গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

আলোকিত ফুল : মুহাম্মদ সারোয়ার হোসেন > উপন্যাস

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মৃন্ময়ীর বাবা-মা এখনও ঘুমুচ্ছে। জানালার পর্দার ফাঁক গলে ঘরে প্রবেশ করা আলোর খেলা দেখে অলস সময় কাটাতে থাকে মৃন্ময়ী। মৃদু বাতাসে পর্দাগুলো দুলে ওঠে সেই সাথে আলোকরশ্মিও নেচে ওঠে। অসম্ভব ভালো লাগে তার! পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে জানান দিচ্ছে সকাল হয়েছে, এবার জেগে ওঠো। ‘মোয়া নিবেন মোয়া, মুড়ির মোয়া।’ হাঁকটা শুনেই ভোঁ দৌড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় মৃন্ময়ী। গ্রিল বেয়ে উঠে যাওয়া নীলপারুল গাছ পুরো বারান্দাজুড়ে রাজত্ব করছে। ঝোপালো চিরসবুজ এই নীলপারুলের লতা গ্রিল বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে মাঝারি ঝোপের আকৃতি নিয়েছে। মৃন্ময়ী একটি পাতা ছিঁড়ে নাকে শুঁকে, কেমন যেন রসুনের মতো গন্ধ লাগে! বারান্দার হাল্কা ছায়া-রোদের উপযোগী পরিবেশে বেশ জেঁকে বসেছে নীলপারুল গাছটি। বছর দুই আগে মৃন্ময়ীর আম্মু বৃক্ষমেলা থেকে নীরপারুল গাছটা কিনে দিয়েছিলো। তারপর থেকেই মৃন্ময়ীর দিনরাত একই চিন্তা, কোনদিন নীলপারুল ফুল ফুটবে? প্রায়ই তার আম্মুকে প্রশ্ন করে, আম্মু কখন গাছে ফুল ফুটবে?
এইতো আর মাত্র কয়েকদিন পর।
আম্মু, নীলপারুল ফুলের রঙ কি নীল?
ঠিক নীল না, হাল্কা বেগুনী।
ফুলগুলো কি অনেক বড় হয়?
অত বড় হয় না, তবে বড় বড় থোকায় একসাথে অনেক ফুল ফোটে।
ফুলের কি গন্ধ আছে?
হুম, খুব মিষ্টি গন্ধ।
আম্মু, ফুলগুলো ফুটলে আমি বারান্দার দরজা সব সময় খোলা রাখবো।
কেন?
ফুলের গন্ধে আমার ঘর মিষ্টি মিষ্টি লাগবে তাই।
হা হা হা, তোমারতো অনেক বুদ্ধি।
হুম, বাবারও অনেক বুদ্ধি ঠিক আমার মতো। আম্মু, প্রথম ফুল ফুটলে নিনাকে দিবো।
আচ্ছা দিও।
আব্বুকেও দিবো।
আচ্ছা।
আম্মু, কোনদিন ফুল ফুটবে? বলো না?

তুমি ল²ী হয়ে মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করো তাহলেই ফুল ফুটবে।

মৃন্ময়ীদের বাসা মিরপুরে। সাততলা অ্যাপার্টমেন্টের চার তলায় থাকে তারা। তার আব্বু-আম্মু দু’জনেই ডাক্তার। আব্বু-আম্মু, একবছরের ছোট বোন সপ্তর্ষী, মেরী আর হ্যারীকে নিয়েই তাদের পরিবার। মেরী আর হ্যারী বিড়াল দুটি মৃন্ময়ীর জান। এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজে ক্লাস ফোরে পড়ে সে। শান্ত-স্থির স্বভাবের মৃন্ময়ীর গায়ের রং ফর্সা, ঘন কালো চুল, খাড়া নাক আর ভাসা ভাসা কালো চোখের জন্য তাকে দেখতে অনেকটা গ্রিক দেবীর মতো লাগে! আম্মু আদর করে তাকে ইন্দিরা গান্ধী বলে ডাকে। শ্যামলীতে মৃন্ময়ীদের নানাবাড়ি। নানু ভাইকে আদর করে নিনা বলে ডাকে সে। নিনার সাথে তার খুব ভাব-ভালোবাসা। জন্মের পর থেকে নিনাকেই সবচেয়ে কাছে পেয়েছে সে। তার যত কথা, রাগ, ক্ষোভ আর বিচিত্র সব আবদার সবই নিনার কাছে। নিনাকে ছাড়া সে এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। তাইতো শ্যামলীতে নিজের বাসা ছেড়ে, নিনা মাঝে মাঝেই মিরপুরে এসে থাকতে বাধ্য হোন। মৃন্ময়ীর প্রাত্যহিক রুটিন শুরু হয় ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার মধ্য দিয়ে। ঘুম থেকে উঠেই তড়িঘড়ি করে তৈরি হয়ে নেয় সে। তারপর আব্বুর সাথে বের হয় বাসা থেকে। গাড়িতে চড়ে বাবার সাথে স্কুলে যাওয়ার সময়টুকু মৃন্ময়ীর খুব উপভোগ করে। এ সময় বাবার সাথে সমসাময়িক বিবিধ সমস্যা নিয়ে বড়দের মতন কথা বলে সে। আব্বুও ব্যাপারটা উপভোগ করেন বলেই আলোচনায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেন। বাপ-বেটির উপভোগ্য এই কথোপকথন অবলোকন করে গভীর আনন্দ পায় মৃন্ময়ীদের গাড়ির ড্রাইভার রানা। রানা আংকেলকেও মৃন্ময়ী পছন্দ করে। স্কুলের বন্ধুদের সাথে ঝগড়াবিষয়ক অনেক কথা রানা আংকেলের সাথে শেয়ার করে সে। ‘মোয়া নিবেন মোয়া, মুড়ির মোয়া।’ হাঁক দিয়ে রোজ সকালে লাবণী মুড়ির মোয়া ফেরি করে বিক্রি করে। লাবণীর বয়স মৃন্ময়ীর মতোই, ১০ বছর! বড় পলিথিনের বস্তা কাঁধে চাপিয়ে মুড়ির মোয়া ফেরি করে সে। শুকনা-পাতলা গড়নের লাবণীরা চার বোন, দুই ভাই। তার বাবা সালাউদ্দিন মিয়া অটোরিকশা চালায়। সালাউদ্দিন মিয়ার নিজের কোনো অটোরিকশা নাই। মহাজনের কাছ থেকে ভাড়ায় নেয়া অটো সারাদিন চালিয়ে রাতে বাড়ি ফিরে যান। যাওয়ার সময় লাবণীদের জন্য চাল-ডাল, আলু-তেল কিনে আনেন। তার মা ময়না বেগম মানুষের বাসায় ঝি-এর কাজ করে। লাবণীর ছোট ভাইয়ের বয়স মাত্র ৬ মাস, তাই তার মা এখন কোথাও কাজে যেতে পারে না। লাবণী ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছিলো, তারপর আর স্কুলে যেতে পারেনি। পড়ালেখা বাদ দিয়ে সংসার চালানোর প্রয়োজনে, মুড়ির মোয়া রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে বেড়ায় সে। মৃন্ময়ীদের বাসায় যখন লাবণীর মা কাজ করত, তখন মায়ের সাথে সেও আসত। সেই সময় থেকে মৃন্ময়ীর সাথে তার ভাব। খেলার সাথী হয়ে মৃন্ময়ীও তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার কথা জানতে পারে। আজ শীতের মধ্যে লাবণী মোয়া বিক্রি করতে বের হয়েছে, ভেবেই মৃন্ময়ীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। চার তলার বারান্দা থেকে মৃন্ময়ী কথা বলা শুরু করে।
লাবণী, কেমন আছো? লাবণী? ওই লাবণী? শুনতে পাও না?
কেডা? কেডা ডাকে? মৃন্ময়ী?
হুম, আমি মৃন্ময়ী। তুমি কেমন আছো লাবণী? তোমার ছোট ভাইটা কেমন আছে?
ভালা আছি। আমার ছোড ভাইডাও ভালা আছে। তুমি কেমন আছো?
আমিও ভালো আছি। তোমার ছোট ভাইয়ের নাম রেখেছো?
ছোট ভাইয়ের নাম রাখছি বাদশা। বাদশা ভালা আছে। তোমার বইন সপ্তর্ষী কেমন আছে?
ভালো আছে। কিন্তু সে খুউব দুষ্টুমি করে। খালি বিছানা থেকে নেমে পড়তে চায়।
জানো, আমাদের মেরীর না বাবু হবে!
কেমনে বুঝলা?
সারাক্ষণ একা একা চুপচাপ বসে থাকে, শুধু ঘুমায়। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিছে। বাসায় আসো। দেখে যাও।
আইজকা পারুম না। ম্যালা কাম আছে। আরেকদিন আহুম নে।
লাবণী, তোমার গায়ের গরম কাপড় কই? ঠান্ডা লাগে না?
নাহ্ লাগে না। দেখতাছো না হাঁটতাছি। বেশি হাঁটলে শইল্যে গরম লাগে।
আজকে মোয়া বিক্রি কেমন হয়েছে? কত টাকা পেয়েছো? সব মোয়াতো দেখি শেষ হয়ে গেছে।
২৭৫ টাকা পাইছি। মোয়া খাইবা?
নাহ্। তুমি বাসায় এসো। একসাথে খেলব।
আহুমনে। অহন যাই।
মোয়া নিবেন মোয়া, মুড়ির মোয়া।

