গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

উনুন : মজিদ মাহমুদ > উপন্যাস

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রাক-ইসলামি যুগে পারস্যের লোকজন আগুন-দেবতার পূজা করতো, অগ্নি দেবতাকেই খোদা বলে মান্য করতো। হয়তো সেই আগুনের দেবতা থেকেই ‘আকা’ শব্দ বাংলায় এসেছে। ‘আকা’ মানে আগুনও হতে পারে, আগুনের দেবতাও হতে পারে। বলা হয়ে থাকে প্রাচীনকালে ইরানি আর্যরদের একটি দল ভারতে এসেছিল, তারাও আগুনকে ভগবান বলে মানে- একই সঙ্গে আলো ও পবিত্রতার প্রতীক। আগুনে তর্পণ করলে পূর্ব-পুরুষের রশি ধরে পরম প্রভুর কাছে পৌঁছানো যায়। আগুন এতো নিখুঁতভাবে গ্রহণ করে- চিহ্নটুকু রাখে না। আমাদেরও রাখেনি, ঘাস গজাতেও সময় লেগেছিল, ততোদিনে ঘোড়া মরে গিয়েছিল।
গ্রাম বাংলার মুসলমানি এলাকাগুলোর অধিকাংশ আঞ্চলিক শব্দ মূল আরবি ফারসির অপভ্রংশ। সে অর্থে উনুন বা ‘আকা’কে আমরা আগুনের দেবতাও বলতে পারি। যখন রব্বেলের মা, চিৎকার করে তার মেয়েদের উদ্দেশে বলতো, ‘আকা তো নিভে গেল রে মাগি, আকার মধ্যে একটা খড়ি দে’ কিংবা তার ক্ষুধার্ত দাদি একা একাই বলতে থাকে ‘ও বৌ, বেলা যে পড়ে গেল, তা-ও আজ আকা জ¦লালি না! তোর আকার মদ্দি এখনো বিলাই শুয়ে আছে লো।’ বব্বেলের মা বলে, ‘তোমার তো খালি আকার খবর, এখনো বিন (সকাল) হলো না, খালি আকা আকা। পেটে কি রাক্ষস গেছে? আমার তো মোটে দুটি হাত। এই রাবনের গুষ্ঠী- আমার পক্ষে একা সামলানো সম্ভব! মিনশি মরে গেলো আমায় নিয়ে গেলো না।’
তারপর একটু থেমে কান্না-ধরা গলায় বলল, ‘এতই যেদি খিদি লাগে, হুলো’র মতন সলুই ধরে খেলিই তো পারো।’ রব্বেলের মা বিড়ালকে ‘হুলো’ আর ইঁদুরকে ‘সলুই’ বলে, কারণ তার শ্বশুরের নাম ‘বিল্লাল পরামাণিক’ আর ভাশুরের নাম ‘ইন্দু পরামাণিক’। মুরুব্বিদের নাম মুখে ধরতে নেই।
ঠিক বলতে পারবো না, কেন এত উনুন ছিল আমাদের বাড়িতে, রান্নাঘর ছাড়াও রান্নাঘরের বাইরের দিকে ছোট একটি উঠোনের মতো ছিল, এই অংশটা ঠিক বাড়ির কিছুটা পেছনের দিকে অবস্থিত- উত্তর-পূর্ব দিকের চার-চালা ঘরের যে কোণ ঘেঁষে ছিল পিছনে পানাপুকুরে যাওয়ার রাস্তা, তারই পাশে একটি পেয়ারা গাছ, যার ডালে উঠে পেয়ারা খেতে খেতে টিনের ঘরের চালার উপরে অনায়াসে যাওয়া যেতো, তার পূর্ব দিকে একটি বিশাল লম্বা খেজুর গাছ, তারই কোল ঘেঁষে একটি তালগাছ এবং ঠিক দক্ষিণ দিকে পূর্ব-পশ্চিম লম্বা একটি রান্নাঘর, এরই মাঝে এক টুকরো ছোট উঠোন, যেটি মূল উঠোনের সম্পূর্ণ বাইরে, এই উঠোনের মাখখানে ছিল একটি উনুন, এর চারপাশে বেশ কিছুটা জায়গা উঁচু করে বাঁধানো। এই চুলোতে রান্না করলে খোলা আকাশ দেখা যেতো। কাঠের পিঁড়িতে বসে আমরা গল্প করতাম, গল্প শুনতাম। গল্প ঠিক থাকতো, কিন্তু রান্না করার রাঁধুনি পরিবর্তন হতো। এই চুলায় মূলত তরুণ রাঁধুনিরা রান্না করতো, একটা পিকনিক পিকনিক ভাব আসতো। রান্না সেই করুক তাদের সাথেই গল্প জমে যেতো, আর অপেক্ষা করতাম- রান্না শেষ হওয়ার। রান্নার চলাকালে কখনো কখনো পাড়ার বয়স্ক মহিলারা যোগ দিতো, পিঁড়ি পেড়ে চুলার ধারে বসতো। তাদের মতো রব্বেলের দাদি, হালের নানি অন্যতম। অবশ্য, কেবল ক্ষুধার্ত থাকলে তারা এখানে এসে বসতো। গরম রুটির গন্ধ তার নাকে গেলে, একটা লাঠিতে ভর দিয়ে কয়েকটি বাড়ির মধ্য দিয়ে রাস্তা পার হয়ে চলে আসতো। বলতো, ‘কী করিস জয়নবের মা, আজ রাতে তোরে খোয়াব দেখলাম, ভাবলাম যাই তোকে দেকি আসি, আর একটু পানপাতাও খেয়ে আসি।’ যেই রান্না করুক, তার বাক্যের পরিবর্তন খুব কমই হতো, ‘ও তুই জাহেদা, ও তুই মলিনা, কী করিস বোন, কী রাঁধছিস?’
মা বলতো, ‘এসো খালা, ভালোই করেছে, একটা রুটি খেয়ে যাও।’ ‘তার আর কী দরকার ছিল জয়নবের মা’ বলেই রব্বেলের দাদি চুলার ধারেই বসে পড়তো। মা বসার জন্য একটি পিড়ি ঠেলে দিতো, আর চুলা থেকে একটি গমের আটার রুটি তার দিকে এগিয়ে দিতো, আর বলতো, ‘তোমার রব্বেলকেও সাথে নিয়ে আসতে।’ রব্বেলের দাদির সামনের দুটি দাঁত এখনো আছে, কোনো কিছুই চিবিয়ে খেতে পারে না। যেদিন রুটির সঙ্গে ডাল থাকে, সেদিন ডালে রুটিটা টুকরো টুকরো করে ডালের সাথে মেখে নরম করে নেয়, মুখে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে গিলে ফেলে। আর ডাল না থাকলে গøাস থেকে একটু পানি ঢেলে লবণের সঙ্গে মিশিয়ে নেয়।
এই ‘কাঠবিড়ালি চুলা’য় দিনের বড় কোনো রান্না হতো না, দিনের বেলা মধ্যবর্তী রান্নাগুলো এখানে সারা হতো, যেমন মিষ্টি আলু সিদ্ধ, কলাই সিদ্ধ, মোটর সিদ্ধ এবং খেসারির ডালের চাপড়া বানানো বড়া বানানোর জন্য এই চুলার ব্যবহার হতো সবচেয়ে বেশি। অবশ্য মাঝে মাঝে রাতের জন্য কাঁঠালের বিচি দিয়ে ডিম রান্নাও কখনো কখনো হতো। কাঁঠালের বিচি দিয়ে ডিম রান্নার দিনে একটি মহা-আয়োজন করতে হতো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাঁচা বিচি থেকে খোসা ছাড়ানোর জন্য জাতি দিয়ে বিচিগুলোকে দু’ভাগ করতে হতো। বিচির গায়ে লেগে থাকা লাল আস্তরণগুলো শাদা করার জন্য মাটির পাতিলে পানি দিয়ে অনেক্ষণ ঘঁষতে হতো, তারপর কিছুক্ষণ সিদ্ধ করে, মসলা দিয়ে ভালো করে কষিয়ে সিদ্ধ ডিমের সঙ্গে রান্না করা হতো। অবশ্য এই পুরো প্রক্রিয়াটা সহজ ছিল না। একার পক্ষে করা বেশ শ্রমসাধ্য ছিল, আমরা যারা ছোট ছিলাম, তাদের প্রধান কাজ ছিল, কাঁঠালের বিচি থেকে খোসা ছড়িয়ে দেয়া, সিদ্ধ ডিমের খোসাগুলো খুব সাবধানে ছড়ানো, আর ডিমের মধ্যে যাতে ঝাল মসলা ঠিক মতো ঢুকতে পারে তার জন্য শুঁচের মতো চোকা বাঁশের একটি চিকন কাঠি দিয়ে- সিদ্ধ ডিমের নরম শরীরে এফোঁড়-ওফোঁড় করা। তারপর সিদ্ধ ডিমগুলোকে মসলা দিয়ে কষিয়ে একটি আলাদা পাত্রে রেখে দেয়া হতো। ডিম আমাদের জন্য ছিল বিশেষ খাবার, দুধ-মাছ নিয়মিত হলেও ডিম, মুরগির মাংস বিশেষ দিনে আয়োজন হতো, জামাই বা আত্মীয়স্বজন এলেই কেবল ডিম রান্না হতো।
