গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

যত দূরে যাই : ইমদাদুল হক মিলন > উপন্যাস

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চড় খেয়েও চম্পা খানিক বুঝতে পারেনি এত জোরে দিপু তাকে একটা চড় মেরেছে। দিপুর কথায় বুঝতে পারল। কী আশ্চর্য তখুনি জ্বলে উঠল চড় খাওয়া গাল। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। বুঝতে পারল না চোখে জল এসে গেল চম্পার। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুই আমাকে চড় মারলি?
দিপু আগের মতোই রাগী গলায় বলল, হ্যাঁ, মারলাম।
দাঁড়া এখুনি গিয়ে মাকে যদি না বলছি!
ভিতরে ভিতরে দিপু বেশ ঘাবড়ে গেছে। তবে মুখে সেটা প্রকাশ করল না। জোর গলায় বলল, যা যা বল গিয়ে। মা আমার কী করবে রে?
তাই? দাঁড়া।
চম্পা আর দাঁড়াল না। ধুপধাপ করে শাশুড়ির ঘরের দিকে ছুটে গেল। এক পলক চম্পাকে দেখল দিপু। তারপর নিজের রুমে এসে ঢুকল। ভয়ে বুকের ভিতরটা ঢিব ঢিব করতে লাগল।
রুমে ঢুকে খানিক পায়চারি করল দিপু। ওয়্যারড্রবের ওপরে রাখা টেপ রেকর্ডার চালিয়ে দিল। টেপ রেকর্ডারে সানটানার একটা ক্যাসেট ঢোকানই ছিল। ভারি সুন্দর মিউজিকের ক্যাসেট। দুপুরের পর পর যে ঘুমভাব থাকে মানুষের সানটানার এই মিউজিকে সেই ঘুমভাব আরো গভীর হয়ে যায়। মিউজিক শুরু হতেই দিপুর ইচ্ছে করল বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহূর্তে তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে। খানিক আগে চম্পাকে সে চড় মেরেছে। চম্পা গেছে মা’র কাছে বিচার দিতে। এই অবস্থায় শুয়ে পড়া কি ঠিক হবে?
দিপুর ঘরে একটা রকিং চেয়ার আছে। চেয়ারটা রাখা আছে দক্ষিণের জানলার কাছে। জানলার দিকে মুখ করে সেই চেয়ারটায় বসল সে। তার পিঠ এখন দরজার দিকে। এই রুমে কেউ ঢুকলে সে এখন আর তাকে দেখতে পাবে না। দেখবার অবশ্য দরকারও নেই। কে ঢুকবে দিপু তো জানেই!
দিপুর এই জানলা দিয়ে বাগানের বেশ খানিকটা অংশ দেখা যায়। গাছপালা দেখা যায়। গাছপালার মাথার ওপর দিয়ে দেখা যায় খোলামেলা স্বচ্ছ নীল আকাশ। জানলার সামনে বসে রকিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে আকাশ দেখতে লাগল দিপু।

*
চম্পা চোখ মুছতে মুছতে রেখার রুমে ঢুকল। তিনি জাঁদরেল ধরনের মহিলা। মোটা মতো। চোখে চশমা আছে? আর সব সময় সাদা শাড়ি পরেন। স্বামী নেই বলেই কি সব সময় সাদা শাড়ি পরে থাকেন তিনি? চম্পা ঠিক জানে না। চম্পার বিয়ে হয়েছে বছর দেড়েক। এই দেড় বছরে সাদা শাড়ি ছাড়া কখনো অন্য কোনো রংয়ের শাড়ি শাশুড়িকে সে পরতে দেখেনি। তবে বহু রকমের সাদা শাড়ি আছে তার এবং বেশ দামি দামি। অল্প দামি শাড়ি তিনি কখনো পরেন না। স্বামী নেই বলে যে সাদা শাড়ি পরেন তিনি এটা অবশ্য চম্পা বিশ্বাস করে না। ভদ্রমহিলা বেশ জাঁদরেল এবং খোলা মনের মানুষ। স্বামী নেই বলে সব সময় সাদা শাড়ি পরে থাকবেন ওই ধরনের মানসিকতা তার আছে বলে চম্পার কখনো মনে হয়নি। হয়তো সাদা শাড়ি পরতে তিনি পছন্দ করেন। অন্য কোনো রংয়ের শাড়ি তার পছন্দ নয়। মানুষের কত রকমের পছন্দ থাকে না। কত রকমের অভ্যাস থাকে না!
রেখার সাদা শাড়ি পছন্দ। আর একটা অভ্যাস আছে তার। যখনই বিছানায় শোবেন কাউকে না কাউকে দিয়ে হাত পা টেপাবেন, মাথা টেপাবেন। এটা না করালে নাকি শুয়ে থাকতে পারেন না তিনি। ঘুমাতে পারেন না।
এই কাজের জন্যে শাশুড়ির স্পেশাল একজন ঝি আছে। চম্পার মতো বয়স হবে, তবে এখনো বিয়ে হয়নি মেয়েটির। নাম মর্জিনা। দেখতে খারাপ নয় মেয়েটি। কালোকোলো গায়ের রং। স্বাস্থ্য ভালো। মুখটা বেশ মিষ্টি। সেই মর্জিনা সারাক্ষণ ছায়ার মতো লেগে আছে রেখার সঙ্গে। উঠতে বসতে মর্জিনাকে আদেশ করছেন তিনি। আর যখন বিছানায় যাচ্ছেন মর্জিনা আছে তার পায়ের কাছে নয় মাথার কাছে। কিছু না কিছু কাজ রেখার জন্যে সারাক্ষণই করতে হচ্ছে মর্জিনার। তবে অদ্ভুত একটা গুণ আছে মেয়েটির, কখনো এই সব টুকটাক কাজে ক্লান্ত হয় না সে। কথা খুব কম বলার অভ্যাস মর্জিনার। হাসে খুব। আর দাঁতগুলো এত সুন্দর মেয়েটির! সুযোগ পেলেই চম্পা তাকে বলে, এই মর্জিনা হাসতো একটু।
এরকম কথা শুনলে কে না হেসে পারে? মর্জিনাও হাসে। আর তার সেই হাসি দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় চম্পা।
রেখার মনটা খুব ভালো, নরম ও মায়ামমতায় ভর্তি। চম্পাকে তিনি তার ছেলের বউ হিসেবে দেখেন না, দেখেন মেয়ের মতো। এই জন্যে সম্পর্কটা খুবই সহজ ধরনের। আজকালকার দিনে এরকম সাধারণত দেখা যায় না। চম্পাকে তিনি বউমা বলে ডাকেন না। নাম ধরে ডাকেন। তুই তোকারি করেন।
সেই চম্পাকে কাঁদতে কাঁদতে তার রুমে ঢুকতে দেখে চমকে উঠলেন রেখা। নিজের বিছানায় কাত হয়ে শুয়েছিলেন। পায়ের কাছে বসে মর্জিনা তার পা টিপে দিচ্ছে। একটু ঝিমুনি মতো এসেছিল। চম্পাকে দেখে মুহূর্তে তা কেটে গেল। মোটা শরীর নিয়ে হাছরপাছর করে উঠে বসলেন। কীরে, কী হয়েছে?
চম্পাকে কাঁদতে কাঁদতে বলল, দিপু আমাকে মেরেছে।
ভঙ্গিটা এই রকম যেন চম্পা এ বাড়ির বউ নয়। অল্প বয়সী এ বাড়িরই আদুরে মেয়ে। মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে এসে বিচার দিচ্ছে। তবে চম্পাকে কাঁদতে দেখে মর্জিনা হেসে ফেলল। চম্পা যখনই দেখে তখনই যেহেতু হাসতে বলে তাকে এ জন্যে মর্জিনা এখন ভেবেছে কাঁদুক আর যাই করুক, মার খাক আর যাই খাক তার হাসি দেখলে খুশি হবে চম্পা। চম্পা খুশি হলো না। মর্জিনাকে একটা ধমক দিল। এই মর্জিনা হাসবি না। আমি তোকে হাসতে বলেছি?
