গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

জল-পর্বতে ঘেরা সৌন্দর্যের শহর ইন্টারলেকেন আর লুজার্ন : ফারুক যোশী > ভ্রমণ

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জুরিক শহরটা অন্য কয়েকটা ইউরোপিয়ান কিংবা আমেরিকান শহরের মতোই মনে হয়েছে প্রথম। প্লেন থেকে নামার পর ট্যাক্সি করে এসে প্রথম ঝাপটাই পড়লো, মনে হলো পৃথিবীর অন্যান্য শহরের তুলনায় এখানকার ভ্রমণটা একটু এক্সপেনসিভই হবে হয়তো।
‘ভিশন অ্যাপার্টমেন্ট’ নামের বিশাল অ্যাপার্টমেন্টটা আমার কিংবা আমাদের হতাশ করেনি। কারণ শুধু অনলাইনে তাদের প্রচারে যা-ই ছিল, তাদের শতভাগই ছিল। চারটা অ্যাপার্টমেন্ট একই বিল্ডিংয়ে বুক করেছি। বুকিং-টুকিংয়ের ব্যাপারটা আমার অজানা কিংবা ঘাঁটাঘাঁটি করার মতো ধৈর্য আমার নেই। সুতরাং এ দায়ভারটা ছিল আমার স্ত্রী হেলেন, তার বড়বোন শিরীন এবং নিউইয়র্ক প্রবাসী জেনীর ওপর। বিশেষত জেনী এবং তার স্বামী শাহেদের পৃথিবীব্যাপী বছরে অন্তত তিন-চারটা ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ফেলে দেয়ার নয়। তাই অ্যাপার্টমেন্ট বুকিংটা আমাকে কিংবা আমাদের মাঝে একটা স্বস্তি নিয়ে এসেছিল।
প্রত্যেকটা ফ্ল্যাটেরই রুমগুলো মোটামুটি চওড়া, ছিমছাম সাজানো-গোছানো। প্রত্যেকটা অ্যাপার্টমেন্টেই আছে সুন্দর লাউঞ্জ। ডাবল দুটো বেডের অ্যাপার্টমেন্টে অন্তত আটজন একসাথে বসে খাবার মতো টেবিল-চেয়ার, সোফা, কিচেনও চমৎকার। লাউঞ্জের আলো এবং আসবাবপত্রের মাঝে ছিল একটা শৈল্পিক আবহ। আমার কাছে যা প্রত্যাশিত ছিল না। তারা অবশ্য বলেছিলো, দেখা যাক প্রচার দেখে বুকিং দিচ্ছি, হতাশ হলে কি আর করা!
সবকিছুই ছিলো অনলাইনে, অ্যাপার্টমেন্টের প্রধান ফটকের পিন নাম্বারটা দেয়া ছিলো এবং সাথে ছিলো প্রত্যেকটা অ্যাপার্টমেন্টের দরজার আলাদা আলাদা পিন নাম্বার। বলে রাখি, ছয়দিন অবস্থানকালীন এই সফরে একদিনও অ্যাপার্টমেন্টের কারো সাথে আমাদের দেখা হয়নি, এমনকি প্রয়োজনও পড়েনি, শুধু রুম ক্লিনিংয়ের জন্য পরিচ্ছন্ন কর্মীরা এসেছেন। এই বিশাল অ্যাপার্টমেন্টে কোনো অফিসও দেখিনি তাদের। একটা প্রয়োজনে শুধু ইমেইল করা হয়েছে এবং রেসপন্সও পাওয়া গেছে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। দুপুর একটার দিকে অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছি। নিয়ম অনুযায়ী ২টায় আমাদের চেক-ইন হওয়ার কথা। কিন্তু একটা অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়া বাকিগুলো প্রস্তুত ছিল। সুতরাং কোনো বেগ পেতে হয়নি। আমাদের বারোজনের বহরে আমার পরিবারের হেলেন ছাড়াও আমাদের তিন মেয়ে প্রভা আরিভা লিয়ানা, শাহেদ-জেনীর দুই মেয়ে সারিয়া সাব্রিয়া এবং শিরীন আপার দুই মেয়ে নিশাত এবং নওরীন। এখানে বলে রাখি আমাদের আগের আরেকটা ভ্রমণের কথা। ১৯১৪ সালে আমরা গিয়েছিলাম ফ্লোরিডায় আরেকটা বিশাল বহর ছিলো তখন। ছিলো আঠারো জনের গ্রুপ। এক আনন্দ সময় কাটিয়েছিলাম তখন। সে সময় ছিলেন আমাদের সাথে নিশাত-নওরীনের পিতা আলমগীর চৌধুরী। এক অসম্ভব আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন তিনি। আসর মাতিয়ে রাখার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। সেই আলমগীর ভাই হঠাৎ করে করোনাকালীন সময়ে চলে গেলেন। ম্যানচেস্টারের উইদিনশো হসপিটালে আমরা যখন অপেক্ষা করছিলাম তার জন্য, তখন ডাক্তার এসে বলেছিলেন ‘আমি সরি’। ফ্লোরিডা সফরের পর যুক্তরাজ্যের বাইরে নিজস্ব পারিবারিক ভ্রমণ প্রায়ই হয়ে থাকলেও বড় পরিসরে এক হয়ে কোথাও যাওয়া হয়নি। আর তাই এবারের যাত্রায় শিরীন আপা আমাদের সহযাত্রী হয়েছিলেন শুধু তার মেয়েদের নিয়েই।
