গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

এক শীতের রাতের গল্প : আজিজুল আম্বিয়া > বড় গল্প

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রায় সন্ধ্যা। গাছের ছায়াগুলো স্থানটাকে যেন আরো আঁধারময় করে দিয়েছে। শীত আসতে আরো দিন পনেরোক বাকি। কিন্তু এরই মাঝে বেশ শীত অনুভব করছে সে। সামান্য দূরে কিছু দূরত্ব রেখে রেখে কয়েকটি কাপল বা হতে পারে নিউ ফিঁয়াসে-যুগল বসেছে। শত ব্যস্ততার মাঝেও সপ্তাহে অন্তত একটি উইক-এন্ডে এখানে এসে সে বসে।
এখানে বসলে সে নিজেকে খুঁজে পায়। এ শহরে মানুষ ছোটে আর ছোটে। যেন ছুটন্ত ঘোড়া। থামবার নাম নেই। সকাল হলেই মানুষ ছুটতে শুরু করে। কাজের স্থানে যাবার জন্য ছোটে যেন এক মিনিটও দেরি না হয় বরং দু’মিনিট আগে গিয়ে পৌঁছলে ক্ষতি নেই। শিক্ষার্থীরা ছুটছে বিভিন্ন ভার্সিটিতে দেরি করার উপায় নেই। দু’তিন মিনিট দেরি হলেই অন্যান্য শিক্ষার্থীদের কাছে লজ্জায় পড়ে যাবে, হাই রিয়াদ, ইজ ইয়োর ওয়াচ রানিং স্লো! ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দেরি করে ঢুকবার উপায় নেই। তাহলে হয়তো সুদূর ওয়েলস্ থেকে আসা কোনো গ্রস বায়ার অর্থাৎ আড়তদার ফিরে গিয়ে অন্য কোনো ব্যবসায়ীর কাছে মালামালের অর্ডার দেবে। সপ্তাহের একটা বড় মুনাফা হয়তো হারাতে হতে পারে। এ লন্ডনে তাই সকাল হলেই মানুষ ছোটে। তারা ব্যস্ত থাকে সব সময়।
এমনকি তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানেও মানুষ কাজ করে অবিরাম। সময়কে সবাই কাজে লাগাতে চায়।
যেখানেই মানুষ ছোটে, যেন সময়ের চেয়ে দু’মিনিট আগে থাকতে চায়।
কিন্তু আজ রিয়াদের তেমন কোনো তাড়া নেই। সে আজ বসে আছে রিজেন্ট পার্কের একটি পেভমেন্টের উঁচু কার্নিশে। স্টুডেন্ট ভিসায় কবে যে এ দেশে এসেছিল, তাও মনে নেই। হয়তো দু’বছর ডিপ্লোমা শেষ করে কম্প্যারেটিভ স্ট্যাডিতে হায়ার ডিগ্রির জন্য ভর্তি হয়েছে, তাও তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এর মাঝে সপ্তাহে সপ্তাহে কুড়ি ঘণ্টা কাজের অনুমতিকে বাড়িয়ে চল্লিশ ঘণ্টা কাজের অনুমতি করে নিয়েছে।
অন্যান্য প্রবাসী স্টুডেন্টদের চেয়ে সে হয়তো একটু আলাদা। সে উইক-এন্ডে লং ট্যুরে যায় না বন্ধুদের সাথে হৈ হৈ করে না। এখনো এ দেশের বিখ্যাত স্কচের স্বাদ গ্রহণ করেনি। এমনকি হুইস্কি, বিয়ারও না। ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের শেখানো নীতি-নৈতিকতা এখনো মেনে চলে সে। এ জন্য অন্য প্রবাসীরা তাকে মাঝেমধ্যে ভালোগার, আরবান বা গেঁয়ো বলে প্রায়ই। কিন্তু সে তাতে কিছু মনে করে না। এখনো চব্বিশ ঘণ্টায় পাঁচবার না হলেও সকাল-রাতে কমপক্ষে দু’বার জায়নামাজের ওপর উঠে দাঁড়ায়। এতে তার ভুল হয় না। এ দেশ বাংলাকে দুই শত বছর শাসন করলেও সে তার নিজস্ব ভূমির সংস্কৃতি ও আচার অনুশাসনে চলতে পিছপা হয় না এখানে এসেও। এ কারণে শিক্ষকরা, কোনো কোনো বন্ধু তাকে খুব ভালোবাসে, খাঁটি বাঙালি বলে সমাদর করে।
এমন সময় সামনের মোটা পাওলোনিয়া গাছের আড়াল থেকে রোজিরোর লং ব্লেজার নিশানের মতো উড়তে দেখা গেল। রোজিরো কাছে এসেই বলল, হাই বাডি! ওয়েটিং লং?
-অলমোস্ট টোয়েন্টি মিনিস্টস।
-সরি। আই ডিন নট ইনফর্ম ইউ এবাউট মাই নিউ ফ্রেন্ড কাম কাজিন লংবার্ড। হি স্টেজ ইউনাইটেড স্টেটস। সে নিউইয়র্কে ব্যবসা করে। ওদের বাসা আমাদের বাসারই পাশেই। প্রায় দশ বছর আগে নিউইয়র্কে চলে গেছে। এখন পুরোপুরি ওখানে ব্যবসা করে সেটেলেড।
-আমি বুঝি তার গল্প শুনবার জন্যই এখানে অপেক্ষা করছি?