সঙ্গে সঙ্গে হাসি বন্ধ হয়ে গেল মর্জিনার। একপলক মর্জিনাকে দেখে রেখা বললেন, কি মেরেছে?
হ্যাঁ মা। ভীষণ জোরে চড় মেরেছে। এই দেখুন না, গালে পাঁচ আঙুলের দাগ পড়ে গেছে। চড় খাওয়া গালটা শাশুড়ির চোখের কাছে এগিয়ে নিল চম্পা। দেখুন, দেখুন না!
চশমার ভিতর থেকে তীক্ষè চোখে চম্পার গালের দিকে তাকালেন রেখা এবং চড়ের দাগ দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ভিতরে ভিতরে দিপুর ওপর খুবই রেগে গেলেন তিনি। কঠিন গলায় বললেন, বদমাশটা কোথায়?
মুহূর্ত মাত্র দেরি করল না চম্পা, বলল, ওর রুমেই আছে। ওই যে শুনুন মিউজিক বাজাচ্ছে
ওর মিউজিক আমি বাজাচ্ছি। চল।
রেখা খাট থেকে নামলেন। স্যান্ডেল পরলেন। সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে গেল চম্পার মুখ। খানিক আগে যে কাঁদছিল এ মুহূর্তে চম্পাকে দেখে কে বলবে? ভারি একটা উৎসাহের গলায় বলল, আসুন। তাড়াতাড়ি আসুন মা। পা টিপে টিপে যেতে হবে। আপনি যাচ্ছেন শুনতে পেলে পালাবে।
চম্পার কথা শুনে খানিক আগের ধমকটা ভুলে গেল মর্জিনা। হেসে ফেলল।

*
নিঃশব্দে মা যে এসে তার পিছনে দাঁড়িয়েছেন, দিপু টের পেল না। সানটানার মিউজিক তখন ভারি সুন্দর একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে। দিপুর রুম ভরে আছে সেই আবেশে। মিউজিকটা দিপু শুনছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে। তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।
দিপুর চেয়ারের পিছনে এসে মুহূর্তকাল দাঁড়ালেন রেখা। তারপর হাত বাড়িয়ে দিপুর একটা কান মুচড়ে ধরলেন। চম্পাকে তুই মেরেছিস?
হঠাৎ এরকম একটা ব্যাপারে যে কারও ঘাবড়ে যাওয়ার কথা। দিপু একদমই ঘাবড়াল না। মা কান মুচড়ে ধরেছেন ব্যাপারটা সে মোটেই পাত্তা দিল না। মা’র দিকে মুখ না ঘুরিয়েই বলল, হ্যাঁ মেরেছি।
কেন মারলি?
আমাকে রাঙামুলো বলল কেন?
তোকে রাঙামুলো বলল তুইও ওকে তেমন কিছু একটা বল, মারবি নাকি?
আমি ওর সঙ্গে কথায় পারি না।
তাই বলে বড়ভাইর বউর গায়ে হাত তুলবি?
ও আমার সঙ্গে লাগতে আসে কেন?
চম্পা রুমে ঢোকেনি। সে দাঁড়িয়েছিল দরজার সামনে। সেখানে থেকে বলল, একশোবার আসব। হাজারবার আসব।
তাহলে আমিও একশোবার মারব। হাজারবার মারব।
মেরে দেখিস।
দিপু আর চম্পার এরকম ঝগড়া দেখে মাঝখানে দাঁড়ান রেখা হতভম্ব হয়ে গেলেন। একবার দিপুর মুখের দিকে তাকান তিনি আরেকবার তাকান চম্পার মুখের দিকে। দিপুর কানটা তখনও মুচড়ে ধরে রেখেছেন।
দিপু বলল, মা ওকে থামতে বল।
রেখা কথা বলার আগেই চম্পা বলল, না আমি থামব না।
দিপু এবার বলল, ওকে চলে যেতে বল মা। আমার বিরক্ত লাগছে।
এবারও কথা বলার সুযোগ পেলেন না। দরজার সামনে দাঁড়ানো চম্পা বলল, না আমি যাব না। ইস বিরক্ত লাগছে উনার! কী আমার জমিদারটারে! কথায় কথায় বিরক্ত লাগে!
দিপু বলল, মা ওকে আমি আবার মারব।
সঙ্গে সঙ্গে চম্পা বলল, মেরে দেখ তো!
মারলে কী করবি? পারবি আমার সঙ্গে?
চম্পা আঙুল তুলে বলল, আরেকবার মারবি আমাকে, আমি তখন কিছু বলব না। বলব তুই যখন ঘুমিয়ে থাকবি। বলব মানে, তুই যখন ঘুমিয়ে থাকবি, কাঁচি দিয়ে তোর চুল সব কেটে এমন করে দেব, ন্যাড়া হওয়া ছাড়া তোর আর কোনো উপায় থাকবে না।
ওদের ঝগড়া শুনতে শুনতে কখন যে রেখার হাত ছুটে গেছে দিপুর কান থেকে তিনি তা বুঝতে পারেননি। অবাক হয়ে একবার দিপুকে দেখছেন আরেকবার দেখছেন চম্পাকে। দিপু ততক্ষণে চেয়ারটা ঘুরিয়েছে দরজার দিকে, চম্পার মুখোমুখি। এবং ঝগড়া করছে বলে চেয়ারটা আর দোলাচ্ছে না। বোধহয় দোলাতে ভুলে গেছে।
চম্পা হঠাৎ বলল, ন্যাড়া হলে আমি তোর মাথায় রোজ ঘোল ঢালব।
দিপু অবাক গলায় বলল, কী ঢালবি?
ঘোল, ঘোল। ঘোল বুঝিস না গাধা।
ঘোল পাবি কোথায়?
এ কথায় চম্পা একটু চিন্তায় পড়ে গেল। ঘোল জিনিসটি কোথায় পাওয়া যায় চম্পা সত্যি সত্যি জানে না। চুপচাপ খানিক কী ভাবল। তারপর যেহেতু ঘোল ঢালবার কথা বলে ফেলেছে, সেটা তো আর ফিরিয়ে নিতে পারে না, কোথায় পাওয়া যায় না যায় সেটা কী কোনো বড় ব্যাপার? চম্পা সরল গলায় বলল, ঘোল কোথায় পাওয়া যায় রে?
কথাটা এমন ভাবে বলল, যেন খুবই আন্তরিকভাবে প্রিয় কোনো বন্ধুর কাছে জানতে চাইছে ঘোল জিনিসটি কোথায় পাওয়া যায়। যাকে প্রশ্নটা করেছে, অনেকক্ষণ ধরে যে তার সঙ্গেই ঝগড়া করছে, ন্যাড়া করে তার মাথায়ই যে ঘোল ঢালবে সেটা বেমালুম ভুলে গেছে।
চম্পার প্রশ্ন শুনে হো হো করে হেসে উঠল দিপু। রেখাও হাসলেন। চশমা খুলে শাড়ির আঁচলে চশমার কাঁচ মুছতে লাগলেন।
দিপুর ওরকম হাসি দেখে থতমত খেয়ে গেল চম্পা। আগের মতোই সরল গলায় বলল, হাসছিস কেন?
তোর কথা শুনে!
আমি আবার হাসির কথা কী বললাম?
আমার মাথায় ঘোল ঢালতে চাইলি না?
হ্যাঁ। তবে ন্যাড়া হওয়ার পর। আগে কাঁচি দিয়ে, তুই যখন ঘুমিয়ে থাকবি তখন তোর চুল এমন করে কেটে দেব যাতে ন্যাড়া হওয়া ছাড়া তোর কোনো উপায় না থাকে। তখন আমি তোর মাথায় ঘোল ঢালব।
কিন্তু আমার কাছেই তো জানতে চাইছিস ঘোল কোথায় পাওয়া যায়?
হ্যাঁ। আমি তো জানি না ঘোল কোথায় পাওয়া যায়। বল না, বল।
আমার মাথায় ঘোল ঢালবি আর সেই ঘোল কোথায় পাওয়া যায় আমি বলে দেব?
দরকার হলে তোকে দিয়েই কিনে আনাব আমি।
আমি আনলে তো!
