সাবের হোসেন চৌধুরী : বনের জমি দখলে সরকারি প্রতিষ্ঠানকেও ছাড় নয়, বন কর্মকর্তার খুনিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে

আগের সংবাদ

সর্বাত্মক অভিযানে যৌথবাহিনী

পরের সংবাদ

পাহাড় জনপদে আতঙ্কের ঢেউ

প্রকাশিত: এপ্রিল ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক, বান্দরবান ও থানচি প্রতিনিধি : সশস্ত্র সংগঠন ‘কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)’ সন্ত্রাসীদের ভয়ানক ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার পর থেকেই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে পার্বত্য অঞ্চলে। সংগঠনটির সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে সাড়াশি অভিযান চালাচ্ছে যৌথ বাহিনী। কুকি চিন সন্ত্রাসীরা পাল্টা হামলা চালাতে পারে- এমন আশঙ্কাও রয়েছে। কখন কোথায় কী ঘটনা ঘটে সেই আতঙ্কে কাঁপছেন পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দারা। অতি জরুরি কাজ ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। বাজার-ঘাটও প্রায় জনশূন্য। জেলা সদরেও লোকের আনাগোনা অনেকটাই কমেছে। জোরদার করা হয়েছে ব্যাংকসহ সামগ্রিক নিরাপত্তা। এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বান্দরবানের থানচি বাজারে যৌথবাহিনী ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে।
যে কোনো গোষ্ঠী বা দলের অপতৎপরতা দমনে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করবে জানানো হয়েছে। এরই মধ্যে কেএনএফের সঙ্গে শান্তি কমিটির শান্তি আলোচনা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা। পাশাপাশি বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় ব্যাংকে ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তাদের বিচার হবে, কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এদিকে, অপহরণের দুদিন পর রুমার সোনালী ব্যাংক শাখার ম্যানেজার নিজামুদ্দিনকে গতকাল বৃহস্পতিবার উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। ম্যানেজারকে ছাড়তে কেএনএফের পক্ষ থেকে ১৫-২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) এম খুরশীদ হোসেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বান্দরবানের থানচিতে দুই ব্যাংকে সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনার পর গতকাল বৃহস্পতিবার উপজেলা সদরে বন্ধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হলেও লোক সমাগম ছিল একেবারেই কম। হাতেগোনা যারা ঘর থেকে বের হয়েছেন- সবারই মনে ছিল উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক। থানচি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জসীম উদ্দিন বলেন, বুধবার এ রকম ঘটনার পর আমরা সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা খুব আতঙ্কে ছিলাম। সে কারণে ফার্মেসির মতো জরুরি দোকান ছাড়া সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছিল। গতকাল বাজারের দোকানপাট খুলেছে। কিন্তু সবার মধ্যে অস্বস্তি, লোকজন বাজারে বের হচ্ছে কম। থানচির বাসিন্দা এক ব্যবসায়ী বলেন, বুধবার ছিল সাপ্তাহিক বাজার। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে লোকজন মালামাল নিতে এসেছিলেন। দুপুর সোয়া ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে তিনটি গাড়িতে করে কয়েকশ লোক আসে। তার মধ্যে দুটি গাড়ি থেকে নেমে সন্ত্রাসীরা দুই ব্যাংকে যায়। একটি গাড়ি ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সন্ত্রাসীদের একটি দল সোনালী ব্যাংকে ঢুকে ম্যানাজারকে খুঁজতে থাকে। না পেয়ে ক্যাশ বাক্সে থাকা টাকা নিয়ে যায়। সশস্ত্র দলটির সঙ্গে কয়েকজন নারীও ছিলেন জানিয়ে ওই ব্যবসায়ী বলেন, দলটির লোকজন খাকি পোশাক পরে ছিলেন। আমাদের ধারণা, তারা কুকি-চিন পার্টির সদস্য। ব্যাংক লুট শেষে সশস্ত্র দলটি থানচি বাজারে প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ে আতঙ্ক তৈরি করে এবং গাড়িতে চেপে চাঁদাপাড়া এলাকার সড়কের দিকে চলে যায় বলে জানান ওই ব্যবসায়ী।
থানচি বাজারের এক ব্যবসায়ী

