গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

উপনিবেশিক এবং স্বাধীন বাঙালি কেরানি : হরিপদ দত্ত > প্রবন্ধ

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইংরেজদেরও আগে পর্তুগিজদের হাত ধরে বঙ্গ-ভারত উপমহাদেশে কেরানি (পষবৎশ) বা করণিক নামের কলমপেশা আধাশ্রমিক, আধাকর্মচারী প্রজাতিটির উদ্ভব। পর্তুগিজ বংবৎবাবহঃব শব্দের সঙ্গে এর কার্যকরণ সম্পর্ক। দখল করা বন্দর গোয়া, দমন, দিউ, পন্ডিচেরী, কালিকট ছিল ইউরোপীয় বণিকদের ঋরষব বা নথিপত্র তৈরির আদি ভূমি। তখন তাদের ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিজয় বা উপনিবেশ স্থাপন ছিল কল্পনার অতীত। পরবর্তীতে ভারতবর্ষে উপনিবেশ স্থাপন এবং কলকাতাকে রাজধানী করে প্রশাসনিক কেন্দ্র ভূমি করে নেয় ইংরেজরা। তখন থেকেই বাণিজ্যিক এবং প্রশাসনিক কাঠামো দ্রুত তৈরি হতে থাকে। তাই প্রধান কাজ হয়ে ওঠে ফাইল বা নথিপত্র তৈরি এবং সংরক্ষণ করা। বিলেতে তখন কাজের যেমনি আকাল তেমনি মাস-মায়নাও কম। কাজ এবং মায়না খানিকটা অধিক ছিল উপনিবেশিক রাজধানী কলকাতায়। সেই লোভে বিলেতের অল্প পাস দেয়া তরুণেরা দলে দলে কলকাতার উদ্দেশে জাহাজে চেপে বসে। অল্প মেধার (বিলেতের তুলনায়) ইংরেজ দরিদ্র ঘরের তরুণদের কাছে তখন কলকাতার মাস-মায়না ৩০ থেকে ৩৫ রুপি কম কিসে? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ইংরেজ শাসকদের অধিক প্রয়োজন ছিল কম মায়নার কেরানি। তাই ইংরেজেরা কেরানি বা ফাইল তৈরির ইংরেজি (কিছুটা ফার্সি) জানা উপজীবী শ্রেণি তৈরির জন্য বাংলার মূল শহর কলকাতা তো বটেই, হিন্দু জমিদারদের সহায়তায় জেলা শহরেও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল প্রতিষ্ঠা করে।
দিল্লির মোঘল সাম্রাজ্যের পতন এবং পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজের পতন, শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহের বার্মায় নির্বাসন, লখনৌর নবাবকে কলকাতার মেটিয়াবুরুজে তুলে এনে বন্দি করার স্মৃতিবাহী মুসলিম সমাজ সঙ্গত কারণেই জাতি হিসেবে ইংরেজ এবং ভাষা হিসেবে ইংরেজির বিপক্ষে। তাই ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেল মুসলিম সমাজ। সুযোগটা লুফে নিল কায়েত-বামুনের মতো উচ্চবর্গের হিন্দুরা। নিচু বর্ণের হিন্দুরা প্রায় শতভাগই ছিল ক্ষুধার্ত-দরিদ্র শ্রেণিভুক্ত কৃষক। এমনিতেই শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহও ছিল না। ইংরেজি ভাষা উদরে প্রবেশ করানোর চেয়ে তাদের জীবন বাস্তবতা ছিল ক্ষুধার্ত পেটের আগুন নেভানো ভাত। অন্যদিকে অলিখিত নিষেধ ছিল শিক্ষাঙ্গনে পা ফেলা। তাই উপনিবেশ যুগে ইংরেজি জানা সিংহভাগ কেরানিই ছিল উচ্চবর্গের হিন্দু। নিচুবর্গের হিন্দুদের দেখা মিলত ইংরেজদের চাকর মহলে। অথবা ধর্মান্তরিত আদিবাসীদের।
নথিপত্র বা ফাইল এবং কেরানি, এরা একে অন্যের প্রতিকল্প বা ছায়াশরীর। বঙ্গ-ভারতে প্লেগ, কলেরা, ম্যালেরিয়া, কালাজ¦র মহামারি রূপে দেখা দিলে বিলেত থেকে কেরানি রফতানি অনেকটা কমে আসে। এর ফলে কেরানি উৎপাদনের জন্য ইংরেজ শাসকেরা বর্তমান গাঙ্গেয় অর্থাৎ গঙ্গা তীরবর্তী বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গের অঞ্চল তো বটেই, পূর্ববঙ্গের ঢাকা অঞ্চল, বিশেষ করে বিক্রমপুর থেকে সিলেট, চট্টগ্রামের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রতি দৃষ্টি দেয়। জমিদার (নব্য) শ্রেণি অতি উৎসাহে ‘স্যার’ পদবি থেকে শুরু করে ‘বিদ্যারতœ’ ‘বিদ্যাবিভূষণ’ ‘জ্ঞানরতœ’, ‘বিদ্যোৎসাহী’, ‘বিদ্যা বিনোদ’, ইত্যাদি পদবিতে অলংকিত হতেন। কোনো নিম্নবর্গের হিন্দুর ভাগ্যে এমন পদবি প্রাপ্তি ছিল কল্পনার অতীত। এর ফলে ‘ইংলিশ হাই স্কুল’ থেকে উৎপাদিত বামুন, কায়েত, বৈদ্য বংশের ছেলেরা ‘দুপাতা ইংরেজি শিখে’ কলকাতার কেরানি হয়ে গেল। অধরাই রয়ে গেল ‘কেরানি বাবু’ পদবি লাভ। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে তৎকালের ওই কেরানিরা বর্তমানের কেরানিদের চেয়ে অতি উত্তম ইংরেজি জানতেন। আজো জনশ্রæতি হয়ে আছে তাদের ‘ইংরেজি মুসাবিদা’। আশ্চর্য এটাই যে বাংলার শহর-গ্রামে আজো ব্যক্তির পেশা বা চাকরির নামে রয়েছে অসংখ্য বাড়ি। ডেপুটি বাড়ি, দারোগা বাড়ি, কবিরাজ বাড়ি, ডাক্তার বাড়ি, পণ্ডিত বাড়ি, মাস্টার বাড়ি ইত্যাদি বাড়ি। কিন্তু সারা তল্লাট খুঁজেও মিলবে না একটি ‘কেরানি বাড়ি।’ কেন নেই? এটাই হাজার কথার এককথা।