তোর ঘাড় আনবে।
দেখ চম্পা!
দেখেছি, দেখেছি। তোকে আমি চিনি না? এমন পটান পটাব তুই টেরই পাবি না ঘোল কেন কিনিয়ে আনছি আমি। পটানোর চোটে সুর সুর করে গিয়ে নিয়ে আসবি।
আমি তো গাধা নই।
না না তোকে তো গাধা বলিনি! তোকে বলেছি, তোকে বলেছি, মানে তুই হলি গিয়ে রাঙামুলো।
সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল দিপু। চম্পার সব কথা সহ্য করতে পারে সে, রাঙামুলোটা একদম পারে না। শুনলে রাগে গা জ্বলে যায় তার। মাথা খারাপ হয়ে যায়। এখনো হলো। ঘরে মা আছেন, চম্পা গিয়েই ডেকে এনেছে তাকে, ভুলে গেল দিপু। রাগে কাঁপতে কাঁপতে চম্পার দিকে ছুটে গেল সে। ব্যাপারটা বুঝতে মুহূর্ত মাত্র সময় লাগল চম্পার। সেও পাগলের মতো ছুট লাগাল। ছুটতে ছুটতে লনের দিকে চলে গেল। দিপুও গেল তার পিছু পিছু। অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলেন রেখা।

*
স্কুটার থামতেই হাসান সাহেব বললেন, নাম মা নাম। এসে গেছি।
বৃষ্টি আনমনা হয়েছিল। যেন গভীর কোনো চিন্তায় ডুবে আছে সে। স্কুটার কখন থেমেছে বৃষ্টি তা টের পায়নি। বাবার কথায় সামান্য চমকাল। তারপর সুন্দর নরম চোখ তুলে প্রথমে বাবার মুখের দিকে তাকাল, তারপর তাকাল স্কুটারের বাইরে। ভাবভঙ্গিতে তাড়াহুড়োর কোনো চিহ্ন নেই। বৃষ্টি এই রকমই। ধীর স্থির, নরম স্বভাবের। বৃষ্টি তাদের মফস্বল শহরের কলেজে বি এ পড়ে। এই বয়সি মেয়েদের যে চাঞ্চল্য থাকে, তার তা বিন্দুমাত্র নেই।
স্কুটারের বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে পেল বিশাল লোহার একটা গেট। গেটটা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। তাছাড়া গেটের মোটা মোটা রডের ফাঁক দিয়েও ভিতরটা স্পষ্ট দেখা যায়। গেটের কাছ থেকে, গাড়ি চলতে পারে এরকম একটা রাস্তা চলে গেছে ভিতরে, বেশ খানিকটা দূর অব্দি। যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে গাড়ি বারান্দা। গাড়ি বারান্দার দুপাশ থেকে বেশ কিছু লতান গাছ উঠে গেছে দোতলা অব্দি। গাড়ি বারান্দার ছাদটা লাল নীল আর হলুদ ফুলে ভরে আছে। রাস্তার দুপাশেই বাগান। হাওয়ায় আকুলি বিকুলি করছে গাছপালা।
এরকম বিকেলে আশ্চর্য এক মন খারাপ করা ভাব হয় বৃষ্টির। সেটা অনেককাল ধরেই। নিজেদের মফস্বল শহরেও। নিজেদের বাড়ির দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে দূরের বিষণ্ন নদীটির দিকে তাকিয়ে এরকম কত বিকেল মন খারাপ করে কেটে গেছে বৃষ্টির। কেন যে! কেউ জানে না! বৃষ্টিও। বোধহয় প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য কোনো কোনো মুহূর্তে মন খারাপ করে দেয় মানুষের। বৃষ্টিরও বুঝি ওরকম কিছু হয়।
বৃষ্টি তখনও বসে আছে দেখে বাবা তাড়া দিলেন, কী হল রে? নাম।
একহাতে একটা রেক্সিনের ব্যাগ অন্যহাতে বৃষ্টির স্যুটকেস নিয়ে বাবা তখন গেটের সামনে নেমে গেছেন। কোন ফাঁকে স্কুটার ভাড়াও দিয়ে ফেলেছেন, বৃষ্টি খেয়াল করেনি। হাতে ব্যাগ স্যুটকেস নিয়ে বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্কুটার থেকে নামল। বাবার দিকে হাত বাড়াল। একটা আমাকে দাও, বাবা।
না না, দরকার নেই। তুই পারবি না।
কেন পারব না? দাও।
না। আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো!
অন্তত ব্যাগটা দাও। এইটুকু জায়গা ওই সামান্য ব্যাগ বয়ে নিলে মরে যাব না আমি!
তুই বুঝতে পারছিস না, তোর শরীর খারাপ।
শরীর খারাপ হলে কেউ বুঝি ওইটুকু ব্যাগ বহন করে না?
কথাটা এমন স্বরে বলল বৃষ্টি শুনে বিষণ্ন হেসে ব্যাগটা তিনি বৃষ্টির হাতে দিলেন।
শাড়ির ওপর কালো একটা শাল জড়ান বৃষ্টির। শালের একটা দিক একটু ঝুলে পড়েছিল। সেটা যতœ করে জড়াল। ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাবার পিছু পিছু বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল।
তখনও গাড়ি বারান্দার কাছাকাছি আসেনি বৃষ্টি, হঠাৎ বাড়ির ভিতর থেকে পাগলের মতো ছুটে বেরোল এক যুবতী, তার পিছু পিছু এলো এক যুবক। যুবতীটিকে ধরবার জন্যেই যেন ছুটছে যুবক। যুবতীটি যুবকের অনেকখানি আগে ছিল বলে ধরতে পারেনি। ছুটতে ছুটতে দুজনেই ভিতর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। যুবতীটি এমন ঘোরের মধ্যে ছিল, ছুটতে ছুটতে সে যে গাড়ি বারান্দার বাইরে এসে পড়েছে এবং তার সামনে যে এখন অচেনা দুজন মানুষ, এসবের কিছুই সে খেয়াল করল না। ভাবল যুবকটি বুঝি এক্ষুণি ধরে ফেলবে তাকে। এই ভয়ে বৃষ্টির পিছনে এসে লুকাল। অনেককালের পরিচিত মানুষের মতো বৃষ্টির দুকাঁধে দুহাত দিয়ে তার ঘাড়ের কাছে মুখ লুকাল। ব্যাপারটা ঘটল এত দ্রুত যে বৃষ্টি খুবই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কাণ্ডটা দেখে হাসান সাহেবও প্রথমে খুব ভড়কে গেলেন। তারপর হো হো করে হাসতে লাগলেন।
যুবকটি ততক্ষণে সামলে নিয়েছে নিজেকে। গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। দাঁড়িয়ে হাসান সাহেব আর বৃষ্টিকে দেখছে। কারা এরা?
বৃষ্টির পিছনে লুকান যুবতীটি মুখ তুলে অদূরে দাঁড়ান যুবকটির দিকে তাকাল। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল তুলল। পারলি ধরতে?
যুবকটি গম্ভীর গলায় বলল, চম্পা।
কী? আয় না। ধর না পারলে।
যুবকটি বলল, গেস্টদের সামনে এমন করছিস? লোকে বলবে কী?
চম্পা থতমত খেয়ে বলল, গেস্ট?
তারপর একপলক হাসান সাহেবকে দেখে বৃষ্টির দিকে তাকাল। সাদার ওপর নীল বুটি তোলা তাতের শাড়ি পরা। গায়ে কালো সুন্দর শাল। গলায় পাতলা একটা সোনার চেন। দুকানে দুটো রিং। এগুলো দেখার মতো কোনো জিনিসই নয়। চম্পা দেখল বৃষ্টির মুখ। দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। সহজে চোখ ফেরাতে পারল না।
মুখটা এত মিষ্টি বৃষ্টির, তাকালে চোখ ফেরান যায় না। ছোট্ট খাড়া নাক। পাতলা লাল টুকটুকে ঠোঁট। বৃষ্টির মুখটাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর করেছে যা, তা হলো তার চোখ। এত সুন্দর চোখ ছবির মানুষ ছাড়া আর কারও কখনো দেখেনি চম্পা। তার মুখের দিকে তাকিয়ে চম্পা বলল, তুমি কে?
