আজকের খেলা

আগের সংবাদ

পাহাড়ে সন্ত্রাস নির্মূল হোক

পরের সংবাদ

আমলার মুজিব দর্শন

প্রকাশিত: এপ্রিল ৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জীবিত বিশিষ্ট আমলাদের মধ্যে সর্বাধিক বয়োজ্যেষ্ঠ নিঃসন্দেহে মোহাম্মদ মতিউল ইসলাম, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব। তার জন্ম ১৯৩০ সালে, ১৯৪৬-এ কলকাতা থেকে ম্যাট্রিকুলেশন। তিনি চেয়েছিলেন দাঁতের ডাক্তার হতে; কিন্তু তার সার্কেল অফিসার বাবার চাওয়া ভিন্ন- তাকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে হবে। ভর্তি হলেন কমার্স কলেজে, কিন্তু ১৯৪৭-এর ভারত ভাগ, কলেজটাকেও ভাগ করল, একাংশ এসে সৃষ্টি হলো চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে পড়াশোনা ও আর্টিকেলশিপ শুরু করলেন। এর মধ্যে বড় ভাই নুরুল ইসলাম ১৯৫০ সালে সিএসপি হলেন (বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে অবসর নেন); সেই প্রেরণাতে মতিউল ইসলাম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসলেন এবং ১৯৫২ সালে সিএসপিতে উত্তীর্ণ হয়ে কর্মজীবন শুরু করলেন। ইংরেজিতে লিখিত তার স্মৃতিকথা ‘রিকালেকশনস অব অ্যা সিভিল সার্ভেন্ট টার্নড ব্যাংকার’-এর অনেকখানি জুড়ে রয়েছেন ‘শেখ মুজিব’। তার রচনা থেকেই অনুসৃত ‘আমলার মুজিব দর্শন’।
***
আমার কলেজ জীবন শুরু করতে ১৯৪৬ সালে যখন আমি কলকাতা যাই তখন শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম দেখি। শেখ মুজিব তখন ইসলামিয়া কলেজে চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র, সে কলেজে ছাত্রদের আনুষ্ঠানিক পোশাক ছিল কালো আচকান। তিনি থাকতেন মুসলমান ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত বেকার হোস্টেলে, মাঝে মাঝে এলিয়ট রোড হোস্টেলেও আসতেন। সেখানে আমার ক’জন বন্ধু থাকতেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ডান হাত হিসেবে ২৬ বছর বয়সে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান আন্দোলনে আরো গতি আনতে জিন্নাহ সাহেব ১৬ আগস্ট (১৯৪৬) ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে পালনের আহ্বান জানালেন। কলকাতা ময়দানে (গড়ের মাঠ নামেই সমধিক পরিচিত) জনসভায় যোগ দিতে আমি আমার বন্ধু ওয়াহিদুর রহমানকে নিয়ে পার্ক সার্কাস থেকে রওনা হলাম। ধর্মতলার ক্রসিং পর্যন্ত পৌঁছতেই আমরা দেখলাম বেশ অভিজাত ডিপার্টমেন্ট স্টোর কমলালয়ে লুটপাট চলছে। চারদিকে আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে।
কলকাতা ময়দানে আমরা দেখলাম বিশাল জনসমাবেশ, সবাই মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অপেক্ষায় রয়েছে, শেষ পর্যন্ত দু’ঘণ্টা পর তিনি এলেন এবং সমাবেশের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, ‘হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে এবং তা অরণ্যের আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনারা বাড়ি ফিরে যান।’ ততক্ষণে সব গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, আমরা বিপজ্জনক এলাকা এড়িয়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছালাম। পরবর্তী ক’দিন কলকাতায় নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হলো। উভয়পক্ষেই নির্মম হত্যাকাণ্ড চলল। কলকাতা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল- মুসলমানপ্রধান ও হিন্দুপ্রধান এলাকা; একজন থেকে অন্যজনে ব্যাপক সংখ্যায় অভিবাসন ঘটতে থাকল।
পার্ক সার্কাসের লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজকে মুসলমান শরণার্থীদের ত্রাণশিবিরে পরিণত করা হলো। সেখানেই আমি প্রথম শেখ মুজিবের সাহস ও মনোবলের একটি ঝলক দেখতে পেলাম। তিনি দিনরাত কাজ করছেন এবং ট্রাক ভর্তি করে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বীদের নিরাপদ অঞ্চলে পাঠাচ্ছেন। এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজ ছিল; কিন্তু শেখ মুজিব ঝুঁকি নিলেন এবং প্রায় একক প্রচেষ্টায় হাজার হাজার নিরীহ মানুষের জীবন রক্ষা করলেন। এক মুজিব তাঁর আনফিনিশড মেমোয়ার্স-এ ঘটনাটি বর্ণনা দিয়েছেন :
লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে রিফিউজিদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। দোতলায় মেয়েরা আর নিচে পুরুষরা। কর্মীদের ভাগ করে দেয়া হয়েছে। আমাকেও মাঝে মাঝে থাকতে হয়। মুসলমানদের উদ্ধার করার কাজও করতে হচ্ছে। দুয়েক জায়গায় উদ্ধার করতে গিয়ে আক্রান্তও হয়েছিলাম। আমরা হিন্দুদেরও উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছি। মনে হয়েছে মানুষ তার মানবতা হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়েছে।
১৯৫৬ সালে শেখ মুজিব আতাউর রহমান খানের সরকারে সবচেয়ে কম বয়সি বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্পমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই ফায়ার ব্র্যান্ড মন্ত্রী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠলেন। তার চিন্তা প্রক্রিয়া ছিল স্বচ্ছ, পরিপক্ব এবং তিনি তা দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়নে সক্ষম। সে সময় ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান অক্টাভিয়াস স্টিলের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছিল। নূরুল আমিনের সরকার উচ্চতর ফি দিয়ে নিয়োগ করেছিলেন। শেখ মুজিব ভাবলেন এটা রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়, বরং দেশীয় প্রকৌশলীরাই এই বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানির চালনা ও ব্যবস্থাপনায় সক্ষম। কালবিলম্ব না করে তিনি বিদেশি অক্টাভিয়াস স্টিলের সঙ্গে সরকারের চুক্তি বাতিলের উদ্যোগ নিলেন এবং দ্রুত ব্যবস্থাপনা দেশীয় হাতে তুলে নিলেন। আমি তখন অর্থের ডেপুটি সেক্রেটারি এবং একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টও বটে। মন্ত্রী আমাকে চট্টগ্রাম গিয়ে অক্টাভিয়াস স্টিলের হিসাবপত্র ভালোভাবে নিরীক্ষা করার নির্দেশ দিলেন।
অর্থ বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ঋণ ও অনুদানের দাবি পেশ করা। এটা ছিল একটি হতাশাব্যঞ্জক কাজ; কোনো না কোনো অজুহাতে কেন্দ্রীয় সরকার তহবিলের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করত অথবা বিলম্ব করিয়ে দিত। সে সময় আমার জন্য বড় বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল একটি টেলিগ্রাফিক বার্তা- ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন স্থাপন করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এক কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করেছে এবং আরো এক কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বাণিজ্য ও শিল্প বিভাগের অধীনে ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই; এই দুটি সংস্থা স্থাপনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তহবিল চেয়ে কোনো অনুরোধ পাঠানো হয়নি। শিগগিরই আমাদের কাছে স্পষ্ট হলো পূর্ব পাকিস্তানের এই ফায়ার ব্র্যান্ড মন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে তহবিল পাওয়া গেছে।
শেখ মুজিবের স্পষ্ট ধারণা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্প ভয়ংকর খারাপ অবস্থায় রয়েছে; টিকে থাকতে এবং ভালো ছবি তৈরি করতে সরকারি সাহায্য প্রয়োজন। ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য একটি সংস্থা গঠন তারই মস্তিষ্কপ্রসূত। তিনি স্পষ্টই অনুধাবন করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষুদ্র শিল্পের উন্নয়নে দক্ষতা বৃদ্ধি, তহবিলে প্রবেশাধিকার এবং অবকাঠামো উন্নয়ন অপরিহার্য। কৌতূহলের বিষয় পশ্চিম পাকিস্তানও তাকে অনুসরণ করে তাদের ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা গঠন করল। শেখ মুজিবই পথ দেখিয়ে দিলেন।
শেখ মুজিবের সঙ্গে আজীবন সংস্রবের শুরু ও শেষ (১৯৫৭-১৯৭৫)