বারান্দার গ্রিল ধরে লাবণীর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে মৃন্ময়ী। লাবণীর কথা ভাবতে ভাবতে উদাস হয়ে পড়ে সে। সপ্তর্ষীর কান্নার শব্দ আসছে। দৌড়ে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে মৃন্ময়ী। তার আব্বু-আম্মু ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন। আব্বুর কোলে সপ্তর্ষী কাঁদছে। মৃন্ময়ীর আম্মু সকালের নাস্তা বানাচ্ছেন। কাজের বুয়া এখনও আসে নাই। দুধ খেয়ে সপ্তর্ষী আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে। দরজার নিচ দিয়ে খবরের কাগজ ঢুকে খসখস শব্দে। মৃন্ময়ী কাগজ তুলে নিয়ে বাবার হাতে দেয়। মৃন্ময়ীর বাবা ডা. নাজমুল সাহেব সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়তে শুরু করেন। সে তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকে। নাজমুল সাহেব জানেন এটা বড় মেয়ের ট্রেড মার্ক আহ্লাদী ভাব। যখন মেয়ের কোনো বিশেষ বায়না কিংবা আবদার থাকে তখনই সে এমনটা করে।
মৃন্ময়ী তার বাবাকে প্রশ্ন করে, আব্বু, আজকে তো তোমার অফিস নাই। হাসপাতালেও যেতে হবে না?
ডা. নাজমুল উত্তর দেন, হুম, আজকে সরকারি ছুটি। হাসপাতাল এবং চেম্বার বন্ধ।
আব্বু, বেড়াতে নিয়ে যাবে? অনেকদিন হয়ে গেলো, কোথাও যাই না।
কোথায় যেতে চাও?
চলো না আব্বু, নিনার বাড়ি যাই। নিনাকে অনেক দিন দেখি না। প্রজন্ম, সৃজন ভাইয়া, শ্রেয়া আপ্পি আর অহনা খালাকে খুব মনে পড়ছে।
তোমার স্কুল বন্ধ হবে কোন দিন থেকে?
ছোট ঈদের ছুটির কথা বলছো? এইতো সামনের সপ্তাহেই ছুটি হবে। মিস বলেছেন, আমরা যেন এই কয়েকটা দিন নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকি।
পড়াশোনা কেমন চলছে? অঙ্ক পারতো? বাসায় টিচার আসেনতো প্রতিদিন।
ভালোই চলছে, আব্বু। লিটন স্যার প্রত্যেক দিনই আসেন। স্যার আমার অঙ্ক পরীক্ষা নিয়েছেন গতকাল।
কত পেয়েছো?
১০০ তে ১০০।
ভেরি গুড। মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে তোমাকে অনেক বড় পাইলট হতে হবে। আমি যখন বুড়ো হয়ে যাব, তখন তোমার বিমানে চড়ে পুরো পৃথিবী ঘুরে বেড়াব।
আব্বু, আমার জন্য দোয়া করো। চলো না নিনার বাড়ি যাই।
আচ্ছা। তাহলে তাড়াতাড়ি গোসল করে তৈরি হয়ে নাও।
মেরী আর হ্যারীকে সাথে নিই। তারাওতো অনেকদিন কোথাও যায় না।
ঠিক আছে। তাদেরও সাথে নিয়ে নাও।
আব্বু, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
বলো।
লাবণীরা কি খুব গরিব?
কেন বলছো এমন কথা?
নাহ্, এমনি। আজকে ভোরবেলায় দেখলাম ঠান্ডার মধ্যে লাবণী পাতলা একটা জামা পড়ে মুড়ির মোয়া বিক্রি করছে। বাহিরে এত্ত শীত! কি কন্কনে ঠান্ডা বাতাস আর ঘন কুয়াশা? তার মধ্যে সে খালি পায়ে আর সুয়েটার ছাড়া বাহিরে বের হয়েছে।

মেয়ের কথায় নিশ্চুপ হয়ে যান ডাক্তার সাহেব। মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। বড় মেয়েটা খুব আবেগী হয়েছে, অনেকটা তার মা মীরার মতো। আশপাশে কেউ কষ্টে আছে দেখলে সে অস্থির হয়ে ওঠে। মন খারাপ করে চুপচাপ একাকী বসে থাকে। তারপরই বাবার কাছে ইনিয়ে-বিনিয়ে সমস্যার সমাধান চায়। বড় মেয়ের এই মানবিক আবেগকে ভালোবাসেন এবং প্রশ্রয়ও দেন নাজমুল সাহেব। তিনি চান তার দুই মেয়ে মানবিক গুণাবলির সমন্বয়ে আলোকিত মানুষ হয়ে গড়ে উঠুক। আভিজাত্য, প্রাচুর্য, বিত্ত-বৈভব তাদের মোহগ্রস্ত করে অহংকারী মানুষ বানিয়ে ফেলুক- এটা তিনি কল্পনাতেও ভাবতে চান না। এ কারণে মাঝেমধ্যেই তিনি বড় মেয়ের সাথে, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন এবং তার কাছে প্রাসঙ্গিক মতামত জানতে চান। সামাজিক শ্রেণিবৈষম্যের নিষ্ঠুর কষাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত সমাজটিকে, মৃন্ময়ীর মতো আগামী দিনের প্রতিনিধিরা আমূল বদলে ফেলুক, এটাই নাজমুল সাহেবের চাওয়া। আগামী দিনের প্রতিনিধিরা আলোকিত বাংলাদেশ গড়ে তুলছে, এমন স্বপ্নই তিনি প্রতিনিয়ত দেখেন।
মৃন্ময়ী বলে, আব্বু, ও আব্বু? কিছু বলছো না কেন?
নাজমুল সাহেব বলেন, কী বলব?
এই যে লাবণীদের কথা বলছিলাম, তারা কি অনেক গরিব?
মা-রে, এই পৃথিবীতে কেউ গরিব হয়ে জন্ম নেয় না। আল্লাহতায়ালা তাঁর সব বান্দাকে সমানভাবে ভালোবাসেন। তাঁর ভালোবাসায় ধনী-গরিব ভেদাভেদ নাই। পৃথিবীর সকল বান্দার জন্য আল্লাহতায়ালার ভালোবাসা সমান, যারা সমাজে কষ্টে আছেন, তাদেরকে তিঁনি পরীক্ষা নিচ্ছেন। সেই পরীক্ষায় ধৈর্য ধরে পাস করলেই সাময়িক কষ্টে থাকা মানুষগুলো সুখের মুখ দেখে। আল্লাহতায়ালা দেখতে চান কষ্টের মধ্যে তাঁর বান্দা তাঁকে ভুলে গেলো কিনা?
তার মানে আল্লাহ লাবণীদের এখন পরীক্ষা নিচ্ছেন?
হুম।
এই পরীক্ষায় ধৈর্য ধরে, আল্লাহ্র নাম নিলেই লাবণীরা বড়লোক হয়ে যাবে?
হুম।
এই পরীক্ষা আর কতদিন চলবে?
তাতো মা আমি বলতে পারব না, এটা শুধু আল্লাহই জানেন। এই পরীক্ষা কয়েক দিনেরও হতে পারে, আবার কয়েক বছরেরও হতে পারে। মৃন্ময়ী, তোমার ওস্তাদজী আসেন না?
আসেনতো, আব্বু। গত পরশুও এসেছিলেন। ওস্তাদজী সপ্তাহে তিন দিন আসেন।
কুরআন শরিফের কত পারা পর্যন্ত পড়েছো?
২২ পারা পর্যন্ত পড়েছি।
মাশাল্লাহ্। এই রোজায় খতম হবে তো ইনশাহ্আল্লাহ্?
ইনশাহ্আল্লাহ্ হয়ে যাবে। ওস্তাদজীও তাই বলেছেন।
কুরআন শরিফ খতম হয়ে গেলে বাসায় একটা মিলাদ দিবো ভাবছি।
আব্বু, মিলাদে লাবণীদের দাওয়াত দিবো না?
অবশ্যই দিবো মা। তোমার পরিচিত সবাইকে দাওয়াত দিবো।
আব্বু, তোমার মোবাইল ফোনের রিং বাজছে।
নিয়ে আসোতো মা।
আব্বু, নিন ফোন করেছেন।
তুমিই কথা বলো।
হ্যালো নিন, আসসালামু আলাইকুম। তুমি কেমন আছো?