বাড়িতে যত উনুন ছিল, এটিই আমার প্রিয় উনুন, প্রিয় জায়গা, কেবল আমার নয়, আমাদের ভাইবোন সবার, এখানে রান্নার পুরো সময় ধরে প্রায় সবাই চুলোর চারিদিকে গোল হয়ে বসে থাকতো, বিশেষ করে দুপুর বা বিকালের রান্নার সময়ে, যতক্ষণ না রান্না শেষ হতো। এমনকি রান্না শেষে আমরা হাতে হাতে থালা নিয়ে এই চুলোর পাশেই বসে পড়তাম, খাওয়া-দাওয়ার শেষ পর্যন্ত এই উনুনের উষ্ণতা আমাদের কাছে টেনে রাখতো। আমি এই চুলার নাম দিয়েছিলাম ‘কাঠবিড়ালের চুলা’। তার অবশ্য কারণও ছিল। চুলার পাশের পেয়ারা গাছে কোথা থেকে চঞ্চল কাঠবিড়ালি এসে পাকা ডাসা পেয়ারাগুলো খেয়ে এঁটো করে রাখতো। শরীরের তুলনায় লোমশ বড় লেজ ও পিছনের দুই পায়ে ভর করে সামানের ছোট দুটি পায়ের আঙুল দিয়ে হাতের মতো ধরে এমনভাবে খেতো, মনে হতো, যেন এক খুদে শয়তান আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে আমার প্রিয় পেয়ারাগুলো খাচ্ছে, আর মনে মনে হাসছে। নজরুলের কবিতায় তখনই পড়েছিলাম- ‘তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও, খুকির মতো বলতে ইচ্ছে করতো ‘ইস! খেয়ো না না মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও! আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও’। যতই সতর্কতার সঙ্গে চুপি চুপি তার কাছে যাই, মুহূর্তে পালিয়ে যায়, পাশেই কোথাও গাছে কাণ্ডের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। মনে হয়, আমি যেন ওর সমান বয়সি বন্ধু, আমার সঙ্গে ‘পালানো টুকটুক’ খেলছে। মনে হতো, এই ধরতে পারবো, এই ধরা দিবে, ওর নমর শরীরটা আমার মুঠোর মধ্যে চলে আসবে, যেই ধরতে গেছি অমনি ক্ষীপ্রতার সঙ্গে সরে গেছে। কাঠবিড়ালির চুলার সঙ্গে আমার শৈশবের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এখনো তাদের দুটি ঘনকালো আঁখি গোলক, চোখের পল্লব, ক্ষুদে দুহাতে গাঁ মুছে ফেলে নিষ্পাপ চেয়ে থাকা, কেন যেন বলতে ইচ্ছে করে, তোমরা কি এখনো বেঁচে আছো ভাই, যখন পুরো দেশটিই একটি জ¦লন্ত উনুনে পরিণত হয়েছিল, যখন শিখাগুলো স্পর্শ করেছিল গাছের মগডাল, তৃণমূলগুলো ভস্মীভূত হয়ে ছাইয়ে পরিণত হয়েছিল, তখন আমার রাঙাদিরা কোথায় আশ্রয় নিয়েছিল, বলতে পারো!
এই কাঠবিড়ালির চুলাটি এ কারণেরই আমার কাছে গুরুত্ব বহন করে, আমার জীবনের জেগে ওঠা, উজ্জীবিত হওয়া, কোনো কিছুকে আলাদা করে চিনতে পারা এখান থেকেই শুরু হয়েছিল, যেভাবে মোসেজের কাছে আগুনের রূপ ধরে ঈশ্বর উপস্থিত হয়েছিলেন, আমার সচেতনা এই অগ্নিকে, এই উনুনকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল। এই চুলার ছাইভস্মকেই আমি সুরমার মতো চোখে কাজলের মতো এঁকে নিয়েছি, যার স্মৃতি থেকে কখনো বিচ্যুৎ হতে পারিনি। সেজ-বু একটি অ্যালুমিনিয়ামের চুলায় মিষ্টি আলু সিদ্ধ করতে করতে বলেছিল, মুসা নবীর কথা। মুসা নবী কীভাবে তুর পাহাড়ে আল্লাহর সাথে দেখা করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহর তেজ মাটির মানুষ সইতে পারে না, সত্তর হাজার পর্দার ফাঁক দিয়ে তিনি যখন মুসাকে এক ঝলক দেখা দিলেন, মুসা তো কুপোকাত, চল্লিশ দিন তার কোনো হুঁশজ্ঞান ছিল না। আল্লাহর নূরের তাজাল্লিতে পাহাড় পুড়ে ছাই হয়ে গেছিল, সেই ছাই আমরা ঈদের দিনে চোখের সৌন্দর্য বাড়াতে ব্যবহার করি, এতে চোখের জ্যোতি বাড়ে। এই প্রশ্ন তখন থেকেই আমার মনে জেগে আছে, সত্যিই কি তাহলে আগুনই ঈশ্বর! গল্পটা আরো বড় ছিল, সেজ-বুর কাছে কাঠবিড়ালি চুলার কাছে গল্প শুনতে শুনতে গল্পটি আমার মুখস্ত হয়ে গেছিল। এই গল্পটি বলতে বুবু খুব পছন্দ করতেন, তার কারণ তার নামও হয়তো জোবেদা, যা প্রাচীন হিব্রুতে যোকেবদ হিসাবে উল্লেখ আছে, মুসার পালিত মায়ের নামে তার নাম আছিয়া, কেউ বলেন ফেরাউনের স্ত্রী, কেউ বলেন বোন, তিনিও একজন স্বর্গীয় রমণী। ফেরাউনের বোন হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ কথিত ফেরাউন খুব বেশি বছর বাঁচেনি, মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে নীলনদে ডুবে মরে। আমার পিতা তার মেয়েদের নাম, নবীদের মা বা পতœী বা কন্যাদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছিলেন। হাদিসের বর্ণনা মতে আমার বাবা একজন স্বর্গীয় মানুষ, তিনি চাইলে সাত বেহেস্তের যে কোনো দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন, কারণ তার সাতকন্যা নিয়ে তিনি বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন, তার তিনটি পুত্র থাকলেও প্রথম ও শেষজনও কন্যা ছিল, এমনকি ছেলেদের চেয়ে মেয়েদেরকে তিনি অধিক প্রশ্রয় দিতেন। তাই সাত কন্যার গর্বিত পিতার মত্যু পর্যন্ত আদরের অভাব হয়নি। মৃত্যুর পরে কিছু থাকলে ভালো, সাতকন্যার পিতার দুনিয়াতেও কম প্রাপ্তি নেই, আমার পিতার প্রশান্তিময় জীবন দেখলেই বোঝা যায়। আমার মনে হয় সেজ-বুবু গল্প বলতে এই কারণে হয়তো বেশি পছন্দ করতেন। জোবেদা বুবুর কাছে মুসা নবীর যে গল্প শুনতে শুনতে আমি বড় হয়েছি, আর আমার দেখা ‘কাঠবিড়ালি উনুন’টি কখনো বৃহত্তর তুর পাহাড়ের জ¦লন্ত চুল্লির মতো প্রসারিত হয়ে গেছে তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না। আমার দৃষ্টিতে সবকিছু আগুন, আগুন থেকেই প্রাণের উদ্ভব, এমনকি পানিও আগুন থেকেই সৃষ্টি হয়েছে, ‘আগুন মানে ঈশ্বর, জীবনের অক্ষবিন্দু’।
