গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত : রুদ্র শাহীন > উপন্যাস

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এখন মেঘ-বৃষ্টি তো কিছুই নেই; বরং আকাশের বুকে বিক্ষিপ্ত হয়ে ফুটে আছে ক্ষুধার্থ কবির রচনার মতো ঝলমল একটি সোনালি রুটি।
ধীরে ধীরে রাতের গভীরতা বাড়ছে। জানালা থেকে আলো সরে গেছে। প্রবেশ করছে ফিনফিনে বাতাস। অনবরত। বাতাস খুব ঠাণ্ডা। ঘরের ভেতরে বেড়ার সাথে সেফটি পিন দিয়ে আটকানো হয়েছে একটি দেয়াল পঞ্জিকা। বাতাসে খুব নাড়া দিচ্ছে। আবছা আবছা অন্ধকার। দেয়াল পঞ্জিকাটা পুরোপুরি দেখা না গেলেও একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে। শব্দটা খুব বিশ্রী ধরনের। -পচ্-পচ্ -পচ্র…
জানালার সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সুচী। মন-মাতানো আকাশের দৃশ্যটা তাকে মুগ্ধ করে রেখেছে। মনেই নেই রাতের গভীরতার কথা।
বিছানায় নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে অতসী। তার কোনো সাড়াশব্দ নেই, মাঝে মাঝে নাক ডাকার শব্দ শোনা যায়। তার সর্দি-কাঁশি লেগেছে। সুচী দৃশ্যটা দেখে হেরে গেছে, অতসীকে দেখার জন্য হৃষ্টচিত্তে ডাকে। -কি সুন্দর আকাশের দৃশ্যটা, দেখ না!
বিছানায় শুয়ে আছে অতসী। প্রথম বারের ন্যায়। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। নিঃশ্বাস ফেলছে ঘন ঘন।
সুচী ভেবেছিল- এক লাফে অতসী বিছানা ছাড়বে। ফ্যাল ফ্যাল করে আকাশ দেখবে। কিন্তু না, তার কোনো সাড়া-শব্দ নেই।
খাটিয়ার কাছে আসে সুচী। অতসীর গায়ে হাত রেখে ডাকে। -আফু! আফু! না, কোনো জবাব নেই। জ্বর এসেছে। শরীর খুব গরম। সর্দি-কাঁশি লেগেছে। নাক দিয়ে অনবরত জল বের হচ্ছে। জ্বরের তাপমাত্রা এত বেশি পাশেও যাওয়া যাচ্ছে না।
-কি-রে আফু! তোর জ্বর এসেছে?
-একটু একটু।
-জ্বরের মাত্রা অনেক। তোর পাশেও যাওয়া যাচ্ছে না।
-ব্যস্ত হবার কিছু নেই।
কথাটা শুনে সুচী চোখ কপালে উঠেছে। টান টান ঠোঁটে বলল- শারীরিক অসুক-বিসুক নিয়ে অবহেলা করতে নেই। তোর শরীরে খুব জ্বর।
-তোর এম্মে লাগছে।
-বলিস কি?
-তোর হাত এন্মে গরম হয়ে আছে, আমার মাথায় হাত রাখার সাথে তোর কাছে বেশি বোধ হচ্ছে।
সুচী কথা বলার সময় হাত উঠায়। বারে বারে। এটা কোনো বদ-অভ্যাস নয়; বরং কথার ভাব প্রকাশের সহায়ক। -না আফু, তুই শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে মোটেই রসিকতা করিস না।
অতসী ফ্যাল ফ্যাল করে সুচীর মুখের পানে তাকায়। সুচী কথার মাস্টার। গল্প বলতে পারে বা বানাতে পারে। তার স্মরণ শক্তি খুব ভালো।
সুচী বলল- তোর কি মনে আছে ভাবীনপুরের সেই রইস্যা বন্ধুর কথা?
-একটু একটু।
-কেন? তোর-তো বেশি মনে থাকার কথা।
ভবানীপুর সরকারি প্রাইমারি স্কুলের ধর্ম শিক্ষক ছিলেন হাফেজ রইস উদ্দিন। বাড়ি নীলগঞ্জে। তিনি সবকিছু নিয়ে রসিকতা করতেন। তাই তাহার নামটা প্রকাশ পেয়েছে- রইস্যা বন্ধু।
রইস্যা বন্ধুর সাতটি ছেলে ছিল। তৎমধ্যে সবচেয়ে ভালো ও মেধাবী ছাত্র ছিল চতুর্থমত ছেলে ওমর।
ওমরের একদিন জ্বর উঠেছে। খুব। জ্বরের মাত্রা বেড়ে গেলে টাইফয়েড আক্রান্ত হয়। আবোল-তাবোল বকাবকি করে। ওমরের তাই হল। পাগলের মতো শুরু করলেন। রইস্যা বন্ধু ডাক্তারের বদলে নিয়ে আসলেন এক পাহাড়ি বৈদ্য। তিনি বললেন- ওমরের জ্বিন-ভূতের আচর পেয়েছে। আচর মুক্ত করতে হবে।
মধ্যরাত। কনকনে শীত। ঝড়ের মতো কুয়াশা ঝড়ছে। এমন শীতের মাঝে ওমরকে নিয়ে ‘জুগিনি পুকুর’ পাড়ে চলে গেলেন বৈদ্য। সাথে পিতা রইস্যা। জ্বিন-ভূতের আচর একের পর এক বেতের আঘাতে ছাড়াতে চেষ্টা করলেন।
শীতের মাঝে বৈদ্যর অত্যাচারে বন কাঁপছিলেন। জ্বিন-ভূতের আচর তবুও মুক্ত হল না। ওমর হয়ে গেলেন বেহুঁশ। যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন সে পুরাপুরি পাগল। তার ব্রেইনে আঘাত হয়েছে।
সেইদিন থেকে ওমর হয়ে গেল চিরদিনের জন্য পাগল। তাকে আর ভালো করা গেল না।
গল্পটা মনে পরেছে অতসীর। তাই মাথাটা নাড়া দিয়ে বলল- মনে পড়েছে।
সুচী ভ্রæ-কুঁচকে বলল- যে কোনো বিষয় নিয়ে রসিকতা করতে নেই।
অতসীর কপালে হাত রাখলো সুচী। গরমে হাতটা পুড়ে যাচ্ছে। -খুব জ্বর। মাথা ব্যথা আছে?
-হু।
-মনে হয় কুয়াশা লেগেছে। জানালা বন্ধ করে দেব?
-কেন?
জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস প্রবেশ করছে। বাতাস কুয়াশা মিশ্রিত। সর্দি-কাঁশি সবার হতে পারে। তাই সুচী জানালাটা বন্ধ করতে গেলে অতসী বলল- না।
সুন্দর গ্রীবাটা বাঁকা করে ফিরে তাকায় সুচী।
-তাহলে?
-একটা কাজ কর।
-কি?
-বাবার ওষুধের বক্সে একটা প্যারাসিটামল খুঁজে পাস কিনা দেখ।
-ঠিক আছে।

প্যারাসিটামল খুঁজতে গেল সুচী। হেঁটে চলার সময় পুরা দেশ-বাড়ি খবর হয়। পায়ের পাতার শব্দ। পচ্-পচ্-পচ্র…..।
কি বিশ্রী একটা শব্দ? এটা একটা বদ অভ্যাস। এ কারণে প্রতিনিয়তি কত বকুনি খেতে হয়, তবু মনের অজান্তে তার অভ্যাসটা আবার এসে যায়।
অতসী বিরক্ত হয়ে বলে- দুত্তরি! তোকে বলাটাই আমার ভুল।
-কি আবার ভুল করলাম?