-ও! নো নো! লেট আস গো। চলো আমাদের সেই প্রথম দেখা হবার মার্কেটটিতে বসে ডিনার করি। রাত ৮টা বেজে গেল যে। আমার ডিনার করতে আজ বেশ লেট হয়ে গেল রিয়াদ! লেট আস গো রিয়াদ।
রোজিরো গোমেজকে নিয়ে রিয়াদ রহমান পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো। মেরেলিবোন রোড ধরে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে গ্রিন ফুড রেস্টুরেন্টে বসে দু’জন একটি ছোট টেবিলের দু’পাশের দুটি চেয়ারে। ভাগ্যক্রমে ফাঁকা পেল টেবিলটি। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সাধারণত সেন্ট্রাল লন্ডনের রেস্টুরেন্টগুলোতে ফাঁকা পাওয়াই কঠিন। সবাই ছুটির দিনে বাইরেই খায়, কেনাকাটা করে, কখনো উইন্ডো শপিং করে, শেষে রাত সাড়ে ১০টা বা ১১টায় একটু বিয়ার খেয়ে বা দু’পেগ হুইস্কি সেরে বাসায় ফেরে। এটি লন্ডনের উইক-এন্ডের একটি নিয়মিত রুটিন হয়ে গেছে এখানকার বাসিন্দাদের। কেউ কেউ আবার ওয়েলস বা আরো দূরে লং ড্রাইভে যায়।
রেস্টুরেন্টটিতে এসে রিয়াদের কিছুটা যেন প্রাণ এলো। শীতের দেশ এই লন্ডনে সে পাঁচ বছর কাটিয়ে দিলেও আজ পর্যন্ত শীতকে আপন করে নিতে পারল না।
-ফিলিং ইজ ? একটু বুঝি স্বস্তি লাগছে, রোজিরো জিজ্ঞেস করে।
-সিয়োর। লন্ডনের সব কিছু ভাল লাগে, কিন্তু এই শীতটা এখনো সয় না।
-কি বলো। তোমার সিলেটেও তো বেশ শীত। আর লন্ডনে দীর্ঘ ছয় বছর ছাত্রজীবন কাটিয়েও এখনো অভ্যাস করে নিতে পারলে না? তাহলে এখানে থাকবে কেমন করে?
ইতোমধ্যে টেবিল বয় আসে। রিয়াদ দু’জনের খাবারের মেনু বলে দেয়। মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর অল্পদিনেই রোজিরোর সাথে তার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। রোজিরো ব্রিটিশ। জন্ম ওয়েলসে। কিন্তু তার বাবা লন্ডন ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে চাকরি নিয়ে লন্ডনে চলে আসে। গোটা পরিবারও সাথে চলে আসে। গোটা পরিবার বলতে রোজিরো গোমেজ, বাবা পিটার গোমেজ আর মা পিয়েরে গোমেজ। তার মাও একটি কমার্শিয়াল ফ্লাইটের এভিয়েশন ইঞ্জিনিয়র। সুখী পরিবার বলা চলে তাদেরকে। রোজিরোই তাদের একমাত্র সন্তান। তাও বিয়ের প্রায় দশ বছর পর তাদের বাবা-মা এই প্রথম সন্তান নেয়। তারা এতো বিলাসিতায় তাকে মানুষ করছে যে রিয়াদও অনেক সময় তার সাথে স্ট্যাটাস মেইনটেন করতে পারে না।
করারও কথা নয়। কারণ রিয়াদ এখানে স্টুডেন্ট ভিসায় এসেছে। প্রথম প্রথম সপ্তাহে কাজের অনুমতি মাত্র কুড়ি ঘণ্টা ছিল। বর্তমানে অবশ্য ৪০ ঘণ্টা হলেও উইক-এন্ডের দিনেও সে কাজ করে। প্রায় প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা করে কাজ করে। তারপরও নিয়মিত ক্লাসে যায়।
রোজিরো পরিবার আসলে ব্রিটিশ না। তার পূর্ব-পুরুষ এসেছিল পর্তুগাল থেকে। দুই পুরুষ ধরে এখানে বসবাস করতে করতে তারা এখন পুরো ব্রিটিশ হয়ে গেছে। একসঙ্গে ক্লাস করতে করতে রোজিরো বহুদিন ধরে রিয়াদকে লক্ষ্য করে। সে অন্যদের মতো সব সময় পার্টিতে যায় না। হৈ হৈ করে না। পড়াশোনাতে বেশ মনোযোগ। রেজাল্টও ভালো। পাস করে বের হলে হয়তো ভালো চাকরি পাবে এখানে। ওয়াইনের ধার-ধারে না। ক্লাস শেষ হলে লাইবেরিতে চলে যায়। ক্লাস থেকে বের হতেই এক দিন রিয়াদের সাথে কথা বলে সে। এভাবে সে রিয়াদকে রিডি বলে ডাকতে শুরু করে।
আস্তে আস্তে সে রিডির পরিবার, দেশ, দেশের আত্মীয়স্বজনকে জানতে পারে। তারা আরো কাছাকাছি আসতে থাকে। রোজিরো ভালোবাসতে শুরু করে রিডিকে।
-কি এতো ভাবছো? জানো, সামনের ভ্যাকেশনে আমি লংবার্ডের সাথে আমেরিকা ট্যুরে যাচ্ছি।
-মানে?
-মানে আবার কি? বেড়াতে যাচ্ছি। সপ্তাহখানেক ওখানে থেকে আবার চলে আসব।
-ওখানে থাকবে কোথায়?
-লংবার্ডের কন্ডোমোনিয়ামে।
-মানে? ওখানে তুমি তোমার কাজিনের সাথে একসাথে ঘুমোবে?
-তাতেই বা কী? ওখানে গিয়ে আমি কি হোটেলে থাকব? এতো বড় বাড়ি পড়ে থাকতে আমি হোটেলে থাকব কী কারণে?
-আমি কিন্তু তোমার এ বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছি না।
-ডোন্ট বি সিলি। তোমাদের দেশে হয়তো এভাবে কেউ রাত কাটায় না। আমরা ব্রিটিশ কালচারের মানুষ। আমরা এসবকে তেমন কোনো গুরুত্ব দিই না।
-তোমার বাবা-মা রাজি আছেন?
-হোয়াই নট?