বুবুর কাছে শোনা গল্পটি ছিলো এমন- ‘‘মিশর বলে একটি দেশ আছে। সেখানে পিরামিড আছে। পিরামিড কি সেজ-বুবু বলেছিলেন, এটি বিশাল ইমারত মাটির সমতল থেকে কৌণিক আকারে উপরে উঠে একটি বিন্দুতে মিলিত হয়। বুবু তার সদ্য কেনা জ্যামিতি বক্সে কাঁটাকম্পাস দিয়ে খাতার উপর ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। বুবুর কাছে জেনেছিলাম, এটি পৃথিবীর সাত আশ্চর্যের একটি। এটি মিশরের ফেরাউন রাজাদের কবর। তাজমহল যেমন বাদশা শাজাহানের স্ত্রী মমতাজ বেগমের কবর। রাজাদের অনেক শখ থাকে, যাদের টাকা আছে তারা মৃত্যুর মানুষের স্মরণে থাকতে চায়, তার প্রতাপ মর দুনিয়ায় প্রকাশিত হোক। তবে সেজ-বু বলেছিল, এটি মানুষের পক্ষে বানানো সম্ভব নয়, অন্তত আমরা যে ধরনের মানুষ দেখি। পাঁচ হাজার বছর আগে এই পিরামিড বানানো হয়েছিল, বিশাল বিশাল ওজনের পাথর এতো উঁচুতে নিয়ে গিয়েছিল কীভাবে তা ভাবাই যায় না। বলা হয়, তাজমহল তৈরি করতে বিশ হাজার শ্রমিক বাইশ বছর কাজ করেছিলেন, আর পিরামিড তৈরি করতে লেগেছিল এক লক্ষ শ্রমিকের বিশ বছর, সেদিক থেকেও বোঝা যায় তাজমহলের চেয়ে পিরামিডের বিশালত্ব।
তাই এখনো অনেক মানুষ বিশ্বাস করে মানুষ এগুলো বানায়নি। সোলেয়মান নবী যেভাবে জি¦ন বশ করে কাজ করাতেন। আমিও আলাদিনের গল্প পড়েছিলাম, একটা জি¦ন প্রদীপের ঘর্ষণে বেরিয়ে এসে তার সব কাজ করে দিচ্ছে। যে সময়ের কথা বলছি সে সময়ে পৃথিবীর সর্বত্র জি¦ন জাতির অবাধ যাতায়ত ছিল। মানুষের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক গড়ে উঠতো। এখন মিশর দেশের রাজধানী কায়রো হলেও তখনকার রাধানীর নাম ছিল পেন্টাটিউক। নীল নদ বলে সেখানে একটা বৃহৎ নদ আছে, এই নদ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে লম্বা। এই নদকে কেন্দ্র করে মানুষের সভ্যতা গড়ে উঠেছে। এই নদের তীরে আল্লাহ সব নবীকে তার কথা দিয়ে পাঠিয়েছেন। একসময়ে মিশরের বাদশা ছিল ফেরাউন। ফেরাউন একজন নয়, অনেক ফেরাউনরা মিশর দেশ শাসন করতো। এ দেশে একজন মহিলা শাসক ছিলেন, তার নাম ক্লিউপেট্টা। তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তার ভাইকে বিয়ে করেছিলেন। আদিম পৃথিবীতে ভাইবোনের বিয়ে একটি স্বাভাবিক ঘটনা। বুবু বলেছিলেন, আগে তো মানুষ বেশি ছিলো না তাই এ রকম বিয়ে বৈধ ছিল। এমনকি মুসা নবীর মা জোবেদাও তার পিতা ইমরানের ফুফু ছিলেন। মুসা নবী হওয়ার পর নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে বিয়ের নিয়ম বাতিল করে দেন।
বুবুর কাছে জেনেছিলাম, ইহুদি বলে তখন এক জাতি ছিল, তাদের বলা হতো বনি ইসরাইল, কারণ তারা ছিল ইয়াকুব নবীর বংশধর, ইয়াকুব নবীর আরেক নাম ছিল ই¯্রাইল। তাদের বংশের লোকজন তখন মিশরে অনেকটা দাস হিসেবে বসবাস করতো, তাদের তেমন অধিকার ছিল না, মর্যাদা ছিল না। প্রাচীন গ্রিসের অধিকাংশ মানুষ দাস ছিল, তারা নাগরিক বলে স্বীকৃত ছিল না, তারা খাদ্য উৎপাদন ও মনিবের সেবা করত। বনি ইসরাইলদেরও তাই করতে হতো। কিন্তু ফেরাউনদের ভয় ছিল এই বনি ইসরাইলরা একদিন শক্তিশালী হয়ে তাদের মনিব হিসেবে মানবে না। নগরের শেষ প্রান্তে তাদের বসবাস করতে হতো, আর তাদের পুত্র সন্তান হলে হত্যা করা হতো।’
এই ভয়ঙ্কর সময়ে জোবেদা ও ইমরানের ঘরে মুসা নবীর জন্ম। পিতামাতা ফেরাউনের জল্লাদের ভয়ে মুসা নবীকে একটি কাঠের সিন্দুকে করে নীল নদে ভাসিয়ে দেন। সিন্ধুকটি আল্লাহর কুদরতে ভাসতে ভাসতে ফেরাউনের ঘটলায় এসে পৌঁছায়। এই ঘাটে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া সখীদের নিয়ে গোসল করতে এসে সিন্দুকটি ঘরে নিয়ে আসে। এমন একটা মায়াময় চেহারার শিশুকে দেখে তার মাতৃত্ব জেগে ওঠে এবং নিজের কাছে রেখে লালন-পালন করার সিদ্ধান্ত নেন। ফেরাউনের সন্দেহ হলেও স্ত্রীর বায়নার কাছে তিনি তার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হন। মুসা নবী খুব রাগী মানুষ। তিনি একবার শিশুকালে ফেরাউনের কোলে বসে তাকে চড় মেরেছিলেন। এ গল্প তখন আমার মতো অধিকাংশ শিশুরাই জানতো। জিরুদ্দি মামাও বলেছিলেন, মুসার এক চড়ে ফেরাউনের এক চোখ কানা হয়ে গেছিল। ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া মুসাকে যখন তার কোলে দেন, তখন ফেরাউন সোনার হুঁকোতে তামাক খাচ্ছিলো। শিশু মুসা ফেরাউনের দাড়ি খামচে ধরে তার মুখে থাপ্পড় মেরেছিলেন। ফেরাউন তাকে তাৎক্ষণাৎ কতল করার আদেশ দেন, তখন ফেরাউনকে সভাসদরা বোঝালেন, এ তো নেহায়েত বাচ্চা পোলা, এর কাছে সবই সমান- মিষ্টিও যা আগুনও তা। তখন চুলা থেকে এক খণ্ড জ¦লন্ত কয়লার আগুন আর এক খণ্ড খেজুরের গুড় শিশু মুসার সামনে রাখা হলো হলো। শিশু মুসা তাৎক্ষণাৎ জ¦লন্ত আগুনোর কয়লাটি মুখে তুলে নেয়, এতে তার জিব পুড়ে যায়। তাই বাকি জীবন নবী মুসা কথা বলতে গেলে তোতলাতেন। এজনই তার বড় ভাই হারুনকেও নবী বানাতে হয়েছিল, যাতে লোকজন তার কথা বুঝতে পারে। শিশু বিবেচনা করে ফেরাউন তাকে ক্ষমা করে দেয়। এরপর বড় হয়ে তিনি একবার এক থাপ্পড়ে একজনকে মেরে ফেলেছিলেন, কারণ সেই ব্যক্তি তার ইহুদি দাসকে মারধোর করতো। আর এই ঘটনার ফলে মুসা নবী মিশর ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। তখনো মুসা নবী হননি। দীর্ঘ পথ ক্লান্ত, ক্ষুধা পিপাসায় কাতর তিনি। তার চোখে পড়ল দূরে একটি কুয়া। তিরি দেখতে পেলেন কুয়ার কাছে বেশ কয়েকজন তরুণী তাদের ভেড়ার পালকে পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল। আর তাদের বাধা দিচ্ছিল অপরিচিত কিছু যাযাবর বখাটে তরুণ। মুসা মেয়েগুলোকে বখাটেদের হাত থেকে রক্ষা করেন। তাদের বাবাও একজন নবী। পিতা মেয়েদের বললেন, পুনরায় ছেলেটির দেখা পেলে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। মুসাকে দেখে মেয়েদের পিতা শোয়ায়েব খুব মুগ্ধ হলেন। বার বছর মেষ চরানোর শর্তে তার বড় মেয়ের সঙ্গে মুসার বিয়ে দিলেন।
