মাদকবিরোধী অভিযান : রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার ২০

আগের সংবাদ

ভোগান্তি মেনেই ঘরে ফেরা : ঈদযাত্রা

পরের সংবাদ

ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন : কেটলির শর্টসার্কিট থেকে বেইলি রোডের আগুন

প্রকাশিত: এপ্রিল ৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনের নিচতলায় চা-কফির দোকানে ইলেকট্রিক কেটলি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। সেই আগুন প্রাণঘাতী রূপ ধারণ করে লিকেজ থেকে ছড়ানো গ্যাসের কারণে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স তদন্তের পর এ তথ্য জানিয়েছে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, গ্যাস জমে থাকার কারণেই কেটলির শর্টসার্কিটের আগুন খুব অল্প সময়ের মধ্যে পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। আর ভবনটির একটামাত্র সিঁড়িতে সিলিন্ডার রাখার কারণে মানুষ নামতে পারেনি। ওই ভবনে বেশ কিছু ‘আইনি ব্যত্যয়’ দেখার কথা জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান, সংস্থার পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী গতকাল রবিবার বলেন, ভবনে একটা এক্সিট সিঁড়ি থাকলেই এত লোক মারা যেত না। লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল বলেন, ভবনের নিচতলায় ‘চা চুমুক’ নামের কফিশপের ইলেকট্রিক কেটলির শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। সেই আগুনটাকে অতিমাত্রায় ছড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে লিকেজের কারণে জমে থাকা গ্যাস। চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে আগুন পুরো নিচতলা গ্রাস করে নেয়। তিনি বলেন, শুধু শর্টসার্কিট বা বৈদ্যুতিক সমস্যা থেকে আগুন ধরলে এত দ্রুত ছড়ায় না বা আগুন এত বড় আকার ধারণ করে না। তিনি আরো জানান, আগুনের একেবারে প্রাথমিক অবস্থার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে সেগুলোতে আমরা দেখেছি, প্রথম চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আগুনটা ‘ডেভেলপড স্টেজে’ চলে যায় (আগুনের চারটি স্তর আছে)। তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, বৈদ্যুতিক আগুন ছড়ায় প্রথমত, কেবলের মাধ্যমে। পরে সেটি আশপাশের দাহ্য বস্তুর মাধ্যমে ছড়ায়। কিন্তু সেই আগুন এত বড় আকার হয় না। এ ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক উৎস থেকে লেগে আগুনটি গ্যাসে ছড়িয়েছে। প্রাথমিকভাবে ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে অনেকে আগুন নেভাতে চেষ্টাও করেছেন। সেখানে একজন পুলিশও ছিলেন। কিন্তু গ্যাসের কারণে তারা ব্যর্থ হন। ছয় মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম গাড়ি যখন সেখানে পৌঁছায়, ততক্ষণে পুরো নিচতলা আগুনে ব্লক হয়ে যায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, যদি জরুরি একটা সিঁড়ি থাকত তাহলে এত মানুষ মারা যেত না। এগুলো তো বিল্ডিংয়ের মেজর ইস্যু। এই ভবনে একটামাত্র সিঁড়ি রয়েছে, সেটিতে আবার গ্যাস সিলিন্ডার রেখে ব্লক করে রাখা হয়েছিল। এই সিঁড়ির মতো মেজর ইস্যুসহ আমরা ভবনটিতে অনেকগুলো ব্যত্যয় পেয়েছি।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম জানান, তদন্তে তারা ওই

