গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

যুদ্ধনারী মায়া খাতুন : বিকুল চক্রবর্তী > নাটক

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রথম দৃশ্য
সময় ১৯৭১ খ্রি. আনুমানিক আগস্ট মাস হবে। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুরখার ইউনিয়নের ষাড়েরগজ গ্রাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পথে। মায়া সহপাঠীদের সাথে খেলায় মত্ত। এ সময় মায়ার মা খেতে ডাকছেন।
সমিত্তা বিবি (মায়ার মা)- মায়া এই মায়া খাইতে আয়গো?
মায়া- আইরামগো মা একটু উবাও। (মায়া খেলতে থাকে)
মা- কিতাবেটি বেইল ভাটি ওইযার খাইলা আইয়া।
মায়া- (অন্য সাথীদের) এই আইজ খেলাবাদ, মায়ে ডাকরা যাইগী।
মা- আয়গো মায়া।
খেলার সাথী- তুই যা খালায় ডাকরা। আমরাও জাইগি।

দ্বিতীয় দৃশ্য
মা- কিতাবেটি তর পেটোখিদা লাগেনানি।
মায়া- না মা ওখনও লাগছেনা তুমি খাইলাও আমি খাইতাম নায়।
মা- খাইলা খাওয়ার পর একতা দিমুনে। তর বাবায় তর লাগি আনছইন।
মায়া- কিতা আনছইন
মা- তর লাগি লাল ফিতা আনছইন। (ফিতা দেখিয়ে) ওউ দেখ। (মা মায়ার হাতে ফিতা দেন মায়া ফিতা পেয়ে খুশি) ওখন ভাত খানিত বও।
মায়া- চল খাইলাই।
মা- ওয় চল। (যেতে যেতে) শুন মা দেশও ওখন যুদ্ধ লাগছে। বাড়ির বাইরে যাইও না। তোমার বাবায় না করছইন।
মায়া- কেনে?
মা- গাউত পাঞ্জাবি-এ ক্যাম্প করছে। আমরার স্কুলও। ভুলেও হেবায় যাইওনা। চলো ওখন খাইলাও।

তৃতীয় দৃশ্য
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চলা ফেরা গ্রামে। সাথে রাজাকার। মানুষের মধ্যে ভয়। মায়াদের বাড়ির অদূরেই ষাড়েরগজ স্কুলে পাক সেনার ক্যাম্প। এ দৃশ্যান্তে (মানুষের ছুটাছুটি, পাক সেনা- সাধারণ মানুষ, গ্রামের যুবতীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে তাদের ক্যাম্পে। মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা দল যুদ্ধের কৌশল নিয়ে আলোচনা করবে। এই দৃশ্যে কোন ডায়লগ নেই। ছুটাছুটি ও চলা ফেরা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র ফুঁটিয়ে তুলতে হবে।)

চতুর্থ দৃশ্য
মায়া খাতুনের ঘর। মায়ার মা ও মায়ার প্রবেশ। মায়া গোসলে যাবে মাকে বলে।
মা- কই যাছ বেটি।
মায়া- মা আমি গোছল কইরা আই। ঘাট যাইরাম।
মা- সকাল করি আইছ। আমি খাইলারাম। তুই লইয়া খাইছ।
মায়া- আইচ্ছা। তুমি খাইলাও
মায়া গোছলে চলে যায়। মায়ার মা ভাত নিয়ে খেতে বসেন।

পঞ্চম দৃশ্য
মঞ্চের এক পাশে উঠবে পাকসেনা ও রাজাকার। অন্য পাশে মায়া। ৯ দৃশান্তর হবে) মায়া পুকুরে নেমে কাপড় কিছুটা খুলে যখন পানিতে পা দিবে তখনই পুকুরের অপর পাড়ে এক রাজাকারসহ পাকিস্তানি সেনা তার দিকে তাকায়। রাজাকার পাকিস্তানি সেনাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় মায়াকে। মায়া ভয় পেয়ে যায়।
পাকিস্তানি সেনা- রজব আলী এই লেরকিতো বহুত সুরত হায়। একে লিয়ে আও ক্যাম্পে।
রাজাকার আব্দুর মজিদ (আব্দুর করিমে ছেলে)- ডাক দেয় এই মায়া সাবে তরে ডাকরা ওবায় আয়।
মায়া ভয় পেয়ে পানিতে না নেমে দৌড়ে তার ঘরে চলে যায়। পেছন পেছন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারও দৌড়ায়।