রিয়াদের মনটা ধক্ করে ওঠে। তার ফিঁয়াসী অন্য আর একজনের সাথে রাত কাটাবে? মনে মনে কতো স্বপ্ন গেঁথেছিল, তার বিজনিস ভিসা হয়ে গেলে সে রোজিরোকে নিয়ে ঘর বাঁধবে। আর সে কি না অন্য আর একজনের সাথে রাত কাটাবে? রোজিরোও তো তাকে খুব ভালোবাসে।
রিডিকে চুপচাপ থাকতে দেখে রোজিরো বলে, তুমি উতলা হয়ো না। এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেই আমি চলে আসব। আবার আমাদের দেখা হবে, আমি তোমাকে ভালোবাসি রিডি।
কিন্তু সেই যে দেড় বছর আগে রোজিরো আমেরিকায় চলে গেল, আর এলো না। মাস ছয়েক আগে একবার রিডির সেলফোনে রোজিরোর কল এলো, সরি রিডি। আমি লংবার্ডকে বিয়ে করে এখানে থাকছি। আর লন্ডন আসছি না। বাবা-মা লংবার্ডকে আমার বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছে।
এসব ভাবতে ভাবতে রিয়াদের চোখে জল এসে যায়। কি সুন্দর মানসিকতা ছিল রোজিরোর। খুবই ভালোবাসত সে তার রিডিকে। তাকে নিয়েই সব সময় ডিনার করে তার বাসায় চলে যেত আর রিয়াদ নিজের রুমে ফিরে আসত। এমনকি রিয়াদের ডিনারের টাকাটাও বেশির ভাগ সময় সে নিজে দিত। দু’জনে ভ্যালেন্টাইন নাইটে সারা রাত লন্ডনের কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াত আর কফি-ক্যাপুচিনো খেত। আর বলত, টাকা জমাও, সামনের ভ্যালেন্টাইন নাইটে আমরা বিয়ে করব।
-মে আই হ্যাভ এ সিট বিসাইড ইউ? হঠাৎ করে রিয়াদের ভাবনায় ছেদ পড়ে। সামনের মেয়েটিকে এশিয়ানই মনে হয়। লম্বা চুল। গোল-গাল মুখ। বেশ ফর্সা মনে হচ্ছে। হয়তো মুখমণ্ডলকে আরো সাদা করার জন্য কোনো পাউডারের প্রলেপ দেয়নি। ঠোঁটে হয়তো সামান্য লিফস্টিকের গোলাপি প্রলেপ পড়েছে। কপালে ছোট্ট একটি টিপ যে সে ইচ্ছা করে দিয়েছে, তা বোঝা যায়। কিন্তু সেটিই যে সারা প্রাচ্যকে তার মুখে টিকিয়ে রেখেছে বেশ তা স্পষ্ট। বাংলাদেশি বা ক্যালকেশিয়ান তা বুঝতে পারে না রিডি। তাকে দেখে গলায় ঝোলানো স্কার্ফ দিয়ে চোখ-মুখ মুছে নিল। মেয়েটি আবারো বলে, মে আই . . .
-ও ! শিয়োর শিয়োর !
মেয়েটি আস্তে আস্তে পার্কের পেভমেন্টের কিনারে উঁচু করে দেয়া কার্নিশে ওর পাশে সামান্য ব্যবধান রেখে বসে পড়ল। বলে, আই অ্যাম ওয়াসফিয়া আখতার ফ্রম বাংলাদেশ।
-আই অ্যাম রিয়াদ রহমান ফ্রম সিলেট বাংলাদেশ।
-আই অ্যাম ফ্রম রংপুর। ডু ইউ নো হোয়ার ইজ রংপুর?
-ইয়েস, আই নো, ইটস্ দ্য নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্ট।
-বোধহয়, আমরা বাংলাতে কথা বলতে পারি। বেশ মৃদুস্বরে বলে মেয়েটি।
-অবশ্যই।
মেয়েটির এতো সৃন্দর মৃদু কণ্ঠ অথচ মনে হচ্ছে দূর কোন গুহা থেকে প্রতিধ্বনীত হয়ে আসছে। রিডি নিমেষেই রিয়াদ হয়ে যায়। তার মনে হয় বাঙালি সেই ললনার কথা সে শুধু শুনতেই থাকুক, সে শুনতেই থাকুক। তার মন থেকে অনেকটা বোঝা নেমে গেছে মনে হচ্ছে। রিডি কেন যেন ক্রমশ দূরে স্ফিংস পাখির মতো হারিয়ে যাচ্ছে।
-আমি নতুন এখানে এসেছি। মাত্র তিন মাস হবে। হিলিংটন-এর কাছে আমাদের ক্যাম্পাস। কেবল বিকেলেই বের হই। বেশি সন্ধ্যা বা রাতে বের হই না। মনে হয়, টিনরা ওভার-ড্রাংক হয়ে যদি আমাকে ধরে বসে! এ ভয়ে সন্ধ্যার ভেতরই ক্যাম্পাসে ঢুকে যাই। ডিপার্টমেন্টাল শপগুলোতে যে সামান্য দেশীয় ভিজিটেবলস্ পাই, তা-ই কিনে নিয়ে গিয়ে প্রেশার-কুকারে রান্না করে খাই। প্রায় মাস-দুই একই ধরনের মেন্যু খেতে খেতে আই বিকেম বোর। এখানে কাছাকাছি কোথাও এশিয়ান ভিজিটেবলস মার্কেট কি আমাকে দেখাতে পারবেন?
-হাই! আমি আপনাকে বলছি। ও মিস্টার রিয়াদ!
চমকে ওঠে রিয়াদ। তখন থেকে সে ওয়াসফিয়ার কথাই শুনছিল। অত্যন্ত মাদকীয়তায় ভরা তার কণ্ঠ। কেমন যেন তখন থেকেই ওয়াসফিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল মুগ্ধতার চোখে। আর তার সুরেলা কণ্ঠের কথা শুনছিল। চমকে উঠে স্বাভাবিকভাবে বলল, সরি। ইয়েস ইয়েস। তা আজই চলুন না সামান্য দূরে থেমস-এর পাশে একটি বাঙালি এলাকা ব্রিকলেনে শপিং মল রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের সব ভিজিটেবলস্ এমনকি হলুদের গুড়ো, মরিচের গুড়ো পর্যন্ত পাওয়া যায়। যা প্রয়োজন হবে, কিনে নেবেন?
-না না। আজ বেশ রাত হয়ে গেছে। অন্যদিন বিকেলে যদি আপনি আমাকে একটু সময় দেন, তাহলে আপনার সাথে যাব সে মার্কেটে।
-লন্ডনে রাত সাড়ে আটটা কোনো রাতই নয় যদি শীতটা সহ্য করতে পারেন। তাছাড়া এ দেশের সব বাস-ট্রেনে হট-সিস্টেম তো আছেই।
-ওকে মিস্টার রিয়াদ। সামনের সপ্তাহে যদি সময় দিতে পারেন, তাহলে ক্লাসের পর বিকাল ৬টার সময় আমরা ওদিকে যেতে পারি!