‘একদিন মেষের পাল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নির্জন পাহাড়ের প্রান্তে এসে পৌঁছলেন মুসা। সামনেই বেশ কিছু গাছপালা। হঠাৎ মুসা দেখলেন সেই গাছপালা আর পাহাড়ের মধ্য থেকে এক আলোকছটা বেরিয়ে আসছে। এক তীব্র আলো মনে হলো দুচোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে। তবুও তিনি স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন সেই আলোর দিকে। তার মনে হলো ঐ আলো যেন তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। একসময় শুনতে পেলেন সেই আলোর মধ্য থেকে এক অলৌকিক কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, কেউ তার নাম ধরে ডাকছে- মুসা….মুসা….। চমকে উঠলেন মুসা। সেই আগুন থেকে এক কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, এক অলৌকিক কণ্ঠস্বর বলে উঠলেন, ‘আমি তোমার এবং তোমার পূর্ব-পুরুষদের এমনকি যারা অনাগত তাদের সবার ¯্রষ্টা ও পালনকর্তা। তুমি আবার ফিরে যাও মিশরে এবং নিজ জাতি বনি ই¯্রাইলদের রক্ষা করো- ফেরাউনের অত্যাচার থেকে। আমি তোমাকে প্রতিশ্রæতি দিচ্ছি- তোমার জাতির জন্য আমি একটি ভূখণ্ড উপহার হিসেবে রেখেছি।’
এই গল্প বলার সময় বুবুর মধ্যে এক অদ্ভূত আবেগের সঞ্চার হতো। বিশেষ করে শোয়ায়েব নবীর মেয়েদের কথা বলার সময় যে যেন নিজেকে খুঁজে পেতো তাদের মধ্যে। আমার ধারণা নবী মুসার স্ত্রী সফুরার সাথে তার মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। হয়তো মুসার মতো কোনো মেষচারক তাকে একদিন এসে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। আমার বড় তিন বোনের বিয়ে আগেই সম্পন্ন হয়েছে। সেজ-বুর বয়স তখন চৌদ্দ-পনেরোর কোঠায়, তার চেয়ে ছোটরাও তখন বড় হয়ে গেছে। শোয়ায়েব নবীর সাত মেয়ের ছাগল চরানোর গল্প আমাদের পরিবারের মধ্যেও ছিল, খুবই বাস্তব, তখনও পৃথিবীর পরিবর্তন খুব সামান্যই হয়েছিল। আমাদের পরিবার গ্রামে বসবাস করলেও, কৃষিজীবী পরিবার বলা যায় না। কিছু জমি-জমা থাকলেও কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল না।
এ সময়ে ঠিক এই উনুনের পাশে বসেই নতুন নতুন কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু হলো। নতুন লোকের যাতায়াত শুরু হলো। এমনকি সবার মধ্যে কেমন যেন একটা ভয়, শঙ্কা চাপা গুমোট পরিস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছিল। যদি আমার ব্যক্তিগত জীবনে এসবের কোনো প্রভাব পড়ছিল না, কিংবা পড়ার মতো বয়সও তখন ছিল না। বিশেষ করে মেজ ভাইকে নিয়ে বাড়ির লোকের শঙ্কাটা একটু বেশিই বাড়তে থাকলো। সামনে মেট্রিক পরীক্ষা, অবশ্য সেদিকে তার খেয়াল ছিল না। সকাল সন্ধ্যা মিটিং মিছিল কবিতা গান নিয়ে মহাব্যস্ত তিনি। সন্ধ্যা হলেই পাড়ার ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে সঙ্গে নিয়ে তার বয়সী কিছু বন্ধুবান্ধব সহযোগে প্রায় প্রতিদিনই মিছিল বের করতে শুরু করলো। কি যেন সব স্লোগান, সবাই একসঙ্গে বলে, যার অর্থ তখনো আমার কাছে পুরোপুরি ছিল না। এই সময় পর্বে শেখ মুজিব নামটি আমার মাথায় ঢুকে পড়ে। পাড়ার শিশুদের সঙ্গে, বড়দের সঙ্গে একযোগে উচ্চারণ শুরু হলো- ‘শেখ শেখ মুজিব, লও লও লও সালাম।’ বিকালে মিছিল বের করার আগে এই ‘কাঠবিড়ালি উনুনে’র কাছে এসে ফিস ফিস করে সেজ-বু জোদোকে মেজভাই বলতো, ‘এই আব্বা কোই রে? মা বাড়িতে আছে? কী রাঁধছিস, দে তো- খুব ক্ষুধা লেগেছে।’ এই হলো তখন তার পরিচিত শব্দ, বাবা বাড়িতে থাকলে মেজ ভাই ভেতরে খুব একটা ঢুকতে চাইত না। কিছু একটা মুখে দিয়ে পেছনের হেঁেসল ঘর দিয়েই বেরিয়ে যেতো।’ বাড়িতে মা আর সেজবুবু ছাড়া কেউ তার উড়নচণ্ডী স্বভাব পছন্দ করতো না।

দুই.
চকলেটে প্রতিকৃতি
আমার কাছে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন- একটি চকলেটের মালার মধ্যে এক উদ্ভাসিত মুখ হয়ে। অনেক চকলেট ও ফুলের মধ্যে তিনি ছিলেন নির্বিকার, তাঁর চোখ দুটি ছিল উজ্জ্বল, উন্নত নাশা- তার নিচেই জোড়া ঘন গোঁফ। প্রশস্ত ললাটের উপর চুলগুলো পেছনের দিকে বিস্তৃত। চশমার কাঁচ গলিয়ে চোখ দুটি ঠিক আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো- কিছুটা ঊর্ধ্বপানে দৃষ্টি রেখে- যেন কিছুই এড়িয়ে যায় না তার দৃষ্টির সীমানা থেকে- যতক্ষণ আমি তাঁর ছবিটির সামনে থেকেছি, ততক্ষণই সেই ছবির মানুষটি আমায় চোখে চোখে রেখেছেন। এদিক ওদিকে গিয়ে অনেকবার পরীক্ষা করেছি, তাঁর গলায় ঝোলানো সম্মান ও শোভাবর্ধনের রঙিন কাগজের মালা, তাজা ফুলের ব্যবহার তখনো খুব বেশি দৃশ্যগোচর হতো না- সেই সব মালার ভেতরে লুকিয়ে রাখা চকলেট চুরি করার ফন্দি এঁটেছি বহুবার, পেরে উঠিনি, মনে হয়েছে এই বুঝি তিনি ধরে ফেলবেন। যদিও তার অবয়বে ছিল না কোনো কাঠিন্য; টোল খাওয়া চিবুক আর ঘন গোঁফের নিচের ঠোঁট দুটিতে লেগে থাকত চাপা হাসির রেখা। মনে হতো সবকিছু তিনি দেখতে পাচ্ছেন; কিন্তু ভাবছেন অন্যকিছু। এমনকি তার বাম গালের ওপর একটি তিলও আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠত। যদিও তখনো আমার মানুষকে আলাদা করে চেনার সক্ষমতা তৈরি হয়নি। তখনো কেবল নিজের বাবা মা ভাইবোনের বাইরে কেবল আশপাশের খেলার সাথীদেরই চিনতে পারতাম। এর বাইরের সকল জগত ছিল অনুদ্ভাসিত, কল্পনার দ্বারা অবিষ্ট। তখন আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে সবই ছিল, অন্ধকার কালো। গ্রামের বিস্তৃত খেলার মাঠে দাঁড়ালে দেখতে পেতাম- আকাশ কীভাবে নিচে নেমে আসে- গোল তাঁবুর মতো হয়ে। তার কিনার ঘেঁষে ছোট ছোট সাইবাবলা ও কালো অন্ধকার তমালের বেড়া। আমাদের বাড়ি ছিল পাবনা শহর থেকে দশ কিলোমিটার পশ্চিমে, ঈশ্বরদী থানা এলাকা থেকেও দূরত্ব প্রায় সমান। এমনকি দক্ষিণে কুষ্টিয়া শহর- যদিও যেতে হলে অতিক্রম করতে হতো প্রমত্ত পদ্মানদী পালতোলা নৌকায়। কিন্তু দক্ষিণে আমাদের গ্রামটিই ছিল শেষপ্রান্ত, তারপর ধূ-ধূ চর। শীতকালে প্রায় দশ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে পদ্মায় খেয়া নৌকা পাড়ি দিয়ে এ এলাকার মানুষ কুষ্টিয়ায় যেতো হাটবাজার করার জন্য। তবে কুষ্টিয়া যাওয়ার উত্তম সময় ছিল বর্ষাকালে। পদ্মার একটি শাখা নদীর তীরে আমাদের গ্রামটি গড়ে উঠেছিল। নদীতে নৌকায় উঠলেই ঠিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গড়াই নদীর তীরে কুষ্টিয়া শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে দিত। এই কয়েক ঘণ্টা রাস্তা বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল। কখনো দাড় বেয়ে, কখনো গুণ টেনে কয়েক মাইল রাস্তা পার হয়ে মূল পদ্মায় পৌঁছাতে হতো। পদ্মা ও গড়াই নদীর দূরত্ব ও পার্থক্য ছিল খুব কম। এই পদ্মা ও গড়াই নদীর এই অঞ্চলই মূলত ছিল রবীন্দ্রনাথ ও লালন ফকিরের বসতি।
