গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

সিয়ার-উল- মুতাখ্খিরিন, সর্বভারতীয় স্বার্থ ও সাতচল্লিশের > বঙ্গভঙ্গের দিনগুলোতে বাংলা সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িকতা : আহমদ বশীর > সাহিত্য

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পলাশীর যুদ্ধের প্রায় দুই দশক পরে, ‘সিয়ার-উল- মুতাখ্খিরিন’-এ গোলাম হোসেন তাবতাবায়ি মুঘল যুগের শেষ বৃত্তান্ত লিখতে গিয়ে এমন সব ঘটনা বিবৃত করেছেন যে মনে হবে, ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান অবশ্যই দুই জাতি, কিন্তু দীর্ঘদিন একসঙ্গে থেকে ইতিহাসের কারণেই তারা যুদ্ধ আর বেঁেচ থাকার সংগ্রামে পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে গিয়েছিল। তিন খণ্ডে সম্পূর্ণ বইটি সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে শুরু হয়েছে, তারপর তৎকালীন মুঘল সম্রাটদের ধারাবাহিক পতনের ইতিহাস বয়ান করে তৃতীয় খণ্ডে দক্ষিণ ভারতে ইংরেজদের যুদ্ধকালীন কাহিনি দিয়ে শেষ করা হয়েছে। এই দীর্ঘ বর্ণনায় গোলাম হোসেন মূলত মুঘল, মারাঠা এবং ইংরেজ- এই তিন শক্তির সামরিক ও সামাজিক দ্ব›দ্ব ব্যাখ্যা ও বর্ণনা করেছেন, কিন্তু কোথাও ভারতবর্ষকে একসঙ্গে একটি দেশ, কিংবা অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করেননি। কিন্তু তৃতীয় খণ্ডের শেষ পৃষ্ঠায় এসে তিনি ‘ভারতের স্বার্থ’- শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
শব্দটি ব্যবহারের প্রেক্ষাপটটিও ব্যতিক্রমী। ১৭৮৩ সালে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে যুযুধান তিন শক্তি, মারাঠা, মুঘল ও ইংরেজদের সাধারণ সৈনিকদের কোন গোত্রপরিচয় ছিল না- মুঘলদের সেনাবাহিনীতে (এমনকি সেনাপতি হিসেবেও কর্মরত) প্রচুর হিন্দু মারাঠা সৈনিক ছিল, আবার ইংরেজদের সেনাবাহিনী তো সম্পূর্ণরূপে দেশীয় সৈনিক দ্বারাই পরিচালিত হতো। এ সব বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে গঠিত কয়েকটি বাহিনী বিভিন্ন স্বার্থে একে অপরের সাথে যুদ্ধে রত ছিল। এই প্রেক্ষাপটে তার বইয়ের শেষ অনুচ্ছেদে গোলাম হোসেন হঠাৎ বিবদমান একটি শক্তি ‘ভারতের স্বার্থে’ কাজ করছে বলে উল্লেখ করেছেন। এই শব্দটি ব্যবহার করেই তিনি বইটি শেষ করেছেন।
…(সবাই মনে করে যে হায়দরাবাদের নিজাম একজন নিরপেক্ষ নবাব) কিন্তু আমাদের কাছে শুধু একটা সংবাদ আছে যে, আর্কট (বর্তমানে তামিলনাড়–-অন্ধ্র অঞ্চল) প্রদেশে ইংরেজ ও হায়দার আলী এবং দাক্ষিণাত্যে ইংরেজ ও মারাঠাদের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে তাতে নিজাম ততটা নিরপেক্ষ নন, যতটা তিনি নিজেকে নিরপেক্ষ দেখান। এবং অবশ্যই তিনি (নিজাম) ভারতীয় স্বার্থের পক্ষে। কিন্তু আমি শুধু এটা অনুমান করছি মাত্র,- এর সত্যতা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। (ঙহষু ঃযবৎব রং ধ ৎবঢ়ড়ৎঃ ঃযধঃ রহ ঃযব ধিৎ যিরপয ৎধমবং হড়ি নবঃবিবহ ঃযব ঊহমষরংয ধহফ ঐধরফবৎ অখর, রহ ঃযব ঢ়ৎড়ারহপব ড়ভ অৎপধঃ, ধহফ ধমধরহ নবঃবিবহ ঃযব ঊহমষরংয ধহফ ঃযব গধৎযধঃঃধং রহ ঃযব ডবংঃবৎহ ঢ়ধৎঃং ড়ভ উবপধহ, ঘরুধস অষর রং হড়ঃ ংড় হবঁঃৎধষ ধং যব ষড়ড়শং, ধহফ ঃযধঃ ঁহফবৎযধহফ, যব ভধাড়ৎরুবং ঃযব ওহফরধহ পধঁংব. ইঁঃ ঃযরং ও ড়ভভবৎ ড়হষু ধং ধ ংঁৎসরংব, ধং ঃযব ঃৎঁঃয ড়ভ রঃ রং যিধঃ এড়ফ ড়হষু সধু শহড়.ি
(সূত্র: ঞযব ঝবরৎ গঁঃধয়যবৎরহ; ড়ৎ জবারবি ড়ভ গড়ফবৎহ ঞরসবং : নবরহম ধহ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ওহফরধ, ঝবরফ এযড়ষধস ঐড়ংংবরহ কযধহ, ধহ ওহফরধহ ঘড়নষবসধহ ড়ভ যরময ৎধহশ, যিড় ৎিড়ঃব নড়ঃয ধং অপঃড়ৎ ধহফ ঝঢ়বপঃধঃড়ৎ, ঠড়ষঁসব ওওও, চঁনষরংযবফ নু: জ ঈধসনৎধু ্ ঈড়., ৬ ধহফ ৮ঃয ঐধংঃরহমং ঝঃৎববঃ, ঈধষপঁঃঃধ, ১৭৮৩, পৃষ্ঠা: ৮০২)
গোলাম হোসেন নিজে প্রত্যক্ষভাবে তখন ইংরেজদের অধীনে কাজ করেছেন। ‘সিয়ার-উল- মুতাখ্খিরিন’ (সমসাময়িক কালের প্রতি দৃষ্টিপাত)- এই বইটিতেও তিনি ইংরেজদের হায়দরাবাদের নিজাম সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য এই বিবৃতিটি দিয়েছিলেন। কিন্তু তার সেই দাপ্তরিক কাজের সূত্রেই ‘ভারতীয় স্বার্থের পক্ষে’- শব্দবন্ধটি তিনি লিখেছিলেন। ভারতীয় স্বার্থের পক্ষে বলতে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন তার ব্যাখ্যা আমরা আর পাবো না। কিন্তু তার এই রচনার ১৬৫ বছর পরে ১৯৪৭ সালে ভারত যখন ইংরেজদের হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছিল, তখনো ‘ভারতীয় স্বার্থে’র কোন সর্বজন গৃহীত অর্থ এই উপমহাদেশবাসী পায়নি।
ভারতের বর্তমান ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ইংরেজদের বিদায়বেলায়, এই সর্বজনীন সংজ্ঞার অভাবের প্রতিক্রিয়া উপমহাদেশের সর্বত্র সমান নয়। সর্বজনীন সংজ্ঞার আভাবে অভিন্ন-ভারতের যে সব প্রদেশ বা জাতি সুবিধা পেয়েছে এবং যে সব প্রদেশ বা জাতি অসুবিধাগ্রস্ত হয়েছে, সেটা অবশ্যই বৃহত্তর গবেষণার বিষয়, কিন্তু এই সংজ্ঞার অনুপস্থিতি তৎকালীন বাংলা প্রদেশকে যে অভিঘাতপৃষ্ট করেছিল সে কথা নতুন করে বলার বিষয় নয়। এ বিষয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু বাংলা প্রদেশের জন্য এই সংজ্ঞার অনুপস্থিতি আরো একটি প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছিল সেই ১৯৪৭ সালে- তা হলো ‘সর্বজনীন ভারতীয় স্বার্থের পক্ষে’ যদি ঐকমত্য না থাকে তাহলে কি বৃহৎবঙ্গের উপস্থিতি সম্ভব? তাহলে কি বৃহৎবঙ্গ কোন জাতি সত্তাকে ধারণ করতে পারে? এসব প্রশ্ন সেই সময় উঠলেও কালের গর্ভে তা হারিয়ে গেছে। সময়ের সাম্প্রদায়িকতাকে এ বিষয়ে দায়ী করা হলেও ভারত বিভক্তির সময়ে বাংলা সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে ভিন্ন এক চিত্র পাওয়া যায়।

দুই.