মৃন্ময়ী, এই মৃন্ময়ী? খেতে আসো তাড়াতাড়ি। বেলা হয়ে গেছে। খেতে আসো। মৃন্ময়ীর আব্বু? কই গেলো সবাই? তোমরা কোথায়? মৃন্ময়ীর আম্মু মীরা খানের ডাকে দু’জনেই উঠে পড়ে।
মৃন্ময়ী বলল, আম্মু আসছি। চলো আব্বু।

খাবার টেবিলে বসে মৃন্ময়ীর মা সবাইকে নাস্তা উঠিয়ে দেন। নাজমুল সাহেবের প্লেটে ২টা রুটি দেন আর ১টা সিদ্ধ ডিম কুসুম ছাড়া। মৃন্ময়ীর ডিমপোচ খুব পছন্দ। আধাসিদ্ধ ডিমপোচের এককোনা ফুটো করে, সুরুৎ করে তরল লালচে-হলদে কুসুমটুকু এক চুমুকে সাবাড় করে ফেলে মৃন্ময়ী। ডিমপোচ খেয়েই আব্বু-আম্মুর দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠে সে। বড় মেয়ের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে নাজমুল সাহেব ভাবেন, মেয়েটা দেখতে অপ্সরীর মতো হয়েছে। আল্লাহ্তায়ালা যেন তাকে মানুষের মতো মানুষ বানিয়ে বড় করে। শীতের সবজি শিম সাথে নতুন লাল আলু ভাজি করা হয়েছে।
নাজমুল সাহেব শিম-আলু ভাজি খেতে খেতে বললেন, চলো মীরা, আজকে শ্যামলী থেকে ঘুরে আসি।
মীরা বললেন, আজকে যাবা? আজ না আমাদের ঈদের শপিংয়ে যাওয়ার কথা?
নাজমুল বললেন, শ্যামলী হয়ে গেলে কেমন হয়? দুপুরে ওখানে খেয়ে তারপর বিকালে শপিংয়ে গেলাম। তাছাড়া সপ্তর্ষীকে কোথায় রেখে যাবো? মায়ের কাছে রেখে তারপর গেলে সুবিধা হয় না?
মীরা বললেন, ভালোই বলেছো। চলো যাই তাহলে। অনেক দিন হয়ে গেলো আম্মাকে দেখি না। বড় ভাইয়া বলল, ভাবীর শরীরটাও বেশি ভালো না। বড় ভাবীকে দেখে আসাও প্রয়োজন।
মৃন্ময়ী বলে, আম্মু, আমি কয়েক দিন থেকে আসি শ্যামলীতে?
মীরা বললেন, তোমার না স্কুল খোলা? স্কুল বন্ধ হোক, তারপর।

নাস্তা শেষ করে, নাজমুল সাহেব বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বের হোন। মৃন্ময়ীর আবদার, তাকেও সাথে নিতে হবে। লিফট দিয়ে নামার সময় দেখা হয় চার তলার কামাল সাহেবের সাথে। ভদ্রলোক সরকারি চাকরি করেন পেট্রোবাংলায়। তার মেয়ে শেফালি, মৃন্ময়ীর সাথে একই ক্লাসে পড়ে। কামাল সাহেবকে দেখেই মৃন্ময়ী সালাম দেয়।
হাসিমুখে কামাল সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বলেন, মৃন্ময়ী, মা-মণি, তুমি কেমন আছো? কোথায় যাচ্ছ?
মৃন্ময়ী বলে, আব্বুর সাথে বাজারে যাচ্ছি। আমি ভালো আছি আংকেল।
তোমার মেরী-হ্যারীর কী অবস্থা?
হ্যারী ভালো আছে, কিন্তু মেরী কেন যেন খেতে চায় না? সারাক্ষণ একা একা বসে থাকে। আংকেল শেফালি কোথায়?
শেফালি? আর বলো না। তার দাদুর সাথে সকাল বেলা চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গিয়েছে। চিড়িয়াখানায় নাকি বাঘের একটা বাচ্চা হয়েছে?
আমরাও বেড়াতে যাচ্ছি আজকে। নিনার বাড়ি যাচ্ছি। নিনা আমাদের দাওয়াত দিয়েছেন। জানো আংকেল, বড় মামা আমার জন্য একজোড়া ঘুঘু পাখি এনেছেন। ভারি সুন্দর নাকি দেখতে! শেফালিকে বলবে কিন্তু মনে করে।
আচ্ছা বলবো। তুমি মা বাসায় এসো।
আসবো আংকেল।