তবে কুষ্টিয়া শহরের আমাদের বড় মাপকাঠি ছিল মোহিনি মিলের চিমনি, আমরা বলতাম চোঙ। খুব ছোটবেলা থেকে আমার কাছে নিজের গ্রাম ছাড়া যে বস্তু প্রতিভাত হয়েছিল সেটি মোহিনি মিলের চঙ। শরৎকালে সন্ধ্যা বা ভোরে প্রায় দশ-বারো কিলোমিটার দূর থেকেও আমরা মোহিনি মিলের চঙ দিয়ে ধোঁয়া উড়তে দেখতাম। আমাদের বাড়িতে ছিল বিশাল একটি তালগাছ। পাবনা হেমায়েতপুর মানসিক হাসপাতাল থেকে তার উচ্চতা দেখা যেতো। বলা চলে পূব দিকে পাবনা শহর আর পশ্চিমে কিছু গ্রাম ছাড়া উত্তর দক্ষিণ প্রায় সবটা ছিল ফাঁকা বিস্তীর্ণ মাঠ। আমার বঙ্গবন্ধু হওয়ার ক্ষেত্রে এই গ্রামের পরিচয়টুকুর কিছুটা প্রয়োজন আছে। যদিও আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচশত গজ দূরে একটি প্রাথমিক ও দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় এবং বিশাল একটি খেলার মাঠ পুরো গ্রামের মর্যাদা হয়েছিল। তারপরেও তালগাছটিও গ্রামের একটি গর্ব হয়ে ছিল; তার পাশেই ছিল সরু ও সমান লম্বা একটি খেজুর গাছ। শীতকাল শেষ হয়ে গেলে কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বাবুই পাখি এসে বাসা করতো। আর গ্রামে গবাদি পশু মারা গেলে বিশাল বিশাল গলাছিলা শকুন তালগাছের শাখায় অবস্থান নিতো।
যে সময়টির কথা বলছি, সেটি ১৯৭০ সালের কাছাকাছি। যখন সারা বাংলাদেশ পাকিস্তানের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের রায় দেয়ার জন্য উত্তাল হয়ে উঠেছে। তারই বছর পাঁচেক আগে এই গ্রামে আমার জন্ম। একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম ও পরিবারে আমার জন্ম হয়েছিল। দশ ভাইবোনের পরিবারে আমি ছিলাম তখন পর্যন্ত সর্ব-কনিষ্ট। ১৯৭১ সালের শুরুর দিক আমার বাবার পরিবারের শেষ সদস্য এক বোনের জন্ম হয়েছিল। আশ্চর্য মাত্র কয়েক মাসে মুক্তিযুদ্ধের মাঝখানেই সে কথা বলতে শুরু করে দিয়েছিল। কোথাও গুলির শব্দ হলেই বলত- বমম, ধুম, মিলিটারি- এই ধরনের শব্দরাজি তার ঝুড়িতে জমা হচ্ছিল। যে সবার আগে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকত। কাছেকোলে কারো দিকে হাত বাড়িয়ে দিত- যে তাকে বহন করতে পারত মিলিটারির ভয়ে দূর গ্রামে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। সে-ও শিখে ফেলেছিল মিলিটারি গ্রামে এলে পালানোর কৌশল, ভুলেও একটি টুঁ শব্দ করতো না। যতক্ষণ না আমরা গ্রাম থেকে প্রায় মাইল চারেক দূরে দক্ষিণে নদী বড়োদাগের কোলের নিচে পৌঁছাতাম। পানি সরে যাওয়ার পরে এই নদীর পাড়ি অনেক দূর নিচে নেমে যেতো। গাঙ শালিকেরা যেভাবে পাড়ের মাটিতে বাসা করে ডিম লুকিয়ে রাখত, আমরাও ঠিক নদীর কিনারায় নানা গর্তে এবং দ’য়ের মধ্যে পালিয়ে থাকতাম- যতক্ষণ ভোর না হতো, যতক্ষণ গ্রাম থেকে কেউ খবর না নিয়ে আসত যে, মিলিটারিরা চলে গেছে। এ কেবল একদিন বা এক রাতের গল্প নয়; অসংখ্য রাতের গল্প। ঘুম থেকে মা কিংবা বোন-ভাইদের কেউ একজন বলে উঠল, মিলিটারি আসছে, ওমনি পুরো গ্রাম জেগে উঠতো, সারি সারি নগ্ন পা মেলে বাঁচার প্রত্যাশায় সকলে প্রায় একই দিকে চলতে থাকত। যদিও এই পলানোতে কেউ নেতৃত্ব দিতো বলে মনে হয় না। তবু সবার গন্তব্য যেন একই দিকে, একই লক্ষ্যে।
একটি যুদ্ধের মধ্যে আমার জন্ম হয়েছিল। যুদ্ধের স্মৃতির মধ্যে আমরা বেড়ে উঠেছিলাম। আর সেই যুদ্ধের যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই ছবির মানুষটি। যার জন্য এই যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল, যার জন্য মানুষ যুদ্ধ করেছিল। তাকে আমি সামনে থেকে সরাসরি দেখিনি কখনো। অথচ তাকেই পুরো পরিবার, এমনকি পুরো গ্রাম ধ্যান-জ্ঞান মেনেছে। তিনি কোথাও ভাষণ দেবে শুনলে ভাইদের মতো বৃদ্ধ বাবাও চঞ্চল হয়ে উঠতেন, তিনি আমাদের জন্য এমন কিছু একটা বলবেন- যা আমরা কেউ জানতাম না; তিনি আসলে ছিলেন এক দেবদূত, যিনি মুক্তির কথা শোনাবেন। তার একটি কথা ও নির্দেশ শোনার জন্য একটি কাঠের ট্র্যানজেস্টারে মানুষ কান পেতে থেকেছে। তার নাম আমরা শেখ মুজিব বলেই জেনেছি। গ্রামের মুরুব্বিদের বলতে শুনেছি শেখের ব্যাটা, কেউ বলত মজিবর। বঙ্গবন্ধু শব্দটিও তখন চালু হয়েছিল। তা কেবল বলত, যারা স্কুল ও কলেজে পড়ত, পাড়ায় মিছিলে নেতৃত্ব দিতো তারা। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে মানুষ জাতির পিতা বলেও মানতে শুরু করেছে।
এবার চকলেটের বঙ্গবন্ধুর কাছে ফিরে আসি। আগেই বলেছি আমাদের গ্রামটি ছিল একটি বর্ধিষ্ণু বসতির, যার অধিকাংশ ছিল শিশু ও তরুণ। বয়স্কদের প্রায় সবাই কৃষি কাজের সঙ্গে ছিল জড়িত। কাজ থেকে ফিরে পাড়ার দহলিজে তাদের নানা বিষয় নিয়ে গল্পগুজব করতে দেখা গেলেও সকাল হতেই তারা লাঙল গরু নিয়ে মাঠে ছুটত। ফিরে এসে গরুগুলোর যতœ নিতো, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, আর ফসলের জো, জমিতে সেচ ও বেচন নিয়ে গল্প করতো। যুবকদের সংখ্যা ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি- যাদের খুব কমসংখ্যক যুবক স্কুলে যেতো, যদিও গ্রামে একটি দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় কেবলই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তবু অধিকাংশ গ্রাম থেকে তিন চার মাইল দূরের পুরনো বাঁশেরবাদা উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি হওয়াকে বেশি মর্যাদার বলে মনে করে। তবে দুই স্কুল মিলে পুরো গ্রামে তখন দশ-বারোজনের বেশি নবম বা দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল বলে মনে হয় না। যদিও এই গ্রামে প্রথম বি.