ষষ্ঠ দৃশ্য
মায়া ভয়ে তাদের ঘরের চকির নিচে লুকায়। তার মা তখন দরজার পাশে বসে ভাত খাচ্ছিলেন। মায়ার মা কিছু বুঝে উঠার আগেই পাকিস্তানি সেনা ঘরে প্রবেশ করে।
পাকসেনা- ছুকড়ি কিদারসে
মা- নিজেই ভীত, কোন কথা বলেন না। কিছুক্ষণ পর বলেন- নেই নেই, নেই (বলে মাথা নাড়েন)
পাকসেনা- জুট বলতাহে। (এ সময় মায়ার মায়ের সামনের ভাতের থাল লাথি দিয়ে ফেলেদেয় এবং রাজাকারের দিকে তাকিয়ে বলে)- ছুকড়িকো পাকারকে লে আও।
রাজাকারসহ এক পাকিস্তানি সৈন্য মায়াকে ঘরের মধ্যে খোঁজে। মায়া ঘরের ভিতরে চকির নিচে ভয়ে কাঁপছিল। এ সময় চকির নিচে তাকিয়ে তারা মায়া কে দেখে ফেলে। মায়ার যেন বুক থেকে প্রাণ চলে যায় এমন অবস্থা। এ সময় পায়ে ধরে টেনে চকির নিচ থেকে মায়াকে বের করে। মায়া ভয়ে কাঁদতে থাকে। মায়ার মা তার মেয়েকে না নেয়ার জন্য তাদের হাতে পায়ে ধরেন।
মা- দোহাই আল্লার। আমার পুরিরে ছাড়িদেও। আমার পুরিয়ে ভাত খাইত।
পাকিস্তানি সেনা (বন্ধুক তাক করে বলে)- চুপ রও
মায়ার মা- আমার পুরি একেবারে বাইচ্চা। তাই কুনতা বুঝেনা। তাইরে ছাড়িদেও।
মায়ার মায়ের আকুতি পাক সেনাদের হৃদয় গলাতে পারেনি। মায়াকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিল। মা মেয়েকে টেনে ধরে রাখে। সেনারা মাকে লাথি দিয়ে মায়াকে ছাড়িয়ে নেয়।
মায়া- আমি যাইতাম নায়। আমি ভাত খাইতাম।
কোনো কথাই এরা শুনেনি। মায়াকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে।

সপ্তম দৃশ্য
ষাড়েরগজ স্কুলে পাকিস্তানি ক্যাম্প। মঞ্চে আসবেন ক্যাম্প কমান্ডার ও দুইজন সৈন্য।
ক্যাম্প কমান্ডার- কসমা লেরকি কাহাহে। ওসকো মেরে কামরামে লে আও।
সৈন্য- জী স্যার।
সৈন্যরা মঞ্চ থেকে নেমে মায়াকে টেনে টেনে নিয়ে আসে। ক্যাম্প কমান্ডারের হাতে তুলে দেয়। মায়ার ভীত চলা।
ক্যাম্প কমান্ডার- তুমতো বহুত সুরত (সুন্দর) হায়। মেরা কামরামে চল। মায়া যাবে না বলে হাতে পায়ে ধরে। কোন কাজ হয়না জোড় করে তাকে নিয়ে যায় ভিতরে। এর পর মায়ার উপর নির্যাতন চলে মায়া চিৎকার দেয়। এর পর শান্ত। (গান-নরপিশাচের লালসায়-মায়ার ইজ্জত যায়…)