২০২৩-এর জুলাই মাসের শেষের দিকের জুরিখ শহর। প্রথম দিনের বিকেলটা ছিল পরিচ্ছন্ন। গুগল ম্যাপ দেখে পাশের একটা পার্কে চলে যাই আমরা, হেঁটে এবং ট্রামে চড়ে পৌঁছি…। বিশাল হাঁটার জায়গাটা বিস্তৃত ব্যাপক। নারী-পুরুষ দৌড়াচ্ছে, বিকেলের ব্যায়াম। স্থানে স্থানে কিশোর-কিশোরীদের জন্য রাখা আছে বিনোদনের ব্যবস্থা। এমনকি ছোট ছোট ফান ফেয়ারের আয়োজন। পাশ ঘেঁষে আছে শান্ত জল, বিশাল হ্রদ আমার কাছে মনে হয়েছে নদী। নৌকা রাখা আছে, এই বিকেলেও মানুষজন নৌকা ভাড়া করে ছুটছে পানির ওপর। হঠাৎ করেই আকাশ মেঘে ঢেকে গেলো। রোদ চলেই গেলো, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে, পার্ক এবং লেকভিউটা মøান হতে থাকলো। এরপর এক প্রচণ্ড বৃষ্টি। প্রথমে বাসস্ট্যান্ড পরে বৃষ্টির ঝাঁজ এখানে সামলানো গেলো না। এখান থেকে সরে যেতে হলো আরেকটা নিরাপদ জায়গায়। প্রচণ্ড বৃষ্টির মাঝে ক্রমেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। প্রথম দিন, তাই নিরাপত্তা ভেবেই উবার ডেকে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসতে হয়।

দ্বিতীয় দিন : গন্তব্য লুজার্ন সিটি
শুরুতেই জানিয়ে রাখি ট্রেন-বাস-ট্রাম মনে হয়েছে সুইজারল্যান্ডে হাতের নাগালের মধ্যেই। জনপরিবহন ব্রিটেনের চেয়েও বেশি ব্যয়বহুল। যেহেতু মাত্র ছ’দিনের জন্য আমাদের সুইজারল্যান্ড অবস্থান, সে হিসেবে জুরিক শহরটাই আমাদের ঘোরাঘুরির প্রধান জায়গা নয়। হিসাব করে দেখলাম, দূরপাল্লার ট্রেন ভ্রমণে এবং ট্যুরিস্ট স্পট পরিদর্শনে একদিনেই হয়তো আমাদের এই বারোজনের ভ্রমণ ব্যয় হতে পারে দুই আড়াই হাজার পাউন্ডের মতো। তাই যাতে জার্নিব্যয়টা স্বস্তির মাঝে আনা যায়, সেজন্য আগের দিন রাতেই টিকেটের ব্যবস্থা করে নিই। আগেই জেনেছিলাম ভ্রমণকারীদের জন্য একটা ‘পাস’ আছে। এই পাস বা টিকেটটি ‘সুইস পাস’ হিসেবে পরিচিত। জেনেভা থেকে এ টিকেট কিনলে এটা হয় জেনেভা পাস। সুবিধা হলো এই পাস বা টিকেট দিয়ে দেশের যে কোনো শহরে ভ্রমণ করা যায়। ট্রেন-বাস-ট্রাম ঐ একই টিকেটেই যাত্রী হওয়া যায়। শুধু তাই নয়, এমনকি দেশের অধিকাংশ ট্যুরিস্ট স্পটেরও অ্যান্ট্রি এই টিকেট। এতে লেকে কিংবা নদীতে বোট রাইডও অন্তর্ভুক্ত, এতে উঁচু উঁচু মাউন্টেনগুলোর ট্রেন রাইডও অন্তর্ভুক্ত। তবে ব্যয়বহুল স্পটগুলো যেমন উঁচু মাউন্টেন ভ্রমণে (ট্রেন সার্ভিস) প্রতিজনের ১০০ পাউন্ডের টিকেটে ৬০ পাউন্ড দিয়ে কেনা যায়। এই টিকেট যদিও হিসাবের বেলায় খুবই এক্সপেনসিভ, তবুও আমরা জুরিকে অবস্থান করে ব্রিটেনের বাসিন্দা হিসেবে মনে হয়েছে এটা যে কোনো ভ্রমণকারীর একটা সুলভ মূল্যের টিকেট। সুইজারল্যান্ডের বাইরের দেশের মানুষ অর্থাৎ ভ্রমণকারীদেরই এই পাস ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। ১২ বছরের নিচের যে কোনো শিশু একটা ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত থাকলে ঐ শিশুটির ফ্রি পাস