তিক্ত গলায় অতসী বলল- যেভাবে হেঁটে যাচ্ছিস, সবার নিদ্রা ভেঙ্গে যাবে। পচ্-পচ্-পচ্র……।
পা আলগা করে সুচী বলল- ও আশ্চা! শুদ্ধ করে হাঁটতে পারি কিনা দেখি।
সুচী খুব সাবধানতা অবলম্বন করে হাঁটার চেষ্টা করছে। পা দেখে দেখে হাঁটছে।
নেশাগ্রস্ত মানুষ বারবার তাওবা করে। ভোরে বিছানা ছেড়ে বলে- গাঁজা আর খাব না। দুপুরে একবার, সন্ধ্যায় একবার এবং রাতের আঁধারেও আবার। এভাবে বারে বার। ভুল পথে না যাবার জন্য ‘তওবা’। অর্থাৎ ইসলাম নির্দেশিত ধর্মপথে বা সৎপথে প্রত্যাবর্তন। যখন ঘন আঁধার নেমে আসে- নেশার টানে মনেই থাকে না সেই ‘তওবা’র কথা; বরং সুখ টানের ‘তওবা’র শব্দটা পরিবর্তন হয়ে রাগ-রাগিনী বনে যায়।
হাঁটার সময় অনেক মানুষের পায়ের পাতার শব্দ হয়। এটা কোনো বদ-অভ্যাস নয়। বরং এটা একটা মুদ্রা দোষ। শব্দ দূষণ।
সুচী হাঁটার সময় পায়ের পাতার শব্দ হয়। তার জন্য কত বকুনি খেতে হয়। প্রতিনিয়ত। বহু চেষ্টা করে পা সেভ করে হাঁটার জন্য। তওবা করে। কিন্তু কবে যে মনের অজান্তে সেই পায়ের পাতার শব্দটা এসে যায়-একটু টের পায় না।
সুচী হাঁটছে। পচ্-পচ্-পচ্র। শব্দটা যখন নিজের কানে ছোঁয়া লাগে নিজেই নিজে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। ভারী ভারী গলায় বলে- দুত্তরি! যত সব! এত চেষ্টা করি- আবার এসে যায়…।
বেড়ার ঘর। এপাশ থেকে ওপাশে শব্দ বয়ে যাওয়া অতি সহজ। নিমিষেই পৌঁছে।
পাশের কক্ষে বাবার সাথে ঘুমাচ্ছে পরী। এখনও তার নিদ্রা আসেনি। সুচীর তিক্ত গলার বাক্যগুলো শুনে খিল খিল করে হেসে ওঠে।
-হি-হি-হি
হাসির শব্দটা স্পষ্ট এবং উপহাস করার মতো। গরম তেলে বেগুনের টুকরো ফেললে যা হয়ে। সুচী জ্বলে উঠে তিক্ত গলায় বলে- চুপ কর। এন্মে নিজেকে সামাল দিতে পারছি না, তার মাঝে কাটা গায়ে জ্বালা দিস্!
শেষের রুমে এখনও ঘুমানি মাবিয়া বেগম। তিনি কি কি যেন কাজ করছে। মেয়েদের কণ্ঠ শুনে তিনি লম্বাস্বরে ডাক দিলেন। বললেন- এত রাত পর্যন্ত তোরা জেগে আছিস কেন? ঘুমা। ভোরে ভোরে জেগে উঠতে হবে।
পরী চুপচাপ বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুম আসছেনা। বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিশ ফিশ করে বলছে-
-বাবা, তোমার কি পায়ে ব্যথা হয়?
-না। এখন হয় না।
-কখন হতো?
-যখন গুলি লেগেছিল। সুস্থ হবার পর আর লাগে না।
-যেই অংশটা কাটা হয়েছে-ওখানে ব্যথা হয়?
-না। অবশ ধরনের হয়ে আছে।
-কেন? আমাদের স্কুলের পণ্ডিত স্যার একদিন ক্লাসে বলেছিল- এই সব আঘাত নাকি আমবশ্যা-পূর্ণিমার রাতে যন্ত্রনা হয়। আজ পূর্ণিমা।
তড়ি-ঘড়ি করে বাবা বলল- আমার- তো কোনো ব্যথা লাগছে না। সুতরাং এটা একটা বানানো কথা।
-হ বাবা। পণ্ডিত স্যার বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে। গল্প বানানোর উস্তাদ।
বাবা বলল- আর ছাত্র-ছাত্রীরা? প্যান প্যান করার উস্তাদ?
বাক্যটা শাসন করার শামিল। তাই পরী চুপ হয়ে গেল। তিনি আবারও বললেন, মা-রে, ঘুমিয়ে পড়।
সেই দিন চৈত্র মাস। চারিদিক খাঁ খাঁ রৌদ্র-আগুন ঝড়ছিল। গরমে এত অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল- বনের পাখি পর্যন্ত ডানা মেলে ধরেছে।
নদীর পাড়ের মানুষ সারাদিন অক্লান্ত খাঁটুনি করেছে। একদিকে খাঁটুনি অন্যদিকে খড় গরম, দুই দিকের ছাপে শরীর ক্লান্ত। খুব। যখন অন্ধকার নেমে এসেছে-পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরও আর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন গ্রামবাসী।
গভীর রাত, তার মাঝে ঘন অন্ধকার। সুযোগটা বুঝে হানাদার ও পাক-বাহিনী গ্রামটা ঘিরে ফেলেছে। এক পা এক পা করে এগুচ্ছে। গুলি চালাচ্ছে। এমন গোলা-বারুদের শব্দে সহজে নিদ্রা ভাঙ্গেনি। তবে ভেঙেছে বুক, ভেঙেছে পাজর। হারাচ্ছে প্রাণ।
স্ত্রী-সন্তানকে ঘুমন্ত রেখে ছুটেছে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জামিল রাজা। কাঁদে ভারী মেশিন গান। রাতের আঁধারে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়েছে। একাকী, ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল পাক-হানাদার বাহিনী। অনেকে মারাও গেছে। কেউ কেউ পালাতে সক্ষম হয়েছে।
যুদ্ধের সময় সুবেহ সাদিকের আজানের ধ্বনি খুব কম শোনা গেছে। প্রান্তের শেষে কেউ কেউ নিস্তব্ধে আযান শেষ করেছে। ভয়ে।
আজানের সু-মধুর ধ্বনির শব্দে নিদ্রা ভাঙ্গেনি জামিল রাজার। ভেঙেছে পূর্ব আকাশে উদিত সোনালি আলোর তাপে। তার বিছানা ছিল- চৈত্র মাসের পাকা ধান ক্ষেতে।
চোখ মেলে ধরে। উপরে সুন্দর একটি আকাশ। কোথাও কোনো মেঘ নেই। ভোরের মৃদু বাতাসে ধুলছে সোনালি ধান।
জামিল সাহেবের জ্ঞান পুরোপুরি এসেছে, কিন্তু তার বাম পা অবশ। পা’টি অচেতন। নাড়া-চড়া করতে পারছে না। গুলি লেগেছে গোড়ালীতে। ফলে রক্ত ঝড়ছে, অনবরত। কবে গুলি লেগেছিল বুঝতে পারেনি।
দেশ স্বাধীন হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু হারিয়ে ফেলেছে জামিল রাজার একটি পা।
জামিল সাহেব নকল পায়ে চলাফেরা করেন। ইদানীং বামহাত প্যারেলাইসিসে আক্রান্ত হয়েছে। ফলে চলাফেরা করতে খুব অসুবিধা। দেয়াল চেপে, চেয়ার ধরে কিংবা টেবিল ধরে ধরে কোনো মতে চলাফেরা করেন।
এখনো ঘুমায়নি জামিল সাহেব। তার নিদ্রা সহজে আসে না। সারারাত নীরব-নিস্তব্ধে বিছানায় গড়াগড়ি করে। কাঁশি রোগেও আক্রান্ত করেছে। তাই ঘন ঘন কাঁশে। খুক্-খুক্-খুক্…..
প্রাণটা যাই যাই অবস্থা। বুড়ো বয়সে যা হয়। নানা চিন্তা, দুঃখ, স্মৃতি কিংবা শেষ বয়সে মৃত্যুর ভাবনা-সব মিলাইয়া মানুষ মানসিক ভারসাম্য হারায়। তেমনি জামিল সাহেব ঐ পথে এগুচ্ছে।
জামিল সাহেবের কাছে মান্ধাতা আমলের একটা রেডিও আছে। খুব পুরাতন। ছাল-বাকল কিছুই নেই। কোনো মতে হাড়-মাংসটা আছে। তবে শব্দ এবং স্টেশন ধরা নিখুঁত। পৃথিবীর যেই কোনো রেডিও স্টেশন সহজে সংযোগ পায়।
যুদ্ধের সময় এই রেডিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জাপানি তৈরি। নামকরা ব্র্যান্ড। আশির বুড়োর মতো তিন বাঁকা হয়েও সকল অত্যাচার নির্যাতনে সহ্য করে। তবু ডা. বাড়ি নিতে হয় না। খুব ভালো মানের ব্র্যান্ড।
নিদ্রা না আসা পর্যন্ত জামিল সাহেব ভলিয়মটা ঘুড়ায়। যেই স্টেশনে খবর প্রচার হয় ওখানে এসে থামে। ভয়েস অফ আমেরিকা, বিবিসি লন্ডন কিংবা রেডিও তেহরান।
‘ভয়েস অফ আমেরিকা’ থেকে শেষ রাতের সংবাদ স¤প্রচার হচ্ছে। জরুরি সংবাদ। গভীর ধ্যানে জামিল সাহেব শুনে। তার মাঝে সুচীর পায়েল পাতার শব্দে ধ্যান ভগ্ন হয়। তাই তিনি নিচুস্বরে বলে- কি-রে মা? এখনও পর্যন্ত জেগে আছিস্ কেন? রাত-তো কম হয়নি…..
বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকারা ডাকছে। বেড়ার এপাশ আর ওপাশ। পোকাদের ডাকে কান ঝালাফালা হবার মতো। সেই ডাক রাতের গভীরতা বৃদ্ধি করে। সুচী বলল- ক’টা বাজে-রে আফু?
-রাত এগারোটার কম নয়।
ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে- গ্রামগঞ্জ বলে গভীর রাত মনে হচ্ছে। কি নিস্তব্ধ! মনে হচ্ছে নিশি রাত।
বেড়ার ওপাশের কক্ষ থেকে পরী নিচু স্বরে বলে- আফু, আমি যখন সাজেদা ফুফুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম, এমন সময়তো রাতই মনে হয় নাই। জানিস আফু, রাত ২টার সময় সন্ধ্যা মনে হতো। তখন বিছানায় যেতাম।
-হ।
সাজেদা ফুফুর বাসা ঢাকার সেগুন বাগিচায়। ঢাকা শহরের কাছে পরিচিতি নাম। সাজেদা ফুফু মারা যাবার পর আর যাওয়া-আসা হয়নি। শেষ পর্যন্ত আত্মীয়তা পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বাবা বললেন- বাসাটা মনে আছে?
-স্মৃতির মতো। দ্বিতীয় তলার পুরাতন একটি বাড়ি। অনেকটা ভূতের বাড়ির মতো।
ওষুধ খাওয়ার পর জ্বর কমেছে অতসীর। ভালো লাগতেছে। এতক্ষণ নাক দিয়ে বৃষ্টির মতো জল ঝড়েছিল, এখন নেই। মাথাব্যথাও আর নেই।
জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অতসী। সুচী পচ্-পচ্-পচ্র করিতে করিতে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়- আফু!
-হুঁ!
-এখন শ্রাবণ মাস, এই সময়ে চারিদিক পানি থৈ থৈ করে। এখন নেই। কোনো আবাসও দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপার কি?
-আমারও একি প্রশ্ন।

পরী নাক ডেকে ডেকে ঘুমাচ্ছে। তার শরীর দুর্বল। নিদ্রা গেলেই নাক ডাক শুরু করে। শব্দটা বয়ে বেড়াচ্ছে। মা বলেছে- এটা একটা বদ অভ্যাস।
সুচী অতিষ্ঠ হয়ে বলল- কি যন্ত্রণা!
-কি?
অতসীর প্রশ্নের জবাবে বলল- কেন? আনাড়ী হয়ে গেলি নাকি? ঐ যে- পরীর নাক।
ফিক করে হেসে উঠে অতসী। হাসিটা অস্পষ্ট। দাঁত মেলে। তবে মৃদু ছায়ায় দেখা যায়নি। দেখা গেলে হয়তো রেগে উঠত সুচী।
চাঁদের আলো খুব ফকফকা। মনে হচ্ছে- আজকের চাঁদটা অনেকটা নিচে নেমে এসেছে। একটু উঁচা ভূমিতে উঠে হাত বাড়ালে ছোঁয়া যাবে।
বৃষ্টি-বাদলের কোনো লক্ষণ নেই। শ্রাবণ মাস হলেও বর্ষণমুক্ত। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নীলাম্বর একটি আকাশ। তার গায়ে চ্যাপ্টা হয়ে লেগে আছে- ঝালসানো একটি সোনার তালা। নব-বধূর কপালে যেভাবে লাগানো হয়- টিপ।
পূর্ণিমার চাঁদ এত সুন্দর। জীবনে প্রথম দেখার মতো মনে হচ্ছে অতসীর। বেহুঁশের মতো তাকিয়ে আছে।
রাতের আঁধারে কাক বিচরণ করে না। বিচরণ করে নিশাচর পাখি। তাই মাঝে মাঝে নিশাচর পাখির স্বর কানে আসে। -এমন ডাক খুব ভয় লাগে।
-হ আফু! মনে হচ্ছে, আসে-পাশে জ্বিন পরী হাটে। চোখ টান টান করে বলল সুচী।
জামিল সাহেবের চোখে নিদ্রা নেই। পা চেপে চেপে, বেড়া ধরে ধরে, খুব কষ্ট করে অতসীদের কক্ষে চলে আসে। এসে থেমে নেই, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। শ্বাসকষ্টে ভুগছে। -তোরা এখনও ঘুমাস্নি কেন?
-ঘুম আসছে না বাবা।
-কেন? তোদের আবার কি হল?
সুচী নিচুস্বরে বলল- আফুর এতক্ষণ জ্বর ছিল।
মেয়েগুলো তার কলিজার অংশ। অস্বাভাবিক কিছু শুনলে অস্থির হয়ে উঠে। -এখন? এখন?
অতসীর কপালে হাত রাখে জামিল সাহেব। সুচী বলল- বাবা, এখন হয়তো ভালো লাগছে।
-ওষুধ-পত্র কিছু খাইয়ে দিয়েছিস?
-জ্বি। প্যারাসিটামল।
-ঠিক আছে। অসুক-বিসুক নিয়ে অপেক্ষা করতে নেই।
খুব চিন্তিত অবস্থায় আছে অতসী। জানালার রঢ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা আর সুচীর চেঁচামেচি তার কানেই নেই। অনেক বার তাকে ডাকা হয়েছে। বেহুঁশের মতো হইয়া আছে।
-কি-রে মা, তোর কি হয়েছে? আমাকে বল।
কোন জবাব না পেয়ে জামিল সাহেব ফিরে গেছে। তার বিছানায় পৌঁছতে অনেকক্ষণ সময় লেগেছে। ততক্ষণে ‘ফটোমেক্স থেকে পদ্মা’ অনুষ্ঠান শেষের পথে।
‘ফটোমেক্স থেকে পদ্মা’ -ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা সার্ভিসের রেডিও অনুষ্ঠান। দিলারা হাসেম, শুভশ্রী মশ্রিণ কুইনের কোকিল কণ্ঠে উপস্থাপনা।
উঠানের পশ্চিম কোণায় হাসনাহেনু গাছ। গাছটা লাগিয়েছে জামিল সাহেবের মা। অতসীর দাদি। তার নামটা খুব সুন্দর। নুর আশা বেগম। সকলে তাকে আশা দাদি ডাকত। আজ তিনি পৃথিবী নাই, না থাকলেও তার স্মৃতি অ¤øান।
হাসনাহেনু গাছে ফুল ফুটেছে। তার ওপর বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে জ্যোৎস্নার আলো। সুগন্ধ্য সারা উঠান বিরাজমান। বাতাসের সাথে মিশ্রিত হইয়া ছিটিয়ে গেছে। জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে।
-খুব সু-গন্ধ্য। ফ্রান্সের পারপিউমকে ফেল মারবে।
সুচী কথাটি যেই কক্ষে শুরু করেছিল তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, অংশ ভাগ হয়ে গেছে। অর্ধেক তাদের শোবার কক্ষে বাকি অর্ধেক তার বাবার শয়ন কক্ষে পৌঁছে শেষ করেছে।
জামিল সাহেব হাবাগোবা হয়ে মেয়ের মুখের পানে চেয়ে আছে। -কি-মা? তোর বড় আফুর বিষয়টা খুঁজে পেয়েছিস?
-কি বিষয়?
-তোর আফুকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে।
-হ বাবা।
জামিল সাহেব অসুস্থ। বয়স হয়ে গেছে। ফলে সামাজিক পারিবারিক বা যেই কোনো বিষয় তাকে কেউ শুনায় না। স্টোক করতে পারে। এই বিষয় অতসী খুব সতর্ক।
-বাবা।
-সুচীর ডাক শুনে বালিশ থেকে মাথা উঠায় জামিল সাহেব। -কি-মা?
-একটা ঘটনা আছে। যেই কারণে আফু খুব চিন্তিত!
একটু ইতস্তত বোধ করলেন। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন- কারণটা জেনেছিস মা? বল।
-কলেজ থেকে ফিরছিল আফু। মাথার উপর রোদ খাড়া। সবুজ দীঘির দক্ষিণের কোণায় কানা ছগির আর রসিদ হাজী দাঁড়িয়ে আছে। পাশ কেটে আসার সময় আফুকে দেখে দেখে কানা ছগিরে বলল- মালটা তো সেই রকম হয়েছে।
-তারপর?
