গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

ছেলেটি সুস্থ হয়ে উঠেছিল : কামরুল হাসান বাদল > গল্প

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হঠাৎ করে গিয়েছিল, হঠাৎই ফিরে এলো।
তন্ময় বলল, ধ্যাৎ, শালারা জ্যোৎস্নাটাও উপভোগ করতে দিল না।
কী মনে করে ছাদের কিনারায় যাচ্ছিল মম। হাঁটা থামিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে বলল, কী বললে? তোমার মুখে এমন ভাষা মানায় না তন্ময়। কেমন যেন শোনায়।
কেমন শোনায়? ছোটলোকের মতো শোনায়?
কথা কেড়ে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে তন্ময়।
তন্ময়ের প্রতিক্রিয়া দেখে একটু অবাক হলো মম। সামনে এগিয়ে এসে তন্ময়ের কাঁধে হাত রাখে।
‘আসলেই খেপে গেছো দেখছি। আরে বাবা বিদ্যুৎ বিভাগ কী করে জানবে এই শহরের এক রোমান্টিক যুবক তার প্রেমিকাকে নিয়ে ছাদে পূর্ণিমার চাঁদ দেখছিল। কারো পূর্ণিমা দেখার সুবিধা করে দিতে কী বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা যায়?’
কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে এবার তন্ময়ের নাকটা আলতো করে টিপে দিয়ে বলল, আসো ছাদে শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখি। তাতে সুবিধা হবে কী জানো? বিদ্যুতের আলো কোনো বাধা হবে না।
‘দারুণ আইডিয়া’ -বলে সঙ্গে সঙ্গে ছাদে শুয়ে পড়ে তন্ময়।
মমের শাড়ির পাড় ধরে টান দিয়ে বলে, ‘কই আসো’।
তন্ময়ের পাশে শুয়ে পড়ল মম।
তন্ময়রা এখানে ভাড়া থাকে। এ এলাকায় এখনও জনসংখ্যার চাপ কম। বাড়িঘরগুলোও ফাঁকা ফাঁকা। আশপাশে মিলে এটিই একমাত্র সাততলা বাড়ি। এ কারণেই বাড়িওলা বোধহয় প্রটেকশন ওয়ালটা যথেষ্ট উঁচু করেননি। তারপরও রাতে বা দিনে ছাদে ঘুরে বেড়াতে কোনো সমস্যা হয় না।
আচ্ছা তুমি কি জান শুধু পূর্ণিমার জ্যোৎস্না উপভোগের জন্যে একজন মেয়র শহরে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতেন কিছুক্ষণ?
মমের দিকে ফিরে হাতের তালুতে মাথা রেখে বলে তন্ময়।
তাই নাকি? কী দারুণ ব্যাপার! আমাদের তো ওই শহরে চলে যাওয়া উচিত।
বিস্মিত হয় মম।
যাবে? গেলে শুধু শহরটা দেখবে, লোকটাকে দেখবে না।
কেন, তিনি এখন মেয়র নেই?
উনি এখন পৃথিবীতেই নেই। রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছেন।
তিনি কোন দেশের, কোন শহরের মেয়র ছিলেন?
তিনি বাংলাদেশের মানুষ। সুনামগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন পদটাকে মেয়র বলা হয়।
কী বলো? শুনিনি তো আগে! বিস্ময়ের ঘোর কাটে না মমের।
হ্যাঁ, উনি যখন পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন তখন প্রতি পূর্ণিমায় শহরে কিছুক্ষণের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকতো। মানুষ যেন পূর্ণিমা উপভোগ করতে পারে।
বলতে বলতে উঠে বসে তন্ময়। মমও উঠে বসে শাড়ি ঠিক করতে করতে বলে, ‘খুব ইন্টারেস্টিং!’