উনিশ শতকে বাংলায় হিন্দু এবং মুসলিম সমাজে পরস্পর ভিন্নধর্মী কথিত যে ‘নবজাগরণ’ ঘটে এবং ঘটে পরস্পর বিচ্ছিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, তার পেছনের কারিগরেরা ছিলেন তৎকালের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এবং সামাজিকভাবে অভিজাতবর্গ। অর্থনৈতিকভাবে তারা ছিলেন ধনী এবং মধ্যবিত্ত মিশেল। বাংলার রাজনীতির অগ্রপথিকও ছিলেন তারা। এদের প্রায় শতভাগই বসবাস করতেন নগরে, বিশেষ করে কলকাতা এবং ঢাকার মতো শহরে। তবে উপনিবেশিক রাজধানী হেতু কেন্দ্রটি ছিল কলকাতাই। এদের বাইরে সরকারি অফিসে, বাণিজ্য বা সওদাগরি দফতরে চলনে, বলনে, কথনে, পোশাকে নিরীহ যে শ্রেণিটি খুবই সামান্য মায়নায় মুখ বুজে মাথা নুইয়ে কাজ চালাত, তারাই হচ্ছে কেরানি। তাদের নামের সঙ্গে ‘সাহেব’ কখনো উচ্চারিত হতো না। কর্ম জগতে এরা ছিল হিন্দু বর্ণপ্রথার মতো নিম্নবর্ণ বা অন্ত্যজ শ্রেণি। মাঠে-ময়দানে, কল-কারখানায় উৎপাদক শ্রেণির মতোই ছিল তাদের সামাজিক মর্যাদা। প্রশ্ন হলো, একুশ শতকে এসেও কি তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রাপ্তি ঘটেছে? মোটেই ঘটেনি। করপোরেট সেক্টরে ওদের মর্যাদা বরং হ্রাস পেয়েছে। মোট কথা, বর্তমানেও তারা অতীত স্মৃতিবাহী। বাংলার কেরানিদের মতো অধস্তন শ্রেণির উদ্ভব ইতিহাসের ফল এবং ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র দর্শনেরই অনিবার্য ফসল।
বাংলার কেরানিকূলের একাল-সেকাল নিয়ে খুব যে গবেষণা হয়েছে, এমন দাবি করা যাবে না। যে গবেষণা কর্মটি আজো অন্ধকারেই রয়েছে তা হচ্ছে তাদের মনস্তাত্ত্বিক জগৎ। অনেক পণ্ডিতের মতে তাদের কোনো শ্রেণি নেই। না এরা সর্বহারা, না শ্রমজীবী, না মধ্যবিত্ত। কিন্তু শ্রেণি তো একটা আছেই। মানুষ তো শ্রেণিহীন হয় না। তাদের শ্রেণি নির্ণয়টা কেবল অর্তনীতিবিদদেরই কাজ নয়, সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীদেরও সমন্বিত কাজ। নিরীহ, গোবেচারী, কষ্ট আর দুঃখ সহ্যকারী, প্রতিবাদহীন, প্রভু বা বসের অনুগত, ভীরু, আত্মমর্যাদা শূন্য, এই শব্দগুলো একাধারে তাদের প্রতি প্রয়োগ করা যায় না। আসলে এই কেরানিকূলের মনটা কেউ বুঝতেই চায়নি বা তারাও পারতপক্ষে বুঝতে দেন না। আশ্চর্য এটাই যে এরা নিজের জন্য প্রাণান্ত শ্রম দেন না, সবটুকু শ্রম, মেধা, সাধ্য-সাধনা সবই পরিবারের জন্য নিবেদিত। আপন সুখ বিসর্জন, আপন রোগ-ব্যাধি গোপন করা এবং ইত্যাদির ভেতর আত্মনিগ্রহকেই তারা জীবন ধর্ম বলে মনে করে। বৌদ্ধ এবং জৈনদের মতো আত্মনিগ্রহের ভেতর সংসার প্রতিপালনই যেন তাদের ‘নির্বাণ’ লাভ।
কেরানিরা যতোই ‘ইংরেজের মতো’ ইংরেজি জানুক, আজকের চাকরির আকালের যুগে দুর্লভ ‘সরকারি’ চাকরি করুক, সামাজিক তাচ্ছিল্য তাদের ছেড়ে যেতে রাজি নয়। পাঠক যদি মতিঝিলের অফিস পাড়া, সচিবালয়ের রোদপড়া বিকালে ছুটির দৃশ্যটি দেখেন, কেবল দুই চোখের দেখা নয়, তৃতীয় নয়নে, বোধ-বুদ্ধিতে দেখেন, নিশ্চয়ই চমকে উঠবেন। কি আকুল-ব্যাকুল, ক্ষেত্র বিশেষে উন্মাদনা ঘরে ফেরার জন্য! কেবল কি ক্ষুধা? অন্য কিছু নয়? ঘর-স্ত্রী-সন্তান, প্রতিদিনের চেনা ঘর, বাথরুম, বারান্দা, চেনা আলনায় শাড়ি, ব্লাউজ, জামা-প্যান্ট, শিশুর রঙিন শার্ট কী জাদু জানে? কেবলই কাছে টানে। কি মায়া কি মোহ, কি অদৃশ্য ছায়া শরীরের সুখ কল্পনা, শান্তির শীতল-জলের পুকুর টলমল করে। এ যে শুধুই কল্পনা, স্বপ্নমাত্র, বাস্তবটা তো শূন্য। এই মনটাই বুঝি কেরানি মন।
বিস্ময় এটাই যে, পরাক্রমশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যে রাজ কর্মচারীদের মেধা-শ্রমে চলমান, সেই কেরানিকূলের প্রতি এই উপহাস? যারা নত মাথায়, ভগ্নস্বাস্থ্যে, ক্লান্তি-ঘামে, তুচ্ছ মায়নায় উপনিবেশবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের সেবা দান করে যায়, সেই ইংরেজি জানা শ্রেণিটির প্রতি এত তাচ্ছিল্য ভাব কারণটা কি বর্ণবাদ? ওরা প্রজা ন্যাটিভ? ওরা কৃষ্ণবর্ণ। আমাদের বিশ্বাস অন্য প্রান্তে। প্রশ্নও আলাদা। কেননা, যে ব্রিটিশরা আধুনিকতার জন্ম দেয়, গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়িত করে তারা কি ঔপনিবেশিক অধীন দেশে তার প্রয়োগে দ্বিধান্বিত ছিল? শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, দাস-প্রভুর মহাভ্রান্তি থেকে কোনো কালেই মুক্ত ছিল না। ‘আধুনিকতা’কে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিল কেবল আপন দ্বীপ দেশে?