উচ্চ শিক্ষার্থে ১৯৫৭’র সেপ্টেম্বরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি লোক প্রশাসনে মাস্টার্স ডিগ্রি নেব; শুনলাম শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, পার্টির উন্নয়নের কাজে পুরোপুরি মনোনিবেশ করবেন। এটাও এক দুর্লভ উদাহরণ। ১৯৫৭’র ডিসেম্বরে লিডারশিপ কর্মসূচিতে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। প্রথমে বোস্টনে এলেন, বোস্টন জেনারেল হসপিটালে তাঁর একটি অপারেশন হলো। হাসপাতালে তাঁর দেখাশোনা করার দুর্লভ সুযোগ আমার হয়েছিল। তাঁর আরোগ্য লাভের সময়টাতে আমি তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলাম, তিনি তখন মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। আজীবন বন্ধুত্ব ভালোবাসা ও স্নেহ আমি তাঁর কাছ থেকে যা পেয়েছি তার সমাপ্তি ঘটল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট, ৪২ বছর আগে (রচনাটি ২০১৭ সালে লিখিত)।
১৯৫৮ সালে আমি ঢাকা ফিরে আসি এবং অর্থ বিভাগে আমার দায়িত্বভার গ্রহণ করি। পরবর্তী ১২ বছর আমি শেখ মুজিবের সঙ্গে যোগাযোগ করিনি, তবে দু’বার তাঁর সঙ্গে আকস্মিক দেখা হয়েছে এবং ১৯৬৯ সালে তাঁর কাছ থেকে একটি টেলিফোন কল পেয়েছি। সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ ১৯৬৯’র ডিসেম্বরে আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে, তবে অভিযোগনামা দাখিল করে ১৯৭০-এর এপ্রিলে। আমার বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীরা পরামর্শ দিলেন সেনাবাহিনীর এই অভিঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আমাকে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে যেতে হবে, যাতে তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব দিয়ে আমাকে উদ্ধার করেন। আমি রাজনৈতিক সহায়তা নিতে অস্বীকার করলাম এবং আমার যুদ্ধ একাই চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু আমি জানতাম না আমাকে অন্যায়ভাবে অবসর দেয়ার বিষয়টি তিনি নিজেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে উপস্থাপন করবেন।
২ জানুয়ারি ১৯৭১ আমি পিএনও-ও (পাকিস্তান ন্যাশনাল অয়েল) ডিরেক্টরদের সঙ্গে যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য ধানমন্ডির বাসভবনে যাই তখনই তা জানতে পারি। শেখ মুজিব বললেন তিনি দুবার জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে আমার বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন এবং আমাকে হয়রানি না করতে তাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি আমাকে সংক্ষিপ্ত সময়ের নোটিসে চাকরিতে যোগদান করার জন্য প্রস্তুত থাকতেও বললেন। আমার কাছে তখন এটা স্পষ্ট হলো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা গ্রহণ করার পর তিনি আমাকে তাঁর পাশে চান। কিন্তু জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করা, ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনার ব্যর্থতা দৃশ্যপট বদলে দিল। শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের লায়লপুরে জেলে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তার বিচার হলো। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ টেলিভিশনে তাঁর বিজয়ী প্রত্যাবর্তন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে দেখলাম, কারণ তাঁর সঙ্গে আমার দেখা করার আর সুযোগ হচ্ছে না, দুদিনের মধ্যেই জীবিকার সন্ধানে লন্ডন যাত্রা করছি। কিন্তু কখনো কল্পনা করিনি এই দুদিনের মধ্যেই শেখ মুজিব আমাকে বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব ঘোষণা করবেন। আমার সম্মানের যে এক স্বীকৃতি। আমার সততা, নিষ্ঠা ও সক্ষমতার ওপর শেখ মুজিবের এমন অখণ্ড আস্থা ও বিশ্বাস যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতের পুনর্নির্মাণের বিশাল দায়িত্ব আমাকে দিলেন, আমি অনস্তিত্ব থেকে রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে উঠলাম।