বেনেডিক্ট এন্ডারসন ‘জাতি’র ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ‘জাতি’কে একটা বৃহৎ সম্প্রদায় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন- যাদের নিজেদের মধ্যে অসমতা-শোষণ যাই থাকুক না কেন, তাঁদের সকলের মধ্যে গভীর আনুভূমিক কমরেডশিপ (যড়ৎরুড়হঃধষ পড়সৎধফবংযরঢ়-পারস্পরিক সৌভ্রাতৃত্ব) থাকবে। এই ভ্রাতৃত্ববোধ লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে এমন এক সম্পর্কসূত্র তৈরি করবে যা তাঁদের শতাব্দী ধরে আত্মত্যাগের, এমনকি স্বেচ্ছামৃত্যুবরণ করার মতো বিষয়েও উদ্বুদ্ধ করবে।
(ঘধঃরড়হধষরংস ) ঋরহধষষু, রঃ রং রসধমরহবফ ধং পড়সসঁহরঃু, নবপধঁংব, ৎবমধৎফষবংং ড়ভ ঃযব ধপঃঁধষ রহবয়ঁধষরঃু ধহফ বীঢ়ষড়রঃধঃরড়হ ঃযধঃ সধু ঢ়ৎবাধরষ রহ বধপয, ঃযব হধঃরড়হ রং ধষধিুং পড়হপবরাবফ ধং ধ ফববঢ়, যড়ৎরুড়হঃধষ পড়সৎধফবংযরঢ়. টষঃরসধঃবষু রঃ রং ঃযরং ভৎধঃবৎহরঃু ঃযধঃ সধশবং রঃ ঢ়ড়ংংরনষব ঃযব ঢ়ধংঃ ঃড়ি পবহঃঁৎরবং, ভড়ৎ ংড় সধহু সরষষরড়হং ড়ভ ঢ়বড়ঢ়ষব, হড়ঃ ংড় সঁপয ঃড় শরষষ, ধং রিষষরহমষু ঃড় ফরব ভড়ৎ ংঁপয ষরসরঃবফ রসধমরহং. (ওসধমরহবফ ঈড়সসঁহরঃরবং: জভবষপঃরড়হং ড়হ ঃযব ঙৎরমরহ ধহফ ঝঢ়ৎবধফ ড়ভ ঘধঃরড়হধষরংস, ইবহবফরপঃ অহফবৎংড়হ, (জবারংবফ ঊফরঃরড়হ) ঢ়ধমব ৭, ঠবৎংড়, ভরৎংঃ ঢ়ঁনষরংযবফ ১৯৮৩, ৎবারংবফ ১৯৯১)
পারস্পরিক সৌভ্রাতৃত্ব যদি জাতি সৃষ্টির জন্য আবশ্যকীয় অংশ, বিংশ শতাব্দীর কলকাতা-কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এর কোনো যথার্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালির বিংশ শতাব্দীর কলকাতা-কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। অথচ সেই মহাসম্মিলনে বাঙালি মুসলমানকে ডাক দেয়া হয় নাই- তাদের স্বার্থকে বাঙালির স্বার্থের সঙ্গে সমন্বয় করে দেখা হয়নি। আবার বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনটির সঙ্গে ‘সর্বজনীন ভারতীয় স্বার্থের’ সংঘাত আছে কি নেই- সেই প্রশ্নের কোন মীমাংসা করা হয়নি। তাই বলা যায়, বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাঙালির স্বদেশি আন্দোলন এমনি এক ধাঁধাঁ, যেখানে স্বদেশ প্রেমকে জাগ্রত করতে বলা হয়েছে- তার স্বদেশের প্রতিবেশীকে অবহেলা করে।
বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের নেতাগণ খুব সচেতনভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আন্দোলনে তাঁরা বাঙালি মুসলমানদের সর্বোতভাবে পরিহার করবেন এবং ভূদেব-বঙ্কিম-রমেশদের প্রদর্শিত পথে পশ্চিমের নেতৃত্বের কাছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কাঠামো নির্ধারণ করবেন। তাই স্বদেশি আন্দোলন ও তার সাংস্কৃতিক আয়োজনে বাঙালি মুসলমানদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বরং নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এবং কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো প্রকারান্তরে বহিরাগত ইংরেজদের সঙ্গে একই কাতারে প্রতিবেশী বাঙালি মুসলমানকেও বহিরাগত বলে সমভাবে বিদ্বেষের শিকার করা হয়েছে। শ্রীঅরবিন্দের দাদামশায়, হিন্দুমেলার মূল আয়োজকদের অন্যতম রাজনারায়ন বসুর বক্তব্য ছিল : মুসলমান ও ভারতবাসী অন্যান্য জাতির সঙ্গে রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ে যতদূর পারি যোগ দিব, কিন্তু কৃষক যেমন পরিমিত ভূমিখণ্ডে কর্ষণ করে… সেইরূপ হিন্দু সমাজ আমাদের কার্যেও প্রধান ক্ষেত্র হইবে। অগ্নিযুগের বাঙলার বিপ্লবী মানস, স›দ্বীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ: ১-১২, (সুভাষচন্দ্র, ভারত ও অক্ষ শক্তি, সুধী প্রধান, পিপলস বুক সোসাইটি, ১৯৯৪ থেকে উদ্ধৃত)
রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গকে বলেছেন “বঙ্গবিচ্ছেদ”। একটা নতুন প্রদেশ হওয়াকে আরেকটি প্রদেশ থেকে চিরতরে বিচ্ছেদ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ভারতবর্ষ যদি একটা দেশ হয়ে থাকে, তবে এর একটা নতুন প্রদেশ হওয়া কি বিচ্ছেদ? রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য এখানে আরেকবার প্রণিধানযোগ্য:
বঙ্গবিচ্ছেদ-ব্যাপারটা আমাদের অন্নবস্ত্রে হাত দেয় নাই, আমাদের হৃদয়ে আঘাত করিয়াছিল। সেই হৃদয়টা যতদূর পর্যন্ত অখণ্ড ততদূর পর্যন্ত তাহার বেদনা অপরিচ্ছিন্ন ছিল। বাংলার মুসলমান যে এই বেদনায় আমাদের সঙ্গে এক হয় নাই তাহার কারণ তাহাদের সঙ্গে আমরা কোনোদিন হৃদয়কে এক হইতে দিই নাই।
সংস্কৃত ভাষার একটা কথা আছে, ঘরে যখন আগুন লাগিয়াছে তখন কুপ খুঁড়িতে যাওয়ার আয়োজন বৃথা। বঙ্গবিচ্ছেদের দিনে হঠাৎ যখন মুসলমানকে আমাদের দলে টানিবার প্রয়োজন হইল তখন আমরা সেই কূপ-খননেরও চেষ্টা করি নাই- আমরা মনে করিয়াছিলাম, মাটির উপরে ঘটি ঠুকিলেই জল আপনি উঠিবে। জল যখন উঠিল না কেবল ধুলাই উড়িল তখন আমাদের বিস্ময়ের সীমাপরিসীমা রহিল না। আজ পর্যন্ত সেই কূপ খননের কথা ভুলিয়া আছি। আরো বারবার মাটিতে ঘটি ঠুকিতে হইবে, সেই সঙ্গে সে ঘটি আপনার কপালে ঠুকিব।
লোকসাধারণের সম্বন্ধেও আমাদের ভদ্রস¤প্রদায়ের ঠিক ওই অবস্থা। তাহাদিগকে সর্বপ্রকারে অপমানিত করা আমাদের চিরদিনের অভ্যাস। যদি নিজেদের হৃদয়ের দিকে তাকাই তবে এ কথা স্বীকার করতেই হইবে যে, ভারতবর্ষকে আমরা ভদ্রলোকের ভারতবর্ষ বলিয়াই জানি। বাংলাদেশে নি¤œশ্রেণির মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা যে বাড়িয়া গিয়াছে তাহার একমাত্র কারণ হিন্দু ভদ্রসমাজ এই শ্রেণিয়দিগকে হৃদয়ের সহিত আপন বলিয়া টানিয়া রাখে নাই। (সূত্র: লোকহিত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )
‘বাংলাদেশে নি¤œশ্রেণির মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা যে বাড়িয়া গিয়াছে’। এই নি¤œশ্রেণিটা কি? কিসের ভিত্তিতে এরা নি¤œশ্রেণির? আর ‘হিন্দু ভদ্রসমাজ’টা কি? রবীন্দ্রনাথ যে সহানুভূতির কথা বলছেন তা কার জন্য? বাংলাদেশে নি¤œশ্রেণির মধ্যে মুসলমানদের জন্য।

সৈয়দ মুজতবা আলী এই উ”চ্চবর্গের বিভেদ বিষয় সম্পর্কে ‘বঙ্গে মুসলিম সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে লিখেছেন :
