প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
দুটি ঘটনা- একটি ইরানের তেহরানের, অন্যটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের। ১৩ বার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, পাঁচবার আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ৩১ বছরের জেল এবং ১৫৪ ঘা চাবুক মাথার ওপরে ঝুলছে। জেলখানায় বসেই ইরানের কলাম লেখক, প্রাবন্ধিক, কবি, সমাজকর্মী নার্গিস মহম্মদিকে নোবেল কমিটি ২০২৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে। তেহরানের এভিন জেলখানায় সাজা ভুগছেন কৃষ্ণকেশী ৫১ বছর বয়সি, পেশায় প্রযুক্তিবিদ নার্গিস মহম্মদি। গত ৮ বছর তিনি তার ছেলেমেয়েদের ও স্বামীকে দেখেননি। ১৬ বছরের যমজ মেয়ে এবং স্বামী সবাই নির্বাসিত-আশ্রিত ফরাসি দেশে। সামাজিক পরিবর্তনের জন্য লড়তে থাকা নার্গিস ‘দেশদ্রোহী প্রোপাগান্ডা ছড়ানো’-র অভিযোগে ইরানের জেলখানায়। নার্গিস লিখেছেন, তিনি জেলখানার জানালা দিয়ে তেহরানের পাহাড়ের গায়ে গাছ ও ফুল দেখেন। ওই জানালার ফাঁকাটুকুই তার বর্তমান বিশ্ব। মুক্ত এক ইরানের কথা ভাবার জন্য ওই দৃশ্যটিই সম্বল। তিনি লিখেই গিয়েছেন- ‘আরো শাস্তি দিক আমাকে, আরো কেড়ে নিক আমার স্বাধীনতা; তত আমি হয়ে উঠব আরো বেশি বদ্ধপরিকর।’ পাশ্চাত্য মিডিয়াতে যেন সাক্ষাৎকার না দিতে পারেন, সে জন্য ইরান সরকার নার্গিসের টেলিফোনে কথা বলা এবং সাক্ষাৎকারের অধিকারও কেড়ে নিয়েছে। নার্গিসের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিশেষ অর্থবহ। কেননা ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ইরান জ্বলে উঠেছিল তরুণী মাহসা আমিনের মৃত্যুর পর। তেহরানসহ ইরানের ৮০টি শহরে হিজাববিরোধী আন্দোলনের আগুন তখন জ্বলে উঠেছিল। পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল অনেক ইরানির; বেমালুম লোপাট হয়ে যাচ্ছিল পথচারীদের কেউ কেউ। সঠিকভাবে হিজাব পরেনি, সঠিকভাবে মাথা ঢাকেনি, সঠিকভাবে কেশ আবৃত করেনি- সেই কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল আমিনিকে। সরকারের নীতি পুলিশের হাতে বন্দি থাকাকালে মাহসার মৃত্যু ঘটে। নার্গিসের পুরস্কার প্রাপ্তি যেন ইরানের মাহসা ও অন্যান্য প্রতিবাদী নারীদের বিজয়ের কণ্ঠস্বরকে মেনে নেয়ার ঘোষণা নোবেল কমিটির।
কানের কাছে ফিস ফিস করে নার্স বলল- ‘স্যার, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছেন আপনাকে দেখতে।’ কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের টিউবে মুখ-নাক সবই ঢাকা। শরীর মিশে আছে বিছানায়। সমস্যা ফুসফুসে। মুখ্যমন্ত্রীর কথা নার্স বলতেই শরীরটা যেন নড়ে উঠল। কিন্তু পারলেন না। চেষ্টা করলেন, হাত নেড়ে ইঙ্গিতে কিছু বোঝাতে। সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বললেন- ‘থাক, থাক; জোর করবেন না।’ উডল্যান্ডস হাসপাতালের রোগশয্যায় প্রাক্তন দেখতে এসেছে বর্তমানকে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্তমানের সামনে ধরা দিলেন প্রাক্তন। এই সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। স্বপ্ন ছিল যার অঢেল। কিন্তু ইগোর আড়ালে হাজির হয়েছিল দুঃসময়। তিনি আজ প্রবল অসুখে আক্রান্ত। তাই বর্তমানের সময় আজ আর ভুল খোঁজার দিন নয়। একটি মানবিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়েছিলেন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এটাই সৌজন্য। রাজনীতির ময়দানে যতই বিরোধিতা থাক, অসুখের সময় পারস্পরিক পাশে থাকাটাই সভ্যতা। একটা সময় ছিল মমতা বুদ্ধদেবের দ্বৈরথ। সময় গড়িয়েছে; সংঘাত ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মমতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। এর আগেও কয়েকবার অসুস্থ বুদ্ধদেবকে দেখতে তার পাম অ্যাভিনিউর বাড়িতে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্যকে ফোন করে বলে এসেছেন- ‘বউদি, যখন প্রয়োজন, আমাকে একটা ফোন করবেন।’ এটাই একজন মুখ্যমন্ত্রীর মানবিক মুখ। এটাই একজন রাজনীতিবিদের মানবিক দায়িত্ব।
গৌরকিশোর ঘোষের একটি লেখার কথা মনে পড়ছে। তখন মাছের বাজারে আগুন লেগেছিল। একদিন বড় মাছের বাজারে মন্ত্রী মশাইয়ের উপস্থিতিতে ন্যায্যমূল্যে মাছ বিক্রি হলো। প্রথম মাছটি বিক্রি হলো মন্ত্রীর হাত দিয়ে। গৌরকিশোর ঘোষ সেই মাছটির সাক্ষাৎকার নিলেন। পোনা মাছ- তাই সাংবাদিক তাকে সম্বোধন করলেন, পোনাদা হিসেবে। কিন্তু তাতে মাছটি বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন- ‘আমাকে পোনা বলে ডাকবেন না; আমি সাধারণ পোনা নই। আমি সরকারি পোনা। মন্ত্রীর হাত দিয়ে বিক্রি হয়েছি, আমাকে একটু আলাদাভাবেই দেখবেন।’ কালের নিয়মে আজ তো সরকারি ছানা-পোনাদের রমরমা অবস্থা স্বাভাবিকভাবেই আরো বেড়েছে। তারা সরকারের মুখ তো বটেই, কালে কালে তারাই সরকার হয়ে উঠেছে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। হুজুর মা-বাপ। কী তাদের রাজনৈতিক কর্তব্য, কী তাদের কাজ- এমন প্রশ্ন করার জো নেই। দৈবাৎ প্রশ্ন উঠলেও তাদের পাল্টা প্রশ্ন- ‘জানিস আমি কে?’
আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, পরাণ বান্ধিবি কেমনে! আসন্ন নির্বাচনের আগে এ গানটির রাজনৈতিক দিকটি নিয়েই আমি ভাবছি। একটু কী তারা ভাবতে পারেন না তাদের কথা, যাদের ভোট প্রয়োজন জনপ্রতিনিধি হতে? এতসব দেখে না লিখে থাকি কী করে বলুন তো? আপনারা কুকথা বলবেন, ধমক দেবেন, মাংস ছুড়ে দেবেন- কিন্তু আপনাদের যে রাজনৈতিক দায়িত্ব সেটা করবেন না। এমনটা হলে না লিখে কি থাকতে পারি? ক’জন আপনারা আপনাদের নেতা-নেত্রীদের রাজনৈতিক সভ্যতার দোহাই দিয়ে ইগো নামের অরাজনৈতিক বিরাগভাজন ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন? আমরা তো আপনাদের মতো পারব না। সরাসরি অনুরোধ করার সুযোগ নেই। তাই বলে কি লিখবও না? তা কী করে হয়! তাই বলে কি প্রেম দেব না, যদি মার কলসির কানা। আমরা লিখছি, অপেক্ষা করছি। লেখা ছাড়া কী-ই বা আছে আমাদের। আমাদের লিখতেই হবে। দায়বদ্ধতা অনেক বড় এবং ভারী শব্দ। তার নানাবিধ দিক আছে। একটি দিক আমাদেরও লিখতে শিখায় এবং অপেক্ষা করতে শিখায়।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যা পারেন, আমরা কেন তা করে দেখাতে পারি না? আমরা কেন রাজনৈতিক ইগোর বাইরে গিয়ে অসুস্থ মানুষটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে মহানুভবতার পরিচয় দিতে পারি না? আমরা চারপাশের লোকগুলো কেন এমন করেই বলতে পারি না? কেন বলতে পারি না- অসুখের সময় পারস্পরিক পাশে থাকাটাই সভ্যতা? নোবেল কমিটি একধাপ এগিয়ে অনেক দেশের সরকারকে এই বলে মেসেজ দিচ্ছে যে, নির্যাতনের বাইরেও একটা দুনিয়া আছে। আমরা ভোট চাই, কিন্তু ভোটের পর নিরাপত্তা দিতে পারি না ভোটারদের। ভোটের পর বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা দিতে পারে না আমাদের হিংসাত্মক রাজনীতি। বন্যার পরও বাড়ি ফেরা যায়। কিন্তু নির্বাচনের পর বাড়ি ফেরা হয় না অনেকের। ফেল করা নেতার পক্ষের কর্মীরা নির্বাচনের পর ঘরছাড়া হয়ে যায়, কবে বাড়ি ফিরতে পারবে জানে না। কেন আমাদের এত রাজনৈতিক হিংসা? কার লাভ হয় এতে? জানা নেই, কবে আমরা ফিরে পাব খেলার মাঠে স্পোর্টসম্যান স্পিরিট আর রাজনৈতিক মাঠে রাজনৈতিক স্পিরিট। সহজাত ভালোবাসা দিয়ে ক্রিকেট মাঠের ৫০ ওভারকে কিংবা রাজনীতির মাঠের কর্মকাণ্ডকে কি আমরা আর দেখতে পাব না? সবকিছু কি চিহ্নিত হয়ে যাবে শত্রæতার অঙ্কে? তাতে কি লাভ হবে খেলার কিংবা রাজনীতির অথবা যোগদানকারী খেলোয়াড়দের কিংবা রাজনীতিবিদদের? না কি লাভ হবে বহমান ঘৃণার লাভাস্রোতের?
এত কথা বললাম, এত উদাহরণ দিলাম এ জন্য যে, আমরা অনেক দিন ধরেই লক্ষ করছি সংঘাতময় রাজনীতি বিরোধী পক্ষকে চিরদিনের জন্য শত্রæই বানিয়ে রাখছে। এমনকি একজনের অসুস্থতায় অন্যজনের প্রাণ কাঁদছে না, মানবিক অনুভূতিও জাগছে না। এসব যে রাজনৈতিক ভুল, তা যেমন নিজের বোঝার বিষয়- ঠিক পাশে থাকা অনুসারীদেরও পরামর্শের মাধ্যমে বোঝানোর বিষয়। শুধু ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার নয়; সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ দেয়াটাই প্রকৃত বন্ধুর কাজ। তা না হলে শুধু ভুলেভরা রাজনীতির ভুল আরো বাড়তেই থাকবে, শুদ্ধতার পথে এগোতে পারবে না কোনোদিন।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।