অষ্টম দৃশ্য
পাকিস্তানি ক্যাম্পে কয়েকজন নারী। সাথে মায়াও পড়ে আছে নিথর দেহে। এদের প্রত্যেকেই কাপড় ছেড়া। ছুল অগুছালো।
একজন মধ্যবয়সী বিরাঙ্গনা- হায়রে হায়নার দল তরা মনে হয় কোন মায়ের গর্ভে জন্ম নিসনি। নইলে কি মেয়ের বয়সী এই বাচ্চা মেয়েটারে ধরে এনে এভাবে নির্যাতন করতে পারতি।
অপর বীরাঙ্গনা- আমার স্বামী আমার গায়ে কোনদিন একটা ফুলের আছরও লাগতে দেয়নি। এরা আমারে কুবলাইয়া কুবলাইয়া খাইছে। এরা মানুষ না পশু। (বুটের শব্দ)
বীরাঙ্গনা- ওই আইছে। কারে যে নিবো আল্লা।
দুই পাকিস্তানি সেনার প্রবেশ। মায়ার দিকে দৃষ্টি। পায়ের বুট দিয়ে মায়াকে নারা দেয়। মায়া উঠে না। বুট দিয়ে বুকে চেপে ধরে তবুও মায়া উঠে না।
সৈন্য এক- গরম পানি লে আও
একজন গরম পানি আনতে যায়। অন্য নির্যাতিত নারীরা ভীত। সে বুট দিয়ে মায়াকে নারাতেই আছে। গরম পানি নিয়ে আসে অপর সৈন্য। তার কাছ থেকে গরম পানি নিয়ে সৈন্য এক মায়ার উপর ছাড়ে। আস্তে আস্তে মায়ার জ্ঞান ফিরে। তারা আবার মায়াকে তুলে নিয়ে যায় ভিতরে। ভিতর থেকে মায়ার আর্তনাদের শব্দ শোনা যায়।
পরে আরো সৈন্য এসে এদেরও নিয়ে যায়।

নবম দৃশ্য
মায়ার বাবা, মেগা মহারদার, গ্রামের মানুষ এর প্রবেশ।
প্রথমে মামায় বাবা মেয়েকে ছাড়িয়ে আনতে গ্রামের মানুষদের সাথে কথা বলেন। তারা পরার্মশদেন মেগা মহালদারের সাথে যোগাযোগ করতে।
মায়ার বাবা আব্দুল বারি- (গ্রামবাসীকে) চাচা ও চাচা তুমরা একটা কিছু করো আমার পুরিটারে আইজ ৫ দিন ধইরা ক্যাম্পে আটকাইয়া রাখছে।
গ্রামবাসী-২ আব্দুর রশিদ- পাঞ্জাবির কাছে যাওয়ার কার সাধ্য আছে। তুমি এক কাজ করো রাজাকার আব্দুল মজিদের কাছে যাও। হেঔতো গ্রামরে উশৃরিঙ্খল কইরা তুলছে। সব তার লাগি আতংকে আছে।
গ্রামবাসী-১ আব্দুল করিম- হে গাউর ছাগল একটাও রাখছে না। ধরি ধরি নিয়া ক্যাম্পও দেয়। ইটা যেমন তার বাপর ছাগল।
গ্রামবাসী-২ আব্দুর রশিদ- এর পরও কইয়া দেখ।
গ্রামবাসী-১ আব্দুল করিম- লাভ নাই। ওউ হারামিয়ে আমার ছাগল নিছে দুইটা। দোকানর জিনিশি নিছে। বউত মাইষের ধান চাউল নিছে। গ্রামর করদর মিয়ার স্ত্রী রফুল বিবিরে ধইরা নিয়া ক্যাম্প দিছে। কদর মিয়াও বহুত হাইট্টা কিচ্ছু করতো পারছে না।