মৃন্ময়ীদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে, বড় রাস্তার দু’পাশে ভ্যানগাড়ি করে হরেক রকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে, দোকানিরা বেচাকেনায় ব্যস্ত। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এ বাজার বসে। তবে শুক্রবার ও শনিবার অন্যদিনের তুলনায় লোকজনের ভিড় বেশি থাকে। বাজারের সময় ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে বড় রাস্তাটি ক্রমেই সরু হতে হতে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, যে একটা রিকশা চলাচলের জায়গাটুকুও আর অবশিষ্ট থাকে না। তাই এই সময় পথচারীরা পারতপক্ষে বড় রাস্তা ধরে না গিয়ে বিকল্প রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে বাধ্য হয়। বাজারে কারো ভ্যানে লাউ, বেগুন, ফুলকপি, পাতাকপি, শিম, টমেটো, গাজর আবার কারো ভ্যানে কাঁচামরিচ, ধনিয়াপাতা কিংবা বিভিন্ন মৌসুমি শাক-সবজির বিচিত্র সমাহার ঘটে। ক্রেতা-বিক্রেতার হট্টগোলে কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা! তবে মাছ ব্যবসায়ীরা অন্য সবার থেকে আলাদা। তারা পৃথক এলাকাজুড়ে হট্টগোলে মশগুল হয়ে মাছ বিক্রি করে। মৃন্ময়ী খুব খেয়াল করে দেখেছে, মাছ বাজারে এলে আর সবার মতো আব্বুও গম্ভীর হয়ে যান। তার আব্বুর মতো শান্ত-স্থির মানুষও মাছের দরদাম বলতে বলতে মেজাজ হারিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কুচকুচে কালো গায়ের রঙ, দশাসই ভুঁড়ির মালিক রুস্তম মিয়ার কাছ থেকেই নাজমুল সাহেব সব সময় মাছ কিনে থাকেন। রুস্তম মিয়ার যেমন বিশাল ভপু ঠিক তেমনি পাহাড়সম উচ্চতা। বোঁচা নাক, পান খাওয়া কালচে-লাল দাঁত, মুখভর্তি বসন্তের দাগ, কপালে বড় এক কাটা দাগ আর অক্ষিকোটরে বসে যাওয়া মায়াহীন চোখ দুটো দেখে যে কেউ তাকে বোম্বেটে বলেই ধরে নেবে। শীত-গ্রীষ্ম, ঝড়-বৃষ্টি বারো মাসেই তার পরনে থাকে সফেদ লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। লাল রঙের একটা গামছা কোমরে বেঁধে, পান চিবুতে চিবুতে ক্রেতাদের সাথে গোমড়া মুখে মাছ বিক্রি করেন রুস্তম মিয়া। তবে মৃন্ময়ীর আব্বুকে খুব সম্মান করেন রুস্তম মিয়া। নাজমুল সাহেব তার সামনে আসা মাত্রই, দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বসে থাকা ছোট টুলটা এগিয়ে দেন। সব সময় নাজমুল সাহেবকে স্যার-স্যার বলে মাথা নিচু করে কথা বলে সে। রুস্তম মিয়া ছোট্ট টুলটায় কীভাবে তার বিশাল দেহ নিয়ে বসে থাকেন, তা মৃন্ময়ীর কাছে বিস্ময়কর লাগে! মৃন্ময়ীর দুশ্চিন্তা হয়, এই বুঝি টুলটা ঝুরঝর হয়ে ভেঙে পড়ল! ইয়া বড় কুচকুচে কালো পাকানো গোঁফে তা দিতে দিতে, একমনে রুস্তম চাচা যখন ক্রেতার কাছে মাছের দরদাম করতে থাকেন তখনও মৃন্ময়ীর নজর থাকে মচমচ শব্দে করুণ আর্তনাদ করে ওঠা ছোট্ট টুলটার দিকে! রুস্তম মিয়ার মাছের দোকানে বিভিন্ন কায়দায় মাছ বিক্রি হয়। বরফে রাখা মরা মাছগুলো রাস্তার ওপর পলিথিন কাগজ বিছিয়ে বিক্রি করেন তিনি আর জীবিত মাছগুলো বিক্রি হয় অভিনব এক পদ্ধতিতে! লোহার শিট দিয়ে বানানো ছোট্ট চৌবাচ্চায় পানি ভর্তি করে, তাতে ছেড়ে দেয়া হয় জ্যান্ত মাছগুলো। ছোট চৌবাচ্চায় রাখা বড়-বড় মাছগুলোর যেন অক্সিজেন সংকট না হয়, সে জন্য মোটরের সাহায্যে প্লাস্টিকের চিকন লম্বা টিউব দিয়ে সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। পানির উপরে ভেসে বেড়ানো অক্সিজেনের বুদবুদ দেখতে বেশ ভালো লাগে মৃন্ময়ীর। একটু বেশি দামে মাছ বিক্রির আশায়, রুস্তম মিয়া এই অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করে নিয়েছেন। ক্রেতারাও ফরমালিনমুক্ত জীবিত তাজা মাছ কেনার জন্য, একটু বেশি দাম দিতেও কার্পণ্যবোধ করেন না। আজকে রুস্তম মিয়ার দোকানে ১টা বড় আইড় মাছ দেখে দরদাম করেন নাজমুল সাহেব।
নাজমুল সাহেব বলেন, রুস্তম, তোমার আইড় মাছটার দাম কত? কেজি কত করে রাখতে পারবা?
রুস্তম মিয়া মাথা নিচু করে বলে, স্যার, কাইট্যা দিমু না আস্তা দিমু?
আস্তাই দাও। মৃন্ময়ীর নানাবাড়িতে নিয়ে যাবো। আগে দামটা বলো?
স্যার যে কি বলেন? দামাদামি আ¤েœর লগে? কারওয়ান বাজার মাছের আড়তের আজকের সেরা আইড় মাছ এইডা। আ¤েœর লাইগ্যাই আনছি।
স্যার, ব্যাগ আছে? না ব্যাগ আনামু।
ধুর পাগল! দামটা বলবাতো আগে?
দাম আমি কইতে পারুম না। আ¤েœ বাসায় চইল্যা যান। আমার লোক মাছ দিয়া আইবো।
এইটা কোনো কথা বললা তুমি? কেজি কত করে বলো?
আমার মতো হারামজাদা রুস্তম আ¤েœর লগে দাম কইবো? এর থাইক্যা জুতা দিয়া আমার গালে দুইডা মারেন।
বলে সত্যি সত্যি নিজের জুতা জোড়া হাতে উঠিয়ে নেয় রুস্তম মিয়া, নিজেই নিজের গালে সবার সামনে কয়েকটা চাপড় মারে। উপস্থিত জনতা অবাক হয়ে রুস্তমের কাণ্ডকারখানা দেখতে থাকে।
নাজমুল সাহেব একটু রাগত স্বরে বলেন, রুস্তম এরকম করলে কিন্তু, আমি আর কোনোদিন তোমার দোকানে আসব না!
রুস্তম মিয়া সাথে সাথে নাজমুল সাহেবের পায়ে পড়ে বলেন, স্যার, আমারে ক্ষমা কইরা দেন। আইজকা আমি রুস্তম নতুন জীবন পাইছি আ¤েœর লাইগ্যা, স্যার। পাপের পথ থাইক্যা আ¤েœ আমারে পুণ্যের পথে আনছেন। উপরে আল্লাহ সাক্ষী, আপনার ঋণ আমি কোনোদিনও শোধ করবার পারুম না।

অবস্থা বেগতিক, আর কথা না বাড়িয়ে পাঁচ হাজার টাকা কোনোমতে রুস্তম মিয়ার পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসেন নাজমুল সাহেব। কম করে হলেও ৭ কেজির নিচে হবে না মাছটা! মৃন্ময়ী খেয়াল করে দেখেছে, রুস্তম চাচা মাছ বিক্রি করে তার আব্বুর কাছ থেকে কখনো টাকা নিতে চান না। আবার আব্বুও কখনো মাছের দরদাম করে টাকা দেন না। মৃন্ময়ীর মনে হয়, প্রকৃত দামের চেয়ে আব্বু বেশি টাকাই দেন রুস্তম চাচাকে। রহস্যটা মৃন্ময়ীকে ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেয়।
আচ্ছা আব্বু, রুস্তম চাচা কেন তোমার কাছ থেকে মাছের দাম নিতে চান না?
জানি না মা।
কেন রুস্তম চাচা বলেন, তুমি তাকে নতুন জীবন দিয়েছো? কেন চাচা বলেন, তুমি তাকে পাপের পথ থেকে ভালো পথে এনেছো?
আজকে নাহ্ মা। বলবো সময় হলে।
আব্বু, দেখো কবুতরের বাচ্চা। কী সুন্দর! আব্বু, বাচ্চাগুলোর পশম কই?
বাচ্চাগুলো এখন খুব ছোট, তাই পশম গজায়নি। বড় হলে ধীরে ধীরে গজাবে।
বাচ্চাগুলোকে খাঁচার উপরে ছেড়ে রেখেছে কেন? উড়ে যাবে না?
মা, তাদের ডানার পালক এখনও ওঠেনি, তাই উড়তে পারবে না।
আব্বু, কবুতর কয়টা ডিম দেয়? কতদিন পর বাচ্চা দেয়?
১ জোড়া ছেলে ও মেয়ে কবুতর ২৮ দিন পরপর ১ জোড়া করে ডিম দেয়। প্রথম ডিমের ১ দিন পর দ্বিতীয় ডিম পাড়ে। তারপর মা আর বাবা কবুতর মিলে পালা করে সেই ডিম জোড়ায় উম দেয়। এভাবে ১৬-১৭ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে।
আব্বু, উম দেয়া কি?
উম হলো তাপ দেয়া। কবুতরের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার জন্য তাপের প্রয়োজন হয়।
আব্বু, জন্মের পর বাচ্চাগুলো কি খায়? অত্ত বড় বড় ধান-চাল, গম-ডাল খেতে পারে বাচ্চাগুলো?
নাজমুল সাহেব হেসে বলেন, নাহ্ মা। জন্মের পর এরা বাবা-মায়ের হজম হওয়া খাবার খায়।
কীভাবে আব্বু?
বাবা আর মা কবুতর এ সময় যে খাবার খায়, হজম হওয়া সেই খাবার তারা পেট থেকে উগলে উগলে এনে মুখ দিয়ে বাচ্চাগুলোকে খাওয়ায়। হজম হওয়া, উগলে দেয়া খাবারগুলো অর্ধ-কঠিন অনেকটা সাদা দুধের মতো। বাচ্চারা বড় হয়ে নিজের খাবার খেতে না পারা পর্যন্ত, এভাবেই তাদের খাওয়া চলতে থাকে।

বাসায় ফিরে মৃন্ময়ী সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত-মুখ ধুঁয়ে আব্বু-আম্মুর রুমে যায়। সপ্তর্ষী ঘুম থেকে উঠে বিছানায় হামাগুড়ি দিয়ে খেলছে আম্মুর সাথে। মৃন্ময়ীকে দেখেই খিল-খিল করে হেসে উঠে সপ্তর্ষী তার কোলে উঠতে চায়। মৃন্ময়ী তাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমের বারান্দায় আসে। সপ্তর্ষীকে বেবিসিডারে বসিয়ে টবের গাছে পানি দিতে থাকে সে। মিঞ মিঞ করে মেরী আর হ্যারী তার পাশে এসে দাঁড়ায়। মেরী আহ্লাদে মৃন্ময়ীর পা পেঁচিয়ে ধরে জিহ্বা দিয়ে চাটতে থাকে। এই খেলাটা মেরী শুধু তার সাথেই খেলে। যতক্ষণ না মেরীকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলানো হয় ততক্ষণ এটা চলতেই থাকবে। মৃন্ময়ী মেরীকে কোলে তুলে নেয়।
কিরে মেরী? ঘুম থেকে উঠছিস?
মিঞ, মিঞ।
পটি করছিস?
মিঞ, মিঞ।
হ্যারী, কী খবর তোর? রাতে ভালো ঘুম হয়েছে?
মিঞ, মিঞ।
চল, তোদের খাবার দিই। আজ তোদের খিচুড়ি আর মুরগির কলিজা খেতে দিবো।
মিঞ, মিঞ! মিঞ, মিঞ!