হয়ে যায়। আবার পাঁচজনের বেশি এক পরিবারের সদস্য হিসেবে গ্রহণও করে না। তাই আলাদা আলাদাভাবে আমরা আমাদের টিকেটগুলো বুকিং করতে হয়। আমরা আমাদের পরিবারের পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য কিনি ৯০০ পাউন্ডের টিকেট। শাহেদ-জেনীর এক মেয়ে ফ্রি থাকায় তাদের তিনজনের জন্য ব্যয় করতে হয় আরও ৬০০ পাউন্ড। শিরীন আপার পরিবার তাদের তিনজনের জন্য একই মূল্য পরিশোধ করেন। তা-ও আমরা এই টিকেট কিনি পাঁচ দিনের জন্য। শেষ দিনটা ছিল আমাদের জুরিক দেখা, তাই।
আমরা জুরিক ছাড়াও ভ্রমণ করেছি সুইজারল্যান্ডের রাজধানী ব্রার্ন, লুজার্ন, ইন্টারলেকান, রেইনফল প্রভৃতি শহর। বাণিজ্যিক হাব কিংবা অফিসিয়াল গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর চেয়ে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি প্রকৃতির সঙ্গে লেপ্টে থাকা নয়নাভিরাম শহরগুলো, যেগুলো আগেই আমরা আমাদের লিস্টে রেখে দিয়েছিলাম। কারণ এই শহরগুলোর প্রকৃতি জীবনকে অন্যভাবে ভাবাতে পারে, পাহাড়ের চূড়ার মেঘমালা যেন ছুঁয়ে দেখার এক বিস্ময়কর অনুভূতি হারিয়ে দিতে পারে যে কাউকে আকাশের নীল নিলিমায়। লেকের নীল জলরাশির মৃদু হাওয়া হৃদয়ে এসে ধাক্কা মারে, আমাদের যান্ত্রিক জীবনটাকে যেন বারে বারে হালকা করে দিয়ে যায়।
আমরা যে যে শহরগুলোতে গেছি ব্যক্তিগত বাহনের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এমনকি জুরিকও গণপরিবহনে কোনো ট্রাফিক দেখিনি। খুব কম জায়গায়ই ট্রাফিকের লম্বা লাইন দেখেছি। তবে পিক সময়ে ট্রেনগুলোতো থাকে ভিড়। দূরপাল্লার ট্রেনগুলোর প্রায় সব কটাই দোতলা। আয়েশে বসে ভ্রমণ করা যায়। আয়েশও মাঝে মাঝে থাকে না, ঐ যে বললাম, যখন রাজধানীর দিকে কিংবা জেনেভার দিকে ট্রেন চলে সকালের দিকে।
আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের মাত্র ২০ মিটারের মধ্যেই লোকাল ট্রেন স্টেশন। ২৬ জুলাই সকালের নাস্তা সেরে সেখান থেকেই শুরু। জুরিক স্টেশনে গিয়ে ট্রেন বদল। যাত্রা লুজার্ন সিটি। লুজারনড সুইজারল্যান্ডের একটি শহর, যা তার অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক আকর্ষণের জন্য খ্যাত। লুসার্ন শহরটি লুসার্ন লেকের তীর ঘেঁষেই তার সৌন্দর্য বাড়াচ্ছে। শহরটি সুইস আল্পস দ্বারা বেষ্টিত। স্বচ্ছ নীল হ্রদ এবং তুষার-ঢাকা পর্বত বিস্ময়ে বিস্ফোরিত করে চোখ, হ্রদের পাশে দাঁড়ালে কিংবা নৌকায় চড়ে পাহাড়ের সান্নিধ্য পেতে নীল জলের পাশ ঘেঁষে ছোট বাড়িগুলো মনে হয় ভাসছে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায়, ঐ কি ডুবে যায় গ্রামগুলো নৌকার ঢেউয়ের আবহে। আর সে জন্যই শহরের অনিন্দসুন্দর চিত্রগুলো এটিকে পর্যটকদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য করে তুলেছে।
