সায়মা ওয়াজেদের কারণে অটিজম নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে : বাহাউদ্দিন নাছিম

আগের সংবাদ

পাহাড় জনপদে আতঙ্কের ঢেউ

পরের সংবাদ

বুয়েট কি ইপুয়েট হতে যাচ্ছে?

প্রকাশিত: এপ্রিল ৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বুয়েট বা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এদেশের ঐতিহ্যবাহী ও শীর্ষস্থানীয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৮৭৬ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার তার জরিপ কাজের সুবিধার্থে ‘ঢাকা সার্ভে স্কুল’ নামে এটি প্রতিষ্ঠা করে। ১৯০৫ সালে এটি শিক্ষানুরাগী ঢাকার নবাব খাজা আহসানউল্লাহর অনুদানে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপ লাভ করে ১৯০৮ সালে ‘আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল’ নামে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৬২ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়’ বা ‘ইপুয়েট’ নামে যাত্রা শুরু করে। বলাবাহুল্য, ব্রিটিশের দুশো বছরের ঔপনিবেশিক কশাঘাত থেকে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। পরবর্তীতে দেখা যায়, বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের নিষ্পেষণের মাত্রা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৭-১৯৭০ অবধি দীর্ঘ ২৩ বছরে নির্মম বঞ্চনা ও প্রবঞ্চনা চরিতার্থের ক্ষেত্রে তারা ছাত্ররাজনীতির ওপরই বারবার প্রবল আঘাত হেনেছিল, যার অন্যতম নিকৃষ্ট উদাহরণ ছিল ’৫২-র ভাষা আন্দোলনে আঘাত। ২৩ বছরে পূর্ববাংলার ছাত্ররাজনীতি কার্যত নিষিদ্ধই ছিল। বাঙালিদের শিক্ষাদীক্ষায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত (ঢ়ধৎধষুুবফ) করার জন্য শিক্ষায় গভীর ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকে। পূর্বপাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও ক্রমেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমিয়ে দেয়া হয়। ইতিহাসের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় রাজনীতির গর্ভে পুনঃজন্ম নেয়া আজকের এই বুয়েট। মুক্তিযুদ্ধে ২৩ জন বুয়েটিয়ান প্রকৌশলীরও জীবন দানের ঐতিহাসিক বীরত্বগাথা রয়েছে। রক্তের প্রস্রবণে জন্ম নেয়া স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য ১৯৭২ সালে ‘ড. কুদরত-ই খুদা’ নামে বঙ্গবন্ধু এক অভূতপূর্ব বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। ১৯৭৩ সালের ২০ মার্চ বুয়েটের প্রথম সমাবর্তনে এই বুয়েটের মাটিতে দাঁড়িয়েই তিনি তার কালজয়ী শিক্ষাদর্শন ব্যক্ত করেছিলন। বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে ভাবতেন যে, ব্রিটিশের দুশো বছরের এবং পাকিস্তানের ২৩ বছরের গোলামির শিক্ষা আমাদের শুধু কেরানিই বানিয়েছে, মানুষ বানায়নি। তাই এই অনুৎপাদনশীল পরনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে মুক্ত চিন্তার মাধ্যমে উদ্ভাবনী শিক্ষা সৃষ্টি করে একটি স্বনির্ভর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। এ লক্ষ্যে শিক্ষাকেই তিনি প্রধান হাতিয়ার রূপে বেছে নিয়েছিলেন এবং সেই আমলেই তিনি শিক্ষায় সর্বোচ্চ তথা জাতীয় আয়ের ২২ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ রেখেছিলেন।
বলাবাহুল্য, ’৭৫-পরবর্তী অগণতান্ত্রিক পন্থায় উত্থিত দুই সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদের শাসনামলেও এমনটি ঘটেছিল। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও শোষকদের মতো তারা দেশে সৃজনশীল মুক্তমত চর্চা অবরুদ্ধ করে রেখে দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের বিকৃতি ঘটিয়েছিল যার দীর্ঘ বিকৃত প্রভাবে রীতিমতো একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে কতিপয় ছাত্রলীগ কর্মী হত্যা করে। এ ঘটনায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল জড়িত ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। উচ্চ আদালতে এটি বিচারাধীন থাকায় রায় কার্যকর হয়নি। বিষয়টি ঘিরে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট প্রশাসন এখানে সব ধরনের রাজনৈতিক চর্চা নিষিদ্ধ করেন। অথচ একই ক্যাম্পাসে ২০০২ সালে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে বুয়েট ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি এবং ২০১৩ সালে বুয়েট ছাত্র ও শাখা ছাত্রলীগের নেতা আরিফ রায়হান দীপকে ধর্মান্ধ হেফাজতে ইসলামের কর্মী ও বুয়েট শিক্ষার্থী চাপাতি দিয়ে কুপিয় হত্যা করে। কিন্তু এদের বিষয়ে কখনোই এখানকার শিক্ষার্থীদের একটা শ্রেণি সরব হয়নি বরং শুধু ফাহাদের মৃত্যুকেই আবেগী পুঁজি করে দীর্ঘ পাঁচ বছর বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধের আড়ালে কার্যত নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন হিজবুত তাহরীর ও জামায়াত শিবিরকে গোপনে কার্যক্রম চালানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছে মর্মে অভিযোগ আছে। যৌথভাবে তাদের বিতর্কিত সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল মর্মে মুক্তিযুদ্ধ সপক্ষের সেখানকার প্রগতিশীল শিক্ষার্থী ও একাধিক গণমাধ্যমের তদন্তে উঠে এসেছে।