আজ যদি শুধুমাত্র সংস্কৃত পুস্তকপত্র থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখতে হয় তাহলে এ দেশে মুসলমান ধর্ম আদৌ প্রবেশ করেছিল কিনা সে বিষয়ে বিলক্ষণ তর্কের অবকাশ থাকবে। অথচ আমরা ভালো করেই জানি, মুসলমান-আগমণের পর প্রচুর সংস্কৃত পুস্তক লেখা হয়েছে, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা পাননি সত্য, কিন্তু তাদের ব্রহ্মোত্তর দেবোত্তর জমিজমার ওপর হস্তক্ষেপ না হওয়ার ফলে তাদের ঐতিহ্যগত বিদ্যাচর্চা বিশেষ মন্দভূত হয়নি। কিন্তু এইসব পণ্ডিতগণ পার্শ্ববর্তী মুসলমানদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন থেকেই আপন আপন লেখনী সঞ্চালন করেছেন। সেই ষঢ়দর্শননির্মাতা আর্য মণীষীগণের ঐতিহ্যগর্বিত পুত্রপৌত্রেরা মুসলমান আগমণের পর সাতশত বছর ধরে যে আপন চতুষ্পাঠীতে দর্শনচর্চা করলেন, কিন্তু পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাদ্রাসায় ওই সাতশত বছর ধরে যে আরবিতে প্লাতো থেকে আরম্ভ করে নিও-প্লাতোনিজম নিজম তথা কিন্দী, ফারাবী, বু আলিসীনা (লাতিনে আভিসেনা), অল গজ্জালী (লাতিনে অল-গাজেল), আবু রূশদ (লাতিনে আভেরস) ইত্যাদি মণীষীগণের দর্শনচর্চা হলো তার কোনো সন্ধান পেলেন না।

সৈয়দ মুজতবা আলী কিন্তু সত্য উদঘাটনে পিছপা হননি- মুসলমানদেরও দায়ী করেছেন তিনি :
এবং মুসলমান মৌলানারাও কম গাফিলী করলেন না। যে মৌলানা অমুসলমান প্লাটো-আরিস্তোতলর দর্শনচর্চায় সোৎসাহে সানন্দে জীবন কাটালেন তিনি একবারের তরেও সন্ধান করলেন না, পাশের চতুষ্পাঠীতে কিসের চর্চা হচ্ছে। তিনি জানতেও পারলেন না যে, তিনি প্লাতোর আদর্শবাদ দৃঢ়ভূমিতে নির্মাণ করার জন্য যেসব যুক্তি আকাশ-পাতাল থেকে আহরণ করেছেন তার পাশের চতুষ্পাঠীতেই হিন্দু দার্শনিক শঙ্করাচার্যের আদর্শবাদ সমর্থনার্থে সেইসব যুক্তিই খুঁজে বেড়াচ্ছে। তিনি ‘গুলাত’ নাস্তিকদের জড়বাদ যেভাবে ঋণ করছেন, ব্রাহ্মণও চার্বাকের নাস্তিকতা সেইভাবেই ঋণ করছেন। এবং সবচেয়ে পরমাশ্চর্য, তিনি যে চরক-সুশ্রæতের আরবি অনুবাদে পুষ্ঠ বু আলী সিনার চিকিৎসাশাস্ত্র যা ‘য়ুনানী’ নামে প্রচলিত (কারণ তার গোড়াপত্তন গ্রিক ‘আইওনিয়ান=য়ুনানী’ চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর)-আপন মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন, সুলতান বাদশার চিকিৎসার্থে প্রয়োগ করছেন, সেই চরক-সুশ্রæতের মূল পাশের টোলে পড়াানো হচ্ছে।
‘বাংলাদেশে নি¤œশ্রেণির মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা যে বাড়িয়া গিয়াছে তাহার একমাত্র কারণ হিন্দু ভদ্রসমাজ এই শ্রেণীয়দিগকে হৃদয়ের সহিত আপন বলিয়া টানিয়া রাখে নাই।’ …রবীন্দ্রনাথের এই কথাটা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত না করলেও, পূর্ববঙ্গের কাহিনিটা একটু ভিন্ন হয়েছিল।
স্বদেশি আন্দোলন যদিও বাঙালি মুসলমানদের থেকে বাঙালি হিন্দুদের পৃথক করার প্রচারণা চালিয়েছিল, ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে এবং কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লি স্থানান্তরিত হলে, যখন বঙ্গদেশে একটা নীরবতা নেমে আসে- স্বদেশি আন্দোলনের নেতাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে, খুব সন্তর্পণে আবার হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি ফিরে আসে পূর্ববঙ্গে।
প্রথম বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে মেনে নিয়ে ইংরেজ রাজা যখন ঘোষণা করলেন যে ভারতের রাজধানী পরিবর্তন করা হবে- তখন এর অন্তনির্হিত লাভক্ষতির হিসাব কেউ কি করেনি? রাজধানী কলকাতাকে পরিত্যাগ করে ঝেটিয়ে বিদায় দিয়ে দিল্লিকে রাজধানী ঘোষণা করায় কলকাতার বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন- এরকম প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং লর্ড মাউন্টব্যাটেনের রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং পরবর্র্তীকালে ভারতের রাজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ভি পি মেননের বিখ্যাত বই ‘দি ট্রান্সফার অব পাওয়ার ইন ইান্ডয়া’তে বর্ণিত ব্যাখ্যায় দেখা যাচ্ছে রাজধানী স্থানান্তর নিয়ে কারু কোন মতো বা মতান্তর ছিল না। সবাই বাংলাদেশের দুটি প্রদেশের পুনর্মিলনে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
মর্লি-মিন্টো সংস্কারের উদ্বোধনের পর ১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানীর ভারত সফর করা হয়। রাজা এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করেছিলেন। একটি ছিল কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর, এবং অন্যটি বঙ্গভঙ্গ রদ। রাজধানী স্থানান্তর নিয়ে বিশেষ কোন উৎসাহ ছিল না, কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ জনপ্রিয় প্রশংসার সঙ্গে গৃহীত হয় (মুসলিমদের একটি অংশ ছাড়া।)
সূত্র : দি ট্রান্সফার অব পাওয়ার ইন ইান্ডয়া, ভিপি মেনন, প্রিন্সটন ইনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৫৭, পৃষ্ঠা ১২

প্রশ্ন হলো, ‘ভারতীয় স্বার্থে’র কোন সর্বজন গৃহীত অর্থ যদি তখন থাকত তাহলে পরাধীন ভারতে কি একটি প্রদেশের ভাঙ্গা-গড়া নিয়ে এত সন্তুষ্টি প্রকাশিত হতো? দেশের ধারণা যদি এক বা অখণ্ড থাকে তাহলে একটি প্রদেশের ভাগাভাগিতে কেন এত অসন্তুষ্টি? পূর্ব বঙ্গ একটি প্রদেশ হলে ‘ভারতীয় স্বার্থে’র কোন কমবেশি হতো কি? প্রদেশের ভাগাভাগিতে বাংলাদেশের স্বার্থের আঘাত বলে মনে হয়েছে, রাজধানীর পরিবর্তনে বাংলাদেশের স্বার্থের কোনো সমস্য হতে পারে বলে মনে হয়নি। কিংবা রাজধানীর পরিবর্তন হলে ‘ভারতীয় স্বার্থে’র ভারসাম্য কি হয়েছে- কেউ ভেবে দেখেননি। (কারণ দিল্লিতো ভারতের কেন্দ্রস্থল নয়, একটি প্রান্তবর্তী এলাকা। বরং কলকাতা ভারতের একরকম মধ্যস্থল হিসাবে বিবেচিত হতে পারত।)
সিয়ার-উল- মুতখ্খিরিন- এ গোলাম হোসেন তাবতাবায়ি ‘ভারতীয় স্বার্থে’র কি অর্থ বোঝাতে চেয়েছিলেন জানি না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছিলেন ‘বাংলাদেশে নি¤œশ্রেণির মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা যে বাড়িয়া গিয়াছে তাহার একমাত্র কারণ হিন্দু ভদ্রসমাজ এই শ্রেণীয়দিগকে হৃদয়ের সহিত আপন বলিয়া টানিয়া রাখে নাই’- এই কথাটার পিছনে ‘ভারতীয় স্বার্থে’র কোন সর্বজন গৃহীত অর্থাৎ না থাকাটা কিছুটা হৃদয়ঙ্গম হয়। গোলাম হোসেন তাবতাবায়ি সূ²ভাবে একটা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছেন সবাইকে। যার উত্তর কেউ খুঁজতে যায় নাই।

তিন.
কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস দেখলে বলতে হবে, প্রকৃতপক্ষে পূর্ববঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতিটা চিরন্তন, সম্পূর্ণ ধর্ম-নিরোপেক্ষ। অষ্টাদশ-উনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীর সময়ে সৃষ্ট গাঙ্গেয় বদ্বীপে, ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের আড়ালে-আবডালে বেড়ে ওঠা এই সম্প্রদায় একটি নতুন অর্থনৈতিক অবস্থার ফলাফল। এই সম্প্রীতি পূর্ববঙ্গের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা টুপি আর পৈতের মধ্যে একটা অর্থনৈতিক মেল-বন্ধন শুরু করেছিলো। নইলে পাট নিয়ে মুসলমান কৃষক এবং পাটের বিক্রেতা ফাড়িয়ারা ক্রমশ পূর্ববাংলায় কিছু অর্থকড়ির মালিক হতে পারত না। জেলেরা মাছ ধরে মাছ বিক্রি করে নতুন চরের বুকে আবাসন তৈরি করতে পারত না। যেমন আমাদের হোসেন মাঝি। হোসেন মাঝি আর ঠকচাচার মতো উপহাসের পাত্র নয়- হাশিম শেখের মতো কাঠফাটা রেদে গরু লইয়া হালচাষ করে না। কিন্তু রামা কৈবর্ত্ত্যর মতো কুবের মাঝিকে নিয়ে পদ্মা নদীতে মাছ ধরে- আর ময়না দ্বীপের মতো চরে তৈরি করে নতুন উপনিবেশ।
হোসেন মাঝি আর তার সহচর কুবেরের আত্মপ্রকাশ কুমিল্লা শহর থেকে প্রকাশিত একটি মাসিক পত্রিকায়। পত্রিকার নাম ‘পূর্ব্বাশা’- সম্পাদক ছিলেন কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য। ১৯৩২ সালে তখনকার ত্রিপুরা জেলার কুমিল্লা শহরের এক চায়ের দোকানে যখন ‘পূর্ব্বাশা’ প্রকাশের সংকল্প বাস্তবায়িত হল, তখন কল্লোল, কালিকলম এবং প্রগতি পত্রিকা অবলুপ্ত। …একদিকে সৃজনশীল সাহিত্য অন্যদিকে ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, সাহিত্য, শিল্প সংগীত, রাজনীতি- এমনি সব নানা বিষয়ের বহু¯্রােতা অবয়ব ছিল ‘পূব্বাশা’র (সূত্র : সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতা, ভারবি)। ‘পূর্ব্বাশা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুর্থ উপন্যাস, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ – পরে গ্রন্থাকারে বেরোয় ১৯৩৫ সালে। কুমিল্লার সঞ্জয় ভট্টাচার্যের পত্রিকায় পূর্ববাংলার হোসেন মাঝি আর কুবের মাঝির সংগ্রামী জীবনের এই মেলবন্ধন এক যুগান্তকারী ঘটনার সাক্ষী। সঞ্জয় ভট্টাচার্যই পরবর্তীকালে প্রকাশ করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নয়নচারা’।
এবার আসি মানিকের উপন্যাসে। হোসেন মাঝির বিবরণ মানিক কি ভাবে দিয়েছিলেন?
একটু রহস্যময় লোক এই হোসেন মিয়া। বাড়ি তাহার নোয়াখালী অঞ্চলে। কয়েক বছর হইতে কেতুপুরে বাস করিতেছে। বয়স তাহার কত হইয়াছে চেহারা দেখিয়া অনুমান করা যায় না, পাকা চুলে কলপ লাগায়, নূরে মেহেদি রঙ লাগায়, কানে আতর মাখানো তুলা গুজিয়া রাখে।
প্রথম যখন সে কেতুপুর আসিয়াছিল পরনে ছিল একটা ছেঁড়া লুঙ্গি, মাথায় এক ঝাক রুক্ষ চুল- ঘসা দিলে গায়ে খড়ি উঠিত। জেলেপাড়া নিবাসি মুসলমান মাঝি জহরের বাড়িতে সে আশ্রয় লইয়াছিল, জহরের নৌকায় বৈঠা বাহিত। আজ সে তাহার বেঁটে খাটো তৈল-চিক্কন শরীরটি আজানুলম্বিত পাতলা পাঞ্জাবিতে ঢাকিয়া রাখে, নিজের পানসিতে পদ্মা পাড়ি দেয়। জমি-জমা কিনিয়া ঘরবাড়ি তুলিয়া পরম সুখেই সে দিন কাটাইতেছে। গত বছর নিকা করিয়া ঘরে আনিয়াছে দু’নম্বর স্ত্রীকে।
এইসব সুখের ব্যবস্থা সে যে কি উপায়ে করিয়াছে গ্রামের লোক ঠিক অনুমান করিয়া উঠিতে পারে না। নিত্য নতুন উপায়ে সে অর্থোপাজ্জন করে। নৌকা লইয়া হয় তো সে পদ্মায় মাছ ধরিতে গেল- গেল সে সত্যই, কারণ যাওয়াটি সকলেই দেখিতে পাইল, কিন্তু পদ্মার কোনখানে সে মাছ ধরিল, মাছ বিক্রিই বা করিল কোন বন্দরে, কারো তাহা চোখে পড়িল না।..
শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যে ‘পদ্মানদীর মাঝি’- একটা অনুপম অসাম্প্রদায়িক উপন্যাস। অসাম্প্রদায়িকতার সাথে আছে সংগ্রামশীল জীবনের কাহিনি। ‘পদ্মানদীর মাঝি’তে হিন্দু-মুসলমান নাই। ও-সব বিকারের ধার ধারে না ‘পদ্মানদীর মাঝি’রা। এখানে কুবের মাঝি হোসেন মাঝি ভাই ভাই- ওরা একসঙ্গে মাছ ধরে, নদীর ঢেউ ঢেউয়ে কেটে যায় ওদের দিনরাত। ওরা জানে না : ‘বাংলাদেশে নি¤œশ্রেণির মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা যে বাড়িয়া গিয়াছে তাহার একমাত্র কারণ হিন্দু ভদ্রসমাজ এই শ্রেণীয়দিগকে হৃদয়ের সহিত আপন বলিয়া টানিয়া রাখে নাই’। এখানে চিতোর নাই, মহারাষ্ট্র নাই, দিল্লিআগ্রার রংমহল শিস্মহল নাই। আছে পানি, নদী, জেলে, মাছ, কুড়োজাল, চৌকী সমান উঁচু বাতা বিছানো মাচা, ছেরা কাঁথা, মেয়েরা সাধ মিটাইয়া শাখা ও কাঁছের চুড়ি পড়ে, ছেলেদের কোমরে বাঁধিয়া দেয় নূতন ঘুনসী, চালায় ছন চাপান লাগে, রাইতের বাদলায় ঘরে জল পড়ে।
‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে কলকাতার প্রসঙ্গ আছে- কিন্তু সেটা কলকাতা থেকে আগত একটি ট্রেন। তাই কলকাতার সাম্প্রদায়িকতা শিক্ষার বিষবাষ্প নেই এই উপন্যাসে। কলকাতা থেকে আগত ট্রেনটি আসে বাংলাদেশের একটি নদীর ঘাটে: অর্থাৎ রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাট।
নদীর তীরে, নদীর জলে এখন জীবনের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। থাকিয়া থাকিয়া স্টিমারের বাঁশি বাজিয়া উঠে। সশব্দে নোঙর তুলিয়া কোন স্টিমার ছাড়িয়া যায়, কোন স্টিমার ভিড়ে গিয়া জেটিতে। কলকাতা হইতে মেইল ট্রেনটি আসিয়া পড়িয়াছে। ঘাটের ও স্টেশনের দোকানপাট খোলা হইয়াছে।
নদীর তীরে, নদীর জলে এখন জীবনের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে।- মানিকের এই সব প্রতীকী বর্ণনা- অবিস্মরণীয় করে রেখেছে উপন্যাসটিকে।
ভোরের আগে ঘুম ভাঙ্গিল হেসেনের। কুবেরকে সেই ডাকিয়া তুলিল। চোখ মেলিয়াই কুবেরের কেন যেন হঠাৎ ত্রাসে মন ভরিয়া গেল। কি হইয়াছে? বিপদ? কিসের? হ কাল রাত্রে সে হোসেন মিয়ার পয়সা চুরি করিয়াছিল। একদফা চোখ মিটমিট করিয়া কুবের আশ্বস্ত হইল। হোসেন মিয়াকে খাতির করিয়া বলিল, যান নাকি মিয়া বাই? খিদায় কাতর হইছেন, সন্দ করি- রাইতে কিছু খান ত নাই। এক কাম করেন, দুইগোটা আম খাইয়া যান।
প্রত্যুষে ঘুম ভাঙ্গা মখেও হোসেন মিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে পারে।
খাওনের কথা থোও কুবির বাই। বাড়িত গিয়া খামু।
একটা প্রকাণ্ড হাই তুলিয়া বিড়ি ধরাইয়া হোসেন উঠিল। ঘুমন্ত গোপীর দিকে এক নজর চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মাইয়ার বয়স কত, কুবির বাই?
নয় সন্দ করিয়া থুইছি।
বিয়া দিবা না মাইয়ার?
হ। দিমু কেরমে কেরমে দিমু।
পকেট হইতে হোসেন ব্যাগটা বাহির করিয়া খুলিল। দেখিয়া পাংশু হইয়া গেল হোসেনের মুখ। কিন্তু না টাকা পয়সা গুনিয়া দেখিবার জন্য হোসেন ব্যাগ বাহির করে নাই। একটা সিকি বাছিয়া লইয়া সে কুবেরের হাতে দিল। বলিল, বাচ্চাগো খাবার কিনা দিও কুবির বাই। বলিয়া ব্যাগটা আবার পকেটে রাখিয়া দিল। কুবের আত্মসম্বরণ করিল তৎক্ষণাৎ। যে বিপদ ঘটিল না তার জন্য কেন বুক বুক কাঁপিবে, মুখ শুকনা দেখাইবে? খুসিতে বেসামাল হইয়া সে জিজ্ঞাসাই করিয়া বষিল, ব্যাগটা নতুন দেখি? মেলায় কিনছেন বুঝি কাইল?
হোসেন বলিল, হ।
কথা কহিতে কহিতে দুজন বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। এখন বৃষ্টি নাই, কিন্তু মেঘে মেঘে প্রভাতের রূপ অস্বাভাবিক থমথমে। হোসেন একবার মুখ তুলিয়া আকাশের দিকে তাকাইল। ইয়া আল্লা, নামানো আকাশের তলে কি দীনা এই পৃথিবী!
কি সুসংহত বর্ণনায়, মানুষ, প্রকৃতি, মানুষের মনের ভাবনা, শ্রেণি চরিত্র, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ..একটা খণ্ড ঘটনার মধ্যে তুলে ধরেছেন মানিক। কতখানি দরদ থাকলে এরকম দুই যুযুধান ধর্মের দুজন মানুষকে একটি নৌকার পাটাতনে এনে, দুজনের অন্তরঙ্গতা, আবার ব্যক্তি-স্বরূপ, দুজনের চেতনার অন্তর্লোক প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে পূর্ববঙ্গের জল-কাদা-মাখা মানুষের লৌকিক-মৌখিক ভাষার শব্দগুলো দিয়ে তৈরি করেছেন বাক-প্রতিমা: ‘দুইগোটা আম খাইয়া যান’, ‘সন্দ করি- রাইতে কিছু খান ত নাই’, ‘খাওনের কথা থোও কুবির বাই। বাড়িত গিয়া খামু’, মাইয়ার বয়স ‘নয় সন্দ করিয়া থুইছি।’ বিয়া দিবা না মাইয়ার?’ ‘হ। দিমু কেরমে কেরমে দিমু।’
‘পদ্মানদীর মাঝি’- কলকাতাকেন্দ্রিক কূপমুণ্ডূক সাহিত্যচর্চ্চর, অর্বাচীন সাম্প্রদায়িকতার, বাঙালি মুসলমানদের ‘নি¤œশ্রেণি’ বলে অভিহিত করার প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রবল এক প্রতিবাদ। মনে রাখতে হবে বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসটি কুমিল্লা শহর থেকে প্রকাশিত একটি মাসিক পত্রিকায়। পত্রিকার নাম ‘পূর্ব্বাশা’- সম্পাদক ছিলেন কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য। বুদ্ধদেব বসু পত্রিকাটিকে শেষ পর্যন্ত কলকাতা নিয়ে যান।
ইয়া আল্লা, নামানো আকাশের তলে কি দীনা এই পৃথিবী! কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই উপন্যাসেই জানান দেয়া হয়েছে পূর্ববঙ্গের, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘বাংলাদেশে নি¤œশ্রেণির মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা যে বাড়িয়া গিয়াছে তাহার’- একজন হোসেন মাঝি ময়না দ্বীপ কিনে সেখানে বসতি তৈরি করছে- আর সেখানে হোসেন মাঝির সঙ্গী হারু-এনায়েতের মতো কুবের মাঝি আর কপিলা। কুবির মাঝি, কপিলা- ওরা ময়না দ্বীপকে জনবসতিতে ভরে দেবে একদিন। প্রস্তুত হবে চর জব্বর, সুবর্ণ চর, বয়ের চর, নোয়াখালীতে ক্রসড্যাম দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড তৈরি করবে নতুন জনপদ-বিস্তৃত হবে বাংলাদেশ। প্রকৃতপক্ষে ‘পদ্মানদীর মাঝি হলো সুপ্ত এক পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাব্য উপাখ্যান। হোসেন মাঝি-কুবের মাঝির যৌথ প্রচেষ্টোয় বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের চিত্র রয়েছে ময়নাদ্বীপের স্বপ্নে- নবগঠিত জাতি শক্তিসঞ্চয় করেছে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবোধে। হোসেন মাঝির কণ্ঠে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তুলে দিয়েছেন নেতৃত্বের গান:

আন্ধার রাইতে আশমান-জমিন ফারাক কইারা থোও, বোনধু কত ঘুমাইবা।
বাঁয়ে বিবি ডাইনে পোলা আকাল ফসল রোও, মিয়া কত ঘুমাইবা।

মানের পাতে রাইতের পানি হইল রূপার কুপি উঠ্যা দেখবা না।
আলা করেন ঘরের চালা কেডা চুপি চুপি, তুমি দিশা রাখবা না!