এ পাস করেছিলেন আমার অগ্রজ আব্দুল ওয়াহাব বিশ্বাস, ১৯৬৪ সালে। তার প্রায় বছর দশেকের ছোট মধ্যম ভ্রাতা আব্দুল খালেক বিশ্বাস তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। বলা চলে তাকে ঘিরেই এই গ্রামে মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি সংগ্রামের উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল। অবশ্য আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র একটি বাড়ি পরে আমার মামা শফিউর রহমান তখন আইএ পাস করেছিল, তিনিও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বে ভূমিকা রেখেছিলেন। আরেক মেজ ভাই, মেজ খালার ছেলে, তার নাম নূরুল ইসলাম- যার সঙ্গে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহোদরের বিয়ে হয়েছিল, সে-ও একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে গমন করেছিলেন।
আমাদের বাড়িতে একটি বাড়তি সুবিধা ছিল- মূল বাড়ির বাইরের দিকে ছিল একটি বৈঠকখানা ঘর। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ছিল গরিব। তাদের থাকার জন্য একটি ছনের ঘর ছাড়া কিছুই ছিল না, ব্যতিক্রম ছাড়া। আমাদের চারি ভিটাতে ঘর ছিল, বাইরের একটি ঘর বৈঠকখানা হিসাবে ব্যবহার হতো। ফলে মুক্তিযুদ্ধকালে একটি বাড়তি সুবিধা পেয়েছিলাম আমরা। তখনো টিনের প্রচলন তেমন শুরু হয়নি, আমাদের বাড়ির এক ভিটায় কেবল একটি টিনের ঘর ছিল, বাকিগুলো ছন দিয়ে ছাওয়া; তখন টিনের চেয়ে ছনের ঘরের কদর একটু বেশি ছিল। এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে সমবেত হতেন, এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমাদের বাড়িতে রেখে দিতেন। তখন অনেক রকম অস্ত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় গড়ে ওঠে। সবচেয়ে বড় যে বন্দুক ছিল, তার নাম মেশিন গান। মাঝে মাঝে মেশিন গানের ফাঁকা গুলি করার দরকার হলে আমার মেজ ভাই আব্দুল খালেক বিশ্বাস এবং মামা শফিউর রহমান- আমাদের শিশুদের বলতেন- তাদের কোমর জড়িয়ে শক্ত করে ধরে রাখতে। মেশিন গানে গুলি ছোড়ার সময় তাদের মনে হতো গুলি নিক্ষেপের গতি তাদের শূন্যে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আমরা সেখানে ভারসাম্যের কাজ করতাম। মেশিন গানের গোলা নিক্ষেপের পরে চারিদিকে গুলির অসংখ্য গরম খোসা ছাড়িয়ে থাকত। আমরা কুড়িয়ে নিতাম, প্রথম প্রথম গুলি ছোড়ার পর পরই খোসা কুড়াতে গিয়ে হাতে ছ্যাকা খেয়েছি, আঙুলে ফোসকা পড়েছে। গুলির খোসাগুলি আমরা কুড়িয়ে রাখতাম, খালি খোসা দিয়ে বন্ধুদের সাথে খেলা করতাম। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে আমরা এগুলো আইসক্রিমওয়ালার কাছে বিক্রি করতাম, খোসার বিনিময়ে আইসক্রিম ও তিলে খাজা খেতাম। পরে অল্প কিছুদিনের মধ্যে খোসার দাম বেড়ে গেল, তখন আমাদের অনেক আফসোস হতে থাকল, যদি তখন এগুলো এভাবে বিক্রি না করতাম তাহলে পরে অনেক দামে বিক্রি করতে পারতাম। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরে বেশ কয়েক বছর ধরে চলেছিল গুলির খোসা সংগ্রহ। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েকশ গজ দূরে স্কুল মাঠ সেখানে মঙ্গল আর শুক্রবারে হাট বসত। আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে ফড়িয়ারা আসত, খরিদ্দার আসত, দোকানিরা আসত। যদিও এই হাটে কোনো ঘর ছিল না, বর্ষায় শীতে একইভাবে খোলা যায়গায় বসে বেচাকেনা করতে হতো, তবু সবার জন্য স্থান থাকত নির্ধারিত। এখনো একইভাবে হাট বসে, এখনো অধিকাংশ দোকানি পসরা বসায় উন্মুক্ত ময়দানে, দু-একটা আধাপাকা দোকানও রয়েছে সেখানে। হাটে বেশির ভাগ বিক্রি হতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, তৈজস, অধিকাংশ খাদ্য দ্রব্য- ধানচাল, গ্রামের মাঠ থেকে তুলে আনা টাটকা শাকসবজি, মাছ। তবে যুদ্ধের পরে গুলির খোসা কেনার জন্য ভিন গাঁ থেকে ক্রেতা আসত, হাটের এক কোণে চটের ছালা বিছিয়ে গুলির খোসা কিনত, অধিকাংশ বিক্রেতা ছিল, আমাদের মতো শিশুরা; বড়রা ও বাড়ির মেয়েরাও খোসা কুড়িয়ে রাখত, কিন্তু নিজেরা খুব কম বিক্রি করতে আসত; শিশুদের দিয়ে বেচাত। এক হাট থেকে অন্য হাটে খোসার পরিমাণ কমতে থাকে আমাদের। ক্রেতারা লোভ দেখায় বেশি দিতে পারলে বেশি পয়সা দেবে। তখন এক পয়সা, পাঁচ পয়সার তামার মুদ্রা ছিল, দশ পয়সা খাঁজকাটা, পাঁচ পয়সা চৌকোনা, সম্ভবত তখনো পাকিস্তানি চাঁদ তারা উৎকীর্ণ মুদ্রা। চার আনা, আট আনা, এক টাকার মুদ্রা ছিল রুপোর; অন্তত বড়রা তাই বলতো। এক টাকা, দু টাকার নোট তখনো চালু হয়নি। একটা গুলির খোসা বেচতে পারলে একটি দুধ মালাই হয়ে যেতো, কখনো তিলের খাজা, বাতাসা, খাইগাই খোরমা, ঝুরি বারোভাজা কিনতাম। মাঝে মাঝে হাটের এক কোণে জিলাপি ভাজা হতো, গরম গরম জিলাপি, গরম তেল থেকে তুলে গুড়ের সিরাতে ভেজানো হতো, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখতাম, কখনো কিনতাম এক ছটাক, দুই ছটাক। তখনো কেজি কিংবা গ্রামের হিসাব চালু হয়নি। ষোল ছটাকে ছিল এক সের। ছটাকেরও নিচে ছিল আধ-ছটাক, কাকচা, তোলা। মানুষের হাতে পয়সা ছিল না। এক আনা পয়সা নিয়ে হাটে আসত। ছোট ছোট শিশি বোতলের গলায় রশি বেঁধে ঝুলিয়ে হাটে আসতো; কোনোটিতে সরিষার তেল, কোনোটিতে নারিকেলের তেল, আবার কোনোটিতে থাকত কেরোসিন তেল। ষোল আনায় এক টাকা। ছয় পয়সায় এক আনা। এসব হিসাব কীভাবে হয়েছিল এখনো তা বলতে পারব না। এক কাচ্চা বা তোলা তেলের পরিমাণ এক টেবিল চামচের চেয়ে কম ছিল, যা দিয়ে পাঁচ-ছয়জনের একটি পরিবারকে অর্ধ-সপ্তাহ চালাতে হতো। তখনো সয়াবিন তেলের প্রচলন ঘটেনি।