তার নাম দেওয়ান মমিনুল মউজদিন। উনি হাসন রাজার বংশধর ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো তিনি কবি ছিলেন।
মমিনুল? তাঁর নাম আগে শুনেছি মনে হচ্ছে। তাহলে তো তাঁর কবিতা পড়তে হবে। নিশ্চয়ই বইগুলো পাওয়া যাবে? নামটি কোথায় শুনেছে মনে করার চেষ্টা করল মম।

তন্ময় এবার দাঁড়িয়ে যায়, সঙ্গে মমও দাঁড়ায়।
একটি কবিতার সামান্য মনে আছে, শোনাতে পারি।
শোনাও না বাবু আগ্রহটা চেপে রাখতে পারে না মম \
তন্ময় পড়ে-
‘তারপর উঠে এসে মশারিটা তুলে ফেলে
তোয়ালেটা ভাঁজ করে রাখে আলনায়
অতঃপর সন্তর্পণে শিয়রে নিবিড় বসে
আমার চুলের যত অলিগলি মেঠোপথে
নিপুণ আঙুল তার বেড়াতে বেরোয়
এইভাবে কাটে দিন তুমিহীন একাকী প্রহর।’
এর আগে পরে আরও ছিল নিশ্চয়ই। আগ্রহ নিয়ে বলে মম।
মনে নেই তো বাবা, সেই কবে পড়েছিলাম
এমন সময় সিঁড়িতে কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। দেখত দেখতে ধুমধাম পা ফেলে ওদের সামনে এসে দাঁড়ায় শিহাব।
কী আলাপ করছিলে দুজন, আমায় দেখে বন্ধ করলে কেন? বলো, বলো, বলতে থাকো।
শিহাবকে হঠাৎ দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে যায় মম। তন্ময়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। যেন লুকাবার চেষ্টা করছে সে।

দুই.
শিহাবের সঙ্গে মমের দেখাটা অকস্মাৎ। কিন্তু জীবনে শিহাব যেন একটি দুর্ঘটনার নাম হয়ে গেল। এক পলকের সামান্য মুগ্ধতা আর তার সাবলীল প্রকাশ মমের নিস্তরঙ্গ জীবনে টর্নেডোর ঝড় বইয়ে দিয়েছে।
একবার একসঙ্গে লিফটে উঠছিল মম আর শিহাব। সেই প্রথম দেখা। লম্বা চুল আর মায়াবি চোখ দেখে দারুণ ভালো লেগেছিল মমের। বয়সে তার চেয়ে বেশ ছোট হবে তাই কিছু না ভেবেই বলে ফেলেছিল, ‘তোমার চুলগুলো তো দারুণ!’ তুমি করে বললাম, স্যরি।
বিন্দুমাত্র দেরি না করে বলল শিহার, আমার তো শুধু চুল। আপনার তো নখ থেকে চুল সবই সুন্দর, অপূর্ব।
বলার মধ্যে এমন একটি জাদু ছিল যেন, সম্মোহিতার মতো মম বলল, ‘তাই বুঝি!’
কেন, কেউ আপনাকে বলেনি? আপনি অপহৃত না হয়ে এখনও মুক্তভাবে চলাফেরা করেন কী করে?
ততক্ষণে লিফট পৌঁছে গেছে সাততলায়। খেয়াল নেই মমের। এক অদ্ভুত মায়াবী জগতে হারিয়ে গেছে সে। ছেলেটির কথায় সম্বিৎ ফিরে পায়।
আপনি তো এ তলাতেই নামবেন?
মায়ার জগৎ থেকে বাস্তবে নেমে আসে মম।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি? না না আপনি?