বৃষ্টি আলতো গলায় বলল, আমি বৃষ্টি।
বৃষ্টি? তোমার নাম বৃষ্টি? ইস কী সুন্দর নাম তোমার? বৃষ্টি! বৃষ্টি কারও নাম হতে পারে জানা ছিল না আমার! তুমি দেখতেও তেমন সুন্দর…
দূর থেকে সেই যুবকটি বলল, কী শুরু করলি চম্পা?
হাসান সাহেব বললেন, আরে না না। ঠিক আছে।
এবার যুবকটি এগিয়ে এলো। আপনাদের আমি ঠিক…
যুবকের কথা শেষ হওয়ার আগে হাসান সাহেব বললেন, আমরা খুলনা থেকে এসেছি। তুমি অপু না?
জি না, আমি দিপু।
তাই নাকি? তোমার কথা শুনেছিলাম। অনেক বড় হয়ে গেছ।
হাসান সাহেবকে তবু চিনতে পারল না দিপু।
হাসান সাহেব বললেন, দীর্ঘকাল দেখা হয় না তোমাদের সঙ্গে। তোমার মা বাড়িতে আছেন তো?
জি, আছেন?
এগিয়ে এসে হাসান সাহেবের স্যুটকেসটার দিকে হাত বাড়াল দিপু। দিন, আমার কাছে দিন।
হাসান সাহেব বিগলিত গলায় বললেন, না না ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি নিতে পারব।
দিন না আমার কাছে।
দিপু প্রায় জোর করেই স্যুটকেসটা নিল। একপলক বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হাসান সাহেবকে বলল, আসুন।
দিপুর পিছু পিছু ভিতর বাড়ির দিকে চললেন হাসান সাহেব। মেয়েকে বললেন, আয় মা আয়।
বৃষ্টির একটা হাত ধরে রেখেছে চম্পা। সে বলল, আপনারা যান। ও আমার সঙ্গে আসছে।
বৃষ্টির হাতের ব্যাগের দিকে হাত বাড়াল চম্পা। দাও ভাই, আমাকে দাও।
না না আমি নিতে পারব।
আহা দাও না আমার কাছে।
কেন আপনি কষ্ট করবেন?
এবার তার চোখের দিকে তাকাল চম্পা। আঙুল তুলে অনেকটা আদেশের সুরে বলল, আপনি না। তুমি। আপনিটা পছন্দ করি না আমি।
এত খোলা মনের মেয়ে আগে কখনো দেখেনি বৃষ্টি। সে জানেও না মেয়েটি কে। তার সঙ্গে কী সম্পর্ক। চম্পার মুখের দিকে তাকাল বৃষ্টি। কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই চম্পা বলল, আমি চম্পা। এ বাড়ির বউ।
বৃষ্টির হাত থেকে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিল চম্পা। এক হাতে ব্যাগ অন্য হাতে বৃষ্টির একটা হাত ধরে বলল, এসো ভাই, এসো।
চম্পার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টি ভাবল, দিপু নামের ওই ছেলেটির বউ চম্পা? স্বামী স্ত্রীতে কি তাহলে তুই তোকারি সম্পর্ক? অদ্ভুত ব্যাপার তো!

*
রেখা দাঁড়িয়ে ছিলেন বারান্দায়। চোখে চিন্তার দৃষ্টি। হাসান সাহেবকে নিয়ে দিপু যে তার সামনে এসে দাঁড়াল, প্রথমে তিনি তা খেয়ালই করলেন না। চিন্তার দৃষ্টি নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন।
হাতের স্যুটকেস বারান্দায় নামিয়ে রেখে দিপু বলল, মা ইনি…
কথাটা শেষ করতে পারল না দিপু। রেখা ধমকে ওঠলেন। চুপ কর তুই। বদমাশ ছেলে।
দিপুর দিকে তাকালেন না তিনি। দিপুর সঙ্গে যে আরেকজন মানুষ এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি তা খেয়ালই করলেন না। দিপু খুবই অবাক হলো। কিছু একটা বলতে চাইল সে। তার আগেই রেখা বললেন, চম্পা কোথায়?
ওই তো আসছে।
চম্পাকে আবার মেরেছিস তুই?
এবার অধৈর্যের গলায় দিপু বলল, না। এত চম্পা চম্পা করছ কেন? তোমাকে যে বলছি ইনি…
এবার হাসান সাহেবের দিকে তাকালেন রেখা। তাকিয়ে মুখটা একটু হাঁ হয়ে গেল তার। খানিকক্ষণ কোন কথা বলতে পারলেন না।
হাসান সাহেব হাসি হাসি মুখে বললেন, কেমন আছ বুবু?
এবার চমকে উঠলেন রেখা। কে রে? কে? কে তুমি? আমাকে বুবু বলে ডাকলে?
হাসান সাহেব আরেকটু এগিয়ে এলেন। বুবু আমি! তুমি আমাকে চিনতে পারছ না?
না তো! না। একদম চিনতে পারছি না।
চোখ থেকে চশমা খুললেন রেখা। আঁচলে চশমার কাচ মুছতে লাগলেন। হাসান সাহেবের দিকে আর তাকালেন না। কাচ মুছতে মুছতে বললেন, চোখ দুটো একদম গেছে। দিপু আমার চশমার কাচ আবার বদলাতে হবে রে?
রেখার এরকম আচরণ দেখে হাসান সাহেব একটু ভড়কে গেলেন। বেশ গম্ভীর এবং অভিমানী স্বরে বললেন, বুবু তুমি কি সত্যি সত্যি আমাকে চিনতে পারছ না?
তখুনি চম্পা আর বৃষ্টি এসে দাঁড়াল তাদের সামনে। চম্পার হাতে বৃষ্টির ব্যাগ। ব্যাগটা স্যুটকেসের সামনে নামিয়ে রাখল চম্পা। এক পলক দিপুর দিকে তাকিয়ে ফিক করে একটু হেসে সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেল।
রেখা চশমাটা পরলেন। পরে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন।
হাসান সাহেব আবার ডাকলেন। বুবু।
এবার তীক্ষèস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন রেখা। কে তোর বুবু? এতকাল পরে এসে কেন বুবু বুবু করছিস?
হাসান সাহেব ¤øান বিষণ্ন গলায় বললেন, তুমি তাহলে আগেই আমাকে চিনেছিলে?
না না। না। আমি তোকে চিনি না। কোনো দিনও চিনতাম না। খবরদার তুই আর আমাকে বুবু বলে ডাকবি না।
এই ধরনের নাটকীয় ব্যাপারের জন্যে কেউ প্রস্তুত ছিল না। হাসান সাহেব, বৃষ্টি, দিপু এমনকি চম্পা পর্যন্ত রেখার আচরণে স্তম্ভিত হয়ে গেল। তবে দিপু এবং চম্পা বুঝে গেল ভদ্রলোক এবং সঙ্গের মেয়েটি তাদের খুব কাছের কোনো আত্মীয়। যদিও দিপু কিংবা চম্পা কোনো দিনও এদেরকে দেখেনি। রেখার কথায় বোঝা যাচ্ছে দীর্র্ঘদিন তার সঙ্গে ভদ্রলোকটির দেখা সাক্ষাৎ এবং যোগাযোগ নেই। এই কারণেই তিনি বোধহয় ভয়ানক রেগে আছেন ভদ্রলোকের ওপর কিংবা তার ওপর আছে রেখার তীব্র কোনো অভিমান।
হাসান সাহেব বললেন, আমি কি তাহলে চলে যাব, বুবু?
মা বললেন, আমি কাউকে আসতেও বলিনি, চলে যেতেও বলছি না।
এবার বৃষ্টি এগিয়ে এলো হাসান সাহেবের সামনে। তার একটা হাত ধরল। নরম শান্ত তীব্র অভিমানী স্বরে বলল, বাবা চল।
তীক্ষèচোখে বৃষ্টির দিকে তাকালেন রেখা। আগের মতোই রাগী গলায় বললেন, এই, এই তুই কেরে? আমার ভাইয়ের সঙ্গে আমি ঝগড়া করছি, মাঝখানে তুই কথা বলার কে?