সুইস আল্পস হলো সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত নয়নাভিরাম পর্বতশ্রেণি, যা দেশের দক্ষিণ অংশজুড়ে বিস্তৃত। রুক্ষ ল্যান্ডস্কেপে প্রকৃতির বিস্ময়কর সৌন্দর্য এবং সারা শহরজুড়েই আছে বিনোদনের অনিঃশেষ সুযোগ। সুইস আল্পস সুইজারল্যান্ডের পরিচিতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এবং সে জন্যই সারা পৃথিবীর হাজার হাজার পর্যটক, অভিযাত্রী এবং প্রকৃতিপ্রেমীদের এই শহরটি আকর্ষণ করে। সুইস আল্পস সুইজারল্যান্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে, ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রিয়া এবং লিচেনস্টাইনের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিস্তৃত। পরিসরটি উচ্চ শিখর, গভীর উপত্যকা, হিমবাহ এবং আলপাইন তৃণভূমি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সুইস আল্পসের সবচেয়ে বিখ্যাত কিছু শৃঙ্গের মধ্যে রয়েছে ম্যাটারহর্ন, আইগার, জুংফ্রাউ, মন্ট কোলন এবং ডুফোরস্পিটজে- সুইজারল্যান্ডের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
সুইস আল্পসের ল্যান্ডস্কেপগুলো অবিশ্বাস্যভাবে বৈচিত্র্যময়। ট্রেনে যেতে যেতে দেখছিলাম শান্ত কোথাও ধীরলয়ে বয়ে যাওয়া স্রোতের স্বচ্ছ-শান্ত নীল জল। চোখ জুড়িয়ে যায় হৃদগুলোর পাশ ঘেঁষেই নয়নাভিরাম গ্রামগুলো। গ্রামের ঘর কিংবা বাসাগুলো মনে হয় যেন জীবন্ত স্ট্যাচু…ট্রেন যাচ্ছে, কোথাও ঘন সবুজ বনরাশির মাঝে চোখ আটকে গেছে আবারও সেই স্বচ্ছ জল, গ্রামগুলো যেন ফুলের বাগান। কোথাও আটকাতে পারি না চোখ, ট্রেন দ্রুত আরও দ্রুত আগাচ্ছে, গ্রামগুলোও আমার সাথেই যেন দৌড়োচ্ছে তার সৌন্দর্য জানান দিতে মাইলের পর মাইল। অন্যদিকে নীল পাহাড় ঐ দূর থেকে আহ্বান করছে তাকে আরোহণের।
লুজার্ন স্টেশনে নামার পর সামান্য কিছু জায়গা হাঁটার পরই স্টেশনেই দেখি শৈল্পিকভাবে তৈরি ত্রিকোনাকৃতি একটা স্তম্ভ, তা-ও তিন স্তরে এখানেই উপরের অংশে লেখা উধং াড়ৎঢ়ৎড়লবশঃ এবং মাঝখানে লেখা উঁৎপযমধহমনধযহযড়ভ খুঁবৎহ অর্থাৎ স্টেশনের নামই হয়তো এগুলো তাদের ভাষায়। প্লাটফর্ম পেরিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি, যেখানে দিয়ে হাঁটছে অগণন মানুষ। রাস্তার পাশ দিয়েই যাচ্ছে অসংখ্য পর্যটক, একটা ছোট্ট নদীর মতো মনে হয়। দুই পারে যেন সাজানো বাগান। নদীর মাঝ খানে কাঠের সাঁকো। ‘এল’ আকৃতির এই ব্রিজটিতে আছে একটা ভিন্নতা। ব্রিটেনের ব্লাকপুল কিংবা লানডুডনো কিংবা অন্যান্য সমুদ্রের পার ঘেঁষেও আছে হাঁটার লম্বা ব্রিজ। এগুলো মূলত খোলা, কোনো ভিন্নতা নেই। শুধুই হাঁটে মানুষ সমুদ্রের কাছাকাছি যায় কিংবা বরশি নিয়ে মাছ ধরতে অপেক্ষা করে দীর্ঘসময়। কিন্তু লুজার্নের এই সাঁকোটার ওপরেও ছাদ, বাংলাদেশের যেটাকে বলে দোচালা। ইচ্ছে করলেই ছোঁয়া যায় না এ চাউনি। মানুষের নাগাল থেকে অনেক উপরে। রোদে উজ্জ্বল ছিলো দিনটি, হঠাৎ করেই বৃষ্টি এলো; কিন্তু কাউকেই ছোটাছুটি করতে হয়নি। হয়তো এই আইডিয়া থেকেই কাঠের ওপর কারুকাজ করে গোটা ব্রিজটি শিল্পময় করে তোলা হয়েছে, কাঠ দিয়েই। ব্রিজের শুরু কিংবা শেষ শুধুই ফুলের সমারোহ, বাইরে কিংবা ভেতরে লাল-হলুদ ফুলগুলো একই লেয়ারে যেন জীবন্ত হয়ে আছে। ব্রিজের নিচ দিয়ে ধীরে বয়ে যাচ্ছে শান্ত জল। যা পর্যটকদের সেলফি আর ছবি তুলতে উদ্দীপ্ত করে তোলে।
এপার থেকে ওপারে হাঁটি, ততক্ষণে দুপুরের ক্লান্তি ভর করেছে সবার। আবারও রোদ উঠে, চারদিকেই খাবারের আয়োজন। ক্রমেই ব্যস্ত হয়ে উঠছে বার আর রেস্টুরেন্টলো। আমরা খুঁজি ব্রিটেনের ধাঁচে পরিবেশিত কোনো খাবার। জুরিখের কিছু রেস্টুরেন্ট আছে, সেগুলোর মতো আমরা হালাল খাবরের জন্য এ গলি ও গলিতে ঢুঁ মারি, তা আর হয়ে উঠে না। তারপর দ্বিতীয় চয়েসের পিজ্জার জন্যই বসে পড়ি নদীর ধারেরই এক রেস্টুরেন্টের একটি বিশাল ছাতার নিচে। প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে উঠেছে পানাহারের জায়গাগুলো। অর্ডারের অন্তত ৪৫ মিনিট পর আসে বলতে গেলে আমাদের আপাতত কাক্সিক্ষত খাবার। এরই মাঝে আসে বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টি, ঝরে অবিরল।