আমার সামনে তখন অতিকায় সংকট। নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে পুনর্গঠন এবং শক্তিশালী করে তুলতে হবে। আমি যখন পূর্ব পাকিস্তানের সরকারের অর্থ বিভাগে কাজ করতাম তখনকার কিছু পুরনো কর্মী তখনো আছেন। কিন্তু জয়েন্ট সেক্রেটারি ও ডেপুটি সেক্রেটারি পর্যায়ে ভীষণ শূন্যতা। আমি হেড-হান্টিং মিশনে বের হয়ে ক’জনকে শনাক্ত করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানালাম যেন তাদের অর্থ মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। তখন জরুরি ভিত্তিতে করার মতো কাজের মধ্যে ছিল বাংলাদেশে চালু বিভিন্ন মানের পাকিস্তানি নোট প্রতিস্থাপন, পরিত্যক্ত ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠন ও ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকিং খাতকে জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, বাজেট প্রণয়ন, রাজস্ব বাজেটে অর্থের সংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল গঠন এবং আরো অনেক বিষয়।
১৭ জানুয়ারি ১৯৭২ অর্থ সচিব হিসেবে আমার যোগদানের আগেই প্রধানমন্ত্রী হামিদুল্লাহকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ করেছেন। নতুন ডেপুটি গভর্নর নির্ধারণ ও নিয়োগের কাজ বাকি। বোর্ড অব রেভিনিউ পূর্ব পাকিস্তানের যেমন ছিল, তার কাজ কেবল ভূমি রাজস্ব আদায় করা, কিন্তু কর শুল্ক ও আবগারি আদায় পরিচালনা করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। নতুন দূতাবাস খুলতে হবে, কিন্তু ব্যয় নির্বাহ করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা নেই।
কিন্তু আমার আস্থার স্তর অনেক উঁচুতে। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে আমার ১৭ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা এবং প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর আস্থাই আমার চালিকাশক্তি। আমি নিজের কাছে প্রতিশ্রæত- যে নীতি আমি অনুসরণ করেছি তা হচ্ছে মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর সমস্যা নিয়ে কখনো যাইনি, সমাধান নিয়ে গিয়েছি। ছয়টি জাতীয়করণকৃত ব্যাংকের ছয়জন ম্যানেজিং ডিরেক্টর নির্বাচনের দায়িত্ব আমি নিজে নিয়েছি, বোর্ড অব ডিরেক্টরস গঠনের প্রস্তাবে সম্মতি দিইনি, তাতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ এড়ানো সম্ভব হয়েছে। যথারীতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ যেতে শুরু করল যে, আমি রুলস অব বিজনেস সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছি আর তা শুনে প্রধানমন্ত্রীর উত্তর ছিল, ‘তাই নাকি, ব্যাংক তো ভালোই চলছে। আমি ওকে বকে দেব।’
যখন জিজ্ঞেস করা হলো, বললাম খুব দ্রুত নিয়োগ দিতে হয়েছে, তার সঙ্গে বা মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করার সময় ছিল না। তবে চাইলে তিনি এখনো পরিবর্তন করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর জবাব ছিল, তিনি কোনো পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন না, তবে আমি যেন এইভাবে আর নিয়োগ প্রদান না করি। দুর্ভাগ্যবশত এভাবেই আমাকে আবারো একইভাবে করতে হলো যখন একেএন আহমেদ পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবাসিত হলেন। তিনি সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী ছিলেন এবং কাজের জন্য আমার কাছে রিপোর্ট করলেন। তার দাবি তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর করতে হবে, কারণ হামিদুল্লাহ কখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাকরি করেননি। এটি বিবেচনার জন্য এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্থাপন করতেও আমার অসামর্থ্যতার কথা বললাম, তবে আমি তাকে পরামর্শ দিলাম সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদটি সে মুহূর্তে খালি হয়েছে, এটি তাকে দিতে পারি। ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম এ চৌধুরী পিও ৯-এ চাকরিচ্যুত হয়েছেন বলে পদবি শূন্য হয়েছে। আমি পরামর্শ দিলাম যদি তিনি সম্মত থাকেন তাহলে পরদিন যেন তার জবাব নিয়ে আসেন। তিনি এলেন এবং সম্মতি জানালেন, আমি তাকে সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিয়োগ করলাম। (ক্রমশ)

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়