কেরানিকূলের জন্মচিহ্ন কেবল ব্রিটিশ সমাজেই ছিল না, ছিল বঙ্গ-ভারতীয় সমাজেও। কই, আপন দেশের কেরানিরা তো এমনি ছিল না বঙ্গ-ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের হোতা রবার্ট ক্লাইভ থেকে শুরু করে অনেকের জীবনই তো শুরু হয়েছিল কেরানি জীবন দিয়ে। পরবর্তীতে লন্ডনের অফিস বাড়ি তো আলোকিত করে রেখেছিল কেরানিকূলই। তাদের হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল শিল্প বিপ্লবের সাংস্কৃতিক ভূমি। নির্মম কিছু প্রশ্ন ওঠে আসে। এসবের মীমাংসা বাঙালি মেধাজীবীদের করতে হবে। কেননা এসব প্রশ্নের উত্তর বাঙালিরা আজো পায়নি। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, ব্রিটিশ কেরানিরাও বাংলার কেরানিদের মতোই অর্থকষ্টে জীবনযাপন করে গেছে। ব্রিটিশ অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে তাদের জীবন চর্চার মান ছিল খুবই পার্থক্য। কিন্তু ইংরেজ ওই কেরানিকূল তাদের কর্মসংস্কৃতির স্বীকৃতি পেয়েছে। সম্মান অর্জন করেছে, ব্রিটিশ সমাজের কাছে তারা কর্তৃত্বহীন প্রজাতি ছিল না। বিদ্রুপের পাত্রও ছিল না। অর্থকষ্ট থাকলেও আক্রান্ত হতে হয়নি হীনমন্যতায়।
গ্রেটব্রিটেনের কেরানিকূলের বাসস্থান বড় বড় শহরে হলেও বাঙালি কেরানিকূলের আদি বাসস্থান কলকাতার উপকণ্ঠে, গঙ্গার অপর তীর হাওড়া অঞ্চলেই ছিল। ঢাকা শহরের কেরানিরা বসবাস করতো বুড়িগঙ্গা নদীর ওপার কেরানিগঞ্জ, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে। কেরানিদের নামেই নাম কেরানিগঞ্জ। ঢাকার বসবাসকারীরা ছিল, নবাব, জমিদার আর সওদাগর। বাংলায় ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক সংগঠন তৈরিতে কেরানিদের খুব একটা অবদান নেই। কৃষক এবং কারখানা শ্রমিকরাই এসবের পেছনে ছিল। উল্টো দিকে ব্রিটেনের কেরানিরাই আপন মেধাশক্তিতে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। উপনিবেশিক কলকাতা কিংবা ঢাকার কেরানিদের পক্ষে আধুনিকতার সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে আত্ম-আবিষ্কার সম্ভব হয়নি। কেননা বাংলার কেরানিরা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সূত্র ধরে আবির্ভূত হয়নি। অর্থাৎ সামন্তবাদ ভেঙে পুঁজিবাদের পথ ধরে বিলেতের কেরানিকূলের ঐতিহাসিক কার্য-কারণেই যেমনি উদ্ভব হয়েছিল, বাংলার বেলায় তা খাটেনি। বরং ওদের উদ্ভব ঘটে উপনিবেশিক পরিবেশের অধীন উপনিবেশে ব্রিটিশ শাসকদের প্রয়োজনে। তাই ব্রিটেন কিংবা ইউরোপের কেরানিদের মতো ‘স্বাধীন’ কেরানির আবির্ভাব ঘটেনি বাংলায়। তারা ‘ভদ্রলোক’ নয়, ‘ইতরজন’ও নয়, নিছক ‘কেরানি’। আত্মসমর্পিত, অনুগত, নম্র, বিনয়ী, বিদ্রোহশূন্য, নির্বিবাদী, ‘নরম গোবেচারা’ ইত্যাদি বিশেষণেই বাংলার কেরানিরা বিশেষিত। আশ্চর্য এটাই যে, পরপর দুটো বিশ্বযুদ্ধ গেল, বাঙালি স্বাধীন হলো, কিন্তু কেরানি মানসের খুব একটা অদল-বদল হয়নি। ১৯৪৭ এর দেশ ভাঙার পর ধর্মের ভিত্তিতে বাংলার কেরানিদের একটি অংশ দেশের বদলে দেশ, চাকরির বদলে বদলাবদলিটাই করেছে কলকাতা থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে কলকাতা।