মৃন্ময়ী তার ছোট বোনকে নিয়ে ঘরে ফিরে আসে। বেশ কিছু কাজ জমে আছে। নিনার বাড়ি যাওয়ার আগে কাজগুলো গুছিয়ে ফেলতে হবে। নিজের ট্র্যাভেল ব্যাগটা খুঁজে বের করে তাতে কিছু কাপড়-চোপড়, বড় কাক্কুর দেয়া কিছু চকোলেট, শ্রেয়া আপ্পির জন্য সুকুমার রায়ের ছড়ার বই ঢুকিয়ে নেয় মৃন্ময়ী। আব্বু-আম্মুর রুমে গিয়ে দেখে আব্বু গোসল করতে ঢুকছেন। গামছা আর লুঙ্গি এনে বাবার হাতে দেয় সে। আজ শুক্রবার, আব্বু জুম্মার নামাজে যাবেন। ইস্ত্রি করে রাখা আব্বুর পাঞ্জাবি-পায়জামা খুঁজে বের করে বিছানার উপর রেখে, তারপর নিজে গোসল করতে যায় সে। বাথরুমে বসে ভাবতে থাকে সে, কেন রুস্তম চাচা আব্বুর কাছ থেকে মাছ কেনার টাকা নিতে চায় না? কেন রুস্তম চাচা বলেন, আব্বুর জন্যই তিনি ভালো পথে চলে আসতে পেরেছেন? এই রহস্য জানতেই হবে। প্রজন্মর সাথে কথা বলতে হবে। আরিশের সাথেও কথা বলা প্রয়োজন। সবাই মিলে বুদ্ধি-পরামর্শ করে এই রহস্য উন্মোচন করতেই হবে।

বাসার সবাই তৈরি হয়ে নেয়। নিনার জন্য বারান্দায় টবে লাগানো কাগজি লেবুগাছ থেকে লেবু পেড়ে আনে মৃন্ময়ী। তার নিনা লেবু খেতে পছন্দ করেন। নিনার একটা পোর্টেট এঁকেছে সে। বেশ কয়েকদিন ধরে আঁকার পর গত সপ্তাহে শেষ করেছে পোর্টেটটি। পোর্টেটটির বিশেষত্ব হলো, ঘরের যে কোনো অংশ থেকে এর দিকে তাকানো হোক না কেন, মনে হবে পোর্টেটের নিনা সেদিকেই তাকিয়ে আছেন। অনেক ভেবেচিন্তে, প্রচুর সময় নিয়ে ছবিটি এঁকেছে সে। নিজের প্রতিভায় নিজেই মন্ত্রমুগ্ধ মৃন্ময়ী। পোর্টেটটিও গুছিয়ে নিয়ে নেয় ব্যাগে। প্রজন্ম আর আরিশ ভাইয়ার জন্য আলাদা করে চকোলেট আর মিমির একটা বক্স নেয় সে। গেলো সপ্তাহে তার আব্বু চেম্বারে গিফট পেয়েছিলো, সে যতœ করে রেখে দিয়েছিলো। সবশেষে মেরী আর হ্যারীকে ঝুড়িতে ভরে নেয় সে।
মৃন্ময়ী তার আম্মুকে বলে, আম্মু, মেরী-হ্যারীর খাবার নিবো না?
মীরা বলেন, প্রয়োজন নাই, তোমার বড় মামার কাছে খাবার আছে।
তাদের পটি নিবো?
দরকার নাই। পটিও তোমার বড় মামার বাসায় আছে। তুমি শুধু সপ্তর্ষীর খেলনাগুলো মনে করে নিও।
ঠিক আছে আম্মু, নিয়ে নিচ্ছি। আম্মু, দাবার বোর্ডটা নিই?
আচ্ছা ঠিক আছে, নিয়ে নাও।
আম্মু, রানা আংকেল চলে আসছে। নিচে গাড়ি পরিষ্কার করছেন। আব্বুর মোবাইলে ফোন দিয়েছিলেন। চলো তাড়াতাড়ি নিচে নামি।
মীরা বলেন, চলো যাই।

গাড়িতে চড়ে মৃন্ময়ীরা নানাবাড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। সবাই একসাথে গাড়িতে উঠলে মৃন্ময়ী সব সময় সামনের সিটে বসে। আজও তাই হলো। গাড়ির পিছনে আব্বু-আম্মু, সপ্তর্ষী আর হ্যারী-মেরী। গাড়িতে বসে সব জায়গা থেকে উপরের নীল আকাশ দেখার সুযোগ হয় না, শুধু সামনের সিট বাদে। তাই সে সব সময় সামনে বসে, দূর নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো ধবধবে সাদা মেঘের খেলা দেখে। সাদা-সাদা মেঘগুলো কখনো ঘনকালো, কখনো হাল্কা কালো, কখনো গোলাপি, কখনো লাল আবার কখনোবা লালচে-গোলাপি বর্ণ ধারণ করে নীল আকাশে দিগি¦দিক ছুটে বেড়ায়। নীল আকাশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে বিচিত্র বর্ণ ও আকৃতির মেঘদলের ছুটে বেড়ানো সে খুব উপভোগ করে। আবার নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘদলের ফাঁক গলে সূর্যরশ্মির বিচ্ছুরিত আলো, মাটিতে নেমে এসে চুমু খাবার আগেই যেভাবে হারিয়ে যায়, সেই দৃশ্য দেখে অসম্ভব ভালো লাগে তার। এমনিতে সে রিকশায় চড়তেই বেশি ভালোবাসে। তাই বাবাকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই রিকশা করে ঘুরে বেড়ায়, তখন হাতে থাকে তার প্রিয় খাবার, আইসক্রিম! এছাড়া গাড়ির সামনের সিটে বসলে, নিজেকে বড় বড় মনে হয় মৃন্ময়ীর, অনেকটা তার আব্বুর মতো। তাই খুব গম্ভীর ভাবসাব নিয়ে সামনের সিটে হেলান দিয়ে, চারপাশের সবকিছু দেখতে দেখতে এগিয়ে যায় মৃন্ময়ী। গাড়ির আশপাশে নতুন কোনো কিছু কিংবা কৌতূহল-উদ্দীপক কিছু দেখেই প্রশ্নের কারখানা খুলে বসে সে। সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে গলদঘর্ম হয়ে ওঠেন কখনো নাজমুল সাহেব কখনোবা গাড়িচালক রানা।

