গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

ইফতার : জামায়াত-বিএনপি টিক্স-ট্রিক্স

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিএনপি-জামায়াত দুদলের জন্যই রাজনীতির পথরেখা কঠিন হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীনরা তা আরো কঠিন করে দিয়েছে। তা বুঝেও উতরাতে পারছে না দুদলের কোনোটিই। তবে থেমে নেই। দম নিয়ে চেষ্টা চলছে অবিরাম। নিচ্ছে নানা কৌশল। টিক্স চালছে। ট্রিক্সও বাদ দিচ্ছে না। আবার ট্রিট ফর ট্রেট পথে এগোবার ঘোষণা দিয়েও কুলাতে পারছে না। টিক্স, ট্রিক্স, ট্রিট, টিপ্স ইত্যাদি মিলিয়ে এবারের রমজানে তারা আবার কাছাকাছি। আশা করছে সামনের রমজান পর্যন্ত এক ভিন্ন পরিস্থিতির। বিএনপি-জামায়াত আবার এক হয়েছে বা তারা একসঙ্গে নেই- কোনোটিই চূড়ান্ত কথা নয়। প্রশ্নটিই আপেক্ষিকতায় ভরা। পারস্পরিক বোঝাপড়ায় তারা ঘোমটা খুলে তারা সম্প্রতি আবার বেশ কাছাকাছি- এটিই সারকথা।
দেশের নামকরা রাজকীয় হোটেল সোনারগাঁওয়ে রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনদের নিয়ে ইফতার মাহফিলে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান কিছু বার্তাও দিয়েছেন। টানা আট বছর পর প্রকাশ্যে করতে পারা এ ইফতারে তিনি বলেছেন, বিনা সংগ্রামে মুক্তি আসে না। মুক্তির জন্য তারা আবার বুক সটান করে দাঁড়াবেন। দলের অসংখ্য সহকর্মী জেলে গেছেন, জীবন দিয়েছেন মন্তব্য করে বলেছেন, সবকিছুর একটা সীমা আছে। বিএনপিসহ সমমনাদের পদভারে উপচে পড়ে জামায়াতের ইফতার মাহফিলটি। বিএনপির ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, আবদুস সালাম, মজিবুর রহমান সারোয়ার, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, জহির উদ্দিন স্বপন, অপর্ণা রায়সহ অনেকে ছিলেন। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির কর্নেল অলি আহমদ, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, বিকল্প ধারার অধ্যাপক ড. নূরুল আমিন বেপারী, জাগপার সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমান, জাতীয় পার্টির (জাফর) আহসান হাবিব লিংকনসহ সমমনা আরো অনেকের উপস্থিতিতে জামায়াতের ইফতার ট্রিক্সটি অবশ্যই সাম্প্রতিক পলিটিক্সের একটি মোটাদাগের ঘটনা।
আর নিজেদের ইফতার মাহফিল থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা একটা কঠিন সময় অতিক্রম করছেন। এই দুঃসময়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বার্তা দিয়েছেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের। এরও আগে ২০১৫ সালের ২৫ জুন হোটেল সোনারগাঁওয়ে রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ বিশিষ্টজনদের নিয়ে ইফতার করেছিল জামায়াতে ইসলামী। এতে অংশ নিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এত বছর পর দুটি দলের নেতাদের এক টেবিলে বসার পেছনে বিশেষ প্রেক্ষিত রয়েছে। রাজনীতির জন্যও কিছু মেসেজ রয়েছে। টিক্স-ট্রিক্সে আর দূরে দূরে না থেকে তাদের কাছে আসা বা কাছে আনার রিমোট কন্ট্রোলার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ব্রিটেনে দেশান্তরী তারেক রহমানের হাতে। দুই যুগের বেশি সময়ের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি।
এক দফা দাবিতে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন সামনে রেখে ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেয়া হয়। অবশ্য ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর বিলুপ্ত জোটের ১২টি দলের সমন্বয়ে ‘১২ দলীয় জোট’ এবং ২৮ ডিসেম্বর আরো ১১টি দল মিলে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট গঠিত হয়। তাতেও জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। বরং গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতও পৃথক কর্মসূচি পালন করেছে। সেই গোস্যা কেটে হালে আবার রাখিবন্ধনের নমুনা। বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের স্পষ্ট দূরত্ব তৈরি হয় ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াতের একাধিক শীর্ষ নেতার ফাঁসি এবং কারাবন্দি অবস্থায় মৃত্যু হলেও তখন কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি বিএনপি। মূলত ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দল দুটির মধ্যে সম্পর্ক ফিকে হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকেই সরে আসে জামায়াত।