বলেন, সাধারণ সময়ে যে ধরনের লোক সমাগম বাজারে হয়, তার অর্ধেকও নেই। মানুষের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছে। পাহাড়ি বিভিন্ন এলাকা থেকে যারা নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করতে আসেন, তাদের সংখ্যাও খুব কম। জানা গেছে, প্রতি রবি ও বুধবার থানচি বাজারে সাপ্তাহিক হাট বসে। ওই দুই দিন শতাধিক বোটে করে মালামাল আসে। সাধারণ সময়ে আসে ২৫ থেকে ৩০টি বোট। গতকাল ১০টি বোটও দেখা যায়নি।
সামনে পাহাড়িদের বর্ষবরণের অন্যতম উৎসব সাংগ্রাই। সেই উৎসব ঘিরে বাজারে বিকিকিনি অনেক বাড়ে। বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে লোকজন বাজারে আসে কেনাকাটা করতে। কিন্তু আশানুরূপ ক্রেতা না দেখে হতাশ ব্যবসায়ীরা। আগামী রবিববার সাপ্তাহিক বাজার। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমরা শঙ্কায় আছি, মানুষজন এবার বাজার করতে আসবে কিনা। স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, বুধবার পাহাড়ি যে সশস্ত্রগোষ্ঠী ব্যাংক লুট করেছিল, তারা গাড়ি নিয়ে চাঁদার পাড়া হয়ে শাহজাহান পাড়ার দিকে গেছেন বলে তারা শুনছেন। বাজার থেকে ওই এলাকার দূরত্ব আড়াই-তিন কিলোমিটার। অস্ত্রধারী লোকজন এখনো ওই এলাকায় থাকতে পারে। তাই আমাদের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছে।
যেভাবে উদ্ধার হলেন ব্যাংক ম্যানেজার : অপরদিকে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় অস্ত্রধারীদের হাতে অপহরণের শিকার সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। রুমায় উপজেলা প্রশাসন কমপ্লেক্স ভবনে হামলা চালিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে অস্ত্র ও টাকা লুট করে নেয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এ সময় তারা ব্যাংকটির ম্যানেজার নেজামউদ্দীনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর থেকে ম্যানেজারকে উদ্ধারে শুরু হয় যৌথ বাহিনীর অভিযান। মানববন্ধন করে উপজেলা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিষদ। উৎকণ্ঠায় থাকা পরিবারের সদস্যরাও অক্ষত অবস্থায় নেজামউদ্দীনকে উদ্ধার করার আকুতি জানায়। তবে ম্যানেজারের হদিস মিলছিল না। এরইমধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয় কেএনএফের পক্ষ থেকে। তখনই র‌্যাবের পক্ষ থেকে মুক্তিপণের বিষয়টি জানিয়ে বলা হয়, ম্যানেজার নেজামউদ্দীন সুস্থ আছেন।
পরে কেএনএফের সঙ্গে আলোচনায় যায় র‌্যাব। সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে উদ্ধার করা হয়েছে অপহৃত নেজামউদ্দীনকে। র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল এস এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, দুই দিনের অভিযানের পর রুমা বাজারের পাশের এলাকা থেকে সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ম্যানেজার নেজামউদ্দীনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তাকে উদ্ধারে কোনো মুক্তিপণ দেয়া হয়েছে কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে র‌্যাব-১৫ সূত্র জানিয়েছে, কেএনএফের কিছু দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে মধ্যস্থতা করা হয়েছে। আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, আর্থিক লেনদেন ছাড়াই নেজামউদ্দীনকে উদ্ধার করা হয়েছে। ম্যানেজার নেজামউদ্দীনকে উদ্ধারের আগে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছিলেন, সেনাবাহিনী ও যৌথ বাহিনীর সহযোগিতায় আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে ব্যাংক ম্যানেজারকে অক্ষত ও নিরাপদে ফিরিয়ে আনা। এজন্য নানা কৌশলে কাজ করছে র‌্যাব। ব্যাংক ম্যানেজারের সঙ্গে বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে তার পরিবারের কথা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তিনি সুস্থ আছেন। তার অবস্থান শনাক্তে কাজ করছে র‌্যাব। একই সঙ্গে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করছি কীভাবে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা যায়। পাশাপাশি স্থানীয়দের সিসিটিভি ফুটেজ দেখিয়ে ও গণমাধ্যমে প্রকাশ করে জড়িতদের পরিচয় শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। এরই ধারাবাহিকতায় উদ্ধার হন নেজামউদ্দীন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নেজাম উদ্দিন কক্সবাজারের চকরিয়ার বিএমচর ইউনিয়নের বাক্যারপাড়া এলাকার মৃত ইমাম উদ্দিনের ছেলে। ২০১৫ সালে তিনি সোনালী ব্যাংকে যোগ দেন। ২০১৮ সালে বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি শাখায় সিনিয়র অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে ২০২১ সালে ম্যানেজার পদে পদোন্নতি ও রুমা শাখার দায়িত্ব পান। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে নেজাম তৃতীয়।