এক অনন্য মুগ্ধতায় রিয়াদ তাকিয়ে থাকে ওয়াসফিয়ার দিকে। মনে মনে শতবার ধন্যবাদ দেয় বিধাতাকে। তার মনের জগদ্দল পাথরচাপা মেঘটাকে এই সুন্দর কণ্ঠের জাদুতে কে হয়তো দূরে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। জ্বি, আমিও আগে থেকেই আপনার জন্য বের হয়ে আসবো।
-তাহলে চলুন। সামনে কোথাও ডিনার সেরে নিই। বের হবার আগে ভেবেছিলাম আজ বাইরে ডিনার করব। রাতের খাবার রান্না করিনি।
-অলরাইট। বাসস্টপের সামনের সড়কে একটা এশিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে ইন্ডিয়ান ফুড রান্না হয়।
-এখানে আবার কোথায় ইন্ডিয়ান ফুডের রেস্টুরেন্ট!
-সামনে দশ মিনিট এগোলেই হবে।
-আমি জানতাম না তো? বেশ চলুন। রেস্টুরেন্টটি চেনা হবে আমার।
ওরা দু’জন পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে। বাসস্টপ পেছনে ফেলে সামনের সড়কটি ধরে এগোতে থাকে। পার্কের বাইরে শীতটা মোটামুটি জমেছে। রিয়াদ একবার তার লং কোটটি খুলে ওয়াসফিয়াকে দিতে চেয়েছিল। ওয়াসফিয়া নেয়নি। তার মিডি টাইপের উলেন জ্যাকেটেই সে শীতকে থামাতে পারছে তা বলেছিল।
সাইডওয়াক থেকেই হোটেল তাজমহল দেখা যাচ্ছিল। অবাক হয় ওয়াসফিয়া। তার হোস্টেলের এতো কাছে এতো সুন্দর দেশি হোটেল থাকতেও সে জানতে পারেনি। আবার ভাবে, জানবেই বা কী করে? সে তো ক্লাস আর রুম। তাছাড়া তো এখনো বাইরের কোনো স্থানে খুব একটা বেড়াতে বের হয়নি। শুধু আজকে একটু বের হয়েছে পার্কে আসবে বলে।
রিয়াদ আর ওয়াসফিয়া ঢুকে পড়ে হোটেলটিতে। উইক-এন্ডের ভিড় বেশ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দুই চেয়ারের একটি টেবিল খালি হলো। ওরা ওখানে গিয়ে বসল। ওয়াসফিয়ার আজ ডাল, আলুভর্তা, ভাজা ইলিশ মাছ খেতে খুবই ইচ্ছা করছিল। এদেশে আসার চার মাসের মধ্যে এসব খাওয়া হয়নি তার। হোস্টেলে বেশির ভাগ সময় ফ্রাইড রাইস আর বিরিয়ানি ধরনের রান্নাই করে আসছে সে। আর রয়েছে চিকেনের রকমারি কারী। ওয়াসফিয়া এতো অয়েলি খাবার পছন্দ করে না। তা ছাড়া এখানে হালাল পদ্ধতিতে বিফ বা মার্টন জবাই হয় কিনা, সে জানে না।
খাবার সময় রিয়াদ আঁড়চোখে লক্ষ্য করে ওয়াসফিয়া খবই সুন্দর এশীয় ধর্মীয় কায়দায় এবং বাঙালি শিষ্টাচারে খাচ্ছে। এখানে থাকবার এই ৯ বছরে সে অনেকের মাঝে দেশীয় এসব ম্যানার দেখেনি। অধিকাংশের মধ্যেই একটা হট আর ওয়েস্টার্ন কালচারের মিশ্রণ দেখেছে। এদিক দিয়ে ওয়াসফিয়াকে তার বর্ষণমুখর বাংলার দূর গ্রামের বনলতার মতো মনে হলো। বিদ্যালয় জীবন থেকেই সে সাহিত্য-কবিতা-নাটক নিয়ে মাতামাতি করে এসেছিল। তাই খুব সহজেই বনলতার নামটি তার এই প্রবাসে এসেও মনে পড়ল। রিয়াদের এসব বিষয় লক্ষ্য করাটি ওয়াসফিয়াও দেখেছে, কিন্তু কিছুই বলেনি। ডিনার শেষ হতেই সে দু’কাপ ক্যাপুচিনোর কথা বলে মুখ খুলল।
-আপনি আমাকে এভাবে এতো কী দেখছেন?
-আপনাকে নয়, আমার দেশকে দেখছি, আমার সমাজকে, আমার গ্রামকে দেখছি।
-আপনি বেশ সুন্দর কথা বলেন।
-সুন্দরের পাশে এলেই মানুষের মাঝের সুন্দরটি আপনা-আপনি জেগে ওঠে।
-আপনার কথায় বেশ মিষ্টতা আছে।
-লন্ডনে থাকার আমার সাড়ে আট-নয় বছর হলো। কিন্তু এতো বছর পর আমি আমার গ্রামদেশের মতো ভদ্র ও বোকা মানুষ এই প্রথম দেখলাম।
কী রকম?
-আমি মৌলভীবাজারের সন্তান। বৃহত্তর সিলেটের মাঝে এই মৌলভীবাজার এলাকার মানুষকে জেলার সবচাইতে বোকা মানুষ হিসেবে বৃহত্তর সিলেটের আর অন্য জেলার মানুষরা গণ্য করে। আজ আপনার সঙ্গে এই যে প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে আপনাকে দেখলাম, তাতে মনে হলো, আমার মতো আরো একজনকে ‘ভোদাই’ বা ‘বোকা’ দেখছি।
-আমরা রংপুর জেলার মানুষ। আমাদেরও অন্য জেলার মানুষরা বোকার দেশের মানুষ বলে।
-ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি যদি আপত্তি না থাকে!
ওয়াসফিয়া ভ্রæ কুঁচকে বলে, কী এমন জরুরি প্রশ্ন?
-আপনি স্কলারশিপের যে পাউন্ড পান, তাতে আপনার চলে?