গ্রামবাসী-২ রশিদ (মায়ার বাবাকে)- মায়ার বাপ তোমার মেয়েরে আমারা গ্রামের মানুষের কথায় হেরা ছাড়ত নায়। তুমি বরং মেগা মহালদারের লগে যোগাযোগ করো। মহালদার হুনছি পিস কমিটির মেম্বার। তান কথা হেরা হুনতো পারে।
মায়ার বাবা আব্দুল বারি- তুমরাও একটু চল না আমার লগে। হকলে মিল্লা কইলে মহালদারসাবে একটা ব্যবস্থা কইরা দিবা।
গ্রামবাসী-২ আব্দুর রশিদ- চল। রওনা দেন এ সময় দেখতে পান মেগা মহালদার তাদের দিকেই আসছেন। ওই যে মহালদারসাব ও দিকেই আইরা।
মঞ্চে মেগা মহালদার সাবের প্রবেশ।
গ্রামবাসী আব্দুল করিম- মহালদার সাব আসালামালাইকুম। সবাই সালাম দিবে
মেগা মহালদার- ও আলাইকুম সালাম।
গ্রামবাসী-২ আব্দুর রশিদ- আপনে আমরা গ্রামবাসীরে বাছাউক্কা। পাকিস্তানি সেনারা দুই দিন পর পরও কেউর বউ, কেউর বইন, কেউর মেয়েরে ধইরা লইয়া যায় ক্যাম্পও। আর আব্দুল মজিদ রাজাকার তারার লগে লগে। ৪/৫দিন আগে আব্দুল বারির বাইচ্চা পুরিরের লইয়া গেছেগি।
আব্দুল বারি- সাব আপনার পাওখানতাত ধররাম। আমার পুরিরে আইন্না দেই। আমার বউ ৫ দিন ধরি খানিবনি ছাড়া। হুনছি ক্যাম্প অখন আমার পুরিরেও নির্যাতন করের বেশি। (বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে )
মেগা মহালদার – ঠিক আছে। আমি দেখি কিতা করা যায়। ওখন তোমরা যাও। আমি ক্যাম্পও যাইরাম।
(সকলের প্রস্থান)

দশম দৃশ্য
যুদ্ধের দৃশ্য। মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর একশন। রাজাকাররা পালায়। পাকবাহিনী দুর্বল হয়।
মঞ্চে মায়ার বাবা আব্দুল বারীর, মা সমত্তা বিবি ও সাথে অসুস্থ মায়া খাতুন এর প্রবেশ। এ সময় মঞ্চে প্রবেশ করবে একজন গ্রামবাসী।
মায়াকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামবাসীর একজন আব্দুল বারিকে আটকান।
গ্রামবাসী- ও মায়ার বাপ। কই যাও।
মায়ার বাবা আব্দুল বারী- ডাক্তারের কাছে।
গ্রামবাসী- তুমার পুরিতো পাঞ্জাবীর ঘর আছিল। তাইরে গ্রামও কেমনে রাখবায়।
আব্দুল বারি- দুআই আল্লার আমার পুরিগু অসুস্থ। তাইরে সুস্থ করতে দেও। এরা আমার পুরিরে ঘর থেকে জোড় কইরা ধইরা লইয়া গেছিল। আমরার কিতা করার আছে।
গ্রামবাসী- মাইনষে মাতের আমি কইলাম তুমারে। অইন্যকানো পাঠাইলেই ভালা।
(গ্রামবাসী চলে যায়)
আব্দুল বারি- মায়ার মা পুরিরে গ্রাম রাখা যাইতনায়। মাইনষে খালি মাতামাতি করের। আমারে ঠিটকারী মারের।
সমিত্তা বিবি- মাইনষে যেছাতা কউক। আগে আমার পুরিরে ডাক্তার দেখাও।
আব্দুল বারি- ডাক্তারো যাইরাম। মায়ার মা মেয়ে সুস্থ হইলে আবার এরা লাইয়া যাইবোগি। তাই আমি মনস্থ করছি মায়ারে ইন্ডিয়াত পাঠাই দিমু। আর আমিও কয়দিনের লাগি সিলেট যাইমুগি।
মা- সমিত্তা বিবি- ধইয্য ধর। আল্লাহ আছেন। চলো ডাক্তরো। (সকলের প্রস্থান)
এগারোতম দৃশ্য
আবারো যুদ্ধের দামামা। অনেক লাশ। মঞ্চে পড়ে থাকবে। মুক্তিযোদ্ধা, পাকিস্তানি সৈন্য, রাজাকার ও সাধারণ মানুষ।
যুদ্ধের পর মঞ্চ নিস্তব্দ।
শ্লোগান আসবে। জয় বাংলা। পেছন থেকে মানুষের কণ্ঠ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। লাইট অফ হবে সবাই উঠে যাবে।
লাল সবুজের পতাকা হাতে বিজয় মিছিল আসবে মঞ্চে।