শ্যামলীতে মৃন্ময়ীর নানা বাড়িটা চার তলা। এ তল্লাটে তার নানার বাড়িটাই সবচেয়ে পুরাতন। চার তলা বাড়িটির তিন এবং চার তলায় নিনা আর তার দুই মামা থাকেন। নিচের দুই তলা ভাড়া দেয়া। মৃন্ময়ীর নানাভাই মারা গেছেন ৪ বছর হলো। তিনি বেঁচে থাকাকালে তারা যখন এ বাড়িতে বেড়াতে আসত, তখন আনন্দ-উৎসবের বারিধারা বয়ে যেত। নানাভাই মারা যাওয়ার পর থেকে, এ বাড়ির সবাই হাসি-ঠাট্টা আর উৎসবের কথা ভুলে গেছে। এক সময়ের কোলাহলময় বাড়িটি এখন শ্মশানের মতো সুনসান এবং নিস্তব্ধ। কেমন যেন ¤øান হয়ে পড়েছে ‘ত্রিরতœ ভিলা’! নানাভাই শখ করে এ বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ‘ত্রিরতœ ভিলা’। তার তিনটি ছেলে-মেয়েই এ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং দেদীপ্যমান। তারা তিনজনেই অনেকটা রতেœর মতো অমূল্য তাই এমন নামকরণ। ‘ত্রিরতœ ভিলা’ সম্পূর্ণ নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন নানাভাই। এ বাড়িতেই জন্ম নিয়েছে তার তিন ছেলে-মেয়ে আর সব নাতি-নাতনি। প্রায় অর্ধশতাব্দী পুরনো এ বাড়ির আলো-বাতাসে মানুষ হয়েছে তার সন্তান আর নাতি-নাতনিরা। তাই অজ¯্র স্মৃতিবিজড়িত, পুরনো ধাঁচের এই বাড়িটি ভেঙে ফেলে, নতুন সুউচ্চ ইমারত বানাতে প্রবল আপত্তি সবার। যদিও রং ঝলসে প্রায় বিবর্ণ হয়ে পড়া ‘ত্রিরতœ ভিলা’-র কিছু অংশের ছাদ বা দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে, কয়েকটি দেয়ালে ছোট ছোট ফাটলও দেখা দিয়েছে। সবকিছু পরেও বাড়িটি সবার আবেগের জায়গা তদুপরি অনুভূতির অপর এক নাম! সবার কাছে মনে হয় ‘ত্রিরতœ ভিলা’-র প্রতিটি অংশে মৃন্ময়ীর নানাভাইয়ের স্পর্শ লেগে আছে।

মৃন্ময়ীর বড়মামা ডাক্তার, বড় মামীও ডাক্তার। তাদের এক ছেলে সৃজন আর এক মেয়ে শ্রেয়া। সৃজন ক্লাস নাইনে পড়ে এবং শ্রেয়া এইচএসসি পরীক্ষার্থী। মৃন্ময়ীর ছোট মামা একটা বেসরকারি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করেন আর ছোট মামী বেসরকারি ব্যাংকে যুক্ত আছেন। তাদের একমাত্র ছেলে প্রজন্ম। প্রজন্ম, মৃন্ময়ীর মতো ক্লাস ফোরে পড়ে। ভীষণ দুষ্টু আর চঞ্চল প্রকৃতির প্রজন্ম, খুবই মেধাবী ছাত্র। সে ক্লাসে সব সময় ১ম স্থান অধিকার করে। মৃন্ময়ীর নিনার ছোট ভাই অরুণ সাহেব এ বাড়ির নিচতলায় ভাড়া থাকেন। তার একমাত্র কন্যা অহনা, শ্রেয়ার সহপাঠী। অহনা খালার সাথে মৃন্ময়ীর অনেক ভাব। বয়সের ব্যবধান অনেক হলেও দু’জনের হৃদ্যতা খুব গভীর। স্কুলের অনেক কথাই মৃন্ময়ী, অহনা খালাকে বলে। ‘ত্রিরতœ ভিলা’-র এক গলি পরেই আরিশদের বাসা। আরিশের বাবা খালেদ মাহমুদ, তিনি উত্তরা ব্যাংকে চাকরি করেন। খালেদ মাহমুদ, মীরার (মৃন্ময়ীর মা) খালাতো ভাই। আরিশ, মৃন্ময়ীর প্রায় সমবয়সী। আরিশরা আলাদা বাসায় থাকলেও বেশির ভাগ সময় সে ‘ত্রিরতœ ভিলা’-তেই খেলাধুলা করে সময় কাটায়।

‘ত্রিরতœ ভিলা’-র নিচতলায় এক ভাড়াটিয়া থাকেন, নাম শানজাবি খাঁ। এ বাড়ির বাচ্চারা দুষ্টুমি করে পাঞ্জাবি খাঁ ডাকে। শানজাবি খাঁ-এর একমাত্র ছেলে, নাম তার শাজিদ খাঁ। ভীষণ বিখ্যাত চোর সে! তাকে দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে না কিন্তু, ভাজা মাছ সে এমনভাবে খায় যে কাঁটাটাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ত্রিরতœ ভিলায় শাজিদ খাঁ এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম! সে যেদিক দিয়ে যায় সেদিক দিয়েই উজাড় হয়ে যায়! তার বয়স ১২ বছর। লেখাপড়া মাথায় ঢুকে না বলে তার বাবা তাকে ‘সুন্দর গাধা’ বলে ডাকে। দেখতে সুন্দর হলেও ভয়ানক দুষ্টু আর লেখাপড়ায় গাধা হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শাজিদ খাঁ, মৃন্ময়ী আর প্রজন্মের সাথে একই ক্লাসে পড়ে। বয়সে বড় হলেও পরপর দুই বছর ফেল করায়, এখনও সে একই ক্লাসে পড়ে। মারামারি, ঝগড়া আর গালিগালাজে শাজিদ খাঁ-এর সমকক্ষ পৃথিবীতে আর কেউ নেই বলেই ধারণা প্রজন্মের। প্রজন্মকে দেখলেই গায়ে পড়ে ঝগড়া শুরু করে শাজিদ খাঁ। সেদিন বিকালবেলা প্রজন্ম বেড়াতে গিয়েছিলো আরিশদের বাসায়। সন্ধ্যার ঠিক আগে একা বাড়ি ফিরে আসার সময় তাকে পথে আটকায় শাজিদ খাঁ।
শাজিদ খাঁ বলে, কি-রে মোটকু? কই গিয়েছিলি? সালাম দিলিনা কেন?
প্রজন্ম উত্তর দেয়, বাজে কথা বলো কেন? ভালো করে কথা বলো। ভদ্রভাবে কথা শিখো নাই?
কি-রে মোটা শুয়োর? আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস? আবার আমাকে তুমি করেও বলছিস? আপনি করে বল শালা, না হলে তোর বিচি কেটে নিবো।
বলেই প্যান্টের পকেট থেকে একটা ছোট চাকু বের করে শাজিদ খাঁ। চাকুটা হাতে নিয়ে উঁচিয়ে ধরে ভয় দেখায় প্রজন্মকে।

ভয় পেয়ে আমতা আমতা করে প্রজন্ম বলে, দেখো আমি আর তুমিতো একই ক্লাসে পড়ি। তাই তোমাকে তুমি করে বলছি।
হারামজাদা গ্যাসবেলুন, আমাকে আবারও জ্ঞান দিচ্ছিস? দাঁড়া তোর গ্যাস বের করে দিচ্ছি। গ্যাস বেশি হয়ে গেছে? শুয়োর কোথাকার?
আমার আব্বুকে কিন্তু বলে দিবো। তখন দেখবা কত ধানে কত চাল?
তোর মতো গোলআলুর বাবাকে আমি ভয় পাই? ডাক তোর বাবাকে। আজকে তোর বাবার সামনেই তোকে শিক্ষা দিবো। একদম উচিত শিক্ষা।
প্রজন্ম বলে, দেখো ভাই ইবলিশ খাঁ, মারামারি করা ভালো না। যারা গালিগালাজ করে আল্লাহ তাদের গুনাহ্ ক্ষমা করেন না।
রেগে গিয়ে শাজিদ খাঁ বলে, কী বললি? ইবলিশ খাঁ? আমি ইবলিশ খাঁ? দাঁড়া তোকে মজা দেখাচ্ছি।
বলেই শাজিদ খাঁ এক লাফ দিয়ে প্রজন্মের কাছে গিয়ে, তার শার্টের কলার চেপে ধরে। ডান হাতের ঘুসি উঁচিয়ে যখন মারতে যাবে ঠিক সে সময় প্রজন্মের বড় কাক্কু রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলো বলে এ যাত্রায় বেঁচে যায় সে। বড় কাক্কুকে দেখেই ভোঁ দৌড়ে পালিয়ে গেলো শাজিদ খাঁ। বড় কাক্কুর সাথে বাড়ি ফিরে আসে প্রজন্ম। ঘটনাটা বড় কাক্কুকে বলেনি কিন্তু মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে এবার মৃন্ময়ী আসলে ‘সংসদ’-এ বিষয়টা নিয়ে কথা বলবে সে। সবাই মিলে একটা ব্যবস্থা না করলে আর শান্তিতে চলাফেরা করা যাবে না, যা দিনকাল পড়েছে!

