গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

ঈদ উৎসব ভরে উঠুক বিশ্ব শান্তি ও সম্প্রীতিতে

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চারদিকে ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে। বাজারে কেনাকাটা চলছে ধুমছে। দিনে বেজায় গরম, তাই রাতে মানুষ শপিংমল থেকে শুরু করে খাবার-দাবার, আতর-টুপি, যেখানে যার যা প্রয়োজন তাই কিনতে ছুটছে। গ্রামেও ঈদের বাজারে সরগরম, সময় হাতে নেই। শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার অপেক্ষায় সবাই। বাংলাদেশে আজ মঙ্গলবার পশ্চিম আকাশে চাঁদের সরু চিহ্ন দেখা গেলে বুধবার, দেখা না গেলে বৃহস্পতিবার অবধারিতভাবে ঈদ হবে। সুতরাং এই দুইয়ের মধ্যে আমরা এখন সবাই আছি। শহর থেকে লাখ লাখ মানুষ নাড়ির টানে গ্রামে ফিরছে। শহরগুলো কিছুটা ফাঁকা হচ্ছে। গ্রামগুলো শহর ফেরত মানুষের উপস্থিতিতে ভরে উঠছে, প্রিয়জনরা আপনজনদের কয়েক দিনের জন্য পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। ঈদের উৎসবের অন্যতম দিকই হচ্ছে পরিবার-পরিজনদের নিয়ে ঈদ করা। যাদের পরিবারে ছোটরা আছে তারা এই ঈদ উপলক্ষে গ্রামে বেড়াতে মুখিয়ে থাকে, বড়রাও ছোটদের কাছে পেয়ে আনন্দে যেন অনেকটা-ই নতুনভাবে জীবন খুঁজে পান।
এখন যুগের পরিবর্তন ঘটে গেছে। জীবনেরও চাওয়া-পাওয়ায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। শহরে যারা জীবিকার কারণে একসময় এসেছেন, তাদের বেশির ভাগই এখন শহরবাসী হয়ে গেছেন। শহরগুলোও এই চাপে ক্রমবর্ধমানভাবে বিস্তৃত হয়ে উঠেছে। তারপরও বেশির ভাগ মানুষেরই গ্রামের ঠিকানা মুছে যায়নি। সেখানে কারো কারো পরিবারের কেউ না কেউ থাকেন। এছাড়া নিকট আত্মীয়স্বজনতো সবারই কম-বেশি রয়েছে। তাদেরও কেউ থাকেন গ্রামে, কেউ থাকেন শহরে আবার কেউ বা থাকেন প্রবাসে। ফলে দেখা, সাক্ষাৎ কিংবা একসঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ সব সময় ঘটে না। ঈদ সেই অপূর্ণতাকেই যেন পূর্ণতা দেয়। সে কারণেই এই ঈদে মানুষের এমন ঘরমুখী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ৬০-৭০ বছর আগে এমনটি খুব একটা বেশি ছিল না। তখন গ্রামেই বেশির ভাগ মানুষের বসবাস ছিল। শহরে কাজকর্ম কিংবা চাকরি করতেন এমন মানুষের সংখ্যাও ছিল খুবই নগণ্য। তারপরও ঈদে তাদের বাড়ি আসাটা অনেকটাই অনিবার্য ছিল কারণ শহরে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতেন, এমন মানুষের সংখ্যা ছিল একেবারেই কম। বেশির ভাগেরই পরিবারের সদস্যরা থাকতেন গ্রামে। তখন যাতায়াতের সুযোগ-সুবিধা খুবই কম ছিল। প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ করতে আসতে তাদের ভীষণ ভোগান্তি পোহাতে হতো। সবকিছুকে উপেক্ষা করে ঈদে তারা বাড়ি আসতেন, প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফোটাতেন। গ্রামের ঈদগুলো তখন চাকচিক্যে ভরপুর না হলেও সবার একসঙ্গে দেখা-সাক্ষাতে আনন্দঘন হয়ে উঠত, কারণ তখন গ্রামে ঈদের মাঠ ছিল। কয়েক গ্রামের মানুষ সেখানে একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করত, কোলাকুলি করত, এবাড়ি-ওবাড়ি দেখা-সাক্ষাৎ, মিষ্টান্ন মুখে নেয়া, গালগল্প এবং বিকালে হাডুডু, দাড়িয়াবান্দা, ভলিবল ইত্যাদি খেলায় মেতে উঠত কিশোর তরুণ, যুবকরা। বাজার কিংবা স্কুলে ঈদ উপলক্ষে নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এক দুদিন উপভোগ করার প্রচলন ছিল। এখন সেসব ঐতিহ্য গ্রাম থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। ঈদের পোশাক-পরিচ্ছদে চাকচিক্য এসেছে, খাওয়া-দাওয়াতেও নানা ধরনের মিষ্টান্ন, পোলাও-বিরানিসহ অনেক কিছুই সংযোজন ঘটেছে। এখন বেশির ভাগ গ্রামেই মসজিদকেন্দ্রিক ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। খুব বেশি মানুষ একত্রিত হওয়ার সুযোগ নেই। গ্রামে মসজিদের সংখ্যাও আগের চাইতে অনেক বেড়ে গেছে। ঈদের খোলা মাঠ এখন অনেক জায়গাতে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। নামাজ শেষে যার যার পরিবার ও নিকট আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া-আসা, খাওয়া-দাওয়ার কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সময় কেটে যায়। এরপর শুরু হয় শহরে ফেরত আসার তাড়া।