পেছন থেকে কণ্ঠ- মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতি ও বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে।

দ্বিতীয় অংক
বারোতম দৃশ্য
স্বাধীনতার ৪০ বছর পর। ষাড়েরগজ গ্রামে এই মায়াখাতুনের সন্ধানে যান মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী। ষাড়েরগজ গ্রামে গাড়ি থেকে নেমে একটি দোকানের সামনে যান। এ সময় বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী সেখানে ছিলেন। সাংবাদিক আস্তে আস্তে তাদের কাছে যান।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- একজন মুরব্বিকে উদ্দেশে করে বলেন, আপনাদের গ্রামের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে আমি এসেছি। এ বিষয়ে একটু কথা বলতে চাই।
গ্রামবাসী আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে সম্মত দেন। সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী বেগ থেকে প্যাড কলম বের করে নোট করেন।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- আপনার নাম-
গ্রামবাসী- আব্দুল ছমেদ।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- আপনাদের গ্রামে ১৯৭১ সালে কোন মহিলা নির্যাতিত হয়েছিলেন এ বিষয়ে কিছু জানেন।
গ্রামবাসী আব্দুছ ছমেদ- পাশে থাকা অপর গ্রামবাসী মখলিস মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন, খাঁর বাড়িত থাকে যে মায়া ও বেটিরে নিছিলনানি ক্যাম্প।
গ্রামবাসী মখলিছ মিয়া- ওয় ওয়। কথ আগের কথা। সংগ্রামর সময়।
আব্দুস ছমেদ- (সাংবাদিকের দিকে) ৪০/৪৫ বছর আগের কথা বাবা। আমরার গ্রাম কত ঘটনাযে ঘটছে। এর মাজে একটা ঘটনা খুবই মর্মান্তিক আছিল।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- কোন ঘটনা একটু বলবেন।
আব্দুস ছমেদ- একটা বাইচ্চা মেয়ে আছিল মায়া। আব্দুর বারির পুরি। দুপুর বেলা ভাতর উড় থাকি তাইরে ধইরা ক্যাম্পও লাইয়াগেছে। খুব নির্যাতন করছে। মায়ারে ছাড়াইয়া আনার লাগি আব্দুল বারি বহুত দৌড়া দৌড়ি করছে।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- কি নাম বললেন উনার।
আব্দুস ছমেদ- মায়া খাতুন।
(সাংবাদিক নোট করেন)
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- কোন বাড়ি একটু দেখিয়ে দিবেন।
মখলিছ মিয়া- মায়া খাতুনওর নিজর বাড়ি নাই। পরের বাড়িত থাকইন। দুই পুড়ি আছে। আমরার গ্রামো আরো নির্যাতনর ঘটনা আছে। কদর মিয়ার বউ রফুল বিবিরেও নিছিল। পাঞ্জাবিরা।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- আচ্ছা। (সাংবাদিক নোট করেন) মায়া খাতুনের বাড়িটা কত দূর।
গ্রামবাসী আব্দুস ছমেদ – সোজা গিয়া বায়ে যাইবা। এরপর আবার বায়ে একবাড়ি পরেই মায়ার ঘর।
(সাংবাদিক এরই ফাঁকে ক্যামেরা নিয়ে গ্রামবাসীর সাক্ষাৎকার নেন)
এর পর মায়ার বাড়ির উদ্দেশে প্রস্থান