ধর্মের প্রশ্নে, চাকরি-বাকরির প্রশ্নে, ভূমির মালিকানার প্রশ্নে বাংলা দ্বিখণ্ডিত হলেও কেরানিদের অবদান এক্ষেত্রে খুব একটা ছিল না। পূর্ববঙ্গের কেরানিদের আত্ম-আবিষ্কারের অনুসন্ধান ঘটে ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের ফলে। ১৯৪৭ এ বাংলা ভাগের ফলে ঢাকা যে কেরানিদের পেল উত্তরাধিকার সূত্রে, তাদের একটা অংশ কলকাতা পরিত্যাগকারী। সংখ্যাটা অধিক নয়। বরং ঢাকা পরিত্যাগীদের সংখ্যাটাই ছিল অধিক। অধিক সংখ্যক হিন্দু কেরানি ঢাকা পরিত্যাগ করলে নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসনিক সংকট তৈরি হয়। শূন্যস্থান পূর্ণ করা বড় সহজ ছিল না। কেননা উপনিবেশিক যুগের কেরানিদের সিংহভাগই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। ঢাকায় পুনর্বাসিত কেরানিদের একটা অংশ ছিল উর্দুভাষী অবাঙালি। পূর্ববঙ্গ বা ঢাকার জল-হাওয়া সম্পর্কে তাদের তেমন একটা ধারণা ছিল না। সে যা হোক, শূন্যতা পূরণের জন্য নতুন একদল কেরানির অবির্ভাব ঘটে। পদের আগমন ঘটে গ্রামাঞ্চলের সম্পন্ন ঘরের ইংরেজি শিক্ষারত তরুণ সমাজ থেকে। দেশভাগ হলেও এদের সঙ্গে মিশে ছিল কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের তরুণ, যারা পূর্ববঙ্গে রয়ে যায়। এই নব্য তরুণ কেরানি আর উপনিবেশের অবশেষ কেরানিদের পার্থক্য যতই থাকুক তারা মিলে মিশে ষাটের দশক পর্যন্ত ঢাকায় কলকাতা থেকে আলাদা একটি কেরানি কর্ম সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, পুরনো ঢাকার কোর্ট হাউজ স্ট্রিট বা আদালত পাড়ায় খোঁজ নিলে এমন দু-একজন টাইপিস্টকে পাওয়া যাবে যে বা যারা উপনিবেশিক যুগের কেরানিদের অবশেষ উত্তরপুরুষ।
উপনিবেশ যুগের অবসান হলে এবং পাকিস্তান যুগের একটি দশক পূর্ণ হতে না হতে সরকারি-বেসরকারি কর্মস্থলে রূপান্তরের লক্ষণ স্পষ্ট হতে থাকে। আশরাফ বা অভিজাত মুসলিম পরিবার থেকে আগত কেরানিদের সংখ্যা কমতে থাকে। প্রভাব বিস্তার করতে থাকে গ্রামের কৃষক পরিবারের মেট্রিকুলেশন পাস করা তরুণ কেরানিরা। ওরা গ্রামের বিকল্প নগর জীবন এবং অর্থনীতি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। দরিদ্র পরিবারের মুসলমান সন্তান তো বটেই, তফসিলি সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত চাকরিতে প্রবেশ করতে থাকে নিম্নবর্গের হিন্দুও।
‘বিস্ময়ের চাকরিঅলা’ নামে খ্যাত আমাদের গাঁয়ের মুচি সম্প্রদায়ের সন্তান সুখলাল রবিদাস এমনি একজন কেরানি। ১৯৪৫ সালের মেট্রিকুলেশন। কাজ করতেন পাকিস্তান ডাক বিভাগে। আমরা তাকে দেখতাম সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে শনিবার সন্ধ্যায় গাঁয়ে ফিরে সোমবার কাকভোরে শহরের পানে ছুটছেন। জনশ্রæতি এই, গাঁয়ের উচ্চবর্গের হিন্দুরা নাকি ফোঁড়ন কাটত, ‘মুসলমানের পাকিস্তানে থাকন যায়, যেই গেরামের মুচির পোলা গরমেন্টের চাকরি করে সেই গেরামে থাকন যায় না।’
সাদা শার্ট-পাজামা পরা মানুষটি হয়তো এসব জানতেন। তাই স্কুল পড়–য়া আমাদের মতো গ্রাম্য কৌতূহলী কিশোরদের ‘গরমেন্টের চাকরি’ বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে প্রায়ই বলতেন, ‘জিন্নাহ সাবের জন্ম না হইলে মুচির পোলা সুখলালের কি কেরানির চাকরি হইতোরে ভাই?’
