মার্চের স্মৃতি

আগের সংবাদ

দুর্ঘটনারোধে নেই কার্যকর ব্যবস্থা : এসি রুমে বসে দুর্ঘটনা দেখেন কর্মকর্তারা > আলোর মুখ দেখে না তদন্ত প্রতিবেদন

পরের সংবাদ

মালাকারটোলা গণহত্যা : দুঃসহ স্মৃতি

প্রকাশিত: মার্চ ২৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একাত্তরের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা স্তব্ধ করে দিতে এই ঢাকা শহরে পাকিস্তানিরা নৃশংস গণহত্যা শুরু করেছিল। একের পর এলাকায় হামলা করে, মানুষ হত্যা করে পুরো ঢাকা শহরকে পাকিস্তানিরা পরিণত করেছিল মৃত্যুপুরীতে। এমনি এক মৃত্যুপুরী ছিল ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার মালাকারটোলা। রাতের অন্ধকারে মালাকারটোলার হিন্দু মহল্লায় পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালিয়েছিল।
আমি মালাকারটোলার অধিবাসী। মালাকারটোলায় আমার পৈতৃক বাড়ি। মালাকারটোলা গণহত্যায় আমি দুই ভাইকে হারিয়েছি। আমার বাবা পাকিস্তানিদের ব্রাশফায়ারের গুলি খেয়েও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। আমি নিজে পাকিস্তানিদের হামলা থেকে বাঁচতে ধোলাইখালের কাঁচা পায়খানার ময়লার মধ্যে মরার মতো পড়েছিলাম। পাকিস্তান বাহিনী ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরুর পর সবচেয়ে বেশি গণহত্যা চালিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জগন্নাথ হলে। পুরান ঢাকায় তারা বেছে বেছে হিন্দু পাড়ায় বেশি হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের মালাকারটোলার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সবচেয়ে বেশি হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
একাত্তরের ২৭ মার্চ রাতে মালাকারটোলার প্রতিটি হিন্দু বাড়িয়ে হামলা করে পাকিস্তানিরা। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে হিন্দু নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ধরে নিয়ে যায় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী লোহার পুলে। সেখানে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে তাদের। সেদিন পাকিস্তানিরা এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ১৫ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বেশ কয়েকজন আহত হন, কয়েকজন গুলির মধ্যেও মৃত্যুর মুখ থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে আসেন। সেদিনের গণহত্যার পর মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় আমার দুই ভাইয়ের নাম। আর আমার বাবা গুলি খেয়েও বেঁচে যান। এখনো সেই দুঃসহ স্মৃতি আমাকে তাড়া করে। যখনই আমি একাত্তরের কোনো ঘটনার কথা শুনি আঁতকে ওঠি, আমার ভাই হারানো আর বাবার আহত হয়ে বেঁচে যাওয়ার করুণ কাহিনি মনে পড়ে, বেদনায় ভারাক্রান্ত হয় মন।
একসময় ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র ছিল গেন্ডারিয়া। সেই গেন্ডারিয়ার একটি মহল্লা মালাকারটোলা। এ মালাকারটোলা পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী মহল্লা। সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকই বেশি। অনেক খ্যাতিমান লোক সে এলাকায় বসবাস করতেন, সাংস্কৃতিক তৎপরতাও সে এলাকায় ছিল বেশি। পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে গণহত্যা শুরু করে। ঢাকা থেকে গণহত্যা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশের শহর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জে। ঢাকায় পাকিস্তানিদের টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স। এর পরই তাদের লক্ষ্য ছিল ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত মহল্লাগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানিরা সবচেয়ে বেশি হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে হিন্দু ছাত্রদের আবাসিক হল জগন্নাথ হলে। একইভাবে তারা হামলা চালায় পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, মালাকারটোলাসহ হিন্দু মহল্লায়। পাকিস্তানিরা একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর পর ২৬ মার্চ সারাদিন পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও থানায় হামলা চালিয়ে যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে মেশিনগানের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। আমরা ভয়-আতঙ্ক আর কারফিউর কারণে বাড়ি থেকে বের হইনি। