মাদকবিরোধী অভিযান : রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার ২০

আগের সংবাদ

ভোগান্তি মেনেই ঘরে ফেরা : ঈদযাত্রা

পরের সংবাদ

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি : ভবিষ্যতে একটি নতুন অধ্যায়

প্রকাশিত: এপ্রিল ৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান সময়ে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যত ধরনের আবিষ্কার রয়েছে, তার মধ্যে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বা সংক্ষেপে ভিআর (ঠজ) অন্যতম। ভিআর শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা বাস্তবতা, অর্থগতভাবে শব্দ দুটি যদিও স্ববিরোধী কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এটি এমন এক ধরনের পরিবেশ তৈরি করে যেটি বাস্তব নয়; কিন্তু বাস্তবের মতো চেতনা সৃষ্টি করে এবং মস্তিষ্কে একটি বাস্তব অনুভূতি জাগায়।
আমরা জানি- স্পর্শ, শোনা কিংবা দেখা থেকে মানুষের মস্তিষ্কে একটি অনুভূতির সৃষ্টি হয়, যেটাকে আমরা বাস্তবতা বলে থাকি। কতগুলো যন্ত্রের সাহায্যে যদি আমরা এই অনুভূতিগুলো সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে অবস্থাটি মানুষের কাছে পুরোপুরি বাস্তব মনে হতে পারে। এটি নানাভাবে করা সম্ভব। অনেক সময় বিশেষ ধরনের চশমা বা হেলমেট পরা হয়, যেখানে দুই চোখে দুটি ভিন্ন দৃশ্য দেখিয়ে ত্রিমাত্রিক অনুভূতি সৃষ্টি করা হয়। অনেক সময় একটি স্ক্রিনে ভিন্ন ভিন্ন প্রজেক্টর দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য দেখিয়ে সেই অনুভূতি সৃষ্টি করা হয়। এই প্রক্রিয়াগুলো সম্পাদন করার জন্য মূলত কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের সমন্বয়ে কোনো একটি পরিবেশ বা ঘটনার বাস্তবভিত্তিক ত্রিমাত্রিক (৩উ) চিত্রায়ণ করা হয়। তাই বলা যায়, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হলো হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে তৈরিকৃত এমন এক ধরনের কৃত্রিম পরিবেশ, যা উপস্থাপন করা হলে ব্যবহারকারীদের কাছে এটিকে বাস্তব পরিবেশ মনে হয়। চলুন একটি উদাহরণ দেখি- রাসেল মঙ্গল গ্রহে যেতে চায়, কিন্তু সুযোগ ও অর্থের অভাবে যেতে পারছে না। কিন্তু তার কম্পিউটার সায়েন্সে পড়–য়া বন্ধু তাকে নতুন একটি প্রযুক্তি সম্পর্কে জানাল, যেটা ব্যবহার করে সে মঙ্গল গ্রহে অবস্থান না করেও মঙ্গলে অবস্থান করার অনুভূতি পেতে পারে! রাসেল বন্ধুর কথামতো একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কাছে গেল এবং প্রতিষ্ঠানটি তাকে বেশ কিছু সরঞ্জাম দিল। যেমন হাতমোজা, চশমা, হেডফোন স্যুট ইত্যাদি। সে এসব পরিধান করে একটি কক্ষে প্রবেশ করল এবং অন্য আরো কিছু প্রযুক্তির সমন্বয়ে মঙ্গল গ্রহের মাটিতে অবতরণের অনুভূতি পেল। এখানে রাসেল যে প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে, তাই হলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটি।
ইতোমধ্যে বিশ্বের কিছু উন্নত দেশ এই প্রযুক্তির সুফল ভোগ করছে, তবে বেশির ভাগ দেশেই এখনো প্রযুক্তিটির ব্যবহার শুরু হয়নি। এমনকি বাংলাদেশেও ব্যক্তির পর্যায়ে ভিআরের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না। সরকারি কিছু সংস্থা যেমন- মিলিটারি, ড্রাইভিং, পাইলটিং ইত্যাদি ক্ষেত্রেই কেবল এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে অনেকের কাছেই ভিআর প্রযুক্তিটি একেবারেই নতুন। তবে এর গোড়াপত্তন হয়েছিল বহু আগেই। যুক্তরাষ্ট্রের কম্পিউটার বিজ্ঞানী জেরন ল্যানিয়ারকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির জনক বলা যায়। তিনি ১৯৮০-এর দশকে এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করছিলেন এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান যেমন- ঠজ এড়মমষবং (এক ধরনের হেডসেট) ও ডরৎবফ এষড়াব (হাতমোজা) তৈরির কাজ করেন। তবে এর পূর্বে ১৯৬১ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী থমাস ফারনেস যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর জন্য একটি ফ্লাইট সিমুলেটর তৈরি করেন, যেটি ছিল বিশ্বের প্রথম সিমুলেশন প্রযুক্তি। এর ঠিক কয়েক বছর পরে ঐগউ : ঐবধফ গড়ঁহঃধরহবফ উরংঢ়ষধু (এক ধরনের হেলমেট) আবিষ্কার করেন ১৯৬৮ সালে। ধীরে ধীরে ভিআর প্রযুক্তি জনপ্রিয় হতে শুরু করে এবং ২০০৭ সালে গুগল স্ট্রিট ভিউ নামে তাদের ভিআর প্রযুক্তি আনে, যেটি বর্তমানে গুগল ম্যাপে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির পরিবেশ তৈরির জন্য কম্পিউটারে সংবেদনশীল শক্তিশালী গ্রাফিক্স ব্যবহার করতে হয়। সাধারণ গ্রাফিক্স আর ভার্চুয়াল জগতের গ্রাফিক্সের মধ্যে তফাত হলো এখানে শব্দ এবং স্পর্শকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। ব্যবহারকারীরা যা দেখে এবং স্পর্শ করে তা বাস্তবের কাছাকাছি বোঝানোর জন্য বিশেষভাবে তৈরি চশমা বা হেলমেট (ঐগউ) ছাড়াও অনেক সময় হ্যান্ড গøাভস, বুট, স্যুট ব্যবহার করা হয়। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটারে গ্রাফিক্স ব্যবহারের মাধ্যমে দূর থেকে পরিচালনা করার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। একে টেলিপ্রেজেন্স বলা হয়। এছাড়া এ পদ্ধতিতে বাস্তবভিত্তিক শব্দও সৃষ্টি করা হয়, যাতে মনে হয়, শব্দগুলো বিশেষ বিশেষ স্থান হতে উৎসারিত হচ্ছে।