চাকরি তো হয়েছিল, কেরানির চাকরি। না হলে সুখলাল রবিদাসের চাকরি জীবনের শেষ দিকে আমাদের ছাত্রজীবনে মানুষটিকে পুরাতন জিপিও বিল্ডিংয়ে খুঁজে পেয়েছিলাম কেমন করে? ইস্ত্রিবিহীন তিন পকেটঅলা জামা পারহিত কালো বর্ণের একটা মানুষ টেবিলে মাথা নুইয়ে বসে আছেন। সামনে মলিন বর্ণের এক স্তূপ ফাইল। বাঙালি কেরানি। এই মানুষটাই সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে তৎকালীন ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে সন্ধ্যার লোকাল ট্রেনে চেপে ঘোড়াশাল স্টেশনে নেমে ‘শহুরে পোশাক’ পাল্টাতেন। এবার গায়ে নিমা, পরনে লুঙ্গি। নগ্নপদ। শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষা ইউনিয়ন বোর্ডের কাঁচা সড়কে পা ফেলে উত্তরে হেঁটে চলেছেন আমাদের গাঁয়ের কেরানি। জব জব ভেজা ঘামের শরীর। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ। অস্পৃশ্য বর্ণের কেরানি। তাকে যে উচ্চ বর্ণের হিন্দু পাড়াটা ডিঙোতে হবে। শহুরে পোশাক কি ওখানে নিষিদ্ধ? এমন কি পাদুকাও? কল্পিত ভয়। ভীরু মানুষ। লাজুক মানুষ। শহরের অফিসে যেমনি ভয়, ততোটাই ভয় জন্ম গ্রামে। নীরবে মাথা নত করে সন্ধ্যার ছায়াচ্ছন্ন আঁধারে মেঠো পথে হেঁটে যাবেন তিনি আপন জন্ম ভিটায়। সেই মানুষটা আজ আর বেঁচে নেই। অথচ প্রতীক হয়ে আছে ক্ষুধা-দারিদ্র্য, সমাজ-রাষ্ট্রবশ্য চির অবনত শিরের চিরকালের বাঙালি অশুচি কেরানিকূলের। মিথ্যা ভয়, অন্ধ সংস্কারের আনুগত্য যে বড় ভয়ঙ্কর।
কলকাতা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা বলে কথিত জব চার্নক কিংবা ইংরেজের মুখে বাংলা বুলি তুলে দেয়ার উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুরে ফোর্ড উইলিয়ম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়ম ক্যারি এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলারা কেবল বাঙালি কেরানিরই উদ্ভাবন ঘটাননি, তাদের যতœ-অত্তি করে পুষতেনও। অনুগত দাস বানানোর মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণও দিতেন। বাঙালি এসব অবজ্ঞাত, তাচ্ছিল্যের উপশ্রেণিই বঙ্গ-ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশের ভিতকে পোক্ত করে গেছে। বাঙালির একেবারে নিচু তলায় এরা ‘বাবু’ পরিচিতিও খানিকটা লাভ করেছিল। অনেক সময় এই ‘বাবু’ হওয়াটা তাদের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়াত। মেরুদণ্ডের ঘনত্বের হের-ফেরের কারণে আমৃত্যু কুঁজো হয়েই নগরের ইটবিছানো পথে তারা হেঁটে যেত।
আশ্চর্য এটাই যে, উপনিবেশিক যুগের স্পাইনালকর্ডের সমস্যার কারণে উত্তর-উপনিবেশিক যুগেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি কেরানি বাঙালি। ফিজিওথ্যারাপির প্রথম চাপটা এসে পড়ে বায়ান্ন সালে। অপেক্ষা করতে হয় ভাষা বিদ্রোহের। স্বজাতি-স্বভাষীর এমনি বিদ্রোহ এই পয়লা দেখল বাঙালি কেরানি। বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য আমরা সহজেই জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের দিকে তাকাতে পারি। নতুন পরিবেশ, পরিস্থিতি বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদির ভেতর পতিত কোনো প্রাণি যেমনি বেঁচে থাকার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে অস্তিত্বের সংগ্রামে জয়ী হয়, তখন তার ভেতর অতি নতুন জীবনধারা তৈরি হয় এবং সে নতুন প্রজাতিসত্তার উদ্ভব ঘটায়। বায়ান্নর ভাষা সংগ্রাম বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে তেমনি তরঙ্গ তৈরি করে। বাঙালি কেরানিকূলও ইতিহাসের অনিবার্য ফল হিসেবে তাতে যুক্ত হয়। তারই ফল বায়ান্নর কেরানিকে প্রাণ দিতে হয় ভাষা সংঘাতে। ঠিক এই একটি কারণ এবং তৎজাত রাজনৈতিক নতুন পরিস্থিতি বাঙালি কেরানির আদি উদ্ভব স্থল উপনিবেশিক রাজধানী কলকাতার কেরানি থেকে মানস জগতে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন প্রজাতির কেরানির উদ্ভব ঘটায়। কলকাতার আদি কেরানিদের ওপর যেমনি পড়েছিল ঔপনিবেশিক চাপ, ঠিক তেমনি চাপ ঢাকার কেরানিদের ওপর না পড়লেও বিকল্প হিসেবে আসে পাকিস্তানি শাসন-শোষণ, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক চাপ। সাতচল্লিশ উত্তর সময়ে কলকাতার কেরানিরা উপনিবেশিক চাপমুক্ত হয়ে পতিত হয় দিল্লির কেন্দ্রীয় চাপে। ঢাকার কেরানিরা করাচি-রাওয়ালপিন্ডির চাপের ভেতর সংগ্রামে রত ছিল একাত্তর পর্যন্ত। মাঝখানে গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল তাদের সংগ্রাম।