আবারও রোদ ঝিলিক দেয়। ঐ নদীরই অন্যপারের সাথে যানবাহন আর সাইকেলের সংযোগ যে রাস্তাটি, সেই রাস্তাটিও একটা ব্রিজ। সেই ব্রিজ ধরে যখন অন্য একটা দর্শনীয় জায়গায় যাওয়ার জন্য তাড়া, ঠিক তখনই চোখে পড়ে নদীর মাঝখানে লোহানির্মিত একধরনের বেড়া (ফেন্স) দিয়ে পানির গতিপথ আরও ধীর করা হয়েছে এবং অন্যপ্রান্তে স্রোত বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সেই স্রোত আর বেড়াটি মানুষ ফোনে বন্দি করছে নিজেকে সাথে নিয়েই, রোদ উঠছে পাশাপাশি ব্রিজের ওপর ভিড়টা বাড়ছে। সুতরাং সেখানকার ভিড়টার সাথে আমরাও মিশে যাই একসময়।
রোদ ঝিলিক দিলেও ঝলকিত হয়ে উঠেনি বিকেল। আমরা হাঁটতে থাকি। এবারে নৌকাভ্রমণ। সমুদ্র নয় একটা বিশাল হ্রদ, (বলা যায় বাংলাদেশের হাওর) বিস্তীর্ণ, এক ধার থেকে অন্য প্রান্ত যেন দৃষ্টিসীমার বাইরে, আমরা ছোট্ট জাহাজের মতো বুট কিংবা নৌকার জন্য আপেক্ষা করছি। আরও আধা ঘণ্টার মতো সময়। ঠাণ্ডা বাতাস আমাদের সবাইকেই হালকা কোট পরিয়ে দেয়। গরম পানীয়ের জন্য হ্রদের পারেরই একটি দোকানের দিকে এগোচ্ছি, আর শোনছি বাজছে ড্রাম, বিশাল মঞ্চে স্থানীয় শিল্পীরা গান শোনাচ্ছে পর্যটকদের, স্থানীয় মানুষদের। একটা চমৎকার কফি সোপের দিকে এগোচ্ছি। দুটা ‘লাটে’ অর্ডার দিয়ে কার্ড বের করলে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে কী জানি বলল, তারপর সরি বললে মেয়েটি বলল পে করার প্রয়োজন নেই এটা নতুন কফির প্রমোশন। তাকে বলি, আমার সাথের কেউ কি নিতে পারবে এ ফ্রি অফার। আবারও সেই হাসি, সবার জন্যই আজ এটা ফ্রি।
বুট অর্থাৎ নৌকা এলো। অনেক আগেই লম্বা লাইন লেগেছিলো হাওরের পারে। আমরাও ছিলাম লাইনের মধ্যবর্তী। বিশাল এই নৌকাটিতে উঠি, ভেতরে বসার জায়গা। যে যার মতই বসেছে। কেউ জানালার পাশে, কেউবা হয়তো ঠাণ্ডা কিংবা গরম পানীয় নিয়ে শুধুই পানি দেখছে, কেউ দূরবীন নিয়ে ঐ পাহাড়ের চূড়ো অবলোকন করছে। আমরা ভেতরে যাই না। ঠাণ্ডা হাওয়া থাকলেও হালকা জ্যাকেট পরা আছে আমাদের, আমরা নৌকাটির সামনেই পেতে রাখা কয়েকটি চেয়ারে বসে পড়লাম। খোলা জায়গা, পত পত করে এগোচ্ছে নৌকা। একদিকে নৌকার ইঞ্জিনের নরম এক আওয়াজ, অন্যদিকে বৃষ্টি ঝরছে ঝমঝম… আমাদের মেয়েগুলো ছবি তুলছে দূর পাহাড়ের, শাহেদ তার স্বভাবসিদ্ধ অসাধারণ সেলফি তুলে সবাইকে ফোনে বন্দি করেন, যেখানে দূর পাহাড়ও আমাদের পেছনে থাকে, থাকে হাওরের শান্ত জল। আমি দেখছি পানির সাথে কীভাবে দুলছে সমতল, ওপারের ঘরগুলো ডুবছে পানির ঢেউয়ে আবার যেন ভেসে উঠছে, সারি সারি ঘর পানির ওপরই যেন ভাসছে। এতক্ষণে নৌকা ভিড়েছে এপারে। অনেকেই এ পার দেখবে বলে নেমে গেলো। আমরা ইচ্ছে করেই নামলাম না। কারণ একদিকে বৃষ্টি, অন্যদিকে ওপারে যেতে দেরি করলে ট্রেন হয়তো খোয়াতে পারি জুরিখের। যদিও একঘণ্টা পর আবার আরেকটা নৌকা ভিড়বে এখানে, নিয়ে যাবে এ গ্রাম পর্যটন করা পর্যটকদের। এ নৌকায়ই ফিরে আসলাম আমরা। বৃষ্টিতে সয়লাব হয়ে গেছে তখন, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নিয়ে আমরা হুড়মুড় করে নেমে পড়লাম। তারপর খোলাবাজারের চাউনিগুলোতে হাজারো মানুষের সাথে আমরাও মিশে গেলাম। আঁধার নামছে, গরম কিছু খাবার এবং আবারও গরম কফি পান শেষে ট্রেনের জন্য পার্শ্ববর্তী ট্রেনস্টেশনের দিকে গন্তব্য আপাতত।