ভবনে অন্তত ১৩টি ‘ব্যত্যয়’ পেয়েছেন; এর মধ্যে কয়েকটি গুরুতর। তিনি বলেন, প্রথম ব্যত্যয়টি হচ্ছে সিঁড়ি। তাদের ভবনের যে আয়তন ও যত লোকের আনাগোনা, তাতে অন্তত দুটি সিঁড়ি থাকা আবশ্যক ছিল। কিন্তু ভবনের একটিই সিঁড়ি, সেটিতেও গ্যাস সিলিন্ডার রাখা অবস্থায় পেয়েছি আমরা। একটা এক্সিট সিঁড়ি থাকলেই মানুষগুলো বেঁচে যেত। অকুপেন্সি অনুযায়ী সিঁড়ি হওয়ার কথা। টোটাল জনবল ৫০ জন হলে একটা সিঁড়ি। পঞ্চাশ থেকে ৫০০ হলে দুটি সিঁড়ি। এক্সিট সিঁড়ি মাত্র একটা ছিল। যেটা হওয়ার কথা ছিল ভবনের আয়তন অনুযায়ী ন্যূনতম দুটি। সেই সিঁড়িও অকুপাইড ছিল সিলিন্ডার রেখে। তখনকার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, ভবনের ওপর তলায় আটকে পড়া মানুষ আগুন লাগার পর নিচে নামার জন্য এসে দেখছে নিচতলায় আগুন, টেম্পারেচার খুবই হাই। যেই নিচের দিকে নামতে পারেনি, তখন ওরা বিভিন্ন রুমের মধ্যে ঢুকে গেছে। তারা ভাবছে তিন-চার তলা মনে হয় নিরাপদ। ওই ভবনের ছাদও খোলা ছিল না। আর বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ মানুষই চিন্তা করে সিঁড়িতে তালা আছে। যারা ফ্ল্যাট বাসায় থাকে তারা দেখে অভ্যস্ত সিঁড়িতে তালা আছে। সে কারণে তারা ভবনের বিভিন্ন কক্ষে ঢুকে যায়। সেসব কক্ষে ন্যূনতম কোনো ভেন্টিলেশনও ছিল না। আমরা একটা রুমেই ৪০ জনের মতো পেয়েছি। ভেন্টিলেশন থাকলে হয়ত বিষয়টা অন্যরকম হতে পারত। ভবনের কাঠামোগত পরিবর্তন করতে গিয়ে আরেকটি ‘গুরুতর ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে’ বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, রাজউকের কাছ থেকে অফিস-কাম-বাসার (এফ টাইপ) অনুমোদন নিয়েছে ভবনটি। কিন্তু সেখানে রেস্তোরাঁ ও দোকান করা হয়েছে। এটা বেসিক্যালি আই টাইপ ভবন। তারা এফ টাইপটাকে আই টাইপ বানিয়ে ফেলেছে। কিছু ডিজাইন চেঞ্জ করছে, কিছু বাড়িয়েছেও। তাজুল ইসলাম বলেন, ভবনটি আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ করার পর ফ্লোর হিসেবে বিক্রি করে দেয়। এর ছাদও বিক্রি করা হয়েছে। এখন ভবনের আটজনের মতো মালিক রয়েছে। এই ভবন মালিকরা কখনোই ফায়ার সেইফটি প্ল্যানের জন্য আবেদন করেননি। শুধু ছাদে অ্যামব্রোশিয়া নামে যে রেস্তোরাঁটি আছে, তারা একটি ফায়ার লাইসেন্সের আবেদন করেছিল। তাজুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের ভবনে কমপক্ষে ৫০ হাজার গ্যালন পানি ধারণ ক্ষমতার ওয়াটার রিজার্ভার না থাকলে আমরা ছাড়পত্র দিই না। কিন্তু সেখানে পানির ক্যাপাসিটি ১০ হাজার গ্যালন। পানি ছিল আরও কম। এ ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ফায়ার সেইফটি প্ল্যান ২০০৩ এবং রাজউক থেকে অনুমোদন করা নকশা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
উল্লেখ্য, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলি রোডের ওই আটতলা ভবনে আগুন লেগে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। ভবনের নিচতলা থেকে ছাদ পর্যন্ত ডজনখানেক রেস্তোরাঁ ও কফিশপ ব্যবসা করছিল। সাপ্তাহিক ছুটির আগের রাতে রেস্তোরাঁগুলোতে ভিড় করেছিল অনেক মানুষ, সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। ওই ঘটনার পর রাজউকসহ ভবনের নকশা ও নিরাপত্তা অনুমোদনকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধেও গাফিলতির অভিযোগ ওঠে। ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস, রাজউক পৃথক তদন্ত কমিটি করে। এছাড়া ঢাকা শহরের আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন-স্থাপনায় পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা আছে কিনা, আইন-বিধি অনুসারে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি করে দেয় হাইকোর্ট। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে ওই কমিটিতে ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রাজউক এবং বুয়েটের প্রতিনিধিদের রাখা হয়। চারমাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে বলেছে উচ্চ আদালত। কমিটিগুলোর মধ্যে ফায়ার সার্ভিস নির্ধারিত সময়ে তদন্ত শেষ করে গত সপ্তাহে নিজেদের অধিদপ্তরে প্রতিবেদন জমা দেয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়