জনমনে আতঙ্ক : রুমা সদরে সরজমিন দেখা যায়, সবার মনে আতঙ্ক। সন্ত্রাসীদের বিশাল বহর আর সশস্ত্র অবস্থানের দৃশ্যে সবাই বাকরুদ্ধ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জানান, শতাধিক অস্ত্রধারী মঙ্গলবার রাতে প্রথমে সোনালী ব্যাংকে হানা দেয়। ক্যাশিয়ারের কাছে থাকা চাবিতে ভল্ট না খোলায় ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনের সন্ধানে তারা পার্শ্ববর্তী মসজিদে যায়। সেখান থেকে তাকে ব্যাংকে নিয়ে যায়; কিন্তু চাবি না পেয়ে নেজামকে তুলে নিয়ে পাহাড়ি সড়কে হেঁটে চলে যায়। বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে তারা সোনালী ব্যাংকে হামলা করে। এ সময় তারা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের মারধর করে অস্ত্র কেড়ে নেয়। পরে নেজামকে অক্ষত উদ্ধার ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তার দাবিতে বুধবার বেলা ১১টার দিকে রুমা উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে মানববন্ধনও করে উপজেলা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিষদ। রুমা থানার ওসি মো. শাহজাহান জানান, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।
পাহাড়ে নববর্ষ ও ঈদের আগে দুই উপজেলায় এমন ঘটনায় ভয় ছড়িয়ে পড়ে পার্বত্য তিন জেলার ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় জড়িত সবার মধ্যে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানে প্রতিটি ব্যাংকই তাদের শাখাকে সংশ্লিষ্ট থানার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছে। বান্দরবানে তিন উপজেলার সোনালী ব্যাংকের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার শাখা বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া জেলার সব ব্যাংকে নিয়মিত কার্যক্রম চলছে।
সোনালী ব্যাংক বান্দরবান শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ওসমান গণি জানান, নিরাপত্তার কারণে আমরা সকাল থেকেই সাময়িকভাবে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি সোনালী ব্যাংকের ৩ শাখার কার্যক্রম বন্ধ রেখেছি; তবে অন্য সব শাখা খোলা রয়েছে।
ব্যাংকে চুরি, ছিনতাই ও জঙ্গি হামলা প্রতিরোধসহ সার্বিক পরিস্থিতি মাথায় রেখে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ। এখন থেকে সব ব্যাংকে পুলিশি নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার কার্যালয়ে জেলার বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক জরুরি সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সময় জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান, পুলিশ সুপার মুক্তা ধরসহ বিভিন্ন ব্যাংকের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা সভায় খাগড়াছড়ি জেলার পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, আমাদের দেশে ঈদসহ সব বড় উৎসবকে কেন্দ্র করে একটি নাশকতাকারী ও অপরাধী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা ব্যাংকিং সেক্টরকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন ধরনের অভিনব অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এ সময় ব্যাংক লুট, জাল টাকার বিস্তার, ছিনতাই, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টির দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়। তাই এমন অপতৎপরতা রুখে দিতে ব্যাংকের ভেতর ও তার আশপাশের সিসি ক্যামেরাগুলো সচল রেখে ভিডিও ফুটেজ সংরক্ষণ করতে হবে। জেলায় যে কোনো নাশকতা রোধে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি, অনলাইন মনিটরিংসহ ব্যাংক কেন্দ্রিক দিবা-রাত্রি টহল ডিউটি জোরদার আছে। পাশাপাশি যে কোনো সন্দেহজনক কিছু দেখলে অতি দ্রুত সংশ্লিষ্ট থানা বা খাগড়াছড়ি জেলার হটলাইন নম্বরে যোগাযোগের অনুরোধ জানান তিনি।