তৃতীয় দিন : ইন্টারলেকেন
ইন্টারলেকেন হলো সুইজারল্যান্ডের একটা মনোমুগ্ধকর শহর, যা থুন এবং ব্রিয়েঞ্জ হ্রদকে (লেক) কেন্দ্র করেই যেন এর মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। সুইস আল্পসের শ্বাসরুদ্ধকর চূড়া দ্বারা বেষ্টিত এই শহরটি। এর সুউচ্চ চূড়াগুলো থেকে যেন বিচ্ছুরিত হয় রোদের উজ্জ্বলতা। শহরটা এক অদ্ভুত সৌন্দর্যে আচ্ছন্ন করে যে কোনো পর্যটককে। অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক দৃশ্য পাহাড় আর সুউচ্চ চূড়াগুলো যেন মানুষকে আহ্বান করে পাখির মতো উপরের দিকে ক্রমশই আরোহণ করতে। অ্যাডভেঞ্চার কিংবা সাহসী অভিযান যাদের পছন্দ, ইন্টারলেকেন সেই মানুষদের যেমন টানে পর্বতারোহণে, প্যারাগøাইডিংএ কিংবা নৌকাভ্রমণে, ঠিক তেমনি প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্যও যেন সাজানো রয়েছে নয়নাভিরাম দৃশ্য। শহরটি জাংফ্রাউজোচ এবং শিলথর্নের মতো আইকনিক সুইস গন্তব্যের প্রবেশদ্বার হিসেবেও কাজ করে। এর মনোরম পরিবেশ এবং দুঃসাহসিক কাজ এবং প্রশান্তি মিশ্রিত ইন্টারলেকেন সারা বিশ্ব থেকে ভ্রমণকারীদের মোহিত করে।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, লেক থুন এবং লেক ব্রিয়েঞ্জের ঝিলমিল জলের মধ্যে আটকে থাকা এবং রাজকীয় আলপাইন শৃঙ্গ দ্বারা আলিঙ্গন করা, ইন্টারলেকেন শহরটি। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন বিমোহিত করে, তেমনি আছে এর চমকপ্রদ ইতিহাস। সুউচ্চ পর্বত থেকে নিচে নেমে আসছে এখানে জলের ধারা, সিলেটের মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের মতো। আছে বলিউড অর্থাৎ ভারতীয় সিনেমার সাথে একটি অপ্রত্যাশিত সংযোগ, যার সৌন্দর্যে সুইজারল্যান্ড যেন হয়ে যায় দর্শকদের কাছে ভ্রমণ করার এ লোভনীয় দেশ হিসেবে।
ইন্টারলেকেনের প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্য ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি পরিচালক ইয়াশ চোপড়ার চোখ এড়ায়নি। তিনি তার বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে ইন্টারলেকেনের পাহাড়-পর্বতের অপরূপ সাজে সজ্জিত শহরটাকে পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করে এই শান্ত শহরটিকে তুলে ধরেছেন দর্শকদের কাছে। চোপড়ার চলচ্চিত্রগুলোতে ইন্টারলেকেনের নির্মলতা এবং সৌন্দর্যকে এতটাই প্রদর্শন করা হয়েছে যে, এটি অনেকের কাছেই স্বপ্নের ভ্রমণ-গন্তব্য হয়ে উঠেছে। আর শহরটিও তাই চোপড়াকে সম্মান দিয়েছে… প্রতি বছর এই শহরটাতে বিশ্বের হাজারো-লাখো ভ্রমণপিপাসু মানুষদের লোভনীয় শহর হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য চোপড়ার একটি মূর্তি (স্ট্যাচু) স্থাপন করা হয়েছে। এই শহরেরই একটা ক্যাসিনোকেও তিনি তার চলচ্চিত্রের ফিতায় জায়গা করে দিয়েছিলেন। হয়তো তাই, এসব কিছুকে মনে রেখেই এই ক্যাসিনোর পাশাপাশি ইন্টারলেকেনের কেন্দ্রীয় উদ্যানে ভারতীয় চলচ্চিত্রের অহংকারের প্রতীক হিসেবেই জায়গা করে নিয়েছেন ইয়াশ চোপড়া। এই মূর্তিটি দেখার পাশাপাশি এ উদ্যানটিও আমাদের টেনেছে। ভ্রমণপিপাসু মানুষ কিংবা ইতিহাস সন্ধানী কিংবা চলচ্চিত্রের প্রতি ঝোঁক থাকা যে কারো জন্য এ স্ট্যাচুটি একটা বিস্ময়, কারণ এটি নির্মাণ করেছে এই শহরেরই স্থানীয় প্রশাসন।