তবে আমার সবচেয়ে পছন্দের বন্দুক ছিল ব্যাটাগান। বেশ ছোট বেটেখাটো দেখতে, কালো সারা শরীর গোল গোল ছিদ্রে ভরা। অনবরত গুলি করা যেতে, সম্ভবত একেই ব্রাশফায়ার বলা হতো। সব ধরনের বন্দুকই আমরা নাড়াচাড়া করতাম। বন্দুক পরিষ্কারের কাপড়ের ন্যাকড়া, কেরোসিন এসব আমরাই সরবরাহ করতাম। মাঝে মাঝে ব্যাটাগান হাতে নিয়ে গুলি করার ভঙ্গিও করেছি। তখন এমন একটা সময়, শিশুরাও যে হঠাৎ করে বড় হয়ে গেছিল, তা কেউ টের পায়নি। এখন ফিলিস্তিনি শিশুদের দিকে তাকালে কিছুটা আঁচ করা যায়। এসব বন্দুকের তখন বেশ সৌখিন ব্যবহারও দেখা যেতো। বিশেষ করে অবসরে বৈঠকখানায় গ্রামের মুরুব্বি ও শিশুদের অনুরোধে শখে ফায়ার করা হতো। একটা বিষয় তখন আশ্চর্য হয়েছি- একটি গাছকে লক্ষ্য করে গুলি করলে, যেদিক দিয়ে গুলি প্রবেশ করত সে দিকটা সামান্যই ছিদ্র দৃষ্টিগোচর হয়, কিন্তু যেদিক দিয়ে গুলি বের হয়ে যায় সেদিকটি বিশাল অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। গুলি ঢোকানো যত সহজ বের করা হতো কঠিন। সবাই বলতো, গুলি গাছের কাণ্ডের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে সবকিছু ছিন্ন ভিন্ন করে বের হয়ে যায়। ব্যাটাগানের বাইরে হাত গ্রেনেড কীভাব পিন খুলে মারতে হয়, তা বাড়িতে ভাই এবং সহ-মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দেখতে দেখতে শিখে গিয়েছিলাম। এজন্যই নাকি পেটে গুলি লাগলে মানুষ বাঁচে না, নাড়ির সঙ্গে পেঁচিয়ে বেরিয়ে যায়। একটি বস্তুর নাম মনে নেই, যেটি অনেকটা হলুদ কলার মতো দেখতে ছিল, মোড়ক খুলে আগুন জ্বালিয়ে দিলে অনেক্ষণ জ্বলতে থাকত। বিশেষ করে শীতের রাতে গা গরম রাখার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ব্যবহার করতেন। আমরাও নভেম্বর-ডিম্বেরে শীত পোহাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সে উষ্ণতা ভাগ করে নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরা প্রথম সতেরঞ্জি দেখেছিলাম, এমনকি কম্বলও। একটি ছোট চাদার ও কম্বলের মাঝামাছি ঘন ঠাসা উল বা সুতা দিয়ে বুনানো। বহনে সুবিধা, মাটিতে পেতে, গায়ে জাড়িয়ে নানা প্রয়োজনে ব্যবহার করা হতো। এই বস্তুটি যথেষ্ট টেসই ছিল; কারণ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও এটি আমাদের বাড়িতে অনেকদিন ব্যবহার হয়েছিল।
পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই আমরা বঙ্গবন্ধুকে চিনতে শুরু করেছিলাম। এখন বুঝতে পারি সেটা ছিল ৭০ সালের নির্বাচনের আগে আগে। এর আগে আমি এতই ছোট ছিলাম সেই সময়ের খুব একটা স্মৃতি মনে করতে পারি না। নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই এসব ছিল মিছিলের অংশ, পরিবর্তনের হাওয়া। আগেই বলেছি, আমার মেজ ভাই তখন দশম শ্রেণির ছাত্র, সামনে মেট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছিল, এর মধ্যে দেশের উত্তাল গণবার্তা আমাদের গ্রামেও আছড়ে পড়েছিল। হয়তো তার আগে থেকেই। মেজ ভাই ছিলেন স্কুলে এবং এলাকায় ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা। যদিও ক্লাস টেনের ছাত্র, তবু বয়স বিশের কোটায়, বেশ স্বাস্থ্যবান, কালো, গাট্টাগোট্টা, সুদর্শন। বেশ ডাকাবুকো হিসাবে পরিচিত, সবাই তাকে সমঝে চলত। যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে একাই এগিয়ে যাওয়া ছিল তার স্বভাব। খারাপ লোকজন তাকে দেখে এক হাত তফাতে থাকতো। গ্রামে চোর ঢুকলে, বেগুন খেতে চোর ঢুকলে- নির্ঘাত তার হাতে ধরা পড়বে। অবশ্য সে একা নয়, তরুণদের একটা দলই তার নেতৃত্বে প্রস্তুত থাকত। যদিও আমাদের বাড়িতে চোর আসতে খুব একটা দেখিনি, যদিও আমাদের গ্রামের একটি বড় অংশের লোকজন চুরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। চোরের নেতা বলে যাদেও পরিচয় ছিল তারাও বাবাকে খুব সম্মান করতো বলে, মামারা বলতেন, তোমার বাপ তো চোরের সর্দার তাই তোমাদের বাড়িতে চোর ঢোকে না।
এই সময়ের একটা ঘটনা মনে আছে, শুক্র কিংবা মঙ্গলবারের কোনো এক হাটের দিনে সন্ধ্যার পরে আমাদের বাড়িতে একজন অপরিচিত অতিথি এসে হাজির হয়েছিল। এলাকার একজন পরিচিত লোক তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, বয়সে তরুণ, লম্বা সুদর্শন। শিক্ষিত ও মার্জিত রুচির বলে মনে হয়েছিল যে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে সে-ই পরিচয় করে দিল- ওই লোকের বাড়ি রূপপুর বিবিসি বাজারে কাছে, আমাদের এক জ্ঞাতির মেয়েকে সম্প্রতি বিয়ে করেছে। এখানে কোথায় আজ বেড়াতে এসেছিল, রাত হয়ে গেছে, যেতে পারেনি; কথায় কথায় জানতে পারে, সে আমাদের সম্পর্কীয় চাচাতো বোনের জামাই। তাকে যদিও কেউ চেনে না, যদিও বিবিসি বাজার আমাদের বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয়, দশ-বারো কিলোমিটারের মতো হবে; মুক্তিযুদ্ধের সময় এলাকাটি বিবিসি বাজার বলে পরিচিতি লাভ করেছে; কারণ তখন এখানকার চায়ের দোকানগুলোতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি নিয়ে বিবিসির খবর শোনার জন্য লোকজন জড়ো হতো, সেই থেকে এর নাম বিবিসি বাজার বলে খ্যাত হয়ে আছে, যদিও এই এলাকায় বর্তমানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ হচ্ছে, যদিও পাকিস্তান আমল থেকে এই এলাকা পরিত্যক্ত পারমাণবিক কেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত ছিল। এখনকার মতো তখন কোনো ফোন মোবাইল ছিল না, চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে সব খবর পাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তাকে সরল মনে জামাই ভেবে, রাতে জামাই আদরে আপ্যায়ন করা হলো। মা নিজ হাতে রান্না করলেন, বাবা খোঁজখবর রাখলেন, বোনরাও সালাম দিয়ে আসল, কিছুক্ষণ হাসিঠাট্টাও