এ সময় খাগড়াছড়ি জেলার প্রশাসক জনাব মো. সহিদুজ্জামান বলেন, ব্যাংকিং নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য করণীয় বিষয়গুলো অতি দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। জরুরি পরিস্থিতিতে প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করার কথাও বলেন তিনি।
সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ির রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শরীফ মোহাম্মদ আমান হাসান বলেছেন, পাহাড়ে স্থায়ীভাবে শান্তি স্থাপনে সেনাবাহিনী কাজ করছে। সেখানে কোনো গোষ্ঠী বা দলের অপতৎপরতা দমনে সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করবে। রিজিয়ন কমান্ডার আরো বলেন, অপারেশন উত্তরণের আওতায় পাহাড়ে সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে সেনাবাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সন্ত্রাসীদের নির্মূল করে পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতি বজায় রাখতে কাজ করবে।
থানচি উপজেলায় টাকা লুট হওয়া দুটি ?ব্যাংকের শাখা পরিদর্শন শেষে চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশের উপমহাপরিদর্শক নূরে আলম মিনা বলেন, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধীদের দমনে বান্দরবানে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে। তিনি বলেন, রুমা ও থানচিতে ব্যাংকের টাকা লুট, পুলিশের ওপর হামলাসহ নানা অভিযোগে ৮ থেকে ৯টি মামলা হতে পারে। মামলার যাবতীয় প্রস্তুতি চলছে। কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম উল্লেখ না করে ডিআইজি বলেন, ফান্ড সংগ্রহের জন্য দুটি ব্যাংকে হামলা হয়েছে। রুমায় বেশি টাকা রয়েছে, তাই ভল্ট ভেঙে নেয়ার চেষ্টা করে। আর থানচিতে ঘটনার দিন হাটবার থাকায় ব্যাংকে লেনদেন বেশি হবে। তাই সেখানে ডাকাতি হয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্র অবশ্যই উদ্ধার করা হবে বলে জানান ডিআইজি নূরে আলম মিনা।
গতকাল সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় ব্যাংকে ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তাদের বিচার হবে, কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেন হঠাৎ তারা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, তা আমাদের জানা ছিল না। আসাদুজ্জামান খান বলেন, কুকি-চিনের আস্তানা র‌্যাব ও আর্মি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। পরে আমাদের সীমানা পার হয়ে তারা ভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। সেখানেই তারা অবস্থান করছিল। এখন তারা কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে এসেছে! মাঝে মধ্যে তাদের প্রতিনিধিরা আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা শান্তি চান বলেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে আক্রমণ ও ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা আমাদের কাছে নতুন কিছু মনে হচ্ছে।
শান্তি আলোচনা স্থগিত ঘোষণা : বান্দরবানে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে শান্তি কমিটির শান্তি আলোচনা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা। গতকাল সকালে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সভা কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য ২০২৩ সালের ২৯ মে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নেতাদের উপস্থিতিতে অরুণ সারকী টাউন হলে মতবিনিময় সভা আয়োজন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ৯ জুন স্থানীয় নেতাদের সমন্বয়ে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফর মধ্যে কয়েক দফা ভার্চুয়াল মিটিংয়ের পর উভয় পক্ষের মতামতের ভিক্তিতে সরাসরি সংলাপে বসার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়।