হাসান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, আমার মেয়ে বৃষ্টি।
ভারি শরীর নিয়েও যতদূর সম্ভব দ্রুত হাসান সাহেব এবং বৃষ্টির সামনে এসে দাঁড়ালেন রেখা। ডান হাতে চিবুকটা তুলে ধরলেন বৃষ্টির। কী বললি, তুই আমাদের হাসানের মেয়ে? এই মেয়ে কথা বলছিস না কেন? মাগো কবে হলি তুই? কবে এত বড় হয়ে গেলি?
বৃষ্টিকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরলেন রেখা। চশমার ভিতর জলে ভরে এলো তার চোখ। জড়ান গলায় বললেন, তুই এত বড় হয়ে গেছিস মা, আর আমি তা জানি না? একটা বদমাশের ঘরে জন্মেছিস। হারামজাদা পঁচিশ বছর আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেনি। আজ এতকাল পর এসে খুব বুবু বুবু করছে।
রেখার চোখের জল টপটপ করে পড়তে লাগল বৃষ্টির মাথায়। সেই অবস্থায় আবার হাসান সাহেবকে নিয়ে পড়লেন তিনি। কায়দা করে কথা বলা হচ্ছে আমার সঙ্গে? আমি যেন ওকে চিনতে পারিনি। পঁচিশ বছর কীরে, পঞ্চাশ বছর পর ফিরে এলেও তো তোকে চিনতে পারব আমি। তুই ভুলে যেতে পারিস আমি তো তোকে ভুলিনি। আমি তো তোকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিলাম। বড় করেছিলাম, তোর মতো করে বুবু বলে ডাকার মতো মানুষ তো পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই রে!
চোখ ততক্ষণে হাসান সাহেবেরও জলে ভরে এসেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন তিনি। বুবু আমার ভুল হয়ে গেছে।
ভুলটা এত বছর ধরে হলো তোর?
এক হাতে হাসান সাহেবকেও কাছে টানলেন রেখা। তারপর শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। তুই যদি আমার আপন ভাই হতি, তাহলে এতদিন বুবুকে ভুলে থাকতে পারতি?
হাসান সাহেব বললেন, এ কথা বোলো না বুবু। তুমি ছাড়া আপন আর কে ছিল আমার? এক মায়ের পেটে আমরা জন্মাইনি ঠিকই…
থাক এতকাল পরে এসে আর ওসব কথা বলতে হবে না।
শব্দ করে নাক টানলেন রেখা।
চম্পা এক পলক রেখার দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরাল। তারও খুব কান্না পাচ্ছিল। বারবার চোখ ভরে আসছিল জলে। মানুষের কান্না সে সহ্য করতে পারে না। যে কেউ তার সামনে কাঁদতে থাকলে সেও এক সময় কেঁদে ফেলে। এখন সেই অবস্থায় এসে গেছে চম্পা। কান্নাটা বুঝি আর আটকে রাখতে পারছে না সে।
এই অবস্থায় চম্পাকে বাঁচিয়ে দিল দিপু। বলল, মা কী শুরু করলে তুমি? থাম তো! এরা এতদূর থেকে এলেন, আগে বসতে দেবে, চা-নাশতা দেবে তা না, পুরনো ইতিহাস তুলে বসে আছ! জার্নি করে এসেছেন, টায়ার্ড না দুজন মানুষ?
দিপুর কথায় বেশ কাজ হলো। সঙ্গে সঙ্গে কান্না থামালেন রেখা। বৃষ্টিকে ছেড়ে দিলেন, হাসান সাহেবকে ছেড়ে দিলেন। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, তাই তো! তাই তো! চম্পা তুই তাড়াতাড়ি কিচেনে যা। বুয়াকে বল খাবার তৈরি করতে। যা তাড়াতাড়ি কর।
মুহূর্তে কিচেনের দিকে ছুটল চম্পা।
রেখা বললেন, দিপু শোন এ হচ্ছে তোর হাসান মামা। বলেছি না তোকে হাসান মামার কথা? বলেছি না? এই সে।
বৃষ্টিকে দেখিয়ে তিনি বললেন, আর এই পুতুলটি হচ্ছে হাসানের মেয়ে। বৃষ্টি। কী সুন্দর মেয়ে দেখেছিস?
এই প্রথম চোখের সম্পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকাল দিপু। তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু বৃষ্টি তার দিকে তাকাল না।

*
চায়ে চুমুক দিয়ে হাসান সাহেব বললেন, কুড়ি একুশ বছর বয়সে তোমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই আমি।
রেখা বসে আছেন খাটের ওপর। হাসান সাহেব বসে আছেন অল্প দূরে পুরনো আমলের একটা সোফায়। তার সামনে লম্বা মতন একটা সেন্টার টেবিল। টেবিলের ওপর অজস্র খাবার। হাসান সাহেব এবং বৃষ্টিকে খেতে দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টি সামান্য কিছু মুখে দিয়ে চম্পার সঙ্গে দোতলায় চলে গেছে। চা-টা পর্যন্ত এখানে বসে তাকে খেতে দেয়নি চম্পা। মর্জিনাকে বলেছে, আমাদের দুজনের চা ওপরে পাঠিয়ে দে। আমরা গল্প করতে করতে চা খাব। তাড়াতাড়ি কর।
খানিক আগেই মর্জিনা ওদের চা পৌঁছে দিয়ে এসেছে। হাসান সাহেবও তেমন কিছু মুখে দেননি। দুটো নোনতা বিস্কুট মুখে দিয়েই চায়ের কাপ টেনে নিয়েছেন। দেখে হা হা করে উঠেছেন রেখা, ও কি কিছুই যে খেলি না?
খিদে নেই বুবু।
মিষ্টিটা খা। খুব ভালো মিষ্টি।
না বুবু মিষ্টি আমি খাই না।
বলিস কি? তুই তো মিষ্টি খুব পছন্দ করতি!
তা করতাম। খুব পছন্দ করতাম।
আমার মনে আছে তোর জন্যে মিষ্টি এনে ঘরে রাখা যেত না। এমনিতে তো খেতিই, চুরি করেও খেতি।
বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল হাসান সাহেবের। সেই দিন কি আর আছে বুবু? বয়স হয়েছে না?
তোর আর কী এমন বয়স হয়েছে?
চুয়াল্লিশ পয়তাল্লিশ তো হলোই।
আমার তো বাহান্ন তিপ্পান্ন।
বুবু আমার ডায়াবেটিস আছে।
তাহলে তো মিষ্টি তোর জন্যে হারাম।
হ্যাঁ। হাসান সাহেব চায়ে চুমুক দিলেন। একটা চুমুক দিয়েই কাপটা নামিয়ে রাখলেন। আমি চিনি ছাড়া চা খাই।
তাই তো খাবি। মর্জিনাকে ডাকলেন বুবু। মর্জিনা।
মর্জিনা কাছেপিঠেই ছিল। ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে এলো। জি।
চিনি ছাড়া চা দে এক কাপ। আমার ভাই খাবে। আর শোন, ওকে সব সময় চিনি ছাড়া চা দিবি। মনে থাকে যেন। আর যেন তোকে না বলতে হয়।
জি আচ্ছা।
খানিক বাদেই চিনি ছাড়া এক কাপ চা এনে দিয়েছে মর্জিনা। সেই চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই কথাটা বললেন হাসান সাহেব। শুনে রেখা বললেন, কেন যে তুই ওই ভাবে চলে গেলি কারণটা আমি একদম বুঝতে পারিনি।
কেমন করে পারবে? তখন তো তুমি আর ওই বাড়িতে ছিলে না! খালা খালু ছিলেন। তোমার সেই হামেদ মামা ছিলেন। তার ছেলেমেয়েরা ছিল। তোমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকেই ওবাড়ির সবাই আমার সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার শুরু করেছিল। তোমার আপন কোনো ভাইবোন ছিল না। ছেলেবেলা থেকেই আমাকে তুমি আপন ভাইয়ের মতো করে মানুষ করেছ। তোমার মা-বাবা, মানে খালা খালুও যথেষ্ট ভালোবাসতেন আমাকে। আপন ছেলের মতোই তারা দুজন স্কুল-কলেজে পড়িয়েছেন আমাকে। শুধু তোমার ওই হামেদ মামা আর তার সেই দজ্জাল বউটি আমাকে একদম সহ্য করতে পারত না। এমন কি হামেদ মামার ছেলেমেয়েগুলো পর্যন্ত যা তা ব্যবহার করত। আড়ালে চাকরানির ছেলে বলে গাল দিত।
কই আমার সামনে তো তোকে কেউ কখনো গাল দেয়নি? হামেদ মামা তো আমার বিয়ের অনেক আগে থেকেই আমাদের সংসারে এসে জেঁকে বসেছিলেন।
তা ছিলেন। খালা, খালু, হামেদ মামাকে আনিয়ে ছিলেন।
বাবা না, আনিয়ে ছিলেন মা।
সেসব আমার মনে আছে।
কেন মা হামেদ মামাকে এনে আমাদের সংসারে ঢুকিয়ে ছিলেন, সেটা কি জানতি তুই?