বাঙালি স্বাধীন হলেও বাঙালি কেরানির সামাজিক মুক্তি আজো অনার্জিত। এটা অনেকটা হিন্দু বর্ণবাদের মতো। যতোই তুমি রাজ কর্মচারী হও, নগর অট্টালিকায় করো বাস, তবু জাতে তো তুমি নিচু। বাঙালি কেরানির এই রোগ জিনগত। তা সে বংশ পরম্পরায় বহন করে চলেছে ঔপনিবেশিক যুগ থেকে। অতি আধুনিকতা, রাষ্ট্রবিপ্লব, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ ইত্যাদির অভিঘাতের ফলে কেরানিতন্ত্রের রূপান্তর ঘটতে থাকে। ক্লার্ক বা কেরানির জায়গায় এল ডি ক্লার্ক, ইউ ডি ক্লার্ক, অফিস সহকারী ইত্যাদি হরেক রকমের কেরানি পদবি। কেরানিও জাতিভাগের ভেতর ঢুকে গেছে। আজকাল চাকরির বিজ্ঞপ্তির দিকে তাকালে এসব পদবি দেখা যায়। আবার তাদের বেতন কাঠামোও আলাদা। অনেকটা আকাশে উড়ন্ত ঘুড়ির মতো। যতই উঁচুতে উড় তুমি, নাটাই কিন্তু আমার হাতে। অর্থাৎ তুমি কেরানিই থাকবে।
দুটি দেশ, দুটি শহর। ভারতের কলকাতা, বাংলাদেশের ঢাকা। যদিও দুটি শহরই বাঙালিদের তবুও মহাসত্য এই যে, মেট্রোপলিটন কলকাতা অতিদ্রুত বাঙালি শূন্য হচ্ছে। জনসংখ্যার ৬০ ভাগই অবাঙালি। কলকাতা শহর কেরানিদের গ্রহণ করে না। কেরানিরা নিত্যযাত্রী মফস্বলী নগরে, স্থায়ী বসবাসের অর্থনৈতিক ক্ষমতা নেই তাদের। ওরা থাকে শহরতলী বা ভিন জেলায়। কলকাতা নগরীকে কেন্দ্র করে শিয়ালদা এবং হাওড়ায় যে দ্রুতগামী লোকাল ট্রেন পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে তা কেরানি এবং শ্রমিকদের অবদান। শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, কল্যাণী, বনগাঁ, কেনিং, যাদবপুর, বারাসাত, মধ্যমগ্রাম, হুগলি ইত্যাদি মফস্বল শহর এবং এদের ঘিরে যে গ্রাম রয়েছে তাদের বাসিন্দারাই লোকাল ট্রেনের নিত্যযাত্রী। বিদ্যুৎচালিত, কাঁটায় কাঁটায় সময় মাপা এবং কম ভাড়ার এই রেল পরিবহন। আড়াই যোগ আড়াই, মোট পাঁচ ঘণ্টার রেল যাত্রা। ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে মানুষ কীটপতঙ্গ হয়ে যায়। শরীরের যত জল নোনা ঘাম হয়ে বেরিয়ে আসে। সঙ্গে বয়ে আনা আরয়নের দাগ পড়া জলের বোতল খালি হয়ে যায়। শরীরে ডি-হাইড্রেশন উঁকি দেয়। সব সয়ে যায় শরীর। ওরা যে সস্তা পোশাক পরা, সস্তা মায়নার কেরানি। কিছুটা প্রশান্তি ঘটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেট্রোতে চাপলে। ওদের সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত হয় ট্রেনে, মেট্রোতে কিংবা ট্রামে, নগরবাসে। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী অন্য অনেকের সঙ্গে এদেরই বলেছেন ক্রুশে বিদ্ধ ‘কলকাতার যীশু’। মানিক বন্দ্যোপাদ্যায় তার গল্প-উপন্যাসে তাদের মুখচ্ছবি বাঙালি পাঠককে নতুন আঙ্গিকে দেখিয়েছেন।
কলকাতা ছাড়িয়ে ঢাকায় পা দিলেই আমরা দেখতে পাই কেরানিদের অন্যরূপ। ঢাকার কমলাপুরে কেরানি বহনের জন্য মিনিটে মিনিটে রেল পরিষেবা নেই। মেট্রো চালু হওয়ায় মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ঢাকায় রয়েছে পিঁপড়ের ঝাঁকের মতো নানা মডেলের বাস পরিষেবা। অফিস শুরু আর শেষ বেলায় পরিবহনের কারণে রাস্তা ঘাটের মাটির তল খুঁজে পাওয়া যায় না। হর্ন বাজার বিচিত্র শব্দে আকাশে চিড় ধরে। শব্দ দূষণের এ যেন ভিন্ন দুনিয়া। মফস্বল থেকে নগরীতে প্রবেশ মুখে দেখা যায় যানজটে পড়া বাস নয় তো হাজার-লক্ষ হিংস্র ক্ষুধার্ত অরণ্যচারীরা ঘিরে আছে আস্ত নগর। এই নগর প্রবেশকারীরা কারা? কেবল কি সাধারণ যাত্রী? শ্রমিক? এদের একটা অংশ সরকারি কর্মীবাহিনী, বেসরকারি অফিসের কলম আর কম্পিউটার টেপা কেরানি। কোথা থেকে নগরে প্রবেশ করে ওরা? অদূরবর্তী মিরপুর দূরবর্তী ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ, কেরানিগঞ্জ, সাভার, নরসিংদী, উত্তরা, টঙ্গী, গাজীপুর, রূপগঞ্জ, কালীগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে ওদের ঘর-গেরস্থালি। এদের একটা অংশ দূর জেলার স্থায়ী বাসিন্দা। মূল শহর তাদের স্বপ্ন মাত্র। তাই ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে সস্তায় বাড়ি ভাড়া কিংবা দু-চার কাঠা জমি-জিরেত কিনে ওরা আধাপাকা ঘর তোলে। যেন উঁইপোকার জীবন। দিন যায়। রাত নামে।