-আমি অ্যাকোমোডেশনসহ মাসে সাড়ে চারশ পাউন্ড-স্টার্লিং পাচ্ছি এখন। নতুন এসেছি। দেড় বছর ডিপ্লোমা করার পর এনভায়ারমেন্টাল সাইন্সে অনার্স পড়তে পারব। নতুন নতুন বই কিনতে, আর অন্যান্য কিছু জিনিস কিনতে হাত খালি হয়ে আসে মাসশেষে। এখানকার ওম্যান্স রিহ্যাব নামে এক প্রাইভেট চ্যারিটি অর্গানাইজেশানে মাসে একটা অনুদানের জন্য আবেদন করেছি। তারা সামনের মাস থেকে একটা অনুদান দেবে। দেখি, সেটা পেলে এই হোস্টেলটি ছেড়ে দিয়ে সিঙ্গিল রুমের একটি বাসায় উঠব।
-কেন? এটায় তো আপনার অনেক খরচ বেঁচে যায়।
ওরা আর এক প্রস্থ ক্যাপুচিনো দিয়ে যেতে বলল।
ওয়াসফিয়া আবারো বলে, হোস্টেলগুলোর জীবন তেমন কিছু না। কাউন্সিলিং-এর নামে ইউরোপীয় বান্ধবীরা যখন-তখন বন্ধুদের নিয়ে আসছে হোস্টেলে। বুঝতেই পারছেন। তা ছাড়াও হৈ-হুল্লড় লেগেই আছে। এর ভেতর পড়াশোনা ঠিকমতো চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন।
ক্যাপুচিনো শেষ করে রিয়াদের আপত্তি সত্বেও ওয়াসফিয়া বিল পে করল। ওরা রাস্তায় নেমে এল। বাইরে কিছুটা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। তার সাথে মিহি দানার মতো বরফকুচিও পড়ছে। এতক্ষণে ওয়াসফিয়া একটু শীত শীত বোধ করল। রিয়াদ তার লং কোটটি খুলে ওয়াসফিয়াকে দিলে সে দ্বিধা করল না। বলল, তুমি কী ব্যবহার করবে?
রিয়াদ বলল, আমি বাসে উঠে সোজা বাসায় যেতে পারব। জানো তো, এ দেশের বাসগুলোও হট কন্ডিশনার।
-আমিও বাসে উঠলেই সোজা হোস্টেলের সামনে নামতে পারব। সামান্য একটু হেঁটেই হোস্টেলে ঢুকতে পারব। এর পর থেকে লং কোর্ট নিয়ে বের হবো। ও হ্যাঁ, আমার কিছু কেনাকাটা করা দরকার। আপনি আমাকে এখানকার কোন বাঙালি মার্কেটে নিয়ে যেতে পারবেন? সময় হবে? সামনে সপ্তাহে আমি স্কলারশিপের যে পাউন্ডগুলো পেয়ে যাব?
-বেশ। সামনের উইক-এন্ডে আমি বিকেল ৪টায় এই স্ট্যান্ডে এসে তোমার জন্য অপেক্ষা করব?
রিয়াদের কোট ফিরিয়ে দিতে দিতে ওয়াসফিয়া বলল, ওকে ডিয়ার রিয়াদ। সি ইউ অন কামিং স্যাটারডে। স্টে সেফ। গুড বাই।
ওর বাস চলে গেল। রিয়াদ সড়কের উল্টোদিকে চেলসফিল্ডের বাসে উঠে বসল। রাত ১০টা বাজে। বাসের বাইরে কুচি কুচি বরফ পড়ছে। বোধহয় শীত এসে গেল।
লন্ডনে মোটামুটি তুষার পড়তে শুরু করেছে।
একদিকে রোজিরোর কাছ থেকে পাওয়া অসহ্য যন্ত্রণা আর অন্যদিকে ওয়াসফিয়ার বাগানে নতুন চেরিফুল ফোঁটা টেনে নিয়ে যেতে থাকে সামনের দিনগুলোতে। ইতোমধ্যে পুরো বিজনেস-ভিসা করতে পেরেছে রিয়াদ রহমান। ওয়েলস্ আর আয়ারল্যান্ড থেকে আসা ভেসেলগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের ভিজিট্যাবল কিনে সে তার আড়তে রাখে। আর সেখান থেকে বিভিন্ন লোকাল সাপ্লায়ার অল্প অল্প করে কিনে নিয়ে গিয়ে তাদের দোকানে বিক্রি করে। এখন সে পুরো ব্যবসায়ী। কিন্তু অর্থ বেশি না থাকার জন্য বেশির ভাগ সময়ে অল্প অল্প করে কিনে নিয়ে আসতে হয়। এতে লভ্যাংশ কমে আসে কিছুটা। তবুও সে এভাবে চালাতে থাকে। হয়তো বছরখানেকের মধ্যেই মোটামুটি ক্যাপিটাল খাড়া করতে পারবে সে। দিনের দিকে তার আড়তে বসে ভিজিটেবিলগুলো খুচরো বিক্রেতাদের কাছে সাপ্লাই দেয়। আর রাতে ব্রিস্টল, ওয়েলস্ বন্দরের আড়ত থেকে মালামাল কিনে নিয়ে আসে। বলতে গেলে সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হয় তাকে। তবু তার সান্ত¡না অনেক কষ্ট করে বিজনেস ভিসায় টেম্পোরারি রেসিডেন্টশিপ পেয়েছে। মোটামুটি একটা দুই রুমের ছোট ফ্লাট নিয়েছে।
ওয়াসফিয়াও এখন ছোট্ট একটি আলাদা রুম নিয়েছে। সেখান থেকেই ভার্সিটিতে যায়। এই দেড় বছরে সে মোটামুটি একটি প্রবাস জীবন ও শিক্ষাজীবন গুছিয়ে নিতে পেরেছে। এখন রিয়াদের সঙ্গে তার কম দেখা হলেও মোটামুটি বেশ ভালো ও সুশীল বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। রিয়াদের মাঝে সে বিশ্বাসী ও সৎ বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ অনুভব করে। তাকে সে বিশ্বাস ও করে। সে কী রিয়াদকে নিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা করে? বুঝতে পারে না ওয়াসফিয়া। মাঝে মাঝেই সে রিয়াদের ছোট কন্ডোমেনিয়ামে যায়। রিয়াদও তার বাসায় আসে। তবে তাদের মাঝে কোনো দৈহিক সম্পর্ক হয় না। কেবল বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার সম্পর্কই চলতে থাকে।