-আরও কি কি যেন বলাবলি করছে। আফু তার আগে দ্রুত পায়ে হেঁটে পথ অতিক্রম করেছে।
রাগে ক্রোধে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে জামিল সাহেব। এমন বাক্য একজন পিতা হয়ে সহ্য করা সম্ভব? দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। -কি বললি?
-সত্যি সত্যি বলছি।
বিছানা ছেড়ে পুনরায় উঠে দাঁড়ায়। ৭১ সালে রণক্ষেত্রে যেভাবে ছুটে গিয়েছিল তারই মতো অতসীর কাছে পৌঁছেছে। আশ্চর্য! অথচ এই কিছুক্ষণ আগে এমন পথ অতিক্রম করতে দীর্ঘ সময় নিয়েছিল। শ্বাস নিয়েছিল বারে বারে।
অতসী এসে তাকে ধরলেন। -কি হয়েছে বাবা?
নিঃশ্বাস ফেলে শেষ করতে পারছিলেন না জামিল সাহেব। -তোকে কানা ছগিরা কি বলেছে?
মুখের উপর আমতা আমতা করে অতসী বলল- বাবা, তোমাকে এসব কথা কে বলল?
-কেন? এসব কথা আর গোপনে থাকে না।
বাবার হাত ধরেছে অতসী। তার হাত চাপা-উত্তেজিত। শিরা চলছে দ্রুত গতিতে।
হাই-প্রেসার আছে জামিল সাহেবের। বয়স হয়েছে। টেনশন সহ্য হবার মতো নয়। তাই অতসী নিচু স্বরে বলল- না থাক বাবা। ওসব কথা আর বিশ্লেষণ করতে নেই।
-কেন?
-ওরা আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের শত্রæ। জন্ম থেকে দেখছি ওরা শত্রæতা করছে।
-তাই বলে কি সবকিছু সহ্য করা যায়?
অতসী দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। তার নিঃশ্বাসে নিরাশের ভাব আছে, তাই জামিল সাহেব মেয়েকে ভরসা দিয়ে বলল- মা-রে, ভয় করিস্ না। অস্ত্র জমা দিয়েছি কিন্তু ট্রেনিং-তো জমা দেইনি…….
অতসী ঠোঁটের আড়ালে মৃদু স্বরে হাসি দিয়ে বলে- এটা কিছুক্ষণের সান্ত¡না। ৭১-এর শত্রæরা এখন জয়-জয়কার অবস্থা।
মানুষের হাসি বহু প্রকার। সুখে হাসবে, দুঃখে কাঁদবে এমনতো কথা নেই। দুঃখেও মানুষ হাসে। ক্রোধ, দুঃখ, হতাশা আর বঞ্চনার মাঝে অতসী হেসে উঠে।
দাঁতের উপর দাঁত কটমট করে উঠে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জামিল সাহেব। ক্রোধে মানুষ এভাবে করে। এক পা নেই, যুদ্ধে হারিয়ে ফেলেছে। আর এক পা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত। ফলে তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বেঁচে আছে হাত দুটি। হাত দুটি মুষ্টি করে, ভারি ভারি গলায় মনের ভাব প্রকাশ করে বলে- বড় ভুল করেছি। যুদ্ধ আমলে এই রাজাকাজ্জ্যারে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। মেরে ফেলতে চেয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা। এমনকি সবকিছু রেডি। এই মুহূর্তে তাকে আমি বাঁচিয়েছি।
-কেন?
-প্রতিবেশী চাচাত ভাই হিসেবে মনটা জ্বলেছে। তার বাবা বড় ভালো লোক ছিল।
সুচী এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুনে যাচ্ছে বাবার কথা। শেষে টানটান গলায় বলিল- সমবেদনা দেখিয়েছ?
-আর বলিস না। আমার উচিত শিক্ষা হচ্ছে। আজ। উপকার করতে নেই!
মনের ভাব প্রকাশ করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গেলেও আবার অসহায়বোধ করলেন এবং নিরুপায় হয়ে বললেন- কি-যে করি মা-রে!
স্ত্রী মাবিয়া বেগমের নিদ্রা ভেঙে গেছে। বেড়ার ঘর। এক রুমে কথা বললে প্রতিরুমে শব্দ সহজে পৌঁছে। যার ফলে ছোট্ট কথাও গোপনে থাকে না।
স্ত্রী মাবিয়া বেগম এসে ভেতরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। নিস্তব্ধে। শুনছে স্বামীর কথা।
-বাবা! সুচীর ডাক শুনে ফিরে তাকায়।
-বল মা।
-রাজাকার যদি মানুষ হতো কিংবা মনুষ্যত্ববোধ বলে কিছু থাকতো পাকবাহিনীর সাথে হাত মিলাতো?
অতসী বাবার মুখে পানে তাকিয়ে আছে। তিনি মাথাটি নাড়া দিলেন। -হ মা। বড় ভুল করেছি। যার ফলাফল প্রতিনিয়তি পাচ্ছি।
অকপটে স্ত্রী মাবিয়া বেগম এসে কহিল- শুরু মাত্র। অদূরে এত কঠিন রূপ নিচ্ছে মরেও শান্তিতে থাকতে দিবে না।
স্ত্রীর মুখের পানে তাকায়। -হ। ঠিক বলেছ অতুর মা।
জামিল সাহেব হাতটা টেনে দিয়ে অতসীকে বলল- মা-রে, আমাকে একবার ধর। একটু জানালার সামনে নিয়ে যা।
অতসী বাবার হাত ধরেছে। হাত খুব ঠাণ্ডা। এক পায়ে পাদুকা নেই। শীতের মৌসুম। জানালা দিয়ে শীত প্রবেশ করছে। ঠাণ্ডার মাঝেও জামিল সাহেব দেশটা আরো একবার দেখবে। ৭১ সালে যেভাবে দেখেছিল।
মেয়ের কাঁধ চেপে জানালা পর্যন্ত পৌঁছা সামান্যতম পথ, সামান্য সময়। এই সময়টুকুতে জ্যোৎস্নার চটক দেখিতে দেখিতে জামিল সাহেব বলতে থাকলেন- বড় ভুল করেছিল আমার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭৫ সালে এসে সেই ফলপ্রসূ স্বরূপ সপরিবারে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হয়েছিল।
ঝন ঝন করিতে করিতে মাবিয়া বেগম বলল- তোমারও অপেক্ষার পালা।
জামিল সাহেব চুপচাপ। অতসী বলল- চুপ করতো মা। আর ভালো লাগছে না।
রান্না ঘরে বিড়ালের দৌড়াদৌড়ি বেড়ে গেছে। খুব ছোটাছুটির শব্দ শোনা যায়। রাত হলে এসব প্রাণীরা এমনই করে। কাপ-প্লেট সব ভেঙে ফেলছে মনে হয়।
সুচী ওদিকে ছুটে গেছে। রান্না ঘর পৌঁছতে চোখের পলক। মুহূর্তে চিৎকার দিয়ে ডাকছে -মা!
-কি?
-এখানে এসো।
ভাত-তরকারি সব সারা ঘরে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাতের থালা। মাছ, তরকারি। মাবিয়া বেগম কপালে হাত রেখে বলল- হায়! হায়!
বিষণ্নমন নিয়ে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে জামিল সাহেব। প্রান্তের শেষে আকাশ। তার গায়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে দুঃখ, বাঞ্চনা, ক্রোধ বা ভুলের শুল্ক।
পেছনে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতসী। ভাব প্রকাশ করার মতো বা জন্মদাতাকে সান্ত¡না দেবার মতো তার মুখে কোনো ভাষা নেই।
রাতের গভীরতা বাড়ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে জ্যোৎস্নার প্রগাঢ়। নীল আকাশে মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে যায়। সাদা-সফেদা ফলের ন্যায় এই মেঘ। নিচের ধূ-ধূ মাঠে সবুজ আর সবুজ। তার ওপর কুয়াশা মেখেছে। সেই সবুজের ওপর যখন চাঁদরের ন্যায় লেপটে পড়েছে জ্যোৎস্নার আলো-চারিদিক এক ধরনের ঝলমল ঝলমল করছে।
ঘরের ভেতরে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন মানুষ। কারও হুস-জ্ঞান কিছু নেই। জ্যোৎস্নার সাথে মিশ্রিত হইয়া প্রবেশ করছে হাসনাহেনুর সু-গন্ধ্যা।
অসাধারণ একটি রাত, একটি সময়। সেই অসাধারণ সৌন্দর্য-কষ্টের মাঝে আরো কষ্ট অভিঘাত হয়। কারণ- এমন কিছু দুঃখ-কষ্ট-হতাশা আছে অসাধারণ মুহূর্তকেও অতিক্রম করে।

দুই.