বর্তমানে সারা বিশ্বে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বাংলাদেশে এর তেমন একটা উল্লেখযোগ্য ব্যবহার লক্ষ্য করা না গেলেও আস্তে আস্তে এর ব্যবহার বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, চীন, জার্মানের মতো প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে ইতোমধ্যে এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। বিশ্ব নাগরিকের জীবন যাত্রায় এখন ভিআর প্রযুক্তি নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নিচের অংশে আমরা জানব কোন কোন ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে।
শিক্ষা ও গবেষণায় : বাস্তবে কোনো কাজ করার আগে কম্পিউটারে কৃত্রিমভাবে প্রয়োগ করে দেখাকে সিমুলেশন বলা হয়। শিখন-শেখানো কার্যক্রমে জটিল বিষয়গুলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে সিমুলেশন ও মডেলিং করে শিক্ষার্থীদের সামনে সহজবোধ্য ও চিত্তাকর্ষকভাবে উপস্থাপন করা যায়। গবেষণালব্ধ ফলাফল বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন, জটিল অণুর আণবিক গঠন, ডিএনএ গঠন, যা কোনো অবস্থাতেই বাস্তবে অবলোকন সম্ভব নয়; সেগুলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটির পরিবেশে সিমুলেশনের মাধ্যমে দেখা সম্ভব হচ্ছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে : চিকিৎসাবিজ্ঞানের সুবৃহৎ পরিসরে এর ব্যবহার ব্যাপক। জটিল অপারেশন, কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন, ডিএনএ পর্যালোচনা ইত্যাদিসহ নবীন শল্যচিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও রোগ নির্ণয়ে ব্যাপক হারে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহৃত হয়।
সামরিক প্রশিক্ষণে : ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে সত্যিকার যুদ্ধক্ষেত্রের আবহ তৈরি করে সৈনিকদের উন্নত ও নিখুঁত প্রশিক্ষণ প্রদান করা যায়। সত্যিকারের যুদ্ধকালীন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে সৈনিকরা তাদের সঠিক করণীয় সম্পর্কে আগেই পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকে।
যানবাহন চালানো ও প্রশিক্ষণে : ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সবচেয়ে বাস্তবমুখী ব্যবহার হয়ে থাকে ফ্লাইট সিমুলেটরে, যেখানে বৈমানিকরা বাস্তবে আসল বিমান উড্ডয়নের পূর্বেই বিমান পরিচালনার বাস্তব জগৎকে অনুধাবন করে থাকেন। এছাড়া মোটরগাড়ি, জাহাজ ইত্যাদি চালানোর প্রশিক্ষণে সংশ্লিষ্ট সিমুলেটর ও মডেলিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ-সংশ্লিষ্ট কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে বাস্তবের ন্যায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে।
বিনোদন ক্ষেত্রে : নানা ধরনের বিনোদনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ত্রিমাত্রিক (৩উ) পদ্ধতিতে নির্মিত ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নির্ভর কল্পকাহিনি, পৌরাণিক কাহিনি, কার্টুন, ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র ইত্যাদি মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আধুনিক সময়ের প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার দেখা যায়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে নানা ধরনের কম্পিউটার গেম সবার কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মিউজিয়াম বা ঐতিহাসিক যেসব জায়গায় ভ্রমণ করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি পদ্ধতি ব্যবহার করে সেসব জায়গায় ভ্রমণ করার অনুভূতি পাওয়া সম্ভব হয়।
এছাড়া প্রাত্যহিক জীবনে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির আরো অনেক প্রভাব রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতেই আমরা মেটাভার্সের (গবঃধাবৎংব) দুনিয়ায় প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যেটা ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে মানুষের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরো দ্রুত বিকশিত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমরা এখন ভিআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘরে বসেও বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে বসে আড্ডা দেয়া, শপিং করা, খেলাধুলা করার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি পেতে পারব। পরিশেষে উল্লেখ্য, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অনেক বাস্তব ব্যবহার থাকার পরেও কম বয়সি বা শিশুদের বেলায় এর যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক যেভাবে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির পরিবেশে প্রতিক্রিয়া করে সে তুলনায় একজন কম বয়সির প্রতিক্রিয়া অনেক তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী। শুধু তাই নয়, এর যথেচ্ছ ব্যবহার তাদের শিখন ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া আমাদের দেশে ভিআরের মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উপযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন যথাযথ মানবসম্পদ উন্নয়ন (শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ), সর্বস্তরে উচ্চ গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট অবকাঠামো, উন্নত মানের ভিআর ডিভাইস আমদানি এবং সরকারি আইন নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগবিধি। তবে আশার কথা, বর্তমান সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ এবং বিকাশমান প্রযুক্তি অবকাঠামোর ক্রমোন্নতি ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশকে সামনের দিকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নেবে।

ড. ইকবাল আহমেদ : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়