এভাবে ওয়াসফিয়া এনভায়ানমেন্ট পড়তে শুরু করেছে। নতুন আর এক ভ্যালেন্টইন ডে এলো। ভ্যালেন্টাইন নাইটে তারা ভ্যালেন্টাইন ইভিনিং পালন করবে বলে ওয়াসফিয়া তার ছোট্ট রুমে ইনভাইট করল। তার আগে বাঙালি কমিউনিটি মার্কেটে নিয়ে গিয়ে মোটামুটি বেশ ভালো বাজার করে দেয় সে ওয়াসফিয়াকে। সন্ধ্যার মধ্যে সব কিছু রান্না করে প্রস্তুত করে রাখে ওয়াসফিয়া। কেন যে তারা ভ্যালেন্টাইন ইভিনিং নাইট পালন করছে, তা দু’জনের একজনও বুঝতে পারে না। কেবল একটা স্মরণীয় দিনকে পালন করার মতো তাদের মনে হয়।
ঠিক সন্ধ্যা ৬টায় দরজায় নক হতেই হাই! হ্যাপি ভ্যালেনটাই বলে দরজা খুলে দেয়। জবাবে রিয়াদও হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে টু ইউ বলে। ওয়াসফিয়া রিয়াদের হাত ধরে নিয়ে এসে সোফা সেটে বসতে দেয়।
-খুব কি ঠান্ডা লাগছে? থাম ফায়ার প্লেসটিতে কয়েকটা কাঠ ফেলে দিই।
বাইরে আসলেই বেশ ঠান্ডা পড়েছিল। সে গাড়ি নিয়ে এসেছে বলে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে সড়কগুলোও আইসে ঢেকে যাবে যদিও আজকের রাতে আইস ক্লিনিং ট্রাকগুলো শহরের প্রায় সব রাস্তাতেই বরফ সরাতে নিয়োজিত থাকবে। তা না হলে মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে আসবে, তারা এদেশে সড়কগুলোতে নিরাপদ চলাচলের জন্য কর দেয় না? দুজনে ফায়ার প্লেসের সামনে বসল। ডানদিকে টিভি চলছে। তাতে লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে ছেলেমেয়েরা কীভাবে ভ্যালেন্টাইন নাইট যাপন করছে তার চলছে ধারাবাহিক চিত্র।
-জানো, আজ আমাকে বেশ ভালো লাগছে এই লন্ডনে। তুমি আছো আমি আছি। বাইরে ভীষণ ঠান্ডা। বরফ পড়ছে। যেন বাংলাদেশের বর্ষাকালের মতো। বাংলাদেশের শীতকালের মতোও বলতে পার।
-আজ তোমার জন্য একটি প্রেজেন্ট এনেছি।
-কই দেখি দেখি!
রিয়াদ দরজার কাছে রাখা, সাথে করে আনা ব্যাগের ভেতর থেকে একটা প্যাকেট বের করে এনে বলল, এ রোজ, ফর এ রোজ।
প্যাকেটটি দ্রুত খুলে ফেলে একটা রোজি ওভারকোর্ট বের করল সে। চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করে উঠল তার। দ্রুত পরে নিল। ভেতরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুখে সুন্দর হাসি ফুটে উঠল তার। বাইরের ঘরে এসে রিয়াদের সামনে দাঁড়াল। উচ্ছ¡সিত হয়ে সে রিয়াদকে বলল, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ ডিয়ার ফর দিস নাইস প্রেজেন্ট। আই অ্যাম ভেরি গø্যাড। থাম, তোমার জন্য ছোট্ট একটি গিফ্ট আছে। বলে সে ঘরের ভেতর গেল।
বেরিয়ে এসে একটা রঙিন কাগজে প্যাক করা একটা প্যাকেট রিয়াদের হাতে তুলে দিল। থ্যাংক ইউ বলে প্যাকেটটা হাতে নেয় রিয়াদ। ওয়াসফিয়া বলে, আগে খুলে দ্যাখো তো!
রিয়াদ প্যাকেটটা ধীরে ধীরে খোলে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে মেরুন রঙের টাই, সাথে একই রঙের ম্যাচ করা টাই ক্লিপ আর সার্টের জন্য একজোড়া কাফলিংস্ (পঁভভষরহমং)। অবাক হয় রিয়াদ, মেরুন রঙ যে তার সবচেয়ে ফেভারিট এটা কোনদিনও তাকে বলেনি সে। অথচ সে জানলো কেমন করে? বারবার ধন্যবাদ দিয়েই যাচ্ছে সে।
-প্লিজ নো মেনশন। এসো আমরা একটু স্যুপ খাই কী বলো ডিয়ার?
-সিয়োর, বলতেই পাশের টেবিলে দু’টো প্লেটে স্যুপ ঢাললো ওয়াসফিয়া। তারপর ডাকল রিয়াদকে। রিয়াদ সেখানে যেতেই একটি স্পুন তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজে আর একটি চামচ নিয়ে দু’জনের হাত এক করে ওয়াসফিয়া বলে উঠলো, হ্যাপি ভালেন্টাইন ইভিনিং।
-হ্যাপি ভালেন্টাইন ইভিনিং, সাথে সাথে রিয়াদও উল্লসিত হয়ে বলে উঠল।
দু’জনে চিকেন স্যুপ পান করতে শুরু করল। চিকেন স্যুপটি কয়েক চামচ মুখে দিয়ে রিয়াদ বেশ বুঝতে পারল, ওয়াসফিয়ার বেশ সুন্দর রান্নার হাত। ওদিকে টেলিভিশনে ট্রাফালগার স্কোয়ারে হাই, হুররে, হ্যাপি ভালেন্টাইন ইভিনিং আর পটকাবাজি চলছে। ওরাও টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে খাওয়া প্রায় ভুলেই যাচ্ছে। স্যুপ শেষ করার জন্য একে অপরকে তাগাদা দিচ্ছে।
তারপর আবারো এসে সেই সোফাসেটে দু’জনে বসে গল্প করা শুরু করল। রিয়াদ বলল, একটা সিগারেটে খাওয়ার অনুমতি দেবে?
-খাও। তবে এর আগে তো তোমাকে সিগারেট খেতে দেখিনি?