তেরোতম দৃশ্য
মায়া খাতুনের বাড়ি। একটি ছোট টিনের ঘর। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক ডাকদেন। সাথে ক্যামেরা পার্সন।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- ঘরে কেউ আছেন। (একটু পর ঘর থেকে ষাটোর্ধ্ব এক মহিলা বের হয়ে আসেন।) আমি মায়া খাতুনকে খোঁজছি।
মায়া খাতুন- জী আমিই মায়া খাতুন।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- আমি সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী। কাজ করি একুশে টেলিভিশন, ভোরের কাগজ ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করি। ১৯৭১ সালে আপনার জীবনে যে ঘটনা ঘটেছে এই বিষয়ে কথা বলতে চাই।
(মায়াখাতু নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণ স্থির থেকে তিনি ভেতরে যান এবং একটা টুল ও একটা চেয়ার নিয়ে আসেন।)
মায়া খাতুন- (চেয়ার এগিয়ে দিয়ে) বউকা (বসতে বলেন) বাবা।
(সাংবাদিক চেয়ারে না বসে টুলে বসেন এবং মায়াখাতুনকে চেয়ারে বসতে বলেন)
মায়াখাতুন- (দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ) যা যাওয়ারতো গেছে। ইটা আমার ভাইগ্যত আছিল। দিন অনেক অইছে। মাইনষে অখন ইটা ভুলছে। ইতা নতুন কইরা আবার সামনে আইননা লাভ কিতা বাবা। যে ঘটনা আমার জীবনরে তছনছ করি দিছে।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- মা আপনি ইতিহাসের অংশ। আপনার প্রতিটা ত্যাগ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক একটি লাইন। আপনার জীবনের কথা আপনি যদি না বলেন তাহলে দেশের জন্য আপনার যে ত্যাগ তা ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবে। আমি জানি আপানার জীবনের এই বিভিশিখাময় ঘটনা বলতে গিয়ে আপনার কষ্ট হবে। তবুও আমিও তা সংরক্ষণ করতে চাই।
মায়াখাতুন- (আস্তে আস্তে বলেন) একাত্তরের যুদ্ধ! পাকিস্তানি সেনা পাঞ্জাবিরা মানুষ আছিল না। এরার চোউখ রক্ত নাই। এরার কোন মায়া দয়া নাই। এরা আমার জীবনটারে শেষ করি দিছে। আমি এখন এই সমাজের অভিশপ্ত মানুষ। যুদ্ধর সময় আমি ছোট আছলাম। অত কুন্তা বুঝতাম না। আমারে ধইরা লইয়া কি নির্যাতন করছে। তারার কথা রাজি না হইলে বুটের লাতি আর গরম পানি উপরে ঢালতো…।
সাংবাদিক- রাজাকার কে ছিল?
মায়া খাতুন- রাজাকার ছিল আব্দুল মজিদ। ওউ রাজাকার এতো লোভি। টেকার লাগি, সম্পদর লাগি এরা নিজর বউ পুরিরেও পাঞ্জাবির হাতো তুইলা দিতো। কিন্তু ইতা কইয়া লাভ কিতা বাবা। রাজাকার ওকল সবই এখনও কোটি কোটি টাকার মালিক। সাধারণ মানুষের সম্পদ লুটপাট কইরা তারা ইতা করছে। আর যারার সম্পদ নিছে তারা ওকন ভিখারী। ইতার গাছতাকি সরকারে ওকল সম্পদ ফিরাইয়া আনতা আছলা।
না ইতা হইতো নায়। সব ভুলে নতুন ধান্ধায় রাজাকার ও তার বংশধর ওকল ওকন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নাওও। আমরা আগেও নির্যাতিত আছলাম। সংগ্রাম কইরা চলছি। আমরা সংগ্রাম ওকনও চলের।
সাংবাদিক- বুজলাম না মা। একটু বুঝিয়ে বলবেন