দক্ষিণমুখী ‘ত্রিরতœ ভিলা’র ছাদটা অনেক প্রশস্ত। ইটের তৈরি কোমর সমান কার্নিশের পাশজুড়ে রাখা টবগুলোতে, গোলাপ গাছ লাগানো। শীতকালে যখন বাহারি রঙের গোলাপফুল ফোটে, মাতাল করা সৌরভ ছড়ায়, তখন ছাদটি স্বর্গের কোনো অংশ বলে মনে হয়। ছাদের চিলেকোঠার ঘরটিকে এ বাড়ির বাচ্চারা তাদের খেলাঘর হিসেবে ব্যবহার করে। খেলাধুলার নানা উপকরণে ঠাসা চিলেকোঠার ঘরটির দরজার উপরে লেখা ‘বিপজ্জনক! সাবধান! প্রবেশ নিষেধ!’ বুদ্ধিটা প্রজন্মের। এ বাড়ির বাচ্চারা তাদের গোপন শলা-পরামর্শ কিংবা নতুন কোনো অভিযানে নামার পূর্বে আনুষ্ঠানিক বৈঠকটি এখানেই বসে করে। বড়রাও ব্যাপারটা জানে, তাই খুব বেশি প্রয়োজনবোধ না হলে পারতপক্ষে এ ঘরে কেউ আসে না, পাছে বাচ্চারা বিরক্তবোধ করে। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, স্বনির্ভর মানবিক মানুষরূপে, আলোকিত ফুল হয়ে সমাজে গড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়ার জন্য, এ বাড়ির ছোটদের অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হয়। আর ছোটরাও অবারিত স্বাধীনতার সুযোগকে যথেচ্ছ ব্যবহার না করে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকেই ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠছে। সামাজিক অবক্ষয়ের অন্ধকার অধ্যায়গুলো যেন তাদের গ্রাস করতে না পারে, সেজন্য নিয়মিত দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতির মিশেলে গড়া বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় এই বাড়িতে। তাদের মুক্ত আলো-বাতাসে বড় মনের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পিত চর্চায় এ বাড়ির প্রতিটি সদস্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
চিলেকোঠার ঘরটি মাঝারি আকৃতির। এতে আসবাবপত্র বলতে ঘরের মাঝখানে ১টা ছয়পায়ার বড় সেগুন কাঠের টেবিল, ১টা টিভি, ১টা ছোট্ট বেডসাইড রেফ্রিজারেটর, ১টা এইট-ব্যান্ড রেডিও, ১টা সিডি প্লেয়ার আর গোটা -দশেক প্লাস্টিকের চেয়ার। ভারী কার্পেটে মোড়ানো মেঝেতে বসেই বাচ্চারা এখানে সময় কাটায়। শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ সভা হলে সবাই ছয়পায়া সেগুন কাঠের টেবিলটাকে ঘিরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে কাজ সেরে নেয়। ঘরের কোণে রাখা বড় এক মাটির ব্যাংক, যার মধ্যে তাদের মাসিক চাঁদা জমা রাখা হয়। প্রতি মাসে ৫০ টাকা করে তারা জমা রাখে মাটির ব্যাংকটিতে। চাঁদা দেয়ার পরিমাণ বেড়ে যায় শুধু দুই ঈদের উৎসবে। রেজিস্ট্রার খাতায় যাবতীয় হিসাব তুলে রাখা হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটি করে শ্রেয়া। ঘরের আসবাবপত্র ঠিকঠাক করে রাখা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজটি দক্ষতার সাথে করে অহনা। এই ঘরের চাবি তিনটা, যা থাকে শ্রেয়া, অহনা আর মৃন্ময়ীর কাছে।
চিলেকোঠার ঘরের যুতসই একটি নামও তারা রেখেছে। ‘সংসদ’! হুম, সংসদ নামেই তারা ঘরটির নামকরণ করেছে। ‘সংসদ’-এর সম্মানিত সদস্য হতে হলে বেশ কয়েকটা শর্ত পূরণ করে শপথ বাক্য পড়ে তবেই কার্যকরী সদস্য হওয়া যায়। কোনো সম্মানিত কার্যকরী সদস্য যদি শর্তের লঙ্ঘন করে তাহলে প্রথম দফায় তার সদস্যপদ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। পরবর্তীতে আবারো যদি উক্ত সদস্য শর্ত লঙ্ঘিত করে তবে তার সদস্যপদ চূড়ান্তভাবে বাতিল হয়ে যায়। তাই ‘সংসদ’-এর প্রত্যেক সদস্য খুব সর্তকভাবে নিয়মাবলি মেনে চলে। প্রতি মাসে একবার ‘সংসদ’-এর সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয় আর ২ বছর পর পর ‘সংসদ’-এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। প্রত্যেক সম্মানিত সদস্যবৃন্দের প্রত্যক্ষ ভোটে যে সর্বোচ্চ ভোট পায় সেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। বিগত ৬ বছর ধরে শ্রেয়া বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে এসেছে। তার প্রতি ‘সংসদ’-এর প্রতিটি সদস্যের আস্থা অবিচল। শ্রেয়াও যোগ্য চেয়ারম্যান হিসেবে দক্ষ কার্যক্রমের মাধ্যমে ‘সংসদ’কে গতিশীল এবং উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কোনো নির্দিষ্ট এজেন্ডার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সদস্যদের ভোটাভুটি হয়। সর্বোচ্চ ভোট পেলে ঐ এজেন্ডা বাস্তবায়িত হয়। তবে মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয় ইচ্ছা পোষণ করলে, যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যায় না। ‘সংসদ’ প্রতিষ্ঠার ৬ বছরের ইতিহাসে শুধুমাত্র একবারই চেয়ারম্যান মহোদয়ের একক সিদ্ধান্তে, সদস্য ভোটে পাস হওয়া একটি এজেন্ডা বাতিল হয়েছিলো। ব্যতিক্রমধর্মী এজেন্ডাটি ছিলো ইবলিশ খাঁ-এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রস্তাবনা পাস। প্রত্যেক সদস্য এই প্রস্তাবনার পক্ষে ভোট দেয় কিন্তু, চেয়ারম্যান মহোদয় শ্রেয়া একক সিদ্ধান্তে প্রস্তাবনাটি নাকচ করে দেয়। প্রস্তাবনাটি উত্থাপন করেছিলো প্রজন্ম, কেননা ইবলিশ খাঁ-এর ভয়াবহ নির্যাতনের একমাত্র শিকার সে! ইবলিশ খাঁ-এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রস্তাবনা ‘সংসদ’-এ পাস হলেও, শ্রেয়ার জন্য তা কার্যকর না হওয়ায়, প্রজন্ম প্রাথমিকভাবে খুবই উত্তেজিত, রাগান্বিত এবং পরিশেষে হতাশ হয়ে পড়েছিলো। রাগ আর হতাশায় সে তার সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছিলো। মৃন্ময়ী আর আরিশের হস্তক্ষেপে ঘটনাটি বেশিদূর গড়ায়নি। তবে সেই থেকে শ্রেয়া আপির প্রতি, ভেতরে ভেতরে একটা চাপা ক্ষোভ বিরাজমান প্রজন্মের।
‘সংসদ’-এর দক্ষিণে ১টি বড় জানালা। থাই অ্যালুমিনিয়ামের ফ্রেমে স্বচ্ছ কাচের জানালাটি ঘরের মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত লাগোয়া। জানালার বাইরে বিশাল দুটি ড্রামে হাসনুহানা আর নীল অপরাজিতা গাছ। গাছ দু’টি ক্রমশই নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার অদ্ভুত এক প্রতিযোগিতায় নেমে, পুরো চিলেকোঠা ঘরটিকে প্রায় আবৃত করে ফেলেছে। দূর থেকে ‘সংসদ’-কে এখন সবুজ পাতা আবৃত গুহার মতো লাগে। গাছ দুটি মৃন্ময়ীর নানাভাই লাগিয়েছিলেন। বর্ষাকালে হলদে-শাদা রঙের হাসনুহানা আর শীতকালে নীল অপরাজিতা ফুলে ছেয়ে যায় চিলেকোঠার গুহাটি। ‘সংসদ’-এর একটাই সমস্যা বিদ্যমান, টিনের চালার কারণে গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরম লাগে। অবশ্য সমস্যাটির সমাধান করে দিয়েছেন মৃন্ময়ীর বড়মামা। তার বড়মামা চিলেকোঠার ঘরটির জন্য ১টি এয়ারকন্ডিশনার কিনে দিতে রাজি হয়েছেন। তবে সংসদ-এর সম্মানিত সদস্যবৃন্দের সম্মিলিত সিদ্ধান্তনুযায়ী, এয়ারকন্ডিশনার না কিনে পুরো টাকাটি তাদের ফান্ডে রেখে দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে ভালো কোনো কাজে এই টাকাটা লাগতে পারে, বলেই টাকাটা খরচ করা হয়নি।
গাড়ি থেকে নেমেই মৃন্ময়ী দৌড়ে গিয়ে অহনা খালাকে জড়িয়ে ধরে।
মৃন্ময়ী বলে, খালা কেমন আছো?
অহনা বলে, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
আমিও ভালো আছি। তোমার মুরগির বাচ্চাগুলো কত বড় হয়েছে?
অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন নিজেরা খেতে পারে। তোমার মেরী আর হ্যারীর কি অবস্থা?
মৃন্ময়ী উত্তেজিত হয়ে বলে, জানো খালা? মেরীর না বাবু হবে!
অহনা অবাক হয়ে বলে, কী বলছো? মেরীকে আনছো নাকি সাথে?
হুম, চলো দেখাই।