তখন জানতাম না। যখন বেরিয়ে যাই তখন জেনে গিয়েছিলাম।
কী জেনে গিয়েছিলি বল তো আমাকে।
তোমার কোনো ভাই নেই। তোমাদের ওই এতবড় সম্পত্তি কে দেখাশোনা করবে ইত্যাদি ইত্যাদি কারণেই বেকার ভাইকে স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ নিজের সংসারে এনে ঢুকিয়ে ছিলেন খালা।
হামেদ মামা মারা গেছেন চৌদ্দ পনেরো বছর হলো। মামি মারা গেলেন বছর তিন চারেক আগে।
তাহলে এখন তোমাদের ওই বাড়িতে কে আছে?
মামার তিন ছেলে।
তিনটি একসঙ্গে? কী করে ওরা?
কিছু করে না। জমাজমি দেখাশোনা করে। আর টাকা পয়সার অভাবে পড়লে আমার কাছে এসে হাত পাতে। না দিয়ে পারি নাকি বল। হাজার হোক মামাতো ভাই।
ওইসব ঘরবাড়ি, জায়গা-জমি তুমি এতদিন রেখেছ কেন? বিক্রি করে দাও। প্রচুর সম্পত্তি তো! ম্যালা টাকায় বিক্রি করতে পারবে। ওগুলো রেখে লাভ কী? বিক্রি করে টাকা-পয়সা নিয়ে এসো। ছেলেদেরকে দাও। ওরা ব্যবসা-বাণিজ্য করুক।
আমার দুটো মাত্র ছেলে। তুই তো জানিস তোর দুলাভাই কাপড়ের ব্যবসা করতেন। আমার যখন বিয়ে হয় তখুনি বেশ বড় ব্যবসায়ী তিনি। মারা গেলেন গুলশানের মতো জায়গায় এই এক বিঘার ওপর বাড়িটা রেখে। আর ইসলামপুর নিউমার্কেটে সাতটা কাপড়ের দোকান রেখে। বড়ছেলে অপু সেই সব দোকানপাট দেখাশোনা করে। ওকে বিয়ে করিয়ে দিয়েছি। বউ তো দেখলিই। চম্পা।
হাসান সাহেব বললেন, হ্যাঁ ভারি ভালো মেয়েটি।
আর দিপু আমার ছোট ছেলে, ডাক্তারি পড়ে। সুতরাং আমি গ্রামের ওই জায়গা সম্পত্তি বিক্রি করতে যাব কেন বল? আছে ওরা, থাক। জায়গা-জমির আয় থেকেই তো খাচ্ছে। ঘরবাড়ি, জমাজমি তো বেচে খাচ্ছে না!
তা একদিক দিয়ে ভালোই করেছ। তোমার যখন কোনো অভাব নেই, কিছু লোক যদি খেয়ে বাঁচে, বাঁচুক। শোন বুবু তোমার ওই হামেদ মামা আর তার বউ ছেলেমেয়ের জন্যেই তোমাদের বাড়ি ছেড়ে ছিলাম আমি। ওদের ধারণা হয়েছিল তোমার যেহেতু কোনো ভাই নেই, তোমাদের এই বিশাল সম্পত্তি আমি একদিন কায়দা করে হাতিয়ে নেব। খালারও তাই ধারণা হয়েছিল। তোমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে এত দুর্ব্যবহার শুরু করলেন আমার সঙ্গে! আমি তখন নাইনে পড়ি। কথায় কথায় তোমার হামেদ মামা, মুরব্বি মানুষ, তিনিও আমাকে বলতেন চাকরানির ছেলে!
কেন বলত কথাটা? তোর মা তো আর কাজের মহিলা ছিলেন না। আমার মা আর হামেদ মামার দূর সম্পর্কিয়া বোন হতেন। তোর বাবা মারা যাওয়ার পর তোকে নিয়ে তিনি আমাদের সংসারে এসে উঠেছিলেন। তোর হয়তো মনে নেই, খুব ছেলেবেলার কথা। তোকে আমাদের সংসারে পেয়ে কী যে খুশি হয়েছিলাম আমি। সারাদিন তোকে নিয়ে মেতে থাকতাম। আমার কখনো মনে হয়নি তুই আমার আপন ভাই না।
মা মারা যাওয়ার পর এজন্যেই তো আমার তেমন কোনো দুঃখ হয়নি। আমার কেবল মনে হতো, মা নেই তো কী হয়েছে, আমার তো তুমি আছ! আমার বুবু। একাধারে যে আমার মা বাবা ভাইবোন সব।
এমন করে বলিস না রে। বুক ফেটে যায়।
শোন, এই এতকাল পর, এজন্যই আমার সবচাইতে বড় বিপদের সময় তোমার কথাই সবার আগে মনে পড়েছে। শুধু মনে হয়েছে, আমার বুবু তো এখনো বেঁচে আছেন। মেয়েটিকে নিয়ে আমি তো তার কাছে গিয়েই দাঁড়াতে পারি।
হাসানের বিপদের কথা শুনে নড়েচড়ে উঠলেন রেখা। বিপদ? কিসের বিপদ তোর? কী হয়েছে রে?
পরে বলছি।
পরে কেন? এখুনি বল। নইলে স্বস্তি পাব না। রাতে ঘুমাতে পারব না।
তুমি ঘুমিয়ে পড়ার আগেই বলব।
হাসান সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শোন বুবু, তোমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমি একদম একলা হয়ে গেলাম।
হ্যাঁ রে। মনে আছে, আমার বিয়ের দিন তুই খুব কেঁদেছিলি।
মা মারা যাওয়ার দিনও এতটা কাঁদিনি আমি। তোমার মনে আছে বুবু, তোমার সঙ্গে চলে যাওয়ার জন্য আমার সব জামাকাপড় গুছিয়ে ফেলেছিলাম। তুমি পালকিতে চড়লে, আমি আমার জামাকাপড়ের পোটলা বুকের কাছে ধরে কাঁদতে কাঁদতে পালকির পিছু পিছু ছুটেছিলাম!
মনে থাকবে না? তোর জন্য কাঁদতে কাঁদতে পালকির ভিতর ফিট হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
একটু থেমে রেখা বললেন, সেই তুই আমাকে এমন করে ভুলে গেলি? এতগুলো বছর তোকে না দেখে কেটে গেল আমার?
হাসান সাহেব ধরা গলায় বললেন, আর বোলো না বুবু।
তবে হঠাৎ করে তুই এমন উধাও হয়ে যাবি এটা আমার ধারণার বাইরে ছিল রে হাসান। আমি ভাবতেই পারিনি।
উধাও হতে বাধ্য হয়েছিলাম।
কিসের বাধ্য?
