আচার বলে কোনো প্রকার ফতোয়া দিতে এগিয়ে আসেননি। কিন্তু সুসংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে তাদের ভিন্নমত বা রক্ষণশীলতা ঠিকই ফতোয়ার মতো উচ্চারিত হয়েছে- যেমন মুসলমান কিশোরীদের যথারীতি সংগীত চর্চার বিরোধিতায়। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো- সামাজিক কুপ্রথা-বিশেষ করে বাল্যবিয়ের মতো অভিশপ্ত প্রথার বিরুদ্ধে মুসলমান সমাজের শিক্ষিত বোদ্ধাদের প্রতিবাদে এগিয়ে যেতে দেখা যায়নি, অথবা বলা যায় কমই দেখা গেছে। ফলে এ অভিশপ্ত প্রথা মুসলমান সমাজে অবাধে বেড়েছে। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার দু-একটি উদাহরণ ব্যতিক্রম বলা চলে। একটি বিস্ময়কর ঘটনা হলো, ১৯ শতকের বঙ্গীয় নবজাগরণের সামাজিক প্রভাব প্রতিবেশী মুসলমান সমাজকে সামান্যই স্পর্শ করেছে। এ ব্যাপারে আমাদের কথিত সমাজ সংস্কারকদের কোনো প্রকার উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি। শাসক ব্রিটিশ রাজ প্রথমদিকে এ ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করেছে। তাদের হয়তো ভয় ছিল- কি জানি সমাজের উপকার করতে গিয়ে আবার শাসক-বিরোধিতার জ¦ালানি যুক্ত না হয়। কিন্তু দু-একজন অগ্রসর চিন্তার সাহসী গভর্নর জেনারেলের বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তে এবং হিন্দুসমাজের জনাকয় সমাজ সংস্কারকের সমর্থনে সমাজে বাল্যবিয়ের কুপ্রথা-বিরোধী ‘সহবাস সম্মতি আইন’ পাস হয়। কিন্তু মজাটা হলো, ফলে প্রতিবাদের ঝড় উঠে উভয় সমাজের রক্ষণশীল সমাজপতিদের আহ্বানে, এমনকি এই আইনের বিরোধিতায় শুধু ব্যাপক হরতালই অনুষ্ঠিত হয় না, রাতারাতি বাল্যবিয়ের ধুম পড়ে যায় তখন। আমাদের গ্রামের এক সচেতন যুবাকে প্রশ্ন করে জেনেছিলাম, তার প্রয়াত পিতার নাকি বিয়ে হয়েছিল বালক বয়সে, তার ভাষায় ‘হরতাইল্যার বছর’। গল্পটা তিনি নাকি বুড়ো বয়সেও রসিয়ে রসিয়ে করতেন। এ ছিল আমাদের বাঙালি সমাজের বাল্যবিয়ে সম্পর্কিত উপভোগ্য ইতিকথা, রক্ষণশীলতার চরম দৃষ্টান্ত।
দুই.
রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হুমায়ুন কবিরের ভাষায় বলতে হয়, ‘সেই ট্র্যাডিশন সামনে (এখনো) চলছে’। বাংলাদেশি সমাজ এই বিশেষ ক্ষেত্রে, উন্নয়নের যুগেও ক’পা এগিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। প্রায়ই দৈনিক পত্রিকায় দেখি বাল্যবিয়ের সংবাদ- কখনো পরিবার পক্ষে, কখনো সমাজপতিদের অনুশাসনে অনুষ্ঠিত হতে। তবে মাঝেমধ্যে বিপরীত ধারার দু’চারটে ব্যতিক্রমী খবর পড়ে আশায় বুক বাঁধি এই ভেবে, দায়বদ্ধরা যাই ভাবুক না কেন, সমাজে কিছু কিছু সাহসী মেয়ের আবির্ভাব ঘটেছে যারা নিজ চেষ্টায় উল্লিখিত অভিশপ্ত বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে বা আসতে পারছে। দৈনিকে প্রকাশিত এ জাতীয় খবরগুলোর উল্লেখে দুঃসংবাদ দিয়েই না হয় কথা শুরু করি। কালের কণ্ঠে একটি সংবাদ শিরোনাম : (২২.৯.২০২১) : ‘কুড়িগ্রামের এক স্কুলের ৮৫ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে’। একুশ শতকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত দেশে স্কুল বন্ধ থাকার সুযোগে এতগুলো বাল্যবিয়ে- যেন পূর্বোক্ত হরতাইল্যার বছরের অন্ধকার ছায়াপাত। এছাড়া আর কিইবা বলা যেতে পারে? কারণ ইতোমধ্যে এ জাতীয় একাধিক খবর দেখেছি পত্রিকায়।
এ জাতীয় একাধিক অনাচারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই এমন সংবাদ দৈনিকে : ‘বাল্যবিয়ে ও শিশুশ্রম রোধে বাড়াতে হবে প্রযুক্তির ব্যবহার’ (১২.১০.২০২১, প্রথম আলো)। আর সেই সূত্রে এমন খবর : ‘বিয়ের ক্ষেত্রে বয়সের প্রতারণা ঠেকাতে অনলাইনে বিবাহ নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে সরকার।’ আমরা মনে করি, আরো অনেক বলিদান সম্পন্ন হওয়ার আগেই দ্রুত প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেয়া দরকার সরকার পক্ষে। এবং তা সর্বাধিক দ্রুততায়, তাহলে অনেক অঘটন ঠেকানো সম্ভব হবে। আমরা চাই না, কয়েক শতক ধরে প্রচলিত সামাজিক অন্ধকার দূর করার প্রক্রিয়ার ওপর দীর্ঘসূত্রতার কালো ছায়ার প্রভাব পড়–ক।