বছরটিকে আমরা একেকজন একেকভাবে দেখছি। ২০২৪-এ ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। সরকারের সম্মুখে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করাসহ ১১টি সমস্যা, যা শেখ হাসিনার সরকারের এই মেয়াদের শাসনকালে নিয়ন্ত্রণ করার প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করা হয়েছে। মানুষও আশা করছে বিগত ১৫ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে যে উন্নয়ন ঘটেছে সেটির সুফল স্থায়ী করতে হলে সরকারকে দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়ন করতে হবে। অবশ্য বৈশ্বিক এই অর্থনৈতিক সংকট অতিমারি করোনা থেকে শুরু হয়, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ তা জটিল করে, ডলার সংকট, মুদ্রাস্ফীতি আমাদের মতো দেশগুলোকেই শুধু নয় বড় দেশগুলোকেও অর্থনৈতিকভাবে বেশ নাড়া দিয়ে গেছে। করোনার শেষ সময় থেকে আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় নৈরাজ্য সৃষ্টি হয় সেটি এ বছরও আমরা টেনে ধরতে পারিনি। রোজায় অবশ্য অন্যান্য দেশে ব্যবসায়ীরা মূল্যছাড় দিয়ে বেচাকেনা বাড়িয়ে দেয়, ভোক্তারাও সুবিধাটি নিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরাই শুধু নয় প্রায় সবাই-ই রোজার এই মাসে বাড়তি আয় উপার্জনের সুযোগ খুঁজতে থাকে। ব্যবসায়ীদের হাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়াও ঈদ উপলক্ষে নানা ধরনের পণ্যসামগ্রী বেচাকেনার সুযোগ থাকে। তারা এটিকেই জিম্মি করে ভোক্তাদের পকেট কাটার সুযোগ খুঁজতে থাকে, বেশির ভাগ ব্যবসায়ী সেটি করেও থাকে। ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা করে যারা অর্থ উপার্জন করতে অভ্যস্ত তারাও কতভাবে মাঠে সক্রিয় থাকে, সেটি সবারই জানা বিষয়। এখন মানুষ ঈদে বাড়ি যাচ্ছেন। পরিবহন মালিক শ্রমিকরা ভাড়া নিয়ে কত ধরনের টালবাহানা ও মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে, তা গণমাধ্যমে পরিবহন যাত্রীদের অভিযোগ শুনলেই বোঝা যায়। আরো অনেকভাবেই ঈদে বাড়তি উপার্জনের জন্য যে যার মতো চেষ্টা করে থাকে। উদ্দেশ্য থাকে ভালোভাবে ঈদ করার। এ বছর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মেলানো অনেকের পক্ষেই বেশ কঠিন হয়েছে। আমরা আশা করব দেশের বাজার ব্যবস্থায় সরকার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগ নেবে, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থায় আরো ব্যাপক নজরদারি জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিরোধী দল সরকারের বিরুদ্ধে ঈদের পর আন্দোলনের আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারের পতন ঘটাতে হলে ঢাকা শহরকে আন্দোলনের দুর্গ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিএনপি এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিল। এখন তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সৃষ্টি করার মাধ্যমে পতন ঘটাতে চাচ্ছে। বিএনপি এবং শরিক আরো কয়েকটি দলের মুখপাত্র কিংবা শীর্ষ নেতারা বলেছেন, দেশে নাকি এখন দুর্ভিক্ষ চলছে, মানুষের পেটে ভাত নেই, সুতরাং ঈদের আনন্দ করার অর্থও তাদের নেই। প্রান্তিক এবং নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বছরটি আর্থিকভাবে টানাটানিতে যাচ্ছে। এতে দ্বিমত করার কারণ নেই। তবে মানুষ না খেয়ে আছে, দুর্ভিক্ষে আছে- এমন দাবি