মায়াখাতুন- কেমনে বুজাইতাম বাবা। ঔযে ঘর দেখরায় ভাইঙ্গা পড়ের। ই ঘরের জায়গাও আমার নায়। ইটা আরকজনর জেগা। ওউ ঘরও দুই মেয়ে আর নাতি নাতনী লইয়া থাকি। একবার বেড়া ভাংলে ঠিক করতে কয়েক বছর লাগে।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- আপনার বাপের ভিটা নেই।
মায়াখাতুন- আমার বাবা ছিলেন ঘর জামাই। আমারে ক্যাম্পে নেওয়ায় মাইনষে আমার বাবারে ঠিটকারী মারতো। রাস্তাঘাটে অপদস্ত করতো। বাবা রাগ কইরা গ্রাম ছাইড়া চলি যাইন। কিছু দিন পর মাও মারা যাইন। আমার দায়িত্ব নেইন আমার নানী। কিছুদিন পর তিনিও মারা যাইন। আমি একলা অইয়া পড়ি। গ্রামের মাইনষে মিললা দ্বিতীয় বর এক জামাই লগে আমারে বিয়া দেইন। ওখানো দুঃখ কষ্টে সংসার চলছিল। কিন্তু কিছু দিন যাওয়ার পর মাইনষে কানাঘোষা শুরু করে আমারে কয় পাঞ্জাবির বউ। স্বামীর সাথে এ নিয়ে শুরু হয় সংসারো ঝামেলা। স্বামী আমারে তালাক দেইন। আমি নিরুপায় হইয়া পড়ি। কয়েকদিন ভবগুরের মতো ঘুরি। একসময় গ্রামের একজনের সাহায্যে শ্রীমঙ্গল সাঁতগাও একটি হোটেলো পেটে ভাতে কাম করা শুরু করি। এই হোটের নাম ছিল গরিবের হোটেল। ইখানো কয়েকদিন ভালোই চলছিল। কিছু দিন পর ওই হোটেলের মালিক নিজের একজন স্ত্রী থাকার পরও আমারে বিয়ার প্রস্তাব দেইন। এক সময় উনার সাথে আমার বিয়া হয়। বিয়ার পর এই সংসারো আমার দুই মেয়ে জন্ম নেয়। বেশ সুখেওউ কিছুদিন কাঠলো। কিন্তু আমার কপালে অত সুখ আল্লায় দিছইনা। কয়েক বছর পর আমার স্বামী অসুখে মারা যাইন।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- তারপর।
মায়া খাতুন- তারপর আর কিতা আবার পথ বইলাম। আগে একলা আছলাম কিছুটা ভালাই আছিল। ওখন মেয়ে দুইটা। তিনজনের পেট। যেন সাগরো ভাসছি। আল্লা কত কষ্ট করছি। দেশ স্বাধীন হইছে ঠিক বাবা কিন্তু আমরার লাগি নায়। আমরার যুদ্ধ ওখনও চলের।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- স্বাধীনতা যুদ্ধে আপনার মতো যে কয়জন মা সম্ভ্রম হারিয়েছেন, ত্যাগ সিকার করেছেন উনাদেরতো সরকার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। মাসে মাসে সম্মানীও দিচ্ছেন।
মায়া খাতুন- ইতা ওখন মুখদেখে মুগের ডাল। আমরার মতো অসহায় রাস্তার মাইনষের ভাগ্যে কিতা মুক্তিযোদ্ধার সম্মান জুটবোনি।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- আমি আপানাকে নিয়ে স্টরি করবো। আপনি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ করে আবেদন করেন। আমি কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নাম্বার দিচ্ছি। আপনি তাদের সাথে যোগাযোগ করেন। আর এটা আমার কার্ড। প্রয়োজনে আমার সাথেও যোগাযোগ করবেন।
সাংবাদিক কথা বলার সময় ক্যামের ম্যান ভিডিও করে। সাংবাদিক ক্যামেরাম্যানের কাছ থেকে ক্যামেরা নিয়ে মায়াখাতুনের ছবি তুলেন।
সালাম দিয়ে সাংবাদিক বিদায় নেন। মায়া খাতুন ঘরে চলে যান। দৃশান্তর।