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গড়া জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টে ছিল না জামায়াত। এমনকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে সমমনা মিত্র দলগুলো নিয়ে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। কিন্তু যুগপৎ আন্দোলন ও এর কর্মসূচি নিয়েও জামায়াতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা বিএনপি না করায় ক্ষুব্ধ হয় জামায়াত। তবু যুগপৎ আন্দোলনের শুরুর দিকের দুটি কর্মসূচিতে জামায়াতের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। এরপর আর কোনো কর্মসূচিতে অংশ না নিয়ে নিজস্বভাবে কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। আন্দোলন চলাকালেই জামায়াতের আমিরকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় বিএনপি বিবৃতি না দেয়ায় জামায়াত আন্দোলন থেকে সরে যায়। সেই থেকে দল দুটি একই অবস্থানে থাকে। তবে ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে বিএনপি দলীয়ভাবে শোক জানায়। কিন্তু সেই শোকবার্তায় সাঈদীর রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ করেনি দলটি। সেই দূরত্ব কাটানোর দৃশ্যায়ন এবারের ইফতারে। বিএনপির ইফতারেও মেহমান হয়েছেন আমিরসহ জামায়াতের চার কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতা। তাদের এই বোঝাপড়ার চক্কর আপাতত একটি ইস্যুতে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য যারাই ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছে, তাদের সবাইকে এক মনে করা।
এর আগে রাজনৈতিক কৌশলের কারণেই জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব রেখেছে বিএনপি। এরপরও ‘বিএনপি-জামায়াত’ সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সফল হয়েছে সরকার। সরকার পক্ষের এ সাফল্যের মাঝে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সতর্কতার বিপরীতে দূরত্ব বাড়তেই থাকে। সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি অন্য সব দলের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শ করলেও জামায়াতকে গণনার মধ্যেই রাখছিল না। ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর যুগপতের গণমিছিল করতে গিয়ে মালিবাগে জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার ও আহত হন। এ নিয়ে বিএনপির কোনো নেতা বক্তব্য বা বিবৃতি দেননি। এসব বিষয়ে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। কার্যত এর পরই জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছে। মান ভেঙে সেখানে এখন আবার মিলমিশের টান। আন্দোলনে লাগাতার ব্যর্থতার পর তাদের আবার একাট্টা হওয়ার তাগিদ ভেতর-বাইর দুদিক থেকেই। দ্বাদশ নির্বাচনের আগে একমঞ্চে থাকার পাশাপাশি দুদলে সমন্বয় থাকলে আন্দোলন এভাবে মাঠে মারা যেত না বলে উপলব্ধি উভয় দলেই।
এই বোধ-উপলব্ধি হুট করে হয়ে গেছে এমন নয়। প্রকাশ্য সভা-সমাবেশ না হলেও গত মাস কয়েক ধরে দুদলে কথাবার্তা হচ্ছে। আন্দোলনের ব্যর্থতা বিশ্লেষণ হয়েছে। ভেতরের কিছু তথ্য এখন কর্মীরা জানছেন। ২৮ অক্টোবরসহ সরকারকে বেকায়দায় ফেলাতে প্রতিটি আন্দোলনে জামায়াত একসঙ্গে থাকার প্রস্তাব দিয়েছিল বিএনপিকে। আন্দোলনের সময় সমন্বয়ের জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছিল। জবাবে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, যুগপৎ ধারা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা সম্ভব নয়। এ ছাড়া আগেরবার অন্য দলের নেতার নেতৃত্বে নির্বাচন আর এবার দলের ওপর ভর করে আন্দোলনের তকমা লাগাতে চায়নি বিএনপি। সেই সঙ্গে আন্দোলনের সময় জামায়াতের ভূমিকা সমমনা দলেও সমালোচনা হয়েছে। ২৮ অক্টোবরে সমাবেশের দিনেও একদিকের কর্মসূচি অন্যদিকে শান্তিপূর্ণভাবে করার ঘটনাকে ঘিরে বিএনপিতে নানা সন্দেহও দেখা দেয়। ফলে পরবর্তী সময়ে একসঙ্গে আন্দোলন করে এর নাটাইয়ের একটি অংশ অন্য দলের হাতে দিতে অনেকের আপত্তি ছিল। মান ভেঙে এখন তারা আবার একাট্টা। জামায়াত নিয়ে বাম ধারার দলগুলোর অ্যালার্জিও কেটে গেছে। সরকার হটানোই তাদের সবার টপ প্রায়োরিটি। সেই হিসাব ও যোগ জিজ্ঞাসা থেকেই বিএনপি-জামায়াতের এবারের ইফতার পলিটিক্স। অতীত-বর্তমান অভিজ্ঞতায় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুদলের টিক্স-ট্রিক্সও আছে। যার দৃশ্যায়ন এখন অপেক্ষার প্রহরে।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়