সরকারের খেয়াল করা দরকার যে, এ বিষয়ে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। স্বভাবতই একটি সংবাদ শিরোনামের প্রতি আমরা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ‘বাল্যবিয়েতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে’। ইউনিসেফের সম্প্রতি তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার এখন ৫১ শতাংশ। উল্লেখ্য, এখনো এই আধুনিক যুগেও সমাজে ও পরিবারে পুত্রশিশুদের সঙ্গে তুলনায় কন্যাশিশুরা বৈষম্যের শিকার। জাতীয় কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে কালের কণ্ঠে এক সংবাদ শিরোনামে বলা হয়েছে (৩০.৯.২০২১) : কন্যাশিশুদের পিছিয়ে দিয়েছে বাল্যবিয়ে। অর্থাৎ তারা মূলত শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে- এটা নিঃসন্দেহে এক ভয়ংকর দুঃসংবাদ। এছাড়া আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা পূর্বোক্ত বৈষম্যের দিকটি স্পষ্ট করে তোলে। শুধু তাই নয়- পরিবারে ও সমাজে তারা নিপীড়নের শিকার। যেমন ওই সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে- ‘বাসাবাড়িতেও কন্যাশিশুরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে’। ভাবতে পারা যায় কি, এমন অসম্ভব ঘটনার কথা? তবু সত্যিটা হলো সমাজে এমনটা ঘটছে। অসহায় বালিকা-কিশোরী, এমনকি তরুণী!
প্রকৃতপক্ষে সামাজিক, পরিবেশ ও ধর্মীয় নিয়মনীতি ইত্যাদি নানা কারণ এবং দারিদ্র্য, নিরাপত্তা, পারিবারিক সমস্যা, এখনো প্রচলিত যৌতুক কুপ্রথা ইত্যাদি কারণে বাল্যবিয়ে লাগামহীন সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। মনে হয়, এক দুঃসময় পার করছে একুশ শতকে পৌঁছেও আমাদের হতভাগ্য কন্যাশিশুরা। নিজ পরিবারও তাকে রেহাই দেয় না। তাই বিরল ক্ষেত্রে হলেও সচেতন কন্যাশিশুরা তাদের দায় নিজ হাতে তুলে নিতে শুরু করেছে। কয়েকটি ঘটনায় আমি অন্ধকারে আসার আলো দেখতে পাচ্ছি এবং চাই এসব উদাহরণ অন্যদের অনুপ্রাণিত ও সাহসী করে তুলুক, প্রতিবাদে দৃঢ় করে তুলুক। একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ-শিরোনাম (২৯.৯.২০২১) : ‘বিয়ে বন্ধে স্কুলছাত্রী থানায়’। ঘটনা চুয়াডাঙ্গা শহরে। তবে এ ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, পরিবারটি দরিদ্র শ্রেণির। তাই সন্দেহ নেই দশম শ্রেণির এই ছাত্রীর সাহস প্রশংসনীয়। দ্বিতীয় সংবাদটিও আমাদের জন্য উৎসাহ-উদ্দীপক। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দশম শ্রেণির এক মেধাবী মাদ্রাসা ছাত্রী নিজ উদ্যোগে তার বিয়ে ঠেকাল পারিবারিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, প্রধানত শিক্ষক ও প্রশাসনের সহায়তায় (প্রথম আলো ৮.১০.২০২১)। দৈনিক ‘সমকাল’ তাই এদের প্রশংসনীয় সাধুবাদ জানিয়ে এক প্রতিবেদনে শিরোনাম প্রকাশ করেছে এই মর্মে : ‘বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে সাহসী কন্যারা’। সত্যি পাশে দাঁড়াক সমাজের সচেতন অংশে। বলাবাহুল্য সমাজের সচেতন ও অগ্রসর চেতনার মানুষ, গণমাধ্যমের প্রধান অংশ এবং পেশাজীবী সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখন বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে চলেছে। তা সত্ত্বেও অভিশপ্ত বাল্যবিয়ে বন্ধ হচ্ছে না গোড়া সমাজপতিদের অন্ধ পিছুটানের কারণে। এদের পেছনে আছে বাণিজ্যিক স্বার্থের লোভ-লালসা।
তাই আজ অগ্রসর চেতনার তরুণদের এবং অনুরূপ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্তব্য হবে সমাজের দায়িত্বশীল অংশকে নিয়ে সর্বজনীন আন্দোলন গড়ে তোলা- এর লক্ষ্য হবে সমাজে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক ও গভীর প্রভাব বিস্তার করা-যাতে বাল্যবিয়ে নামক কুপ্রথার চিরতরে অবসান ঘটে।
আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়