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল হলে আমি আমাদের আশপাশের এলাকা দেখতে বের হই। বিধ্বস্ত চেহারা বিভিন্ন এলাকার। শাঁখারী পট্টিতে অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখি। আমাদের বাড়ির কাছেই সূত্রাপুর থানা, সেখানে গিয়ে দেখি পাকিস্তানিদের মর্টার আর মেশিনগানের গুলিতে পুরো ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে আছে। থানার ভেতরে দেখি এক পুলিশের লাশ পড়ে আছে। পাকিস্তানি সৈন্যবোঝাই গাড়ি লোহার পুলের ওপর দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। এরই মধ্যে দেখলাম একদল লোক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে লুটপাট করছে। অন্যদিকে অসংখ্য মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে শহর ছেড়ে। শহরের এমন করুণ অবস্থা দেখে আমার মনে ভয় ধরে যায়। এরপর নিশ্চয়ই আমাদের পাড়ায়ও হামলা হবে। এমন ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে ঢাকা ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করি। ঠিক করি আগামীকালই আমরা ঢাকা ছেড়ে বিক্রমপুরের দিকে চলে যাব। এসব ভাবনা-চিন্তার মধ্যেই ২৭ মার্চ রাত নেমে আসে। রাতে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা করতে পারে ভেবে আমি পাশের এক বাড়িতে চলে যাই রাত কাটাতে। আমার বোনরাও অন্য এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বাড়িতে থেকে যায় বাবা, ভাই দুলাল ও বিপ্লব। সারা এলাকায় থমথমে, মানুষের সাড়া-শব্দ নেই, শুধু পাকিস্তান আর্মির গাড়ি চলাচলের আওয়াজ কানে আসে। সন্ধ্যা থেকে আবার কারফিউ শুরু হয়েছে। পাকিস্তান বাহিনী রাত ১১টার দিকে এসে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। দরজা ভেঙে তারা ঘরে ঢুকে আমার বাবা কালিপদ দে, ভাই দুলাল দে ও বিপ্লবকে ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তান আর্মি সবাইকে জেরা করে এবং কাপড় খুলে দেখে নিশ্চিত হয় যে, তারা সবাই হিন্দু। ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার ভাই বিপ্লব করুণ কণ্ঠে বাবার কাছে জানতে চায়, বাবা আমাদের তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। বাবা কোনো উত্তর দিতে পারেননি, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। এসব কথা বাবা পরে আমাদের বলেছেন।
মধ্যরাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনা সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় লোহারপুলে, সেখানে সবাইকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে সবার দিকে মেশিন গান উঁচিয়ে গুলি করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। গুলি খেয়ে সবাই লুটিয়ে পড়ে। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবাসহ আরো দুই-তিনজন বেঁচে যান। আমার বাবার হাতে ও বুকের পাশে গুলি লাগে, দুয়েকজনের গায়ে একেবারেই গুলি লাগেনি। তবে তারা ধোলাইখালের ময়লা পানিতে মরার মতো পড়ে থাকেন। পাকিস্তান আর্মি গুলি করার পর আহত শরীর নিয়ে আমার বাবাও মাটিতে শুয়ে থাকেন। আহত হওয়ায় তার ওঠার শক্তি ছিল না। কয়েক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর খুব ভোরে ফজর নামাজের আজানের শব্দ শুনে বাবা উঠতে চেষ্টা করেন। উঠেই তিনি দেখেন আমার ভাই দুলাল দে শুয়ে আছে পাশেই। তিনি খুব মিহি কণ্ঠে দুলালকে ডাকেন- এই দুলাল উঠ, চল পালিয়ে যাই। কিন্তু একটু পরই বুঝতে পারেন দুলাল বেঁচে নেই। এরপরই তিনি খুব ভয় পেয়ে যান। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি আস্তে আস্তে ধোলাইখালের পাড় দিয়ে হেঁটে কাছেই আমাদের পরিচিত ডা. আজিজুন্নেসার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। ডা. আজিজুন্নেসা তাড়াতাড়ি একজন লোক দিয়ে বাবাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠান।
বাবা-ভাইকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে এমন খবর পাওয়ার পর আমি যে বাড়িতে রাতে থাকতে গিয়েছিলাম সেখান থেকে পালিয়ে ধোলাইখালের দিকে চলে যাই। সেখানে নিরাপদ মনে না হওয়ায় খালের পারে কাঁচা পায়খানার নিচে ময়লার মধ্যে শুয়ে পড়ি। সেখানে ৩-৪ ঘণ্টা মরা মানুষের মতো নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকি। ভোর হলে খালে নেমে শরীর পরিষ্কার করে ভেজা কাপড়ে হেঁটে নদী পেরিয়ে জিঞ্জিরায় চলে যাই। মালাকারটোলা হত্যাকাণ্ডের পর অনেক বছর কেটে গেছে। আমার বাবা সেই গণহত্যার দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে তিন বছর বেঁচে ছিলেন।
দেখতে দেখতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেল। এই ৫২ বছরেও আমরা যারা ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার মালাকারটোলা মহল্লার অধিবাসী তারা ভুলতে পারিনি মালাকারটোলায় একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার দুঃসহ স্মৃৃতি। ৫৩ বছর ধরে সেই ভয়াবহ গণহত্যার স্মৃতি প্রতিনিয়ত আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে জীবন দিয়েও স্বাধীন দেশে শহীদের মর্যাদা না পাওয়া- সব মিলে মনে হয় কত অবহেলিত জীবন আমাদের শহীদ পরিবারগুলোর।

বাবুল দে : কলাম লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়