হয়তো হলো, জামাই বলে কথা। রাতে চৌকির উপর সুন্দর বিছানা করে শুতে দেয়া হলো। কিন্তু পরেরদিন ভোর হওয়ার আগেই সেই নতুন জামাই পলাতক। কী হলো! কী হলো! সবার মধ্যেই কৌতূহল। প্রথমে তো সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল, না জানি কোনো ভুলত্রæটির কারণে গোস্সা করে নতুন জামাই চলে গেছে। পরে রূপপুরে বাবার আত্মীয়দের বাড়িতে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেলো, সে আসলে প্রতারণা করেছে, তার মনে কোনো স্বপ্ন থেকে থাকলেও বিয়ে-টিয়ে কিছু হয়নি। এর কিছুদিন পরে জানা গেল সে বেচারা তার সেই আত্মীয়ের বাড়িতে আবারো এসেছে, আত্মীয় এই ঘটনা জানত না, সে তার কাছেও গোপন করেছিল। মেজ ভাই এবং তার তরুণ গ্যাং সেই জামাই বেচারাকে সন্ধ্যার পরে ধরে আনল আমাদের বাড়িতে। অবশ্য শুরুতে তাকে বুঝতে দেয়নি। বাইরের বারান্দায় অনেক্ষণ তার সঙ্গে সবাই রসিকতা ইয়ার্কি ফাজলামো করে কাটাল।
‘‘কি গো নতুন জামাই, না বলে চলে গেলে যে বড়! আমরা কি তোমার ঠিক মতো আপ্যায়ন করতে পারিনি। বেশ আজ থেকে যাও, সেদিন যেটা কম ছিল আজ সেটা পুষিয়ে দেবো।’’ তখন আমি এতই ছোট এর কিছু বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ মেজ ভাই আদেশ দিলেন আমরা শিশুরা যেনো ভেতরের বাড়িতে গিয়ে পড়তে বসি। এর মধ্যে তাকে উত্তম-মাধ্যম দেয়া শুরু হয়ে গেল। এদিকে জিরুদ্দি (জহিরউদ্দীন) বলে আমার এক মামা ছিলেন, সে-ও অল্প বয়স্ক, বেশ রসিক ও তৎপর। সে-ও বলল, জামাই এবার কী খাবে, এক একটা মাইরকে তারা এক এক নামে অভিহিত করল, কখনো ‘‘রসগোল্লা, কখনো পায়েস, আবার বলে জামাইকে একটু দই দাও, আরেকজন বলে জামাইয়ের পাতে তো গোস্ত নাই।’’ আর জামাই বেচারা আব্বার উদ্দেশে চিৎকার কান্না করে করে বলতে লাগলো, ‘‘চাচামি ধরেন তো, চাচিমা ঠেকান তো, চাচামি বাঁচান তো।’’ আব্বা প্রথমে চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে ছিলেন। মারের পরিমাণ বেশি হতেই তিনি সবাইকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে ছেড়ে দাও।’ ভাইয়ের রাগ যদিও পড়তে চায় না, তবু বাবার ওপরে কথা নেই। এই জামাই বেচারার ঘটনার পরে ‘নিশিকুটুম’ বলে একটা নতুন শব্দের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটল। মেজ ভাই তখন থেকেই ছোট বেলা থেকে বিড়ি সিগারেটে আসক্ত, কিন্তু গ্রামের মুরুব্বি, শিক্ষক ও বয়স্কদের দেখলে অতি বিনয়ী ভাব দেখাতেন। কেবল নিজ এলাকা নয়, ভিন-গাঁয়ের বৃদ্ধ ফকির ভবঘুরে, বাউল, চারণ সবার সঙ্গে ছিল তার গলায় গলায় ভাব। বাইরে কঠিন হলেও খুব নরম দিলের মানুষ, গরিব-দুখীর জন্য কিছু একটা করার জন্য তার মন কাঁদত।
এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক মহিলা পাশের মাধবপুর গ্রাম থেকে আমাদের বাড়িতে প্রায়ই বেড়াতে আসতেন, সঙ্গে দু-একটা আম ও নারকেল নিয়ে আসতেন। আমরা জেনেছি এই বৃদ্ধা গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। হয়তো ভিক্ষা করে চেয়ে-চিন্তে পাওয়া নারকেল আম আনতেন। পরে অবশ্য আমরা দেখেছি, তার বাড়িতে আম ও নারকেল গাছ ছিল। আমাদের বাড়িতে সেই বৃদ্ধাকে বেশ সম্মান করা হতো, আমরা তাকে দাদি বলে ডাকতাম। সেই ভিক্ষুক মূলত ছিলেন আমার মেজ ভাইয়ের পাতানো দাদি। সে যে স্কুলে পড়তো হয়তো সেখানেই তার সাথে তার কোনো কারণে পরিচয় ও সম্পর্কেও সূচনা হয়েছিল। এ রকম দাদি-নানি পাতানোর অভ্যাস মেজ ভাইয়ের ছিল। তারপর থেকে তাকে ঘরে এনে উঠানো। এমনকি মাধপুর গ্রামে ভিক্ষুকের সংখ্যা বেশি হওয়ায়, সেই ভিক্ষুক দাদি ধানকাটার মৌসুমে আমাদের বাড়িতে থেকে সারাদিন গায়ে গায়ে ভিক্ষা করে বেড়াতো, রাতে আমাদের সঙ্গে খাবার খেতো, হাসি ঠাট্টা করতো। কিছুটা বড় হয়ে যখন ম্যাক্সিম গোর্কির আমার ছেলেবেলা পড়েছি, তখন তাকে লেক্সেইর দাদি বলে মনে হয়েছে। সারাদিন কোথায় কোথায় গিয়েছে জানতে চাইলে বলত, ভাই তুমি বুঝবে না, ফকিরের পায়ে ল²ী। মৌসুম শেষ হলে অধিকাংশ চাল ধান-বিক্রি করে নিজ গায়ে ফিরে যেতো। এসব নিয়ে আমাদের বাড়িতে তেমন অভিযোগ ছিল না। আমি ঠিক জানি না, আমার বাবা তখনো বেঁচে ছিলেন, নিজ মায়ের প্রতি তার ছিল দুর্মর ভালোবাসা, যদিও আমাদের জন্মের আগে তার মৃত্যু হয়েছে, তবু বাবা-মা ডাক না দিয়ে বাড়িতে ঢুকতো না, রাতে কিংবা দিনে তার এই অভ্যাসের পরিবর্তন দেখিনি। তিনি ছিলেন অ্যাজমার রোগী, বর্ষার মৌসুমে তার অ্যাজমা যেতো বেড়ে। তার অসুস্থতার সময় সব ছেলে মেয়েকে উপস্থিত থাকতে হতো; এমনকি যাদের বিয়ে হয়ে গেছে, শ্বশুরবাড়িতে থাকে, তাদেরও নিয়ে আসতে হতো। সেই ঘোর অসুস্থতা কালেও তিনি আমাদের কারো সেবাকে মূল্য না দিয়ে মাঝে মাঝে মা বলে ডেকে উঠতেন। তার খুব শৈশবে আমার দাদা মারা গিয়েছিল, মায়ের কাছে মানুষ; মায়ের ছিল সহজাত ব্যক্তিত্ব, আগলে রাখার অসম্ভব ক্ষমতা- হয়তো অসুস্থকালেও ভাবতেন মায়ের আশ্রয়ে যেতে পারলে তিনি নিরাপদ বোধ করবেন, হাঁপানির কষ্ট থেকে মুক্তি পাবেন। আমার বাবাও এই ভিক্ষুক মহিলাকে আমাদের দাদি হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। তবে তিনি তাকে কোনো কিছু বলে সম্বোধন করতেন না। তার চলনে একটি রাজকীয় ব্যাপার থাকলেও সবাইকে সম্মান করতেন। তাকে মা বলে সম্বোধন না করলেও তার সঙ্গে বেশ মোলায়েম ব্যবহার করতেন। আমি নিজেও দু-একবার ওই বুড়ির বাড়িতে বেড়াতে গেছি। তবে প্রথম প্রথম তাকে দাদি বলে ডাকতে চাইতাম না, মেজ ভাই প্রচণ্ড ভয় আর প্রচুর চকলেট ঘুষ দিয়ে সেই ভিখারিনীকে দাদি বলা শিখিয়েছিল। তবে এই বুড়ো দাদিও আরো কিছু কাজ ছিল বলে পরে জেনেছিলাম। মেজ ভাই স্কুলে থাকতেই তার এক সহপাঠীর প্রেমে পড়েছিল, সেই প্রেমিকার সঙ্গে চিঠি চালাচালির জন্য তাকে দরকার ছিল। অনেকট

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়