সূর্য ঘড়ি দেখে মনে হচ্ছে বেলা তখন ১০টা।
জামিল সাহেব উঠানে। বসেছিলেন ইজি চেয়ারে। মুখ ভর্তি খোঁছা-পাকা দাঁড়ি। শেভ করেনি। গায়ে চাঁদর পেছানো।
সকাল থেকে ঠান্ডায় কাঁপছিলেন। সূর্যের তাপ মাত্র যখন লেগেছে কাঁপুনিও কমেছে। তার গায়ে আলো পড়েছে।
তার হাতে একটি পুরাতন দৈনিক পত্রিকা। দিন-তারিখের অংশ ছিঁড়ে গেছে। যে ক’ইঞ্চি পরিমাণ হাতে পেয়েছে, তাও মূল অংশটি পেয়েছে।
জামিল সাহেব গভীর ধ্যানে পত্রিকা দেখছিলেন। ঘরে কেউ নেই। মেয়েরা যার যার মতো স্কুল-কলেজে পাড়ি জমিয়েছে। একমাত্র স্ত্রী মাবিয়া বেগম রান্না ঘরে ব্যস্ত। রান্না করছে।
এটা একটা সুবর্ণ সময়। এমন সময়ে তার সামনে উপস্থিত হন শরিফ উদ্দিন। তার জন্মস্থান নদী ভাঙ্গা দেশ খ্যাত স›দ্বীপে। অনেক দিন যাবৎ কানা ছগিরের বাড়িতে গৃহভৃত্যের কাজ করে।
মাদ্রাসায় দু’এক শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে কিনা সন্দেহ। এখন সে বিশিষ্ট আলেম। ছগিরের হাতে নির্মিত মাদ্রাসা ও মসজিদের পেশ ইমাম।
জামিল সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ায়। লম্বা একটা সালাম প্রদর্শন করে শরিফ উদ্দিন। -আস্সালামু আলাইকুম।
সালাম প্রদর্শনের ভাব শুনে ভিড় ভিড় করে উঠে জামিল সাহেব। চোখ তুলে তাকায়। -কি ব্যাপার? হঠাৎ কি মনে করে……
পায়ের গোড়ালি হতে মাথা পর্যন্ত জামা-কাপড়ে ঢাকা। মাথায় পাগড়ি। জামাটা জুব্বা ধরনের। মুখ ভর্তি যমকালো দাঁড়ি। দাঁড়ি এক হাতের উপর লম্বা।
শরিফ উদ্দিন কাগজের একটা মোড়কে হাত দিলেন। কাগজটা শক্ত ধরনের। তাই শব্দ হচ্ছে। মোড়কের ভেতর থেকে একটা দলিল বের করছে। নিচু স্বরে বলতে থাকে-আপনি আমাদের একটু সাহায্য করবেন।
হাবাগোবা হইয়া আছে জামিল সাহেব। -কি?
-আমরা সবার সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে একটা দ্বীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতে যাচ্ছি। এতিমখানা ও হেফজখানা। ভবিষ্যৎ বড় মাদ্রাসা করার আশাবাদী।
-আমাকে কি সাহায্য করতে হবে?
শরিফ উদ্দিন দারুণ বুদ্ধিমান। কথার মাস্টার। কথায় কথায় আল্লাহকে স্মরণ-সাক্ষী রেখে কথা বলে। এটা একটা অভিনব কৌশল। এমনটা সবার দ্বারা সম্ভবও নয়।
কানা ছগির হিসাব-নিকাশে খুব দক্ষ। শরিফ উদ্দিনের কাছে ভালো দক্ষতা আছে। তাই তার একান্ত মানুষ হিসাবে কাছে রেখেছে।
শরিফ উদ্দিন নিচু স্বরে বললেন- যা করিবেন একমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে। আল্লাহর পথে……
-বল। আমাকে কি করতে হবে!
ফ্যাল ফ্যাল করে শরিফ উদ্দিন জামিল সাহেবের মুখের পানে তাকায়। ভাবনাগ্রস্ত নয়ন দুটি। ঠোঁট কাটতে কাটতে শরিফ উদ্দিন বলে গেল।
-সবার সাহায্য-সহযোগিতায় আমরা যে স্থানে এতিমখানা আর হেফজখানাটা করেছি-ওখানে আপনার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এক খণ্ড জমি আছে। জমিটা ঠিক হেফজখানার মাঝখানে।
ওয়াজ-মাহ্ফিলে মৌলভীরা একটানা বর্ণনা করে যায়। এটা একটা অভ্যাসের মতো। জামিল সাহেবের সামনে এসে কথাগুলো ওভাবে বলেছিলেন শরিফ উদ্দিন।
জামিল সাহেব ইতস্তত বোধ করলেন। এমন প্রস্তাবে হঠাৎ কি করে সিদ্ধান্ত নিবেন? বারবার ঘরের দিকে নজর দিলেন। ডাকলনে স্ত্রী মাবিয়াকে।
-ওগো, অতসীর মা, -এদিকে এসো।
মরিচের ঝাল খুব বেশি। হাতে, মুখে আর চোখে লেগেছে। খুব জ্বলছে মাবিয়া বেগমের চোখ। নাক দিয়ে জল বের হচ্ছে। আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে সামনে এসে দাঁড়ায়। -কি-গো? বল দেখি।
-চেংরা হুজুর ছেলেটা কি বলে, শোন।
-এই অসময়ে কি উদ্দেশ্য?
-জানিনা। তুমি জেনে নাও।
মাবিয়া বেগম ফিরে তাকায়। অমনি ঠোঁট লম্বা করে ঝাল কণ্ঠে বলে- কি বিষয় নিয়ে এসেছ?
শরিফ উদ্দিন প্রথমবারের মতো বললেন। -স্যারকে বিস্তারিত বর্ণনা করেছি। আপনাকেও সংক্ষিপ্ত ভাবে বলি…
-বল।
-বৃক্ষ ভানুপুরে পাহাড়-ঘেরা অঞ্চলে জামিল সাহেবের এক খণ্ড পৈতৃক সম্পত্তি রয়েছে। ঠিক তার পাশেই আমাদের এতিমখানা ও হেফজখানা।
‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ -এভাবে দিন অতিবাহিত হচ্ছে একটি সংসারে। যার ফলে দুর্গম পাহাড়ে ঘেরা অযোগ্য ভূমির তথ্য মনে রাখার মতো নয়। খনিক ইতস্তত বোধ করে আবার স্বাভাবিকে ফিরে এসেছে জামিল সাহেব। -ও আশ্চা, মনে পড়েছে, মনে পড়েছে। আমার পৈতৃক সম্পত্তির অংশ বিশেষ। তবে পরিমাণ মনে নেই।
-কতটুকু হবে? স্ত্রী মাবিয়া বেগম প্রশ্ন করে।
শরিফ উদ্দিন ঠোঁটটা একটু লম্বা করে বলে, এই যে ধরো- গণ্ডা পাঁচ-দশেক এর মতো হবে। সামান্য বেশিও হতে পারে।
জামিল সাহেব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
শরিফ উদ্দিনের হাত মোড়কের ভেতরে। ওখানে কাগজপত্র। হলুদ রঙে ছাপা কিছু অংশ দেখাও যাচ্ছে। সেই কাগজটি বের করতে করতে বলল- আপনি যদি সেই জমিটুকু আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেন- বড় ছওয়াবের অংশীদার হবেন। ইহকালের পথটা একেবারে পরিষ্কার।
মাবিয়া বেগম ঠোঁট কাটতে কাটতে বলল- আমার শ্বশুর বলেছিল- ওখানে তার অনেক ভূমি আছে। কিন্তু কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভূমি হইল কেন?
জামিল সাহেব স্ত্রীর কথায় কান দিলেন না। তিনি শরিফ উদ্দিনকে জিজ্ঞেস করিলেন- এতিমখানার প্রতিষ্ঠাতা কে?