একটা সময়ে এমন অভিমান হয়েছিল সবার ওপর! আমার বিরুদ্ধে অবিরাম খালা-খালুর কান ভারি করে যাচ্ছিলেন হামেদ মামা, মামি আর তাদের ছেলেমেয়েরা। খালা-খালুও এক সময় লোভী ভাবতে শুরু করেছিলেন আমাকে। তখন প্রায়ই ঢাকায় তোমার কাছে এসে থাকতাম আমি। তখন তোমার কোল জুড়ে অপু।
অপুর কথাটা বলেই হঠাৎ করে রেখার মুখের দিকে তাকালেন হাসান সাহেব। অপুকে তো দেখলাম না! অপু কোথায়?
দোকানে। আসবে রাত ন’টার দিকে। বড় ব্যবসায়ী হয়েছে।
ভালো ভালো। হাসান সাহেব একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, বিয়ের পর তুমিও খানিকটা বদলে গিয়েছিলে।
কী রকম?
সেটা ঠিক বলতে পারব না। তবে যখনই তোমার কাছে আসতাম, বিয়ের আগের তোমাকে আর খুঁজে পেতাম না। মনে হতো আগের তুমি আর নেই। হারিয়ে গেছ। এসব ভেবে ফিরে যাওয়ার সময় প্রতিবারই আমার খুব কান্না পেত।
বিয়ের পর সব মেয়েই একটু আধটু বদলায়। বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার পর আরো বদলায়। এটাই নিয়ম।
তখন কি আর এত কিছু বুঝতাম? খুব অভিমান হতো তোমার ওপর। এ জন্যে তোমার এখান থেকে বাড়ি যাচ্ছি বলে উধাও হয়ে গিয়েছিলাম। কোনোদিনও আর তোমার কাছে আসতাম না যদি না মেয়েটিকে নিয়ে এই বিপদ…
বিপদটার কথা বল।
বলব। তার আগে বলি, তোমার কাছে এসে সেই ছেলেবেলার তোমাকে আবার ফিরে পেলাম। সেই সময়কার মতো অভিমান করলে তুমি। গালাগাল করলে। বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলে। কাঁদলে। আমি তো এক সময় ভাবলাম তুমি বুঝি আমাকে চড়চাপড় মারবে।
মারতে চেয়েছিলাম।
মারলে না কেন?
ছেলেমেয়েদের সামনে মারা ঠিক হতো না।
মারলে আমি কিছু মনে করতাম না। বরং খুশিই হতাম। মনে হতো আমি বুঝি এখনো আমার সেই বালক বয়সেই আছি। তোমার স্নেহে, শাসনে। ভালোবাসায়, আদরে।
ইচ্ছে করলেও আমরা সবকিছু আর আগের মতো পারি নারে! বয়স আমাদেরকে বহুদূর সরিয়ে নিয়েছে।
বেশ বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রেখা।
রুমে তখন সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকার। স্মৃতির ভিতর ডুবে ছিলেন বলে দুজন মানুষের কেউ তা খেয়াল করেননি। খেয়াল করলেন রেখা। লাইট জ¦ালবার জন্যে খাট থেকে নামলেন। সুইচ বোর্ডের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, এবার বিপদের কথাটা বল তো! এত সুন্দর মেয়েটিকে নিয়ে কিসের বিপদ তোর? মেয়েটি আমাকে দিয়ে দে।
ওই ধরনের কোনো সমস্যা না বুবু। মেয়েটির ভারি অসুখ।
কী অসুখ?
সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। আমাদের মফস্বল শহরের ডাক্তাররা ওর অসুখটাই ধরতে পারছে না। আবোল-তাবোল সব অসুখের কথা বলে।
কী ধরনের অসুখের কথা বলে?
সেটা আমি মুখ ফুটে বলতে পারব না বুবু। মেয়েটিকে আমি তোমার কাছে নিয়ে এসেছি, তুমি ওকে বাঁচাও। যে অসুখের কথা ডাক্তাররা বলেছে ওই অসুখের চিকিৎসার সামর্থ্য আমার নেই।
সুইচ বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে খানিক অপেক্ষা করলেন রেখা। বললেন, তুই এত ভেঙে পড়িস না হাসান। তোর বুবু এখনো মরে যায়নি। বেঁচে আছে। তোর মেয়েটির জন্যে যা যা করতে হয় আমি করব। যত টাকা ব্যয় করতে হয় করব। ঢাকা শহরের সব বড় বড় ডাক্তার দেখাব। তুই ঘাবড়াবি না। মেয়েটিকে আমি সারিয়ে তুলব।
কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বেলে দিলেন রেখা। মুহূর্তে ঝকঝকে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে গেল অন্ধকার হয়ে আসা রুমটি। যাবতীয় অন্ধকার কেটে গেল।

*
চম্পা বলল, এসো বারান্দায় বসি।
বৃষ্টি কোনো কথা বলল না। তাকিয়ে তাকিয়ে দোতলার চারদিকটা দেখতে লাগল। এ বাড়ির দোতলাটা অদ্ভুত ধরনের। দোতলার অর্ধেক জুড়ে চারটে রুম। বাকি অর্ধেক খোলা উঠনের মতো। চারদিকে রেলিং দেওয়া। সেই জায়গায় অজস্র টব। টবে কত রকমের যে গাছপালা! বারান্দাটাও বেশ চওড়া। দোতলার ড্রয়িংরুমের পাশে বারান্দায় ছড়ান ছিটান বেশ কয়েকটা আরামদায়ক চেয়ার। নিচু ধরনের কালো বার্নিস করা সুন্দর একটা টেবিল। সেই টেবিলে এইমাত্র দুকাপ চা রেখে গেল মর্জিনা।
চম্পা বসবার কথা বলার পরও উদাস বিষণ্ন সুন্দর চোখে চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল বৃষ্টি। ব্যাপারটা খেয়াল করে চম্পা তাকে হাত ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। চল চা খেতে খেতে গল্প করি।
বৃষ্টি এবারও কোনো কথা বলল না।
চায়ের কাপ যতœ করে বৃষ্টির হাতে তুলে দিল চম্পা। নিজে অন্য কাপ নিয়ে চুমুক দিল। এতদিন পর আমাদের কথা মনে পড়ল?
আলতো করে চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াল বৃষ্টি। যেন চা-টা খুবই গরম। স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট পুড়ে যাবে। ব্যাপারটা খেয়াল করে চম্পা বলল, ঠোঁট পুড়বে না। তেমন গরম না।
বৃষ্টি বলল, গরম চা আমি খেতে পারি না। চা আমি ঠাণ্ডা করে খাই।
সে তোমাকে দেখেই বোঝা যায়।
দেখে কেমন করে বোঝা যাবে আমি ঠাণ্ডা চা খেতে পছন্দ করি?
তা বোঝা যায় না। তবে তুমি যে খুব নরম মেয়ে সেটা বোঝা যায়।
বৃষ্টি কোনো কথা বলল না।
চম্পা উচ্ছ¡সিত গলায় বলল, তোমার মতো এত সুন্দর একটা ননদিনী আছে আমার, আশ্চর্য আমি তা জানতামই না।
আমিও তো জানতাম না আপনার মতো চঞ্চল ছটফটে মিষ্টি একটা ভাবি আছে আমার।
এই তোমাকে না বললাম আপনি চলবে না।
বৃষ্টি আবার চায়ে চুমুক দিল। হঠাৎ কাউকে তুমি বলতে আমার যেন কেমন লাগে?
যাকে বলবে সেই তো তোমাকে পারমিশান দিচ্ছে!
তা দিচ্ছে, তবুও।
কোনো তবুও নেই। বল তো একবার। বলে প্র্যাকটিস কর। হারি আপ।
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতে অবিকল পুরুষ মানুষের মতো করে চুটকি বাজাল চম্পা। দেখে হেসে ফেলল বৃষ্টি। হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা বলছি। তুমি।
গুড। শোন আমি এত কায়দাটায়দা পছন্দ করি না। আমি খুব সরল মানুষ, সবকিছু সরলভাবে দেখতে পছন্দ করি। যাকে ভালো লাগে আমি চাই তার সঙ্গে আমার একদম খোলামেলা সম্পর্ক হোক। দেখলে না আমার শাশুড়ি আমাকে নাম ধরে ডাকেন। বউমা বলেন না।
বৃষ্টি আস্তে করে বলল, তবে একটা ব্যাপার আমার ভালো লাগেনি। স্বামীর সঙ্গে তুই তোকারি।
চম্পা ভুরু কুঁচকে বলল, স্বামীর সঙ্গে মানে? তারপর খিলখিল শব্দে হেসে উঠল। তুই ভেবেছিস ওই গাধাটা আমার স্বামী? আরে ধুৎ ওটা তো আমার দেবর। ওই সাইজের একটা পুঁচকে ছোকরাকে আমি বিয়ে করব? তোর কি মাথা খারাপ?