সর্বশেষ গত বছরের ৩০ জুলাই সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে শিবিরের ২৪ জন নেতাকর্মী গোপন বৈঠক হতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে মুক্ত হয়ে তারা এই কার্যক্রম চালায়। হিজবুত তাহরীর কিউ আর কোডের মাধ্যমে তীক্ষè কৌশলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। এমতাবস্থায় সম্প্রতি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন রাতে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ পক্ষের শিক্ষার্থীরা ফুঁসে ওঠে। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ইমতিয়াজ রাহিমের সিট বুয়েট প্রশাসন তৎক্ষণাৎ বাতিল করেন। কোনো তদন্ত ও আত্মপক্ষ সমর্থন ছাড়াই বুয়েট প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্ত সচেতন মহলে বেশ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এতে বুয়েট প্রশাসন তার স্বকীয় ওজন হারিয়েছে যা কখনোই শোভনীয় নয়। এতদবিষয়ে বুয়েট ভিসির প্রতিক্রিয়াও সচেতন মহলকে হতবাক করেছে। এতে তার দুর্বল ব্যবস্থাপনার প্রকাশ ঘটেছে। অথচ রাজনীতি নিষিদ্ধের মাধ্যমে বিগত চার-পাঁচ বছর ধরে এখানে জাতীয় দিবসগুলো যথার্থভাবে পালিত হয়নি। পালিত হয়নি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘের অনুষ্ঠানাদি। সর্বশেষ, উচ্চতর আদালত, বুয়েটে রাজনীতি চলতে বাধা নেই মর্মে রায় প্রদান করেছেন। প্রশ্ন হলো রাজনীতি উন্মুক্তের ক্ষেত্রে কেন আদালতের শরণাপন্ন হতে হলো? এর জন্য কি বুয়েট কর্তৃপক্ষের নৈতিক দায় ছিল না? উল্লেখ্য, দ্রুত সময়ে আবরার ফাহাদের বিচার ঘোষিত হয়েছে (যদিও সনি ও দীপের বিচার আজো সম্পন্ন হয়নি)।
তারপরও সংঘটিত ঘটনায় কেন ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকবে? সংঘটিত ঘটনা তো বিচারাধীন। শিক্ষার্থীদের রাজনীতির বিরুদ্ধে বা রাজনীতি প্রতিহতে ভূমিকা রাখা কখনোই সচেতন প্রকাশ হতে পারে না। বরং রাজনীতির নামে যা এদেশের জাতীয়তা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে সেই অপরাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াই হতো আদর্শিক পরিচয়। কিন্তু অন্যের সাধারণ রাজনৈতিক অধিকারের বাধা প্রদান শুধু সাংবিধানবিরোধী অপতৎপরতাই নয় বরং মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন বটে। বিস্মিত বিষয় হলো মহামান্য আদালতের নির্দেশনার বিরুদ্ধেও তারা প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাচ্ছে, যা স্বাধীনতা বিরোধীগোষ্ঠীর মতো দেশের বিচার বিভাগকে অবমাননার শামিল বৈকি। হ্যাঁ ’৭৫-পরবর্তী এদেশের আবহমান সৃজনশীল রাজনীতি তার পথ হারিয়েছে। বিনষ্ট হয়েছে রাজনীতির ঐতিহ্যিক ধারা। জাতীয় স্বার্থে মেধাবী শিক্ষার্থীদের কি দায় নেই জাতীয় রাজনীতিকে সংস্কার করার? ২০২২ সালের ইউজিসির তথ্যানুযায়ী বুয়েটের শিক্ষার্থী প্রতি বছরে রাষ্ট্রের ব্যয় হয় ৩ লাখ ১৪ হাজার ৪৭৭ টাকা যা জনগণেরই রক্ত ঘামের পয়সা। সেই হিসাবে একজন শিক্ষার্থীর পূর্ণ কোর্স অবধি রাষ্ট্রের লাখ-লাখ টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু আমরা অনেক শিক্ষার্থীকে দেখেছি, দেশকে অবহেলা করে স্কলারশিপের মাধ্যমে বিদেশে স্থায়ী পাড়ি জমাতে। অনেককেই দেখেছি সরকারি কর্মজীবনে বড়-বড় দুর্নীতিবাজ হতে। স্বাধীনতার পূর্বাপর এদেশের অনেক প্রখর মেধাবীদের দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে দেখেছি এবং দেখছি। রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থানও এক ধরনের বিশেষ অপরাজনীতি। যে মেধা রাষ্ট্রের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সংস্কৃতি, জাতিসত্তাকে আঘাত করে সেই মেধা অবশ্যই পরিত্যজ্য। প্রকৃত রাজনীতির মাধ্যমে মননশীলতার বিকাশ ঘটে, স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হয়। জাগ্রত হয় মানবিকতা ও সুনাগরিকতা। তাই বিরাজনীতি নয়, বরং সুস্থ ধারার রাজনীতির মাধ্যমে বুয়েট তার স্বমহিমায় অনুকরণীয় হয়ে উঠুক এই শুভ প্রত্যাশায় আমরা।

কাজী মাসুদুর রহমান : লেখক ও গবেষক, যশোর।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়