মাথার উপর সূর্যের আলো খাড়া। গরমে বিতৃষ্ণা লাগছে। মাথা থেকে পাগড়িটা খুলে ফেলেছে শরিফ উদ্দিন। মাথাটা ন্যাড়া। তার উপর যখন আলো পড়েছে মাথাটা চকচক করছে।
প্রতিষ্ঠাতারা নাম বাহবা বাহবা পাওয়ার যোগ্য। প্রতিষ্ঠাতা কি সবাই হতে পারে? পারে না। সেই বাহবা পাওয়ার আশা নিয়ে শরিফ উদ্দিন বলল- প্রধান প্রতিষ্ঠাতা হাজী ছগির আহমদ চৌধুরীসহ আরও ক’জন।

চুক্তিপত্র দলিলটা ততক্ষণে জামিল সাহেবের হাতে এসেছে। বর্ণনা দেখছে এবং পাশাপাশি নামটা কান পেতে শুনে যাচ্ছে। নাম শোনামাত্র দু’জনে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় শরিফ উদ্দিনের মুখের পানে। জামিল সাহেব রেগে উঠে। -কি নাম বললি?
৭১ সালের রণক্ষেত্রে যেভাবে গর্জে উঠেছিল দেশ, যোদ্ধা বা জাতি ঠিক সেদিনের মতো গর্জে উঠে জামিল সাহেব। লাল হয়ে উঠে নাক-মুখ, চোখ। আগুন বের হচ্ছে।
রাগে আর ক্রোধে এক ধরনের হয়ে উঠলেন জামিল সাহেব। তড়িৎ দলিলটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে যাচ্ছে এবং ভারি ভারি গলায় বলল- ৭১ সালে যুদ্ধ করেছি, মুক্তি করেছি এদেশ। এদেশ রাজাকারদের কোনো স্থান নেই।
বক্তৃতা শুনে শরিফ উদ্দিন ঠোঁটের আড়ালে তুচ্ছ করে হাসে। ফলে জামিল সাহেব আরও একটু রাগান্বিত হয়ে উঠে। বলে- মনে রাখবি, অস্ত্র জমা দিয়েছি ঠিক, ট্রেনিং জমা করি নাই। প্রয়োজনে আবার যুদ্ধ করব। যেই ভুল করে তোদের রেহায় দিয়েছি তা আবার শুদ্ধ করব।
পরিষ্কার উঠান। ধূ-ধূ বালু পুরা উঠান জুড়ে। তার উপর সোনালি রোদ পড়েছে। ফলে বালুগুলো ঝলমল ঝলমল করছে।
কাগজের টুকরোগুলো নির্দিষ্ট স্থানে আর নেই। বাতাস বইছে। বাতাসে এদিক সেদিক এলোমেলো করে ফেলেছে কাগজের অংশগুলোকে।
শরিফ উদ্দিন অনেক আগে স্থান ত্যাগ করেছে। তার যাওয়ার স্টাইল ভিন্ন। অস্পষ্ট স্বরে বলে বলে যাচ্ছিল- দেখা যাক, কার দৌড় কত দূর।
নদীর উপাড়ে শিবরাম মহাজনের বাড়ি। গুটি কয়েকটি পরিবার আছে, বাকিরা ভারতবাসী হয়ে গেছে।
সেই মহাজন বাড়ি থেকে প্রায় সময় পায়ে হেঁটে মন্দিরা আসে। মাঝে মাঝে পার্বতীকেও দেখা যায়। ইদানীং পার্বতী আসা-যাওয়া প্রায় গুছিয়ে ফেলেছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভারতী এসেছে। তাই তিন বান্ধবী মিলে অতসীকে দেখার জন্য পা রাখে।
-কোন দিকে যাবি? রাস্তা দিয়ে নাকি ধান ক্ষেতের আঁকা-বাঁকা পথে?
মন্দিরার প্রশ্ন শুনে ভারতী নিচু স্বরে বলে- সেই লোকটা কি এখনও বেঁচে আছে?
-কে?
-কানা ছগিরা।
-ও তো এখনও বুড়ো হয়নি। মরবে কেন? যে শক্ত শরীর!
-আশ্চর্য! পার্বতী হতভম্ব হয়ে বলে।
ভারতী বলল, শুনেছি- কানা ছগিরা নাকি এখন ভালো অবস্থানে? ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা ইত্যাদিতে।
-হ। বিশাল কারবার। একটি রাজনৈতিক দলের নেতাও।
-এত কিছু হল কেমনে?
-যুদ্ধের পরপর ৭৪-এর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। ওই সময় গ্রামবাসীর প্রায় ভূমি হাতিয়ে নিয়েছে। দু’মুঠো ভাত দিয়ে জমি রেজিস্ট্রারি করে ফেলেছে।
স্বাধীনতার যুদ্ধের পর পরই ভারতীরা এদেশ ছেড়ে চলে গেছে। তখন তার জ্ঞান-বুদ্ধি ভালোই। এখন তাদের বংশ গোত্রে কেউ নেই। ভিটা-বাড়ি সূর্যের আগুনে পোহায়।
লম্বা লম্বা সময় নিয়ে ভারতীর বাবা মদনমোহন সপরিবারে এদেশে আসত। বেশ কিছু দিন থাকা হতো। সেই সুবাদে অতাসীর সাথে ভারতীয় খুব খাতির।
পার্বতী বলল- চল’না, অতসীকে একবার দেখে আসি। চাচার শরীর খুব খারাপ।
ভারতী খুব সুন্দর রমনী। চোখ ফেরানো মুশকিল। সে যখন কোনো পুরুষকে একবার তাকায় তার বুক কেঁপে উঠে। কলকাতার একটি থিয়েটারে কাজ করে। কত পুরুষ তার পেছনে পেছনে ঘুরে। পাখির বাসার মতো তার আঁকি দুটি। সেই আঁকি দুটি মেলে ধরে প্রান্তের আকাশে। -আকাশটা খুব সুন্দর না-রে।
-হ। তুই আবার আকাশ নিয়ে গবেষণায় চলে গেলি কেন? চল।
ভারতী নিচুস্বরে বলল- দেশ আমাদের। তবু হয়ে গেছি পরবাসী। অথচ এই দেশকে পাকবাহিনী থেকে মুক্ত করতে কত না প্রাণ দিতে হয়েছিল।
মন্দিরা বলল- জামিল চাচার গায়ে গুলি লেগেছিল। ও’নার এক পা আর ভালো হয়নি। অর্ধেকটা কেটে ফেলতে হয়েছিল।
-এখন কি অবস্থা?
-অন্য পা প্যারালাইসিস আক্রান্ত হয়েছে। হাঁটতে-চলতে খুব কষ্ট।
-ইস্।
-চল, দেখে আসি।

শরৎকালের শেষ বিকেলের আকাশ খুব চমৎকার।
দু’ধারে কাঁশফুল ফুটে আছে। মাঝখানে বয়ে গেছে জামিনের আইল। সেই আঁকা-বাঁকা আইলটা হয়ে গেছে গ্রামের মেঠো পথ। তারপর সবুজ আর সবুজ। তবে গ্রামের লোকাচরণ-কম, তাই পথটা সবুজ ঘাসে ভরে গেছে।
-দেখছিস পার্বতী?
-কি?
-কি চমৎকার!
ভারতী পোড়ামাটির ভেতরে বসবাস করে। নিঃশ্বাস পর্যন্ত পোড়া পোড়া। পায়ের তালুতে সবুজের ছোঁয়া-তো কল্পনার মতো, মাটি পর্যন্ত ছোঁয়া হয় না।
ভারতী তার পাদুকা দুটি হাতে নিয়ে ফেলেছে। মজা করে করে হাঁটছে। -আহ! কি মজা!
ঝিরঝির বাতাস বহে। বহে কাঁশফুলের উপর দিয়ে। দোল খায় কাঁশবন। মাঝে মাঝে বাতাসের গতি-বেগ বৃদ্ধি হলে আঁশির বুড়োর মতো তিম বাঁকা হয়ে যায় কাঁশফুল। ফিরে গেলে নিঃশ্বাস ফেলে।
ভারতী নিচুস্বরে বলল- মাঝেমাঝে গ্রামে সুটিং করতে যাই। ওখানে এমন দৃশ্য বিরল। তবে আমার কমই যাওয়া হয়।
-কেন?
-আমি মঞ্চের মানুষ, মঞ্চে বেশি থাকতে হয়।
-ও আশ্চা!