-এ দেশে পাবলিক প্লেসে সিগারেট পান করার অনুমতি থাকে না, তাই হয়তো আমাকে সিগারেট খাওয়া দেখোনি। রিয়াদ একটা ফাইভ-ফিপটি-ফাইভের প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে ধরিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল।
ঘরটি ধোঁয়ায় মোহনীয় একটি রূপ নিল। ওরা টিভিতে খেয়াল করল, রাতে ভীষণ বরফ পড়বে, হয়তো রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই সব চ্যানেলই সবাইকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বলছে। তাদের কেউ কেউ তবুও ফিঁয়াসীকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকছে সাইডওয়াকে, সড়কের পেভমেন্টগুলোতে। তবে তাদের সবার মাঝে একটা চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে।
-এসো, ডিনার সেরে নিই। ডাকে ওয়াসফিয়া। আবারো ডাইনিংয়ে গিয়ে বসে দু’জন। রিয়াদের প্লেটে পোলাও আর ইলিশ মাছ ভাজার দুই টুকরো তুলে দিয়ে নিজের প্লেটেও নেয় ওয়াসফিয়া। তারপর বলে ওঠে লেটস্ চেরী উইথ দ্য ভ্যালেনটাইন ইভিনিং।
-হ্যাপি ভ্যালেনটাইন ইভিনিং।
দুজনে খাওয়া শুরু করে। মাছ-বিফ-ফ্রাইড চিকেন-সালাদ-বেগুন ভাজা-ধনে পাতার চাটনি খেতে খেতে অবাক হয় রিয়াদ। ভাবে ওয়াসফিয়া একা একা এসব কেমন করে করলো। তবুও খাঁটি দেশের খাবার পেয়ে গপ্ গপ্ করে খেতে লাগলো। তার সাথে ওয়াসফিয়া জোর করে আরো বেশি বেশি তরকারি ওর প্লেটে তুলে দিচ্ছিল। তুমি তো কিছুই খাচ্ছো না।
ওর কথা শুনে ওয়াসফিয়া চেয়ারে বসে নিজেও ভালভাবে খাওয়া শুরু করল। মাথার ওপরে টেলিভিশনে তখন ঘোষণা আসছে, বিশেষ জরুরি কাজ না থাকলে বাসার বাইরে বের হবেন না। শুনে রিয়াদ বলল, ফিরে যেতে বোধহয় অসুবিধাই হবে।
-আচ্ছা, তেমন অসুবিধে হলে তুমি আজ আমার এখানেই থেকে যেয়। এতো বরফ শাওয়ার নিয়ে না গেলেও চলবে। তারা খেতে লাগলো।
একসময় ওয়াসফিয়া বলে উঠলো, আমরা ভ্যালেন্টাইন উদযাপন করছি অথচ জানিই না আমরা একে অপরকে ভালোবাসি কিনা।
-এটাও একটা বিস্ময়ের বিষয়।
-আমার কাছেও অবাক লাগছে। আমরা এতোদিনেও কেউ কাউকে বলিনি আমি তোমাকে ভালোবাসি। বাদ দাও, এখন খাবার খেয়ে নাও। আমি নিজ হাতে সবকিছু তোমার জন্য করেছি।
-থ্যাংক ইউ ওয়াসফিয়া।
একসময় ওরা খেয়ে আবারো সোফা সেটে হেলান দিয়ে বসে। রিয়াদ একবার দরজা খুলে বাইরে আসে। দেখে। বিরবির করে ওঠে, এই ফেব্রুয়ারিতে তো এমন মুষলধারায় বরফ পড়ে না। তবে সারা বিশ্বে আবহাওয়ার যে পরিবর্তন আসছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
-ভেতরে এসো, বাইরে প্রবল শীত। ভেতর থেকে ওয়াসফিয়া ডাকে। রিয়াদ ভেবে পায় না সে কী করবে! আর রাতে তোমার যাবার দরকার নেই। সারা রাত গল্প করেই কাটাব। ভ্যালেন্টাইন নাইট যাপন করব আমরা।
-বেশ। আরো ভালো হবে যদি একটু রস থাকে বলে দরজার কাছে ফেলে রাখা তার ব্যাগের ভেতর থেকে একটি স্কচ হুইস্কি বের করল, মিডিয়াম বতল। বলল, লন্ডনে এসে কোনোদিন খাইনি। আজ যদি একটু পান করতে অনুমতি দাও।
-এলোমেলো হয়ে যাবে না তো?
-না না। তেমনটি না। সামান্যই পান করব।
-আমি কিছুটা বিফ গরম করে আনছি।
একটু পরে গরম বিফের বাটিটা টেবিলে রাখে ওয়াসফিয়া। রাত বাড়তে থাকে। প্রথমদিকে একটু তিক্ত টেস্ট ছাড়া স্কচ হুইস্কির কিছুই বুঝতে পারে না রিয়াদ। বাইরে তুষার ঝড়। ঘরের মধ্যে ক্রমেই একটা মাদকীয়তা তাকে উষ্ণতা এনে দেয়। ওয়াসফিয়া বলে, কী জিনিস এটি এমন! আমি একটু টেস্ট করি। রিয়াদ আপত্তি করলেও ওয়াসফিয়া মাত্র দুই সিপ স্কচ হুইস্কি গেলে। তাতেই তার চোখ ঢুলু ঢুলু হয়ে আসে। সে বলে, আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি শুয়ে পড়লাম। তুমি আমার বিছানার পাশের বেডে শুয়ে পড়ো।
পান করতে করতে অর্ধেক বোতল শেষ করে ফেলেছে রিয়াদ। একটু একটু গরম লাগছে। আস্তে আস্তে কোর্ট-প্যান্ট-টাই খুলে ব্যাগ থেকে ট্রাইজার বের করে পরে নেয়। সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে ঘর ভরে গেছে। বাইরে তুষার ঝড় আর ঘরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী এক ভৌতিক রূপ ধারণ করেছে। সে কোন কিছু ঠিকমতো ভাবতে পারছে না। ঘরে গিয়ে ওয়াসফিয়ার পাশে শুয়ে পড়ল। ওয়াসফিয়ার ব্লাংকেটের নিচে গেলে তার আরো উষ্ণতা লাগল।
পরদিন সকাল প্রায় পৌনে ৮টায় ঘুম ভাঙল ওর। দেখল, বেডসাইড টেবিলে একটি চিরকুট। লেখা, জানি না, গতরাতে কী হয়েছে। সে যাক, আমি ক্লাসে চলে গেলাম, পরোটা আর বিফ হটপটে রয়েছে, খেয়ে নিয়ো। রেডিমিক্স কফি গরম পানিতে দিয়ে কষ্ট করে খেয়ে নিয়ো। যাবার সময় দরজাটা ভেতর থেকে টিপে দিয়ে বাইরে টানলেই ভেতর থেকে লক হয়ে যাবে। আমার কাছে চাবি আছে। সামনের সপ্তাহে দেখা হবে।
তাড়াতাড়ি উঠে গিজার ছেড়ে গরম পানিতে গোসল করতেই শরীরের সমস্ত অবসাদ সেরে গেল। দ্রুত নাশতা সেরে বাইরে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে জমাট বরফের ভেতর থেকে গাড়ি বের করে নিয়ে মেইন রোডে নামল।
আবার ব্যস্ত লন্ডন শহরের মানুষ সে। সে সপ্তাহে ওয়াসফিয়ার কোনো কল পেল না। কয়েক দিন ধরেই প্রচণ্ড তুষারপাত হচ্ছে বলে কোনোরকমে অফিস যেতে পারছে সে।
পরের সপ্তাহেও তার কোনো কল পেল না। কিছুই বুঝতে পারছে না এত সুন্দর মেয়েটির কী হলো। অনেক কষ্টে বরফ ভেঙে অফিস যাচ্ছে শুধু। একজন বাঙালি কর্মচারীই পোর্ট থেকে মালামাল এনে আড়তে রাখছে। এখান থেকেই ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং মালামাল বিক্রিও কম আনা হয়ও কম। সারা বছরের এই সিজিনে সচরাচর কম বিক্রিই হয়।
প্রায় দেড় মাস পর হঠাৎ একরাতে ওয়াসফিয়ার কল। অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে, আমি প্রেগনেন্ট। চমকে ওঠে রিয়াদ। কীভাবে? কে করল এসব?