রাইডিং দ্য ট্র্যাক অব হিস্ট্রি : ইন্টারলেকেনের একটা মনমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা হলো ‘ঝপযুহরমব চষধঃঃব’র (স্কিনিজ প্ল্যাট) ঐতিহাসিক ট্রেনে যাত্রা। সমতল থেকে উপরের দিকে আরোহণ করতে থাকে ট্রেন, আমাদের সঙ্গে যাত্রীরাও আছে, অথচ একটা ভয়ও কাজ করেছে আমার, যদিও বুঝতে দিইনি কাউকে, তবে দুঃসাহসী অভিযানের মতোই মনে হয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে কিংবা মাধ্যমিক স্কুলে পড়ুয়া কিংবা চাকরি জীবনে প্রবেশ করা আমার মেয়ে কিংবা ভাতিজিগুলো এ যাত্রাকে নিয়েছে নিছক একটা আরোহণের থ্রিল হিসেবেই।
রোদে ঝলমল ছিলো দিনটি। ডরষফবৎংরিষষ নামের একটা স্টেশন থেকে উপরের দিকে উঠছে ট্রেন, গন্তব্য ঝপযুহরমব চষধঃঃব। আমরাসহ ভিন্ন ভিন্ন দেশের শিশু-কিশোরসহ অনেক মানুষেই ভর্তি ট্রেনের কামরাগুলো। স্বাভাবিক ট্রেনের মতো এত বড় মনে হয় না ট্রেনটি। তবে ভেতরের পরিসর খোলামেলা। হাঁটা যায়, সেলফির জন্য অনেকেই জানালা খোলেও শক্ত করে হাতে ফোন ধরে গাছ-গাছালি আর নিচের আবাসন কিংবা হ্রদকে ধারণ করে।
১৮৯৩ সালে চালু হওয়া রেললাইনটি সে সময়ের প্রযুক্তির একটা বিস্ময়। ১২০ বছরেরও বেশি সময় পূর্ব থেকে চালিত হয়ে এ ট্রেনলাইনটি এখনো সেই বৈদ্যুতিক লোকোমোটিভ (ভ্রমণ সহায়ক শক্তিশালী রেলগাড়ির ইঞ্জিন) দিয়েই পরিচালিত হয়। এক ধরনের দাঁতাল (কগহুইল) চাকা এই ট্রেনটিকে উপরের দিকে টেনে নেয় এবং নিচের দিকেও নামায়। এই ঊর্ধ্বমুখী আরোহণে (যাত্রা) ট্রেন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার মিটার উপরে আমাদের নিয়ে যায়, যা যে কোনো মানুষকেই রোমাঞ্চিত করে তোলে। পাথর কেটে কেটে বানানো হয়েছে পথ, কখনো কিছু সময়ের জন্য ঢুকছি আমরা গুহার ভেতর, …মনে হয় পাথরের মধ্যেই অন্ধকারে চলছে ট্রেন ঝমাঝম। আবার গুহা থেকে বাইরে বেরিয়েই সবুজ গাছ-গাছালির মাঝে পাখির কিচির-মিচির, বিচ্ছুরিত রোদের ঝিলিক। উপরে আরোহণ করতে করতে পথের ধারেই যেন হাতছানি দেয় ঊরমবৎ (এইগার), গস্খহপয (মন্ক) এবং ঔঁহমভৎধঁ (জাউংফ্র) চূড়ার শ্বাসরুদ্ধকর মনোরম দৃশ্য।
আল্পাইন গ্রিন কার্পেট : স্কিনিজ প্ল্যাটের শীর্ষে পৌঁছানোর পর এক পার্থিব দৃশ্য, ডান দিকে চোখ রাখি, মনে হয় কাজী নজরুলের সেই গানটি ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায়’…এই রৌদ্রজ্জ্বল মধ্যাহ্নে বরফের ওপর চিকচিক করছে রুদ্দুর, যেন হাত দিলেই স্পর্শ করা যায় উড়ে যাওয়া মেঘমালার সেই পার্থিব দৃশ্য সমান্তরাল দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের আরেক চূড়ায়। এ চূড়ায় পৌঁছে অপ্রত্যাশিত দৃশ্যের মুখোমুখি হয় পর্যটকরা- যেন আকাশে একটি আলপাইন বাগান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক অনেক উঁচু এই পাহাড়ের বাগানে ৬৫০টিরও বেশি প্রজাতির গাছপালা বেড়ে ওঠেছে, যা এই পাহাড়ের জীববৈচিত্র্যকে