এই নেতৃত্বই পরবর্তীকালে পূর্ব-পাকিস্তানের খোলস ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে।
‘অচ্ছুত পূর্ববঙ্গ’র গাওদিয়া গ্রামকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘পদ্মানদীর মাঝি’র আগে, ১৯৩৪ সালে, বহুল প্রচলিত ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায়। পূর্ববাংলার আরেকটি বিজয় ঘোষণার বিবরণ মানিকের লেখনিতেই পরিস্ফুট হয়েছে এখানে। তার আগেই বঙ্গভঙ্গ রদ করে ইংরেজ শাসকরা কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লি নিয়ে গেছে। স্বদেশি আন্দোলনে নিমগ্ন কলকাতার নেতারা হয়তো এটাকে তাদের বিজয় হিসাবে দেখেছেন। ততদিনে প্রথম মহাযুদ্ধের বিভীষিকাময় ইউরোপীয় শক্তির স্পর্শ করেছে আমাদের দেশকে। মোস্তফা কামাল পাশা তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষ ঘোষণা করলে খিলাফত আন্দোলন নিঃশেষ হয়ে গেছে এই দেশে। ১৯৩৫-এ ভারত শাসন আইন শুরু হলে কলকাতার বিমুখ প্রান্তরে দেখা দেবে কিছু নতুন নাটক। মানিক এই সময় উচ্চশিক্ষিত শশী ডাক্তারকে ফিরিয়ে আনলেন ‘অচ্ছুত পূর্ববঙ্গ’র গাওদিয়া গ্রামে। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় সেরকম কোন কাহিনি নেই- শশী ডাক্তারের মতো উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি কিভাবে পূর্ববঙ্গের গাওদিয়া গ্রামের পুতুল নাচে আষ্টে-পিষ্ঠে জড়িয়ে যেতে পারে- এটা তারই বয়ান। এর মূল কথা ‘মোটরে চড়িয়া কলিকাতা শহর গাওদিয়া গ্রামে চলিয়া গেল’।
‘পদ্মা নদীর মাঝি’র গ্রাম আর ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র গাওদিয়া গ্রাম -দুটোই পদ্মা নদীর পাড়ে। দুটোই দুই নারীর একই আর্তনাদকে ধারণ করেছে। কপিলা আর কুসুম। (আজকের বাংলাদেশে ‘গাওদিয়া’ হলো মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার একটি গ্রাম। আজ এই গ্রামের ওপর দিয়ে নির্মিত হয়েছে পদ্মা ব্রিজের হাইওয়ে এবং ট্রেন লাইন।) নারী জীবনের সার্থকতার খোঁজে তারা সমাজ-সংসারের বন্ধনকে অস্বীকার করতে চেয়েছে। পূর্ববঙ্গের এই নারীরা সংসারের জন্য শ্রম দিয়েই সন্তুষ্ট নয়- বরং নতুন জীবন সৃষ্টিতেও উৎসাহী। এরা ভ্রমর-সূর্যমুখী-আশা-বিনোদিনীদের মতো, কিংবা মেজদিদি, এমনকি অচলার মতো নিষ্ক্রিয় অনুঘটক নয়, এরা ক্রীয়াশীল এবং বাক্সময়। বঙ্কিমচন্দ্রের নায়িকা বলতে পেরেছে, ‘ফুলটি ফুটিলে কি সুখ? লোকের দেখে সুখ। ফুলের কি?’ আর কুসুম বলেছে, ‘আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটবাবু?’ কিংবা ‘এমন চাঁদনি রাতে আপনার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে সাধ হয় ছোটবাবু।’ আর কপিলাতো কুবেরের সাথে ময়না দ্বীপে যাবে বলে একটা সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়েছে।
তিরিশের দশকে-চল্লিশের দশকে, বিংশ শতাব্দী যত এগিয়ে যাচ্ছিলো, রবীন্দ্রনাথও তার মতো কলকাতাকেন্দ্রিক স্বারস্বত সমাজ যে জীবনকে দেখতে চাননি, পূর্ববঙ্গে জন্মগ্রহণকারী কথাসাহিত্যিকরা ততই পূর্ববাংলার দারিদ্র-জীবন-সংগ্রাম-অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের মানুষের ভালোবাসা ও নিষ্ঠুরতাকে কাগজের পৃষ্ঠায় তুলে আনতে থাকলেন। তৎকালীন সাহিত্য ও রাজনীতির মধ্যে ভয়ংকর একটা পার্থক্য দেখা গেছে- কিন্তু পরবর্তী সমালোচক- ঐতিহাসিকদের লেখায় সেই ভাষ্যটা বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায় না। কমরেড মুজাফফর আহমদ-নজরুল- থেকে শুরু করে সাহাদৎ হোসেন- ফররুখ আহমদ- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ- আবদুল কাদির- কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকরা যখন কলকাতায় জড়ো হয়েছেন- তাঁরা হয়তো বিশাল অভ্যর্ত্থনা পাননি- কিন্তু পূর্ববঙ্গ থেকে আগত তাঁদের সতীর্থ অনেক হিন্দু যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, অমরেন্দ্র ঘোষ সবাই একসাথেই সহ-অবস্থান করেছেন, সাহিত্যচর্চ্চা করেছেন- এবং একই ভূগোলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনী এবং তার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’- এ প্রসঙ্গে আরো একটি প্রামাণ্য দলিল- যা দিয়ে অসাম্প্রদায়িক পূর্ববঙ্গবাসীর অবস্থান চিহ্নিত করা যায়।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৫-৪৬ সালে। তার রচনাবলি সম্পাদনা করতে গিয়ে গবেষক ইসরাইল খান বলেছেন :
অদ্বৈত মল্লবর্মণ ১৯৪৫ সনে ‘দেশ’ পত্রিকায় যোগ দিলেও তাঁর বিখ্যাত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ঐ সময়েই ‘মোহাম্মদী’তেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের জন্য পেশ করেন এবং তাতে তা ছাপা হয়, প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৫ এর সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৬ সনের মে-জুন পর্যন্ত সময়ে। … যতগুলো পত্রিকাতে তিনি কাজ করেছেন- নবযুগ, কৃষক, আজাদ, মোহাম্মদী- সবই মুসলিম মালিকানার। ‘দেশ’ পত্রিকায় চাকরি করার সময় অদ্বৈত মিত্র-ঘোষ-বোস-মুখুজ্ঝে-চাটুজ্জেদের সঙ্গে যাতে দেখা না হয়, সেই জন্য আগেভাগেই কাজ শেষ করে তিনি দেশ কার্যালয় ত্যাগ করে চলে যেতেন এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুদের তাচ্ছিল্য ও ঘৃণার কারণেই তিনি মোহাম্মদীর পাতাতে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছাপতে দিয়েছিলেন। (সূত্র: অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাবলী, সংগ্রহ ও সম্পাদনা: ড. ইসরাইল খান, প্রকাশক : সূচিপত্র, ঢাকা)
পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার প্রান্তিক জনজীবনের প্রতিনিধি অদ্বৈত কলকাতার উচ্চবর্ণের হিন্দুদের তাচ্ছিল্য ও ঘৃণার কারণেই মোহাম্মদীর পাতাতে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছাপতে দিয়েছিলেন- এটা অনুমান-নির্ভর হতে পারে, অবশ্যই, কিন্তু সাগরময় ঘোষের ‘দেশ’ পত্রিকায় চাকরিরত অবস্থায় তাঁর এই উপন্যাস বা কোন গল্পই ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি- এত জ্বাজ্জল্যমান সত্য।
এই উপন্যাসের শুরুতেই অদ্বৈত তাঁর মাতৃভূমির নদীর বর্ণনা দিতে গিয়ে পূর্ববঙ্গের নিরহঙ্কার স্বভাবকে তুলে ধরেছেন:
তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূল জোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছা¦াস।… মেঘনা-পদ্মার বিরাট বিভিীষিকা তার মধ্যে নাই। আবার রমু মোড়লের মরাই, যদু পণ্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া যাওয়া শীর্ণা পল্লীতটিনীর চোরা কাঙ্গালপনাও নাই। তিতাস মাঝারী নদী।… তার সাপের মতো বক্রতা নাই, কৃপণের মতো কুটিলতা নাই । কৃষ্ণপক্ষের ভাটায় তার বুকের খানকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙ্গাল করে না। শুকপক্ষের জোয়ারের উদ্দীপনা তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্বেল করে না। … সওদাগরের নৌকারা পাল তুলিয়া তার বুকে বিচরণ করিতে আসে না। ভূগোলের খাতায় তার নাম নাই।… তিতাসের বুকে তেমন কোন ইতিহাস নাই। সে শুধু একটা নদী।
মুসলমান-মালিক পরিচালিত পত্রিকার সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনে আরেকটি দিগন্ত হলো আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের সখ্য। এই সখ্যর সুবাদে তিনি মোহাম্মদী পত্রিকায় জড়িত হয়ে নিজের গুণে সেখানে কর্তাব্যক্তি হয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালের পূর্বে কলকাতায় আবুল কালাম শামসুদ্দিনের ভূমিকা বাংলা সাহিত্যের অসাম্প্রদায়িক চেতনার উত্থানে আরো বিস্তৃতভাবে জড়িত হয়ে রয়েছে আরেকজন গুণী সাহিত্যিকের কল্যাণে। তিনি হচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের একজন বিস্মৃত লেখক অমরেন্দ্র ঘোষ। ১৯৪৭-এর পরে অমরেন্দ্র ঘোষের চরম বিপদের দিনগুলিতে আবুল কালাম শামসুদ্দিনের ভূমিকা পূর্ববাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির একটা ঐতিহাসিক স্বীকৃতি। অমরেন্দ্র ঘোষের ‘চরকাশেম (১৯৪৯)’ ‘পদ্মদীঘির বেদেনী (১৯৪৯)’, ‘ভাঙছে শুধু ভাঙছে (১৯৫১)’, দক্ষিণের বিল (১৯৫০)’ বাংলা সাহিত্যের অসাম্প্রদায়িকতার চেতনার এক একটি স্তম্ভ। অসাম্প্রদায়িকতার আলো জ্বালিয়েছেন বলেই পশ্চিমবঙ্গের উপন্যাস সাহিত্যের আলোচনায় তাঁর স্থান নেই। তাই হয়তো অমরেন্দ্র ঘোষের লেখা নিয়ে শ্রীকুমার-সরোজ-ক্ষেত্রগুপ্তদের কোন বিশেষ চিন্তার কারণ থাকতে পারে না। তিনি ছিলেন ‘কল্লোল-কালিকলম-প্রগতি’ পর্বের লেখক। আধুনিক বাংলা উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য লেখক হওয়া সত্ত্বেও তাকে নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করে, তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে পাঠকের আগ্রহ সৃষ্টি করা কিংবা যথার্থ মূল্যায়নের এযাবৎ কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। ফলে সমালোচনা সাহিত্যে একদিকে আজ তিনি উপেক্ষিত, বিস্মৃত- অথচ ‘চরকাশেম’, ‘পদ্মদীঘির বেদেনী’, ‘ভাঙছে শুধু ভাঙছে’, ‘দক্ষিণের বিল’ প্রভৃতি উপন্যাসের মাধ্যমে অমরেন্দ্র একদা বাংলা সাহিত্য পাঠকের হৃদয় জয় করেছিলেন তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতার ঐশ্বর্যে এবং লিখনশৈলীর আন্তরিকতায়। শত শত পাঠক সেদিন নিমগ্ন হয়ে পাঠ করেছে তাঁর লেখা। তিনি নিজেই বলেছেন তাঁর ‘জবানবন্দি’- আত্মজীবনীতে, ‘যা কোটি কোটি হিন্দু-মুসলমান জনসাধারণ গৌণ ছিল সাহিত্যে, তাঁদের রক্ত-মাংসে-মননে মুখ্য করতে ঘাম ঝরিয়েছি’। (সূত্র : জবানবন্দি, অমরেন্দ্র ঘোষ, পৃষ্ঠা ৩৫, পাইওনিয়ার পাবলিশার্স, ১৯৬০)
‘যুদ্ধোত্তর যুগে আমি এলাম। কি বলব, হয়তো ঐতিহাসিক প্রয়োজন ছিল, নয়তো কোনো দুর্জ্ঞেয় শক্তির টানে কেন আমিই আমার প্রশ্নের জবাব হয়ে এলাম? সভ্যতা ভাঙে অসম বণ্টনে, মনের, অর্থের অথবা ভূমি ব্যবস্থার। তুমি আমার যে কোনো উপন্যাস অথবা ছোটগল্প খোলো এর নজির পাবে। আমি সার্বিক দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করেছি। যে কোটি কোটি হিন্দু মুসলমান জনসাধারণ গৌণ ছিল সাহিত্যে তাঁদেরকে রক্ত মাংসে মননে মুখ্য করতে ঘাম ঝরিয়েছি।
‘চরকাশেম’ ও ‘পদ্মদিঘীর বেদেনী’ প্রকাশিত হবার পর কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর ইবহমধষর খরঃবৎধঃঁৎব প্রবন্ধে লিখেছিলেন: ‘অভঃবৎ গধহরশ ইধহফড়ঢ়ধফযুধুধ রং ঃড় নব সবহঃরড়হবফ অসধৎবহফৎধ এযড়ংয. ঐরং দঈযধৎ কধংযবস’ রং ধ সবসড়ৎধনষব ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ ড়ভ ড়ঁৎ ঃরসবং ষরশব রঃং ঊঁৎড়ঢ়বধহ ঈড়ঁহঃবৎঢ়ধৎঃ, দএৎড়ঃিয ড়ভ ঃযব ঝরড়ষ.’ আলোচক প্রতাপ রঞ্জন হাজরা তাঁর অমরেন্দ্র ঘোষ : জীবন ও সাহিত্য সাধনা বাইতে বলেছেন: মনে হয় বাংলা কথাসাহিত্যে অমরেন্দ্রই প্রথম কথা সাহিত্যিক যিনি সর্বপ্রথম হিন্দু-মুসলমানের মিলিত জীবন সার্থকভাবে সাহিত্যে উপস্থাপন করেছেন। (সূত্র : অমরেন্দ্র ঘোষ : জীবন ও সাহিত্য সাধনা, ড. প্রতাপ রঞ্জন হাজরা, পৃষ্ঠা ৩৮, পাইওনিয়ার পাবলিশার্স, ১৯৬০)।

অমরেন্দ্র ঘোষ আরও লিখেছেন :
খাদ্য বিভাগ থেকে বিদায় নিচ্ছি। উনিশ তিপ্পান্ন। সত্যবন্ধু ভৌমিক অগ্রণী হয়ে বিদায় সম্বর্ধনার আয়োজন করলে। প্রধান অতিথি কাজী আবদুল ওদুদ। তিনি সভায় এসে একান্তে আমায় ডেকে বললেন, আপনি অসন্তুষ্ট না হলে একটা কথা বলি। আপনাকে সাহিত্যের কোন কৃতি পুরুষের সঙ্গে তুলনা করতে চাই। এহেন বিদগ্ধ জনের মুখে এ উক্তি শুনে আমি একটু আশ্চর্য হলাম, বললাম, জিজ্ঞাসার কি আছে?