কলকাতার নিত্যযাত্রী অফিসকর্মী বা কেরানিদের জীবন বড় বিচিত্র। মগজের ভেতর কিলবিল করে ঈশ্বরের দান একটি চাকরি এবং স্বপ্নের সংসার। চাকরির প্রতীক্ষায় হারাতে বসে যৌবন। অবসাদ-বিষণ্নতায় ঘটে আত্মহত্যা। মাত্র একটা চাকরি। ভাগ্যের চাকা ঘুরলে চাকরি হয়। তখন চলে দেবতার কাছে মানতের ঋণশোধ। চাকরি হলেই স্বপ্নে জাগে একটি নারী, স্ত্রী পদবির নারী আর অনাগত সন্তানের কল্পনা। অপার সুখ, অন্তহীন শান্তি ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায় মনের ভেতর। এখানে বৈবাহিক জীবনের সঙ্গে চাকরি প্রাপ্তি এক জটিল খেলা চলে। স্ত্রী নামক নারীর সঙ্গে একজন দীর্ঘ বেকার জীবনের যন্ত্রণা ভোগা যুবকের সংযোগ ঘটলেই চিরদিনের পিতামাতার সংসার আর পিতামাতা, ভাই-বোন নামের প্রিয় মানুষ আর সম্পর্কগুলোতে ভাঙনের প্রতিধ্বনি ওঠে। সমাজ আর রাষ্ট্রের বলে দেয়া ‘মাইক্রো ফ্যামেলি’ হাতছানি দেয়। সেই মাইক্রো ফ্যামেলির অধিশ্বরী স্ত্রী রাত তিনটের ঘুম ভেঙে তৈরি করে ভাত, তরকারি, সবজি এবং অতিরিক্ত প্রোটিনের জন্য সেদ্ধ ডিমের অর্ধেক টিফিন ক্যারিয়ারে ঢুকিয়ে দিয়ে পুনরায় ঘুমোতে যায়। ভোর পৌনে ৫টার লোকালে চেপে শহর কলকাতা যাবে বলে ছুটতে থাকে স্টেশনের উদ্দেশে। যেতে হবে ধর্মতলা কিংবা নবাব রফী আহমেদ কিদোয়াই রোড। দিনান্তের ট্রেনে চিড়ে চ্যাপা হয়ে ঘরে ফেরে কেরানি। শরীর না-তো লাশ। শার্ট-প্যান্টে ঘামের গন্ধ নয় তো মর্গের লাশের গন্ধ।
ঢাকাইয়া কেরানির অন্দর মহল কেমন? ওরা নিত্যযাত্রী নয়। তাদের সদ্য বিবাহিতা যুবতী স্ত্রীদের স্বামীর সঙ্গে একটা সেদ্ধ ডিমকে আধাআধি ভাগ করে ভালোবাসার সাম্যবাদকে চর্চা করতে হয় না। বরং ওরা যতীন্দ্রমোহন বাগচির ‘অন্ধবধূ’ কবিতার অন্ধবধূর মতো। অন্ধবধূর স্বামী দীর্ঘ প্রবাসী। স্বামীর ঘরে ফেরার প্রতীক্ষায় মাসের পর মাস যায়। বর্ষায় ভরা দীঘির জল কমতে থাকলে ননদিনীর হাত ধরে পায়ের তলার সিঁড়ি গুণে অন্ধবধূ বুঝতে পারে সময় কত গড়িয়েছে। জল আনতে গেলে পায়ের তলায় বকুল ফুল পড়লে বুঝতে পারে বসন্ত এসেছে। ননদিনীর প্রতি তার আর্ত জিজ্ঞাসা, ‘একি ঝরা বকুল নয়?’
কেন এমন হলো? ঢাকাইয়া কেরানির তো এলেম নেই শহরের ভাড়া ঘরে বৌ নিয়ে থাকার। সাপ্তাহিক ছুটি কিংবা মাসে একবার তাইতো ছুটে যেতে হয় মফস্বল কিংবা গ্রামের বাড়ি। সঙ্গে গুলিস্তানের ফুটপাতের সস্তা জামা কাপড়, শাড়ি, বোরখা, স্নো-পাউডার। রোজার মাসে সঙ্গে যাবে বায়তুল মোকাররম থেকে কেনা জায়নামাজ কিংবা কিতাব-কোরআনের রেহেল। শহর থেকে একজন গাঁয়ে ফেরা কেরানির সঙ্গী হয় প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ আর ক্ষমতা। অন্যদিকে বৃদ্ধ পিতার সন্তানের কাছে প্রাপ্তি তো জায়নামাজ কিংবা পবিত্র গ্রন্থ। আর…আর ওই যে চিরকালের পারিবারিক সম্পর্ক।
বিশ্ব বাঙালি কেরানিকূলের ভেতর একমাত্র বাংলাদেশের কেরানিরাই মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামে তারা সরাসরি অংশ গ্রহণ করেছে। এভাবে নিজেদের রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। পরিবেশ এবং ভৌগোলিক কারণও রয়েছে। মতিঝিল, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, পল্টন, তোপখানা রোড, নীলক্ষেত, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মতো স্থানকে ঘিরেই বাংলাদেশের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে। মিটিং, মিছিল, লড়াইয়ের ঐতিহ্যবাহী এসব এলাকা। অন্যদিকে সচিবালয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্যিক নানা অফিস, রাজনৈতিক দলের প্রধান কার্যালয়ও এসব এলাকা ঘিরে। এসব পরিবেশ ঘটনাবলি অফিস কেরানিদের মনে প্রভাব ফেলেছে। একঘেয়ে জীবনকেও নাড়া দিয়ে গেছে। ভেতর থেকে বদলের তাগিদও অনুভব করেছে কেউ কেউ।
স্বাধীনতার পূর্বকাল থেকেই কেরানিরা ঢাকা শহরে বসবাসের অধিকার পায় পরিবার সমেত। কমলাপুর, মতিঝিল, পল্টন, মিরপুর সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণির কর্মীবাহিনীর জন্যও গৃহ নির্মাণ শুরু হয়। এর ফলে গ্রামে জন্ম নেয়া কেরানিরাও শহরে বসবাসের সুযোগ পায় সামান্য অর্থের বিনিময়ে। সামাজিক অনগ্রসরতার কারণে বহুসংখ্যক কেরানিবধূই গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাসের অধিকার পায়নি। তাছাড়া এই যে কেরানি সমাজ, রাষ্ট্র যে কিভাবে তাদের শ্রেণি নির্ধারণ করে দেয় তার জলজ্যান্ত প্রমাণ তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণি নাম নির্ধারণ করা কেরানিদের জন্য নির্মাণ করা আবাসন। কবরের গর্তও এর চেয়ে সুখপ্রদ। কত টাইপের যে কোয়ার্টার। এ থেকে জেড টাইপ!