সাদা সফেদা ফলের ন্যায়-মন্দিরা, নীল পরী ভেসে-পার্বতী। আর তারা দু’জনকে অতিক্রম করেছে- ভারতী। তার পোশাক পরিধান ঝাড়–ল ফুলের রং। শারীরিক আর পোশাকে এক অসাধারণ বনিবনা।
শরৎ মৌসুম হলেও আকাশে মেঘ-বৃষ্টি কিছুই নেই। শেষ বিকেলে যখন সূর্যের বিরহ বাঁশি বেজে উঠেছে- দু’এক টুকরো মেঘের দেখা মিলে। দক্ষিণের প্রান্তের শেষ। দেখে মনে হচ্ছে- মেঘ গুলো শিল্পীর হাতে আঁকা কাঁট-পেন্সিলের কিছু ছবি।
দু’পাশের তটভূমি সবুজ আর সবুজ। কোথাও ঘন কুঁড়ে ঘর, কোথাও বিষণ নির্জনতা। কোথাও গাছপালা। তবে সবার উপরে স্পষ্ট হয়ে আছে তালপাতা। শূন্য প্রান্তের চারিদিক এক অসাধারণ দৃশ্য ফুটে উঠেছে। নিছক প্রাকৃতিক সেই সব সৌন্দর্যকে হার মানিয়ে যায়- বাঙালি তিন কন্যা।
রমনীর চুলের ন্যায় আঁকাবাঁকা জমিনের আইল। সেই আইল বয়ে যেতে যেতে সংযোগ হয়েছে সবুজ দীঘি পর্যন্ত। দীঘির গা ঘেঁষে নাক সোজা গেছে বাড়ির পথ।
দীঘির অর্ধেকের বেশি এখন কানা ছগিরের। জলে মৎস্য খামার হলে, ডাঙ্গায় ফলাদিসহ নানা প্রজাতির গাছ। আবার আলাদা করে তৈরি করেছে গোয়াল ঘর। তার ভেতরে আদর-যতেœ পালিত হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড়।
উত্তরে জামিল সাহেবের বাড়ি। জমিদার বাড়ি। তবে জমিদারি বিলীন হয়ে গেছে। কোথাও দেয়াল ভেঙে গেছে। কোথাও মোটেই নেই।
জমিনের আইলটা রাস্তার সাথে সংযোগ হয়েছে অনেকটা ন্যূব্জ হয়ে। কষ্টকর একটি পথ। সেই কষ্টটা পাড় করে মন্দিরার দল।
কয়েক পা হাঁটলে সহপাঠী অতসীর বাড়ি। ভারতী বলল- পায়ে জলকীট লেগেছে কিনা দেখ।
পার্বতী বলল- জলকীট কি?
পা আলগা আলগা করে হাঁটছে ভারতী। সবুজ ঘাসে জলকীট থাকতে পারে। মন্দিরা বলল- রক্ত চোষা প্রাণী।
-ও আশ্চা! জোঁক?
-হ।
দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে বেলায়ত হোসেন। তার পাশে রসিদ তালুকদার। হালকা বয়সের দু’জন ছেলে। পরনে জুব্বা ধরনের পোশাক।
বেলায়ত হোসেন ক’দিনের জন্য এ বাড়ি দেখাশুনা করছে। কেননা- কানা ছগির দেশের বাইরে গেছে। পাকিস্তানের লাহোর প্রদেশে।
বেলায়ত হোসেন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বাতাসে ভারতীয় উড়নাটা উড়ছে। রসিদের হাতে চাপ দিয়ে বলল- দোস্ত, দেখেছিস্?
-কি?
-ঐ যে, ঝাড়–ল ফুলের রঙের কাপড় পড়া মালটা।
-জাড়–ল পরী?
-হ। মালটা সেই রকম। খুব সুন্দর।
-সত্যি বললি-তো দোস্ত।
বেলায়ত হোসেন চাপা উত্তেজিত হয়ে বলে- ইস্! কি সুন্দর! যদি পাইতাম…..
মন্দিরার কানে স্পষ্ট লেগেছে। তাই তার পা লম্বা-লম্বা করে হাঁটছে। আনমনা স্বরে বলে- দ্রুত হাঁট।
-কেন-রে?
নিচু স্বরে বলতে চেয়ে থেমে গেছে মন্দিরা। কানের কাছে মুখ এনে ফিশ ফিশ করে বলে- ঐ জন্তু জানোয়ারদের ভাষা শুনতে পাসনি?
পার্বতী মাথাটা নাড়া দিয়ে উঠে। -হ।
-তাহলে পা লম্বা করে হাঁট।
ভারতী বলল- এ রকম বাক্য আমি প্রায় সময় শুনি।
-কোথায়? পার্বতী বলল।
ভারতীর চুল বাতাসে নাড়া দিচ্ছে। বার বার কপালে ঝুলছে। কলমের মতো আঙ্গুলের গঠন তার। সেই আঙ্গুল দিয়ে কপাল থেকে চুল একপাশে নিতে নিতে বলে- নিয়মিত শুনতে হয়। হয়তো কোনো মঞ্চ-থিয়েটারে নতুবা শুটিংয়ে।
মন্দিরা রেগে উঠে বলে- দুত্তরি! এটা মঞ্চ বা সুটিংয়ের কোনো স্পট নয়, এটা বাস্তব। তাড়াতাড়ি হাঁট।
পার্বতী যেতে যেতে একটু থমকে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে তাকালো। বেলায়েত হোসেন আর রসিদ তালুকদার খুব জোরে জোরে সিগারেটে সুখ টান দিচ্ছে। ধোঁয়া উড়ছে। ধোঁয়ার ভেতরে বাহিরে হইয়া তবু স্পষ্ট দেখা মিলছে দু’জনের অমীমাংসিত বিদ্বেষী চেহেরা।

তিন.
আগের মতো সেই কোলাহল আর নেই। ৭১ সালের যুদ্ধের পর পুরা কলেজ তরঙ্গহীন হয়ে পড়ে।
দীর্ঘ বিরতীর পর প্রাক্তন ছাত্র সমিতির কয়েকজন তুখোড় সংগঠক উঠে এসেছে। ‘সাপ্তাহিক পূর্ববাংলার’ সাহিত্য সম্পাদক সুজিত কায়সার অন্যতম। তিনি খুব দাপটের সহিত লিখেন। পূর্ব পাকিস্তান থাকাকালীন দেশদ্রোহী কবিতার জন্য জেলে যেতে হয়েছে। কারাবাস করেছে বহুদিন। তিনি এখন উন্মুক্তভাবে লিখতে পারেন। আর কোনো বাঁধা নেই।
কলেজের ছাত্র সংগঠন একেবারে নিভে আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে সুজিত কায়সার হাত রাখলেন। ফলে পূর্ব আকাশে উষার আলো নতুনভাবে উদিত হল।
কলেজের নিয়মিত ছাত্র রামকানাই, পবন দাস, রুদ্র, শহিদুল্লাসহ গুটি কয়েকজন। কেউ ২য় বর্ষে, কেউ ৩য় বর্ষে বা শেষ বর্ষের ছাত্র। প্রথম ছাত্রী হিসেবে যোগ দিলেন প্রীতিলতা। তাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসলেন সুজাতা, রোকেয়া, রাবেয়াসহ অনেকেই।
ক্লাস শেষে প্রতিদিন আড্ডায় মেতে উঠে। আড্ডাটা জমে ছাত্র/ছাত্রী মিলনায়তনের কক্ষে। পবন দাসের ভালো গলা আছে, তার কণ্ঠে মান্না দে হুবহু মিল। তাই সবাই পবনকে অনুরোধ করে। বলে- পবন, মান্না দে টান। তোর গলায় ভালো মানায়।
-আগে মুখে একটু মিঠাই মিষ্টি দে- নারে।
-চা খাবি?
-হ।
কারো পকেটে কত মাল আছে নিজেই ভালো জানে। একে অপরের দিকে তাকায়। বলে- কিছু বলবি?
-আমি তো ভাই শূন্য।
রফিক বলে- পকেটে ক’আনা আছে। যদি খরচ করে ফেলি- পায়ে হেঁটে বাড়ি যেতে হবে।
রাতুল চাঁদা তুলতে গেলে সুজাতা বলে- না।
-কেন?
-আমি দিচ্ছি।
রুদ্র খুব বিবেকবান ছেলে। মাথা খাটিয়ে কথা বলে। বলল- প্রতিদিন কি একজনের জন্য প্রযোজ্য?