কাজী আবদুল ওদুদ বললেন. শরৎচন্দ্র জীবনের শেষভাগে সংকল্প করেছিলেন মুসলমান সমাজের চিত্র তিনি যা জানেন অঙ্কিত করে যাবেন। কিন্তু তার সময় তিনি পাননি।.. শরৎচন্দ্রের মতো দরদী শিল্পী অমরেন্দ্র ঘোষ যেন তাঁর গুরুকৃত্য পালন কররেন। …লেখক বামপন্থি … (সূত্র : জবানবন্দী, অমরেন্দ্র ঘোষ, শ্রীগুরু লাইব্রেরি, ভাদ্র, ১৩৬০)
‘চরকাশেমে’ ‘পদ্মদিঘীর বেদেনীতে’- প্রকৃতপক্ষে অমরেন্দ্রের সকল সাহিত্যজুড়েই বাংলাদেশের অন্ত্যজ মানুষের যে জীবনযাত্রা, যে ভাষা, হিন্দু-মুসলমানের একত্রিত সমাজ ও অর্থনীতি ব্যবস্থার চিত্রায়ন, প্রচণ্ড জীবনবাদী এক লেখকের সাহিত্যিক পদচারণাকে উপস্থিত করে। চরকাশেমের নায়ক কাশেম হাওলাদার মেছো যেন পদ্মা নদীর মাঝির হোসেন মাঝির আরেকটি সংস্করণ- মাটি, নদী আর হার-ভাঙ্গা পরিশ্রমের জীবন-সংগ্রাম। এই জীবন-যন্ত্রণার পাশাপাশি সে ছিলো আর আরেকটি মহাসম্পদের অধিকারী, সেটি তার হৃদয়ধর্ম। সেই হৃদয়ধর্মের বশে হিন্দুমুসলমানের পৈশাচিক হানা-হানির দিনেও পূর্ব-বঙ্গের মুসলমান তার হিন্দু প্রতিবেশীকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিল। আর উদ্বাস্তু অমরেন্দ্র ঘোষ তাঁর অভিজ্ঞান ও প্রেমের মণিহার ফেলে আসা জন্মভূমি পূর্ববঙ্গের এক অবজ্ঞাত মুসলমান জেলে-জেলেনী সম্প্রদায়ের গলায় পরিয়ে দিলেন।
তিরিশের দশকে-চল্লিশের দশকে কল্লোল-পূর্বাশা-প্রগতি-পরিচয়- এইসব পত্রিকার সঙ্গে মাসিক মোহাম্মদী-সওগত-মোসলেম ভারত ক্রমশ এক নতুন জীবনাবেগ, নতুন সংস্কৃতি সৃষ্টি করছিল। বাংলার ইাতহাসে এটা একটা অভূতপূর্ব অসাম্প্রদায়িক নবজাগরণের দিকে যাত্রা করেছিল বৃহৎবঙ্গ। নাট্য সাহিত্যে সিরাজদ্দৌলা-মীর কাশেমের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘শাহজাহান’ কবিতা। একথা জানিতে তুমি ভারতঈশ্বর শাহজাহান-কালো¯্রােতে ভেসে যাবে জীবন যৌবন ধনমান। রবীন্দ্রনাথ কালক্রমে পূর্ববাংলার কবি-সাহিত্যিকদের অস্তিত্ব স্বীকার করছিলেন- এমনকি ১৯৩৮ সালে তিনি যখন বাংলা কবিতার একটি সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন, তখন পূর্ববাংলার মুসলমান কবিদের নির্বাচিত কবিতাও সেখানে অন্তর্ভুক্ত করেন। কবিতা সংকলনটির নাম : বাংলা কাব্য পরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত, (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ, ১৯৩৮), বিশ্বভারতী। প্রথম কবিতাটি আলাওলের লেখা, দ্বিতীয় লেখাটি কৃত্তিবাস ওঝার। এই সংকলনে তৎকালীন আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ আছেন, বুদ্ধদেব বসু, অমীয় চক্রবর্তী, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, -এদের সঙ্গে আছেন কাজী নজরুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন, বন্দে আলী মিয়া, সুফী মোতাহার হোসেন, হুমায়ুন কবীর, আবদুল কাদির, কাজী কাদের নওয়াজ। আর শেষ কবিতাটির কবি মহীউদ্দিন। মহীউদ্দিন নামের এই কবিকে এখন আমরা চিনি না, তখন তাকে রবীন্দ্রনাথ চিনতেন।
ইতিহাসের পটভূমিতে দেখা যায় সাহিত্যের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের কিছু সামাজিক কর্মতৎপরতাও বিদগ্ধ সমাজের কাছে ক্রমশ : গুরুত্বের কথাও তখন বিবেচিত হচ্ছিল। বিংশ শতাব্দীর নতুন কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের কাছে পূর্ববঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থানসহ গুরুত্ব, পূর্ববঙ্গের লেখকদের লেখক-অস্তিত্বসহ ব্যক্তিত্ব, -এ সব ধারণার ক্রমবিকাশে সাহিত্য পত্রিকাগুলোর অবদানকে খুঁজে দেখা দরকার। এক্ষেত্রে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘কল্লোল যুগ’ (সূত্র: কল্লোল যুগ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, এম সি সরকার এ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লি:, ১৯৫০ ) এবং জীবেন্দ্রসিংহ রায়ের ‘কল্লোলের কাল’ (সূত্র: (কল্লোলের কাল, জীবেন্দ্র সিংহরায়, দে’জ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, ১৯৬০)-এই দুটি বইয়ের সাক্ষ্য থেকে অনেকগুলো তথ্য পুনর্নির্মাণ করতে হবে। এই বই দুটি যেন সেই ইতিহাসের বর্ণনা দেয়ার জন্যই রচিত হয়েছিল।
পূর্ববাংলার ঢাকাকে কেন্দ্র করে যে নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের কতিপয় ছাত্র তা প্রমাণ করার জন্য যেন আবহ নির্মাণ করেছিলেন। ১৯২১ সলে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নতুন সারস্বত সমাজ সৃষ্টি হওয়ার যে সম্ভাবনা ছিলো তার দুটি রূপ দুই ধারায় বিকশিত হয়েছে। নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ সেই সময়ের তরুণদের কণ্ঠস্বর হয়ে ১৯২৭ সালে এই ঢাকা শহর থেকেই দুটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। একটি হলো বুদ্ধদেব বসু আর অজিত দত্তের সম্পাদিত ‘প্রগতি’, অন্যটি ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সংসদের মুখপত্র ‘শিখা’। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এদের ভূমিকা আলোচনা করলে পূর্ববঙ্গের নবজগরণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
‘শিখা’ একদিকে মুসলমান সমাজের মধ্যে সাহিত্যচর্চ্চার সঙ্গে মুক্তবুদ্ধির সংস্কৃতিবোধ- জাতীয়তাবাদের চিন্তন অনুশীলনের অনুরণন রেখেছে। এই গোষ্ঠীর আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আনোয়ারুল হক, আবদুল কাদির, আবুল ফজল, কাজী আবদুল ওদুদ এদের অংশগ্রহণ বিদগ্ধজনের কাছে তখনই নতুন যুগের বার্তাবহের কাজ করেছে। ১৯২৭ সালে বুদ্ধদেব বসু আর অজিত দত্তের ‘প্রগতি’ -তেমনি জানিয়েছিল এই বঙ্গের উল্লেখযোগ্য হওয়ার ঘোষণা।
‘কল্লোল’- পত্রিকার আয়ুষ্কাল মাত্র সাত (৭) বছর, ১৯২৩ এর এপ্রিল থেকে ১৯২৯ এর ডিসেম্বর। এই ৭ বছরের সাহিত্য আন্দোলনে ‘কল্লোল’ কলকাতা থেকে ঢাকার আহবান প্রকাশ করে। কল্লোলের কালের অনেকগুলি পৃষ্ঠায় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর ধারা বর্ণনা পাওয়া যায় তখনকার দিনের পূর্ববাংলার নবজাগরণের উপস্থিতি ও সর্বগ্রাসী আত্মপ্রকাশ।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে নি¤œশ্রেণির মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা যে বাড়িয়া গিয়াছে তাহার একমাত্র কারণ হিন্দু ভদ্রসমাজ এই শ্রেণিয়দিগকে হৃদয়ের সহিত আপন বলিয়া টানিয়া রাখে নাই।’ কিন্তু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অমরেন্দ্র ঘোষ, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়- এঁদের লেখাতে নি¤œশ্রেণি আর ঊর্ধ্বশ্রেণির ফারাকটা পাওয়া যায় না।
তখন মনে পড়ে যায় বেনেডিক্ট এন্ডারসনের কথা, জাতির নিজেদের মধ্যে অসমতা-শোষণ যাই থাকুক না কেন, তাঁদের সবার মধ্যে গভীর আনুভূমিক কমরেডশিপ (যড়ৎরুড়হঃধষ পড়সৎধফবংযরঢ় -পারস্পরিক সৌভ্রাতৃত্ব) থাকবে।
আর তখন গোলাম হোসেন তাবতাবায়ির ‘সর্বজনীন ভারতীয় স্বার্থের পক্ষে’র কিছু যুক্তিতর্ক হয়তো খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়