-কেন সেই রাতের কথা ভুলে গেলে? তোমার অজান্তে, আমার অজান্তে আমরা এক হয়ে গিয়েছিলাম।
চিৎকার করে ওঠে রিয়াদ। অসম্ভব। কার না কার সাথে, এসব করে এখন আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছ।
-রিয়াদ তুমি আমাকে খুব ভালোভাবে চেন। জান। আমি সে প্রকৃতির মেয়ে নই।
-সে রাতের কোনো কথাই আমার মনে নেই। কী হয়েছে, তাও আমি মনে করতে পারি না।
-একজন নারী আর একজন নর কাছাকাছি এলে এসব অনেক সময়ই মনের অজান্তেই ঘটে যায়।
-সাট আপ। এসব কথা আমাকে শোনাবে না। আই হেট ইউ। বলে সেলফোনটির লাইন কেটে দিলো সে।
আর কখনো ওয়াসফিয়ারও খবর নেই। রিয়াদও খবর নেয় না। ব্যবসায় সে আরো বেশি মনোযোগ দেয়। অন্য কিছু ভাবতে চায় না। সেক্সপিয়ারের দেশ তার আর এখন ভালো লাগে না। ভাবে নারীরা ছলনাময়ী। তার কেবল মনে হতে থাকে, ওয়াসফিয়া আমি তোমাকে খুবই বিশ্বাস করেছিলাম! আমি তোমাকে ভ্যালেন্টাইন রাত্রিতে এ কথাই বলতে গিয়েছিলাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর তুমি আমাকে ট্র্যাপে ফেলতে চাইলে?
এরও প্রায় তিন বছর পার হয়ে গেছে। ইদানীং নিজেকে বেশ ক্লান্ত মনে হয় রিয়াদের। বেশির ভাগ সন্ধ্যায় সে বাইরে ডিনার করে বাসায় ফেরে। আজও সে এলো। এ সুপারমলটি বেশ বড়। ডাইনিং ফ্লোরটিও বেশ বড়। এক কিনারে একটি টেবিলের পাশের চেয়ারে বসল। সামনের চেয়ারটি খালি। ইতোমধ্যে খাবার দিয়ে গেছে। সে প্রথম স্পুন ভাত মুখে তুলতেই একটি ফুটফুটে বাচ্চা এসে তার সামনে দাঁড়াল। ভীষণ সুন্দর চোখ দুটি। তারই মতো গোলগাল মুখ। সে নির্বাক চেয়েই থাকল কিছুক্ষণ। বাচ্চাটিই বলল, তুমি আমার বাবা হবে?
চমকে ওঠে রিয়াদ। তারই কণ্ঠ বেজে ওঠে শিশুটির মুখে। এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে বাচ্চাটির মুখের দিকে। শিশুটি আবারো বলে, তুমি আমার বাবা হবে?
-তোমার মা কোথায়?
-আমার মা এক বছর ধরে আমার বাবাকে খুঁজছে।
-কোথায় তোমার মা?
-ওই তো! বলে সামান্য দূরে একটি টেবিল দেখিয়ে দেয়। ওয়াসফিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে কফি খাচ্ছে। ছেলেটি যে এখানে এসেছে, তা খেয়ালও করেনি। রিয়াদ বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে চিন্তা করছে আর ভাবছে আমার পরিচিত যে কেউই দেখলে বাজি ধরে বলবে, এটা তোরই ছেলে। দেখছিস না তোর মতো চোখ, মুখের আদল, এমনকি কণ্ঠস্বরও তোরমতোই পেয়েছে। সে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে বসিয়ে বলে, হ্যাঁ বাবা, আমি তোমারই বাবা।
স্পুন দিয়ে তার মুখে খাবার তুলে দিতে থাকে।
অনেকক্ষণ তুষারকে পাশে না দেখে টেবিলে ক্যাপুচিনোর বিল রেখে, এদিক-সেদিক খুঁজতে থাকে ওয়াসফিয়া। তারপর একটু সামনে এসে দেখে তুষার রিয়াদের কোলে বসে। রিয়াদ তার মুখে স্পুন দিয়ে ফ্রাইড রাইস তুলে দিচ্ছে। রিয়াদ অন্য একটি টেবিল দেখিয়ে বলে, বসো। ওয়াসফিয়া বসে পড়ে।
খাবার শেষ হলে বাচ্চাটি বলে, আই ওয়ান্ট টু গো হোম পাপ্পা।
-সিয়োর, বয়।
ওয়াসফিয়া বলে কোথায়?
রিয়াদ বলে, চলো আমরা বাসায় যাই ওযাসফিয়া। অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে। আর নয়, চলো আমার বাসায়।
তিনজন সুপারমলের ডাইনিং থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে পার্কিং করা গাড়ির দিকে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়