কেরানি বা নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীদের জীবনের গতির বাঁক বদল ঘটায় ইউরোপে বাইসাইকেল আবিষ্কারের ফলে। শিল্প বিপ্লবের সময় পায়ে চালানে এক চক্রযানটি কাজের জায়গায় যাতায়াতের শ্রম আর সময় দুটিই কমিয়ে দেয়। উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বাইসাইলের একটা ভূমিকা ছিল। গ্রামে-গঞ্জে পুলিশি শাসন কায়েম থেকে শুরু করে, খাজনা আদায়, নীল চাষ আর ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে বাইসাইকেলের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। কলকাতার কেরানিরা অফিসের শ্বেতাঙ্গ কর্মকর্তার কাছ থেকে বাইসাইকেল চালানো শেখে। এর ফলে কর্মদিবস যেমনি রক্ষা পায়, তেমনি বেঁচে যায় ট্রাম ভাড়া। স্বাধীনতা পূর্বে ঢাকা শহরে বাইসাইকেলের বেশ প্রভাব ছিল। ঢাকা শহরে এবং শহরতলীতে বসবাস করা কেরানিদের মূল বাহনই ছিল বাইসাইকেল। তাছাড়া সমাজে বাইসাইকেল এতটাই মর্যাদার ছিল যে, কন্যার বিবাহে পিতাকে যৌতুক হিসেবে বাইসাইকেল দান জামাইয়ের মনগলানোর অন্যতম কৌশল ছিল।
প্রযুক্তি বদল বা কম্পিউটার যখন অফিস পাড়ায় ঢুকে যায় তখন আচমকাই সনাতনী কর্মসংস্কৃতির ভিত ভেঙে পড়ে। উপনিবেশিক যুগে ফার্সির বদলে ইংরেজি সরকারি দাপ্তরিক ভাষা প্রচলিত হলে বেকায়দায় পড়েছিল ফার্সি জানা হিন্দু কেরানিরা। ঢাকার কেরানিরাও একই ফেসাদে পড়েছিল। বাধ্য হয় তারা প্রযুক্তিটি রপ্ত করতে। দেখতে দেখতে অফিসের মান্ধাতার আমলের চেয়ার-টেবিল-লেজার বুকও বদলে যায়। কলম পেশা কেরানিরা কিবোর্ড টেপা কেরানি বনে যায়। এই কর্মসংস্কৃতি আমূল পাল্টে গেলেও কেরানিকূলের প্রতি সমাজের মনোভাব পাল্টায়নি। প্রযুক্তির আগমনে কর্মসংস্কৃতি বদলালেও কেরানির জায়গায় পড়ে থাকে কেরানি, মর্যাদা অর্জন করে উঠে দাঁড়িয়ে ইতিহাসে স্থান পায়নি আজো তারা।
সামন্ত সংস্কৃতি থেকে ওঠে আসা একটি বচন বাঙালিরা দীর্ঘবছর কপচে গেছে। ‘অন্যের গোলামী’। জমিদার পরিবারের উচ্চবর্ণের ইংরেজি জানা ভদ্রলোকেরা ইংরেজের অধীনে কেরানির চাকরিতে অবজ্ঞা করতেন। তারা ইংরেজ অধীন বাঙালি কেরানিদের দুর্দশার কথা জানতেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে এরা ভীষণ রকম জাতীয়তাবাদী ছিলেন। উপনিবেশবাদীরা বাঙালি হিন্দু-মুসলমান অভিজাততন্ত্রের এই মনোভাব জানত। সুকৌশলে নিজেদের তৈরি কেরানি সমাজকে অবজ্ঞা করতে তাদের শিখিয়েছিল। কেরানিদের কোনো শ্রেণি-পরিচয়ও দেয়নি তারা। বিষয়টি অনেকটা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের বর্ণ পরিচয়ের বাইরে ঠেলে দেয়া অন্ত্যজ সমাজের মতো।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব পরিবেশ এই ‘শ্রেণিহীন’ শ্রেণিটির ভেতর আলোড়ন তুলেছিল বটে, কিন্তু অধস্তন সমাজটিকে ‘মাছিমারা কেরানি’ অপবাদ থেকে মুক্ত হতে দেয়নি। উপনিবেশিক প্রভুদের মতো আজো উচ্চপদের অফিস কর্তারা তাদের দেখতে চায় মাথানত, অনুগত, আদেশ নির্দেশ পালনকারী কলম-কম্পিউটার টেপা মানুষ হিসেবে। উপনিবেশ আনুগত্যের ঐতিহ্যবাহী এই কেরানিরা আজো বসের পাদুকার শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের কর্মচারী সমাজে আজো তারা হীনজন বর্ণবহির্ভূত পতিত হয়েই রইল। পেশাজীবী সমাজের এই নিম্নবর্গ শ্রেণিটি সামাজিক স্বীকৃতির লড়াইয়ের পরিবর্তে প্রমোশন পেয়ে উচ্চবর্গের একেবারে শেষ প্রান্তে স্থান পাবার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টায় রত। কেরানিদের প্রতি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি পরিবর্তনের সংগ্রামে ওরা আগ্রহী নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন সমষ্টিগত মানুষের পাশাপাশি তাদেরও স্বাধীন মর্যাদাশীল মানুষে বিবর্তিত করতে পারল না। বসকে তোয়াজ করার মানস থেকে দিল না মুক্তি।
এই অবহেলিত, মর্যাদাশূন্য কেরানিরাই রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখে। রক্ত সঞ্চালন করে ধমনীতে। সরকারের সব কার্যক্রম ওরাই চালনা করে। সামান্য মাস-মাইনের সঙ্গে যৎকিঞ্চিত ঈদ বোনাসেই তৃপ্তির হাসিটা হাসতে হয় তাদের। অবসরপরবর্তী পেনশনের স্বপ্ন দেখতে দেখতেই জীবনাবসান ঘটে তাদের। উপনিবেশবাদের সৃষ্টি কেরানিকূল ঐতিহাসিক কার্যকারণের ভেতর দিয়ে টিকে আছে, টিকে থাকবেও। অথচ নীরবে বয়ে চলবে উত্তর উপনিবেশের সময়-স্রোত। স্বাধীনতার ভেতর উপনিবেশিক পরাধীনতার আশ্চর্য বিস্ময়। রাজনৈতিক স্বাধীনতা কি তাদের মুক্তি এনে দিতে পারল টেবিলে রাখা নথিপত্রের স্তূপে নুয়ে পড়া মাথাকে?

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়