২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর এবং পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৫ মার্চ দুই দফা সরাসরি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। উভয় সংলাপে কেএনএফর সকল প্রকার সশস্ত্র কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা ও অন্যান্য বিষয়সংক্রান্ত দুটি সমঝোতা স্মারক সম্পাদিত হয়। কিন্তু তারা সম্পূর্ণভাবে চুক্তি ভঙ্গ করে বিভিন্ন সময় সশস্ত্র কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। কমিটির তরফ থেকে এ বিষয়টির ব্যাপারে বারবার অবগত করা হলেও তারা কর্ণপাত করেনি। বরং বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সময় স্থানীয়দের ওপর হামলা, চাঁদাবাজি, অপরহণসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে গেছে।
সর্বশেষ গত ২ এপ্রিল রুমায় তারাবি নামাজিদের ওপর বর্বরোচিত হামলা, সরকারি কর্মকর্তা ও পথচারীদের জিম্মি করে হামলা, অর্থ লুটের উদ্দেশ্যে সোনালী ব্যাংকে হামলা, ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ১৪টি অস্ত্র লুট করে নেয়া এবং ৩ এপ্রিল থানচি উপজেলায় স্থানীয়দের জিম্মি করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ ও দুটি ব্যাংক লুট করে কেএনএফ সদস্যরা। এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানান তিনি। কয়েক দফায় চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করায় কুকি চিনের সঙ্গে শান্তি কমিটির সব শান্তি আলোচনা স্থগিতের ঘোষণা দেন তিনি।
থানচিতে জিম্মি হয়েছিল ৪০ জন : বান্দরবানের থানচিতে দুটি ব্যাংক থেকে টাকা লুট হওয়ার সময় বাধা দিতে যাচ্ছিল ওসিসহ পুলিশের একটি দল। এ সময় তাদের লক্ষ্য করে দুই দফা গুলি চালায় অস্ত্রধারীরা। তারা ব্যাংক কর্মকর্তা, ২ বিজিবি সদস্য, ৯ জন পুলিশ সদস্য ও ব্যাংকে আসা লোকজনসহ প্রায় ৪০ জনকে জিম্মি করে। পুলিশ গুলি চালালে জিম্মিদের গুলি করার হুমকি দেয়া হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ সদস্যরা বলছেন, পুলিশ ধৈর্যের পরিচয় না দিলে অনেক লাশ পড়ত। গতকাল থানচি উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের দুটি শাখার সামনে গিয়ে দেখা যায় সতর্ক পাহারায় রয়েছেন পুলিশ সদস্যরা।
থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি জসীমউদ্দীন বলেন, ব্যাংক লুটের খবর পেয়ে থানা থেকে পুলিশ ফোর্স নিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, তখন থানার প্রধান ফটকের সামনে থেকে পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই। একই সঙ্গে থানার পেছন দিক থেকেও গুলি করা হয়। পরে বিকল্প পথে পুলিশ ফোর্স নিয়ে ব্যাংকের সামনে যখন যাই, ততক্ষণে অস্ত্রধারীরা টাকা নিয়ে চলে যায়। এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, আমরা জানতে পারি দুটি ব্যাংকের ভেতরে ব্যাংক কর্মকর্তা, টাকা তুলতে আসা দুই বিজিবি সদস্য, পুলিশ সদস্য, ব্যাংকের গ্রাহকসহ ৪০ জনকে জিম্মি করে রেখেছে অস্ত্রধারীরা। এসব লোককে বাঁচাতে পুলিশ যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, থানচিতে ব্যাংকে ডাকাতির খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান বিজিবি সদস্যরা। এর ফলে রক্ষা পায় সোনালী ব্যাংকের ভল্টের প্রায় দুই কোটি টাকা। এছাড়া বিজিবির জন্য ব্যাংকের শাখা ম্যানেজার ফয়সাল হুদাকেও অপহরণ করতে পারেনি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এ বিষয়ে বলিপাড়া ব্যাটালিয়নের (৩৮ বিজিবি) অধিনায়ক লে. কর্নেল তৈমুর হাসান খান বলেন, ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক আমাদের সদস্যদের ঘটনাস্থলে যেতে নির্দেশ দেই। তারা ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সেখান পৌঁছান। এর আগেই আমাদের উপস্থিতির খবর পেয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সোনালী ব্যাংকের ভল্ট ও ম্যানেজারকে রেখে পালিয়ে যায়। সোনালী ব্যাংকের শাখা ম্যানেজার ফয়সাল হুদা বলেন, সন্ত্রাসীরা ভল্টের চাবি না পেয়ে সেটি ভাঙার চেষ্টা করে। এ সময় তারা আমাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাখে। তবে বিজিবি আসছে এমন খবর পেয়ে তারা পালিয়ে যায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়