তিন তলায় উঠেই প্রজন্মের সাথে দেখা মৃন্ময়ীর। খুশিতে দুজনে কোলাকুলি করে নেয়।
প্রজন্ম বলে, মৃন্ময়ী, তুই কেমন আছিস?
মৃন্ময়ী উত্তর দেয়, ভালো আছি। তুই?
খুব ভালো না রে!
কেন? কী হলো আবার?
প্রজন্ম অভিযোগের সুরে বলে, আর বলিস না, হারামজাদা ইবলিশ খাঁ ইদানীং খুব জ¦ালাচ্ছে। কিছুদিন আগে আমাদের ফুটবলটা চুরি করে নিয়ে গিয়েছে।
কিছু বললি না?
আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই, আমার দিকে তাকিয়ে যে বাজে কথা বললো, তারপর আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে সাহস করিনি।
মৃন্ময়ী বলে, কী বললো তোকে?
প্রজন্ম বলে, ইবলিশ খাঁ আমাকে বলে, কি-রে ফুটবল? কেমন আছিস? খেলবি আমার ফুটবল দিয়ে? তবে তোর মতো ফুটবলের কিন্তু ফুটবল খেলা মানায় না। খেলতে গেলে দেখা গেলো, আমার লাথিতে তোর পা চার টুকরা হয়ে গেল? তখন কী করবি রে? তার চেয়ে বসে বসে আমার খেলা দেখ। ফুটবলটা দুই দিন আগে কিনে আনলাম। সুন্দর হয়েছে না? গুলিস্তান স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে কিনে এনেছি। একদম বিদেশি জিনিস!
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলে, বলিস কী! ইবলিশের এত্ত সাহস বেড়েছে?
প্রজন্ম অনুযোগের সুরে বলে, সাহসের কী দেখলি? আরো একটা ঘটনা ঘটেছে। ২ দিন আগে আমাকে রাস্তায় আটকে চূড়ান্ত অপমান করে চাকু মারতে চেয়েছিলো।
ওহ্্ মাই গড! তুই একা ছিলি?
হুম, আরিশদের বাসায় গিয়েছিলাম। ফিরে আসার পথে, একা পেয়ে সুযোগ বুঝে হারামিটা চাকু মারতে চেয়েছিলো। বড় কাক্কু সময়মতো না এলে, এতক্ষণে আমার কুলখানি খেতে পারতি।
মৃন্ময়ী বলে, এবার সংসদে বিষয়টার একটা দফারফা করতেই হবে।
প্রজন্ম হতাশ হয়ে বলে, ধুরো! ঘোড়ার ডিমের সংসদ? শ্রেয়া আপু থাকলে কোন কিচ্ছু হবে না। ইবলিশের বাবা পাঞ্জাবি খাঁ-কে বলেছিলি?
মাথা খারাপ, এতে যদি হিতে বিপরীত হয়? দেখা গেলো অপমানের পরিমাণ আরো বেড়ে গেলো!
মৃন্ময়ী বলে, তা অবশ্য ঠিক বলছিস। চিন্তা করিছ নাহ্। এবার একটা ব্যবস্থা নিবোই।
প্রজন্ম বলে, বাদ-দে এসব কথা। কাজের কথা বলি। আজকে নাহ্ ফাটাফাটি খানাদানা হবে রে? পোলাও, ডিমের কোর্মা, মুরগির রোস্ট, খাসির রেজালা, গরুর কালাভুনা, জর্দা আর দই। এক্কেবারে বিয়ের খাবার রে!
মৃন্ময়ী বলে, তাই নাকি? সত্যি বলছিস তো?
প্রজন্ম উত্তেজিত হয়ে বলে, আল্লার কসম! এজন্য আমি গত দুই দিন ধরে না খেয়ে আছি! দেখ না পেটটা কেমন চুপসে গেছে?
বলেই পরনের গেঞ্জি উঁচিয়ে প্রজন্ম তার ট্রেডমার্ক বিশাল ভুঁড়িটা মেলে ধরলো সবার সামনে। সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। তাদের হাসির উচ্চশব্দে শ্রেয়া আর সৃজন ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বড় মামাকে দেখে মৃন্ময়ী সালাম করে।
মৃন্ময়ী বলে, সোনামাম, কেমন আছো?
বড়মামা বলেন, মা-মণি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
ভালো আছি মামা। সোনামাম, আজকে কী রান্না করেছো?
তোমার পছন্দের সব খাবার-ই রান্না করেছি।
মৃন্ময়ী বলে, সোনামাম, রোস্ট রান্না করেছো?
বড় মামা বলেন, হুম। আর কিছু লাগবে তোমার?
মৃন্ময়ী উত্তর দেয়, নাহ। রোস্ট হলেই চলবে।
প্রজন্ম বলে, কাক্কু, গরুর মাংসে বেশি ঝাল দাওনি তো? আমি কিন্তু ঝাল খেতে পারি না? আর রানের মাংস কিনেছো তো? পেছনের রানের মাংস আমার খুব পছন্দের। কাক্কু, কাচ্চি-বিরিয়ানি রান্না করলেও পারতে! বাদ দাও, এই বেলায় না হলে, রাতের বেলাও তো হতে পারে?
প্রজন্মের কথা শুনে আবারো সকলে একযোগে হেসে উঠলো। ভাই-বোনদের মধ্যে প্রজন্ম একটু পেটুক প্রকৃতির, এ কথা সবাই জানে। স্বাস্থ্যবান, ভোজন রসিক প্রজন্মকে নিয়ে তাই মাঝেমধ্যেই হাসিঠাট্টা হয়। ব্যাপারটাকে অবশ্যই প্রজন্ম তেমন একটা পাত্তাই দেয় না! বড় মামাকে ভালোবেসে মৃন্ময়ী সোনামাম ডাকে। মৃন্ময়ীর জন্মের পর থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত, এ বাড়ির আলো-বাতাসেই বড় হয়েছে। নিনা আর সোনামামের আদর, ভালোবাসা, স্নেহের কথা সে এখনো ভুলতে পারে না। ডাক্তারির পাশাপাশি অবসর সময়ে সোনামাম রান্না করতে পছন্দ করেন। তার হাতের চিকেন ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিকেন গ্রিল, বার্গার, পনিরের স্যান্ডুউইচ, খাসির কাচ্চি-বিরিয়ানির স্বাদ এখনো জিহ্বায় লেগে আছে মৃন্ময়ীর। ছোট মামা-মামির সাথে দেখা করে মৃন্ময়ী, তাদের সালাম করে। তারপর চার তলায় উঠে সে। নিনা এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে।
মৃন্ময়ী বলে, নিনা কেমন আছো তুমি? শরীরের কী অবস্থা?
নিনা বলেন, ভালো আছি। তুমি কেমন আছে, নিন? তোমার শরীর শুকিয়ে গিয়েছে কেন? স্কুলে টিফিন নিয়ে যাও না? বাসায় সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করো না? পড়ালেখার চাপ কি খুব বেশি? প্রত্যেকদিন কোচিংয়ে যেতে হয়? তোমার আম্মু রোজ ১ গøাস দুধ খেতে দেয় না? রোজ একটা ডিম খাও না? হরলিক্স খাওনা? বিকালে ঘুমাও না?
মৃন্ময়ী বলে, নিনা আস্তে! কী শুরু করলে? এত্ত এত্ত প্রশ্ন করলে উত্তর দেব কীভাবে? আগে একটু বসতে দাও, এরপর তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।
নিনা বলেন, আমার পক্ষী কই?

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়