চৌদ্দতম দৃশ্য
৫/৬ মাস পর
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তীর নিউজ কর্নারে আসেন মায়া খাতুন। হাতে অনেক কাগজপত্র।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- আসেন আসেন।
বীরাঙ্গনা মায়াখাতুন- আদাব মামা। আমি আপনার কথামতো সব আবেদন করছি। আবেদনের পর মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা (মধুছন্দা দাশ) তদন্ত কইরা রিপোর্ট দিছইন। তাইন সত্যতা পাইছন। ওউ দেখউকা কাগজ।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- (কাগজ হাতে নেন) আপনার রিপোর্ট একুশে টিভিতে প্রচার হয়েছে। ভোরের কাগজেও প্রকাশ হয়েছে। দেখছেন।
মায়া খাতুন- জ¦ী মামা। দেখছি।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- আপনার ঘটনার বাস্তবতা এখনো সমাজে বিরাজমান। এটি সত্য ঘটনা। আপনি মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা পাবেন।
মায়াখাতুন- আমার জন্য দোয়া করবা মামা। আইজ আইগি।
(সৌজন্যতা করে বিদায় নেন মায়াখাতুন দৃশান্তর)

পনেরোতম দৃশ্য
মঞ্চে এমপি উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, ইউএনও নজরুল ইসলাম, এসিল্যান্ড নুরুল হুদা, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী ও মায়া খাতুনসহ অন্য অতিথিরা।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার নজরুল ইসলাম- আমরা আজ আনন্দিত যে, ১৯৭১ সালের বীর মাতা সিন্দুরখান ইউনিয়নের ষাড়েরগজ গ্রামের মায়া খাতুনকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে জমিসহ একটি ঘর উপহার দিতে পেরেছি। সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তীর রিপোর্টে আমরা মায়া খাতুনের অসহাত্বের কথা জানতে পেরেছি। পরে যাছাই বাছাই করে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর বরাদ্দ দেই মায়া খাতুনের নামে।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কুমুদ রঞ্জন দেব- মায়াখাতুনের ঘটনার সময় আমরা ভারতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণে। যুদ্ধ শেষে দেশে এসে অনান্য ঘটনার সাথে এই ঘটনাও আমরা শুনেছি। মায়া খাতুন এখনও মুক্তিযোদ্ধা গেজেট না হলেও আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উনাকে আমন্ত্রণ জানাই।
উপস্থাপক- এবার মায়াখাতুনের হাতে প্রধানমন্ত্রীর ঘরের কাগজ তুলে দেন স্থানীয় এমপি উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ।
(সবাই মিলে মায়া খাতুনের হাতে ঘরের চাবি হস্তান্তর করেন। সাংবাদিক ছবি তুলেন।)
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- আজ আমার খুব ভালো লাগছে যার চোখেমুখে সবসময় কান্না এবং দুঃখের ছাপ লেগে থাকতো একটু হলেও আজ উনার মুখে হাঁসি ফুটে উঠেছে।
মায়াখাতুন- স্বাধীনতার ৫০ বছর পর জীবনে প্রথম স্বাধীন বাংলায় নিজের ঠিকানা পাইছি। এর লাগি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি লাখ লাখ শুকরিয়া।
সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী- মায়া খাতুনদের দুঃখগাথা এই কাহিনিগুলো বাংলার ইতিহাস। এগুলো সংরক্ষণ জরুরি। আর নিজস্ব স্বার্থ ত্যাগ করে মানবিক মুল্যবোধ থেকে সত্যতা নিরিখে ১৯৭১ সালে সম্ভ্রম হারানো মায়া খাতুনসহ আরো যে সকল মায়েরা আছেন তাদের মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত করে যথাযত সম্মান প্রদান করা হোক।
সমাপ্ত
চরিত্র
যুদ্ধনারী- মায়া খাতুন
মায়া খাতুনের মা- সমিত্তা বিবি
গ্রামবাসী-১ আব্দুস ছমেদ(স্বাধীনতার পর)
গ্রামবাসী-২ মকলিছ মিয়া (স্বাধীনতার পর)
বীরাঙ্গলা রফুল বেগম
আরো দুইজন বীরাঙ্গনা (নাম অজ্ঞাত)
রাজাকার- আব্দুল মজিদ
পাকিস্তানি সেনা- ১
পাকিস্তানি সেনা-২
ক্যাপ্টেন একজন
মেগা মহালদার
গ্রামবাসী-১ আব্দুর রশিদ( যুদ্ধের সময়)
গ্রামবাসী-২ আব্দুর করিম (যুদ্ধের সময়)
সাংবাদিক- বিকুল চক্রবর্তী
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা- নজরুল ইসলাম
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার- কুমুদ রঞ্জন দেব
একজন ফটোগ্রাফার-
এমপি-উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়