সুজাতা সহজ মুখে হাসে। -অসুবিধা নেই।
তার বাবার পোদ্দারী ব্যবসাসহ নানা কারবার আছে। শহরের চাপাতী গলিতে বাড়ি আছে। ভালো ভাড়া আয় হয়। সেই হিসেবে সুজাতার ব্যাগে দু’চার টাকা সব সময় থাকে। নগদ টাকার নোট’টা দপ্তরী মাঈনুলকে দিতে দিতে বলে- চা-পুড়ি এবং বাদাম। ক’পয়সা অবশিষ্ট থাকলে- তোর।
মাঈনুলের পা আর মাটি ছুঁই না। পলকে যায় আর আসে। এসে বাদামের পোঁটলা আর চা-পুড়ি বাতাসীর হাতে গুছে দিয়ে বলে- নে বোন। এবার বিতরণ কর।
সুজিত কায়সার সবার মাঝে প্রস্তাব রাখলো- এবার কলেজে সংসদ নির্বাচন হবে।
প্রস্তাবটা সবাই সমর্থন করলো।
কলেজজুড়ে আনন্দ-উল্লাস বিরাজমান। শহিদুল্লা সভাপতি পদে মোকাবিলা করবে। তার প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে রয়েছে হামিদ মীর। সে কোনো দলের হয়ে প্রার্থী হয়নি। স্বতন্ত্র প্রার্থী।
দেশ এখন স্বাধীন। মুক্ত। যে কোনো দলের হয়ে নির্বাচন করতে বাঁধা নেই।

নগরীর আল-ফালা গলিতে জামায়াত-শিবিরের আস্তানা। ওখানে কানা ছগিরের একটা বাড়ি। ওই বাড়ির নিচতলায় চায়ের দোকান। তার পেছনে ছোট্ট একটা ওয়ার্কসপ। উপরের তলায় ট্রাভেল অফিস এবং কিছু ছোট ব্যাচেলার বাসা। প্রতিটি কক্ষে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার থাকে।
অফিসের পেছনে গলির শেষ অবধি একটি কক্ষ। সবসময় তালা ঝুলানো। চাবি কানা ছগিরের হাতে। ভেতরে বিষয় রহস্যময়।
বরিশালের অজপাড়া গায়ের সন্তান সাজ্জাত। নগরে পালিয়ে এসেছে। পাড়ার এক মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাড়া-প্রতিবেশীরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। প্রাণে রক্ষা পেতে এ নগরে ছুটে এসেছে। ক্ষুধার জ্বালায় রিক্সার পেট্রোল চাপাচাপি নিয়েছে।
রিক্সায় পেট্রোল চাপাচাপি করছে। তখন দুপুর। গরমে অতিষ্ঠ জীবন। গামছা দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে জিজ্ঞেস করে- কোথায় যাবেন সার?
-আল-ফালা গলির সামনে।
কৌতূহল প্রকাশ করে সাজ্জাত বলে- আপনার বাসা ওদিকে?
-হ। কিন্তু কেন?
-না মানে আমাদের গ্রামের এক বালকের মুখে শুনেছি আল ফালা গালি কথা।
-কি শুনেছ?
-এই গলিতে জামাত শিবির ক্যাডাররা অবস্থান করে। যে বলেছে সেও একজন শিবির ক্যাডার।
-তার নাম কি?
-রগ কাটা মন্টু।
ক্ষুদ্র কথার পরিচয়ে সাজ্জাদ এখন দক্ষ কারিগর। কৌশলে মানুষ খুন করে এবং আরাম আয়েশে জীবন-যাপন করে। থাকে আল-ফালার পরের গলিতে।
অন্ধকার গলিতে তালাবদ্ধ কক্ষের ভেতরের রহস্য জানা গেছে। কানা ছগিরের অস্ত্র ভান্ডার। বন্ধ কুটুরি বলে কেউ নজর দেন না। ওয়ার্কসপে তৈরি হয় আর লোক-চক্ষুর আড়ালে স্টোরে জমা হয়। যেদিকে নির্দেশ হয় সাজ্জাত তালা খুলে অস্ত্র চালান দিয়ে থাকে।
সাজ্জাত এখন কিং। রিক্সা ভেনে পেট্রোল চাপতে হয় না। ছগিরের বিশ্বস্ত মানুষ।
‘সাপ্তাহিক পূর্ব বাংলা’ পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হয়। ‘স্বাধীনতা বিরোধী দল আবারও সক্রিয়’ -কলামের নামটা স্পষ্ট। ছাপা হওয়ার তিন দিনের মাথায় পত্রিকা অফিসে হামলা। গুরুতর আহত সুজিত কায়সার।
পরের দিন কলেজে ছাত্র-ছাত্রীরা গণমিছিল বের করে। মিছিলের সামনে ছিল শহিদুল্লা। স্বতন্ত্র প্রার্থী হামিদ মীরও আন্দোলনে যোগদান করে।
ঘটনা এখনও ছাপা পড়েনি। উত্তেজনা চলছে। তার সপ্তাহ খানেকের মাথায় ঘটে গেল দুরন্ত এক অনাকাঙ্কিত ঘটনা। দিন দুপুরে জামাত-শিবিরের ক্যাডাররা শহিদুল্লাকে গলা কেটে হত্যা করে।
শহিদুল্লাকে হত্যা করে কলেজে দাপটের সহিদ চলাফেরা করে জামায়াত-শিবির ক্যাডার। ছিন্ন-ভিন্ন হয় নির্বাচন। প্রগতিশীল দলের সংগঠন, নেতাকর্মীরা কে কোথায় গিয়ে অবস্থান করছে জানা নেই।
চার.
প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ কী না করে।
অতসী মিথ্যা কথা বলা শুরু করেছে। প্রেমে পরলে মানুষ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে। এটা একটা জ্বলন্ত প্রমাণ।
কলেজ থেকে ফিরতে বিলম্ব হলে মা জিজ্ঞেস করে, এত বিলম্ব কেন-রে মা?
মুখটা খাট্টা করিয়া, হাতের আঙ্গুল মোছড়াইয়া অমনি বলে- আর বলো না-মা। সামনে পরীক্ষা। ক্লাসে খুব নজরদারি।
-তাই নাকি?
-হ মা। প্রতিটি স্যার ক্লাসে খুব সময় দিচ্ছে।
-ও আশ্চা!
জামিল সাহেব কান হালকা করিয়া মেয়ের কথা শুনে। লম্বা গলায় বলে- তোদের পরীক্ষা কবে-রে?
-আর বেশি দিন নেই বাবা।
-কষ্ট হলেও পাঠে মন-দে। রেজাল্ট ভালো করতে হবে।
পরী খুব বাঁচাল। নিচু স্বরে অস্পষ্টে বলে- প্রেমপত্র লিখতে লিখতে দিন যায়, রেজাল্ট ভালো করবে কোত্থেকে?
অতসী তার কাছে ছুটে গিয়ে রাগান্বিত হয়ে বলে- কান ছিঁড়ে ফেলবো। তুই দেখেছিস?
পরী চুপ করে থাকলেও মুচকি হাসে। তার হাসি বা চেহেরার ভাব দেখে বোঝা যায়-সে অনেক কিছু জানে।
কাছে এসে অতসী বলল- তুই কি কি- জানিস রে?
-না, আমি কিছু জানি না।
-মিথ্যা বলবি না। চোখ রাঙিয়ে তাকায় অতসী।
পরী ভয়ে ভয়ে বলে- তোমার ডায়েরিতে একটা চিঠি দেখেছি। চিঠি খানা প্রেমপত্র।
-কার?
-তুষার ভাইয়ার।
অতসীর মুখটা পরীর কানের কাছে নিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বলে- মা-বাবাকে বলবি না। জানলে খুব বকা দিবে। মনে থাকবে?
-হ আফু! কিন্তু……..
চোখ টান টান করে বলে- ‘কিন্তু’ কি আবার?
-আমি খেলব, গাছে উঠব, সাঁতার কাটব। আমাকে বাঁধা দিতে পারবে না। মারতেও পারবে না।
-তা কি হয়? গাছ থেকে পড়ে গেলে হাত-পা ভেঙে যেতে পারে, আবার সাঁতার কাটতে গেলে সর্দি-কাঁশি হতে পারে।
পরী হাবাগোবা হয়ে আফুর মুখের পানে চেয়ে রইল। ফ্যাল ফ্যাল করে। বিরক্ত হয়ে বলে- কোনটা করব?
-সবকিছু করতে পারবে। খেলতে পারবে, গাছে উঠতে পারবে এবং সাঁতার কাটতে পারবে। তবে সীমাবদ্ধতার মাঝে।
-ঠিক আছে।

জুন মাসের শেষ সপ্তাহ। প্রচণ্ড গরম। আকাশটা থম থমে হয়ে আছে। গরমে গা পোঁড়াচ্ছে। গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না। বাতাস বলতে নেই। গরমে মানুষের জীবন-যাত্রাও চাতক পক্ষীর মতো হয়ে গেছে। বারবার আকাশের দিকে দৃষ্টি রাখে। বর্ণহীন আকাশ।

তুষার ভালো বক্তা। দুপুরের শেষ অবধি বটবৃক্ষের তলায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সৈনিক হিসেবে তার বক্তৃতা শুনে কলেজের সকল ছাত্র/ছাত্রী একত্রিত হয়ে গেল। জোরালো এক মিছিল হল। এমন ভস্মীভূত গরমে

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়