করেছে আরও সমৃদ্ধ। যদিও এই বৈচিত্র্য শুধুই প্রাকৃতিক নয়, এটি তৈরি করেছে তারাই, যারা ভালোবাসে জীববৈচিত্র্য, যারা পরিশ্রম করতে জানে, যারা ভালোবাসে প্রকৃতির নিখাদ সৌন্দর্যকে এবং এরাই সেই কৃষকরা যারা শতাধিক বছর থেকে এই জমিগুলো চাষ করছেন। প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আর কৃষকদের নিখাদ ভালোবাসায় সারা পাহাড়েই ছড়িয়ে আছে সবুজের সুশান্ত বাতাস। তাদেরই হাতের ছোঁয়ায় পাহাড়ের চূড়ায়ও জেগে উঠেছে পুষ্পের বাগান, যেন গ্রিন কার্পেট, যা সারা গ্রীস্মজুড়ে পর্যটকদের টানে, আকর্ষণ করে।

গ্রিন্ডেলওয়ার্ল্ড গ্রাম : দাঁতাল চাকার ট্রেন দিয়ে উপরে আরোহণ করাটাই শুধু নয়, স্কিনিজ প্ল্যাটের অভিযানটি বিস্ময় জাগায়। অল্প অল্প করে ট্রেন চলতে থাকে, আরোহণ করে উপরের দিকে… দুদিকে তাকালেই থরে থরে সাজানো ঘরগুলো যেন সবুজের মাঝে বন্য কোনো স্থাপত্য। এই ঘরগুলো নিয়েই গ্রিন্ডেলওয়ার্ল্ড (সুইস গ্রাম)। গ্রিন্ডেলওয়ার্ল্ডের ইতিহাস তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মতোই চিত্তাকর্ষক। ব্রোঞ্জ যুগের বসতির প্রতœতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকেই বলা হয় এই গ্রামটি ৩ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। গ্রিন্ডেলওয়ার্ল্ড তার গ্রামীণ আল্পাইন স্থাপত্য, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং আইগারের উত্তরমুখী নিখুঁত দৃশ্য দিয়ে পর্যটকদের মোহিত করে রাখে গরমকালের এই দিনগুলো।
সিনেম্যাটিক সংযোগ, ঐতিহাসিক বিস্ময়, কৃষিকাজে অর্জন এবং কালজয়ী গ্রামের আকর্ষণের অনন্য মিশ্রণের সাথে ইন্টারলেকেন শহর অন্য যে কোনো ভ্রমণের চেয়ে একটা ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসবে বলেই আমার বিশ্বাস। সুইজারল্যান্ডের দুর অতীতের ঐতিহ্য অবলোকনের জানালা হিসেবে কাজ করে এই শহর। হাজার হাজার বছর থেকে মানুষের বুদ্ধিমত্তা আর নিরলস শ্রমে মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রার একটা চমৎকার শহর ইন্টারলেকেন। আর সেজন্যই সিনেমাটিক ল্যান্ডস্কেপ হিসেবে এই শহর হাতছানি দেয় বারবার। এই শহরে হাঁটা-চলা কিংবা চারদিক অবলোকন করা কিংবা বিস্ময় নিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকা শুধু একটা ভ্রমণই নয়, এটি সময়, সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির মধ্য দিয়ে একটি ভ্রমণ যা সারাজীবনের স্মৃতিই থেকে যায়।
পাহাড়েও রোদ ছিলো, তবে এত ঝাঁজ ছিলো না, নেমে এসে মনে হলো এ রোদে এক ভিন্ন তেজ। লোকাল ট্রেনের সময় এখনো হয়নি। এ ট্রেনটি ধরেই আমরা ধরবো আরেকটা ট্রেন। ডরষফবৎংরিষষ (উইল্ডারসউইল) স্টেশনে একসময় ট্রেন আসে, হুড়মুড় করে উঠে পড়ি লোকাল ঐ ট্রেনে। ইন্টারল্যাকেনের প্রধান স্টেশনে এসেই হালকা খাবার খেয়ে জুরিখমূখী ট্রেনে চড়ি। আগামী তিন দিনের ভ্রমণ-সিডিউলে লেগে যান শাহেদ আর জেনী- যে তালিকায় আছে রেইনফল শহর, নায়েগ্রার জলপ্রপাতের মতো না হলেও বিস্তৃত যেখানকার জলের ধারা (জলপ্রপাত) পর্যটকদের টানে এই শহরটার দিকেই। এ তালিকায় আছে রাজধানী ব্রার্ণ শহর, আছে জুরিখ ঘোরে দেখা, জুরিখের ঐতিহাসিক চকলেট কারখানা এবং ফুটবল মিউজিয়াম।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়