কথা বলতে বলতে কখন যে বৃষ্টিকে তুই তোকারি করছে চম্পা নিজে তা খেয়াল করেনি। খেয়াল করল বৃষ্টি। করে মনটা ভালো হয়ে গেল তার। জীবনে প্রথমবার বৃষ্টির মনে হলো সত্যিকার কিছু আপন মানুষজনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে।
হাসি থামিয়ে চম্পা বলল, তবে দিপুটা বড় ভালো ছেলে। সারাদিন আমরা দুজনে ঝগড়া করি, মারামারি করি। রাঙামুলো বললে দিপু খুব চটে। আমি চান্স পেলেই রাঙামুলো বলি। তোরা যখন এলি তখন ওই নিয়েই তো…
কথাটা শেষ না করে বৃষ্টির মুখের দিকে তাকাল চম্পা। আচ্ছা শোন, আমার ওরকম ছুটাছুটি দেখে মামা কিছু মনে করেননি তো?
কী মনে করবেন?
মনে করতে পারেন মেয়েটা বাড়ির বউ হয়ে কী রকম গেছো ধরনের। আমাদের দেশে তো বাড়ির মেয়েরা কোনো কিছু করলে সেটা নিয়ে গার্জিয়ানরা তেমন কিছু মনে করেন না। বাড়ির বউরা করলে, বাপরে তার আর রক্ষা নেই। মেয়েদের সাত খুন মাফ, বউদের পান থেকে চুন খসলেই অপরাধ।
তোমাদের ব্যাপারটা বাবা হয়তো খেয়ালই করেননি।
কেন, খেয়াল করবেন না কেন? তার চোখের সামনেই তো আমি ছুটতে ছুটতে তোর পিছনে গিয়ে লুকালাম।
চোখের সামনে ঘটলেও অনেক কিছুই তিনি আজকাল আর দেখতে পান না।
কেন, চোখ খারাপ নাকি মামার? কই চোখে তো চশমা দেখলাম না?
না চোখ খারাপ না। মন খারাপ।
কেন, মন খারাপ কেন?
আমার জন্যে।
তোর আবার কী হয়েছে?
এ কথায় বৃষ্টি আগের মতো আনমনা হয়ে গেল। তার একটা হাত ধরে নাড়া দিল চম্পা। কীরে, কোথাও প্রেমটেম করে ঝামেলা বাঁধিয়েছিস নাকি?
ধুৎ।
তাহলে তোকে নিয়ে মামার কেন মন খারাপ থাকবে?
আমার যে খুব অসুখ!
অসুখ! চম্পা একটু থতমত খেয়ে গেল। কী এমন অসুখ যা নিয়ে সব সময় মন খারাপ থাকবে? চোখের সামনে কিছু ঘটলেও দেখতে পাবেন না?
আমাদের শহরের ডাক্তাররা তেমন কিছু বলতে পারেননি। এজন্যেই তো তোমাদের এখানে…
এখানে এসে খুব ভালো করেছিস। আমাদের ঘরেই তো ডাক্তার আছে। ওই দিপুটা। তবে হাফ ডাক্তার। এখনো পাশ করেনি। এবার ফাইনাল দেবে। অসুখ বিসুখ নিয়ে চিন্তা নেই। ঢাকা শহরের সব বড় ডাক্তারের সঙ্গে দিপুর পরিচয়। তোর চিকিৎসার কোনো অসুবিধা নেই। আমরা তোকে ভালো করে দেব।
বৃষ্টি কথা বলল না। বুক কাঁপিয়ে ভারি একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার।
তখন দ্রুত সন্ধ্যা বসে যাচ্ছে। এ বাড়ির গাছপালায় এবং আনাচে কানাচে ঘন হয়ে জমছে অন্ধকার। চম্পা এবং বৃষ্টি দুজনেই দুজনার কাছে আবছা হয়ে উঠছিল।
চম্পা বলল, লাইট জ¦ালব?
বৃষ্টি আনমনে বলল, না দরকার নেই। এমনিতেই ভালো লাগছে।
আমারও এরকম অন্ধকারে বসে থাকতে বেশ লাগে।
বৃষ্টি কথা বলল না।
চম্পা বলল, তোর এ রকম অসুখ তাহলে আরো আগে আমাদের এখানে চলে এলি না কেন?
আমাদের ওই শহরেই বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন। যত ডাক্তার আছে সব দেখান হয়ে গেছে। তারপর তোমাদের এখানে চলে এলাম।
মামিকে নিয়ে এলি না কেন?
মাকে আনব কোত্থেকে? থাকলে তো? মা মারা গেছেন আমার ছেলেবেলায়। মা’র চেহারাও আমার আর এখন মনে নেই।
মামা আর বিয়ে করেননি?
না।
তাহলে সংসারে তুই আর মামা?
আরেকজন আছে। বুয়া। সে ঠিক কাজের লোক না। মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমাদের সংসারে আছে। আমাকে বুয়াই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। সাতকুলে তার কেউ নেই। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের মাস ছয়েক পর স্বামী মারা যায়। তারপর থেকেই আমাদের সংসারে। ভারি ভালো মানুষটা। আমাকে কী যে ভালোবাসে!
তুই এত সুন্দর মেয়ে, তোকে কে না ভালোবেসে পারে বল? দেখলি না মুহূর্তের পরিচয়ে আমিও ভালোবেসে ফেললাম তোকে।
মানুষের চেহারার সৌন্দর্যই আসল সৌন্দর্য না। মানুষের মনের সৌন্দর্য হচ্ছে আসল।
বাববা। তুই দেখি একদম বইয়ের ভাষায় কথা বলিস।
বইয়ে তো সব ভালো ভালো কথাই লেখা থাকে।
বাদ দে ওসব। এতসব গম্ভীর কথাবার্তা আমার ভালোøাগে না। তারচেয়ে তোর কথা বল। তোর জীবনের কথা। পড়াশোনার কথা। প্রেমটেমের কথা।
আমি বি এ পড়ি। আর জীবনের কথা তো খানিকটা শুনলেই। প্রেমটেমের কথা যে বললে, ওরকম কিছু আমার নেই।
কেন নেই? তোকে দেখে তো ছেলেদের মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা! কীরে মাথা কারও খারাপ করতে পারিসনি?
কথাটার জবাব না দিয়ে খুক খুক করে দুবার কাশল বৃষ্টি।
চম্পা বলল, কাশছিস কেন?
কাশি হচ্ছে। শরীরটাও একটু একটু গরম। বোধহয় জ্বর আসবে।
বলিস কী!
চম্পা সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির গালে এবং কপালে হাত দিল। শরীর সত্যি খানিকটা গরম হয়েছে। তবে এটাকে ঠিক জ্বর বলা যায় না। চম্পা বলল, আরে না। জ্বর না। এমনিতেই শরীর একটু গরম হয়েছে। জার্নি করে এসছিস তো। চল আমার রুমে গিয়ে রেস্ট নিবি।
না আমরা যে রুমে থাকব সেই রুমেই যাই।
তুই দোতলায়ই থাক না। আমার পাশের রুমে। রুমটা সুন্দর। ওখানেই তোর থাকার ব্যবস্থা করি।
আর বাবা?
মামা থাকবেন নিচে। দিপুর রুমের পাশে।
তাহলে আমিও সেখানেই থাকব। বাবার সঙ্গে ছাড়া থাকতে পারি না আমি। বাবাও আমার সঙ্গে ছাড়া থাকতে পার

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়