মোটেও ঠিক নয়। সরকার টিসিবির মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষদের কিছু পণ্য কম মূল্যে ক্রয় করার সুযোগ দেয়ায় তারা উপকৃত হয়েছেন বলে গণমাধ্যমেই শোনা গেছে। সুতরাং দেশে এবার গরিবরা ঈদে কষ্টে থাকবেন কিংবা না খেয়ে থাকবেন এমন পরিস্থিতি মোটেও সত্য হওয়ার কথা নয়। ঈদে ধনী, মধ্যবিত্ত এবং সামর্থ্যবান সবাই দরিদ্রদের পোশাক-পরিচ্ছদ, নগদ অর্থ এবং খাদ্যদ্রব্য দিয়ে সাহায্য করে থাকে। এ বছরও এর ব্যত্যয় ঘটার কোনো কারণ নেই। সুতরাং এ বছরের ঈদ অতীতের চাইতে খারাপভাবে উদযাপিত হওয়ার কারণ আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে নিকট অতীতে যেভাবে এই ঈদটিকে সবাই আনন্দঘন পরিবেশে যেভাবে উদযাপন করেছে এবারো আশা করা যায়, তার চাইতে কোনো অংশেই খারাপ কাটার সম্ভাবনা নেই। তবে আমাদের প্রতিবেশী যারাই আমাদের পরিচিত জন তাদের নিয়ে ঈদের আনন্দ একসঙ্গে ভাগাভাগি করা, একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া এবং মেলামেশা করার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখা আমাদেরই দায়িত্ব। আমাদের দেশে অতীতেও আমরা এই ঈদে নিজেদের বন্ধুবান্ধব এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ের পরিচিতদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি, এখনো আমরা সেটিকেই ধরে রাখব- এমনটি যেন আমরা ভুলে না যাই। গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে, যার রেশ এখনো কাটেনি। ২০২০ সালে অতিমারি করোনার কারণে ঘরবন্দি জীবন কাটাতে হয়েছে সারা বিশ্বের মানুষকে। আমাদের মতো জন ঘনবসতিপূর্ণ দেশে মানুষের জীবনে এটি ছিল এক কঠিন বাস্তবতা। যাদের দিন আনতে পান্তা ফুরায় তাদেরতো এভাবে পেট চলে না। তারপরও অসংখ্য মানুষকে জীবন-জীবিকার তাগিদে বের হতে হয়েছিল। অনেকেই জীবনে আর ফিরে আসতে পারেননি। প্রিয়জনদের ছেড়ে তাদের চলে যেতে হয়েছে। তখন ঈদও আমাদের জীবনে স্বাভাবিক নিয়মে উদযাপন করা যায়নি। গ্রামে প্রিয়জনদের কাছে ছুটে আসার সুযোগ ছিল না। ঈদও সেভাবে পালন করা যায়নি। বিশ্বজুড়ে করোনার অভিঘাতে অর্থনৈতিক সংকট হানা দিয়েছে। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতি চরম মন্দায় পড়েছে। ২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। এই ধাক্কা সামাল দেয়ার আগেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ পৃথিবীকে যেন নতুন করে জানান দিয়েছে যে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের পাখির মতো হত্যা করলেও কারো যেন বলার কিছু থাকে না। প্রতিদিন অসংখ্য ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের আক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছে। তাদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে জাতিসংঘের ত্রাণ কর্মীদেরও প্রাণ হারাতে হয়েছে। ফিলিস্তিনি নারী, শিশু, বৃদ্ধ বিনা কারণে ইসরায়েলি আক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছে, পঙ্গুত্ববরণ করছে, অর্ধাহার-অনাহারে জীবন কাটাচ্ছে। এই মানুষদের পাশে মুসলিম বিশ্বের সেভাবে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না। এবার ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের জীবনে ঈদের আনন্দ কিছুতেই ধরা দেয়ার অবস্থানে নেই। বিশ্বে এমন পরিস্থিতি যখন বিরাজ করে, তখন সচেতন মানুষের মন ভেঙে যায়, হতাশায় নিমজ্জিত হয় তাদের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎকে দেখার। এবার আমাদের নতুন করে উপলব্ধি করতে হবে বিশ্বে বহু জাতি, বহু ধর্ম, বহু রাষ্ট্র এবং ৮০০ কোটি মানুষ বসবাস করছে। সব মানুষেরই জন্মগত সব অধিকার রক্ষা করতে হবে, সম্মান জানাতে হবে তবেই বিশ্ব শান্তিময় এবং সম্প্রীতিতে ভরে উঠবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়