আমি তো চারতলাতে নামতাম। আপনার জন্য এ পর্যন্ত ওঠা। যাই, তবে সাবধানে থাকবেন ডাকাত কিন্তু আশপাশেই আছে।
এরপর থেকে মম নয়, মমের জীবনের শান্তিটাই ডাকাতি হয়ে গেল।
শিহাব চারতলায় থাকে বাবা-মায়ের সঙ্গে। দু পরিবারে আসা-যাওয়া না থাকলেও মি. ও মিসেসের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলে কেমন আছেন, ভালো আছি পর্যন্ত কথাবার্তা হয়েছে কয়েকবার। ভদ্রলোক সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে শিক্ষকতা করেন।
শিহাবের আচরণে একটা দুর্বিনীত ভাব আছে। সেটাও ভালো লেগে গেল মমের। তন্ময় অফিসে যেতে না যেতেই ঘরের কলিং বেল বাজিয়ে যাবে সে না খোলা পর্যন্ত। প্রথম, প্রথম দরজা খুলতো না ভয় ও সংকোচে। কাজের মেয়েটি ঘরে থাকায় একদিন দরজা খুলে ড্রয়িংরুমে বসতে দিল। এরপর তার আসাটা নিয়মিত হয়ে গেল। এ সময় ছেলেটিকে মুগ্ধ হয়ে দেখত আর তার জাদুকরী কথায় আচ্ছন্ন হয়ে যেত মম।
একদিন বলল, তুমি কি সিলেট যাও, গিয়েছো কয়েকবার? কোনো অনুমতি ছাড়াই মমকে তুমি বলে সম্বোধন করা শুরু করেছে শিহাব।
হ্যাঁ, গেছি তো কয়েকবার। কেন বলছো?
তাহলে একটা কবিতা শোনাই-
কিছুই জানি না আমি কোনোই খবর
কার মেয়ে কার বোন কার বা প্রেমিকা?
কোথায় চলেছো তুমি ঠিকানা কোথায়
বহুদূর চায়ের বাগান? নগ্ন জলের হাওর?
ট্রেনের জানালা বেয়ে ভেসে যায় বুনো মেঘ উদাস সবুজ
বিদ্যুতের ধ্যানী থাম সন্ধানী রাখাল
লঞ্চ বাস রোদ আর বৃষ্টির প্রণয়
তারাও জানে না তুমি চলেছো কোথায়?
মুখোমুখি বসে শুধু দেখেছি তোমাকে মেয়ে
আর, গেঁথে যাচ্ছি কৃষ্ণবর্ণ শব্দের কসুম
উত্তরের উদ্বেল বাতাস সাদা ওড়নায় মুখ ঘষে ঘষে
তোমাকে অস্থির করে তোলে
ভ্রæ বাঁকিয়ে তাকে যতই ধমকাও
বাতাস তো শাসন মানে না।
তোমার আনত চোখে দুপুরের নীল ঘুম নামে
কয়েকটি স্খলিত চুল লুটেপুটে খায় দুটি ঠোঁটের সুষমা
সুদূর নীলিমা থেকে ছুটে আসে মেঘ
স্টিলের জানালা গলে ছুঁয়ে যায় চুলের বিনুনি
হাতের পাতায় বোনা লাল কারুকাজ
কাঞ্চনজঙ্ঘার ভোর ঝিলিমিলি করে ওঠে কখনো কখনো
কালো চোখে
এইভাবে একজোড়া চোখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
কেটে গেলো দশ জুন গোলাপি প্রহর
সিলেট স্টেশনে এই কবিতার শেষ
একজোড়া চোখ গেলো চোখের গন্তব্যে
পিছনে রইলো পড়ে হাহাকারপূর্ণ এক কবির হৃদয়।

ভরাট কণ্ঠে শুদ্ধ উচ্চারণে আবৃত্তি শুনে মনে হলো এমন কবিতা কতদিন শোনেনি সে।
‘তুমি কবিতা লেখো?’ সপ্রশংস চোখে প্রশ্ন করে মম।
আরে দুর! আমি আর কবিতা লিখতে জানি নাকি?
সুনামগঞ্জের কবি মমিনুলের কবিতা।
এই ঘোর কেটে যেতে বেশি দেরি হলো না মমের। তাছাড়া মেয়েদের একটি বাড়তি ইন্দ্রীয় শক্তি থাকে ফলে তারা পুরুষের চোখ দেখে বোঝে কে কী চায়।
ছেলেটির বাড়াবাড়ি ধরনের ভালোবাসা আর আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে ক’দিনেই। বিষয়টি সে তন্ময়কে জানায়। তন্ময় বলে, ঘাবড়াবার কিছু নেই, আমি ধমক দিয়ে দিলেই সোজা হয়ে যাবে। তবে ওকে আর প্রশ্রয় দিও না।
তন্ময়ের ধমকের কারণে নাকি মমের দিক থেকে উপেক্ষার কারণে ছেলেটি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল। সে যেখানেই যেত টের পেতো দুটো চোখ তাকে অনুসরণ করছে। একদিন তো সরাসরি সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমি আমার। তোমাকে হারাতে দেব না।’
সে থেকে খুব ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করে মম। পারতপক্ষে ঘর ছেড়ে বের হয় না। সন্তানহীন দশ বছরের দাম্পত্য জীবনে এখন খুব করে মনে হয়, কেন যে সন্তান হচ্ছে না এত চিকিৎসায়ও। থাকলে বাচ্চাকে নিয়ে অনেকটা সময় কেটে যেত তার।

তিন.
এমনিতে তন্ময় শান্ত স্বভাবের। তবে একবার রেগে গেলে সহজে শান্ত করা যায় না। মম নিশ্চিত আজ শিহাবকে কিছু করতে পারে সে। তাই পেছন থেকে বলতে থাকে, বাদ দাও, চলো বাসায় চলে যাই।
এ সময় বিদ্যুৎ চলে গেল আবার।
এক হাতে পেছনে মমকে বাধা দিয়ে শিহাবকে বলে, ‘স্টুপিড, হাউ ডেয়ার?
তন্ময়ের চেয়ে আরও উচ্চ কণ্ঠে শিহাব বলে, শাট আপ। আমি মমের সঙ্গে কথা বলছি, তুই কে?
মম যে আশঙ্কা করেছিল তাই ঘটল। শিহাবের নাকে মুখে ঘুষি বসিয়ে দিল তন্ময়।
কয়েক সেকেন্ড লাগল আঘাতটা সামলাতে। তারপর হিংস্র চিতার মতো শিহাব ঝাঁপিয়ে পড়ল তন্ময়ের ওপর।
প্রতি আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল তন্ময়। শিহাবের চেয়েও অধিক ক্ষিপ্রতায় মমকে টান দিয়ে একপাশে সরে গেল। কোনো বাধা না পেয়ে শিহাবের শরীরটা ছাদের অনুচ্চ দেয়াল পেরিয়ে গেল। সামান্য সময় বাতাসে ভাসলো শুধু। তারপর কিছু একটা পতনের শব্দ শোনা গেল।
‘কী হলো’ চিৎকার দিয়ে দেয়ালের দিকে যেতে চেয়েছিল মম। এক হ্যাচকা টানে তাকে ফিরিয়ে আনলো তন্ময়। তারপর তাকে নিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল।
বাইরে কোলাহল শোনা যাচ্ছে। একটু পর শোনা গেল অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ।
কয়েকদিন পুলিশ ও সাংবাদিক আসলো-গেল। বিল্ডিংয়ের সবাই খুব মর্মাহত এমন মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। কুলখানির দোয়া মাহফিলে সবার সঙ্গে তন্ময় ও মমও যোগ দিয়েছে। দোয়া শেষে ওদের ঘরে শিহাবের বাবা-মাকে সান্ত¡না দিতে গেছে সবাই। শিহাবের মায়ের কথা বলার অবস্থা নেই। ওর বাবা বলছেন, ‘আমি যখন সিলেটের এমসি কলেজে তখন শিহাবকে সেখানে ভর্তি করালাম। এসএসসিতে খুবই ভালো রেজাল্ট করেছিল সে। সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর একটি মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়েছিল। মেয়েটি খুব ল²ী ছিল। কিন্তু কপাল খারাপ। একদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় মেয়েটি শিহাবের সামনে। সে থেকে তার মানসিক সমস্যা দেখা দিল। তার ভেতর আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। চেষ্টাও করেছিল দুবার। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর চিকিৎসকের পরামর্শে ওকে সঙ্গে এনে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু ঠিকই সে আত্মহত্যা করল।
আসলে এটাই ছিল ওর কপালে।
পরদিন সকালে তন্ময় বাড়িওলাকে জানিয়ে দিল মাসের শেষে বাসা ছেড়ে দেবে তারা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়