ঢাবি ছাত্র রহিম হত্যা মামলা : চব্বিশ বছর পর সাত জনের যাবজ্জীবন

আগের সংবাদ

ঈদযাত্রায় এবার স্বস্তির আশা

পরের সংবাদ

স্বাধীন রাষ্ট্র লাভে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসে বিরল

প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ষোড়শ শতকে ইউরোপের কতিপয় রাষ্ট্র পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন করতে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এটিকে ঔপনিবেশিক যুগ হিসেবে অবহিত করা হয়ে থাকে। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে স্পেন, পর্তুগাল, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ডসহ আরো ছোট ছোট কিছু দেশ পশ্চিম গোলার্ধের দুই আমেরিকা মহাদেশ, আফ্রিকা, এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড দখল করে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে ওইসব ভূখণ্ডের সম্পদ শোষণের মাধ্যমে নিজ নিজ দেশে এনে নিজেদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছিল। এটিকে কার্ল মার্কস ইউরোপে শক্তিশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পুঁজির আদি সঞ্চালন হিসেবে অবিহিত করেছিলেন। তবে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ ধীরে ধীরে স্বাধীনতা লাভের আকাক্সক্ষায় সংঘবদ্ধ হতে থাকে। উত্তর আমেরিকায় ব্রিটিশ কলোনির বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলন ১৭৭৬ সালে সফল হয়। ব্রিটিশরা উপনিবেশ ছেড়ে নিজ দেশে চলে আসতে বাধ্য হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। দক্ষিণ আমেরিকায় স্পেনের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা সশস্ত্র পন্থায় আন্দোলন সংগ্রাম ও যুদ্ধ করে ২০টির বেশি দেশ ১৮০৪ থেকে ১৮৩০-এর মধ্যে স্বাধীনতা লাভ করে। এভাবেই পৃথিবীতে নতুন নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটতে থাকে। এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ভাঙার আন্দোলন বিশ শতকে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এশিয়া এবং আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোথাও সশস্ত্র পন্থায় আবার কোথাও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শক্তিকে হটিয়ে একের পর এক রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে। ফরাসি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন করেই আফ্রিকা মহাদেশের বেশিরভাগ রাষ্ট্রকে স্বাধীনতা লাভ করতে হয়েছে।
ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সীমিত সশস্ত্র আন্দোলন ঘটলেও শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলন সা¤প্রদায়িক, রাজনৈতিক শক্তির অবিমৃষ্যকারিতার কারণে ভারত-পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়। পাকিস্তান নিজেই দুই অঞ্চলে বিভক্ত একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। তবে এই রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ভাবে আধুনিক রাষ্ট্রের বিশিষ্টে গড়ে তোলার কোনো আদর্শ-নীতি-কৌশল, পরিকল্পনা এর প্রতিষ্ঠাতাদের চিন্তার ধারেকাছেও ছিল না। অধিকন্তু একটি ধর্মীয় সা¤প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার আড়ালে ছিল পশ্চিম অঞ্চলের ধনী সামন্ত, আমলা, সামরিক এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কর্তৃত্বে পরিচালিত হওয়ার ছল-চাতুরিপনা। এ পর্যন্ত যেসব রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তি লাভ করেছিল তাদের বেশিরভাগই স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করলেও ব্যাপক কোনো গণহত্যা কোথাও ঘটেনি। কিন্তু ভারতবর্ষে স্বাধীনতা লাভে ইংরেজদের হাতে কিছুসংখ্যক বিপ্লবীকে প্রাণ দিতে হলেও তার চাইতে বহুগুণে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েক লাখ মানুষের জীবনহানি এবং সম্পদহানি ঘটে, মাতৃভূমি ছাড়তে হয় লাখ লাখ মানুষকে। এরপরও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি দুই অঙ্গ নিয়ে টিকে থাকতে পারেনি। না পারার কারণ ছিল পূর্ব বাংলার ওপর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। পূর্ব বাংলাকে তাদের কলোনি হিসেবে দেখা এবং এর সম্পদ লুটেপুটে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া এবং পূর্ব বাংলার জনগণকে দেশের নাগরিক হিসেবে খাটো করে দেখাসহ নানা নিপীড়ন, জেল জুলুমের মাধ্যমে এই অঞ্চলটিকে দাবিয়ে রাখা। কৃত্রিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার মানুষের ভাষা সংস্কৃতিকে বিলুপ্ত করে উর্দু ভাষায় পাকিস্তানি জাতীয়তা তৈরির অপচেষ্টা ১৯৪৭-১৯৭১ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছিল।
পাকিস্তান আন্দোলনটি ছিল সা¤প্রদায়িকতা ও স্বাধীন রাষ্ট্র চিন্তাবিরোধী একটি হটকারী ‘আন্দোলন’। প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবিরোধী স্বাধীনতার আন্দোলন ছেড়ে হঠাৎ ৪০-এর দশকে পাকিস্তান নামক একটি কল্পিত রাষ্ট্রের মরীচিকার পেছনে ছুটতে কতিপয় মুসলিম লীগ নেতা সাধারণ জনগণকে বিভক্ত করেছে, সা¤প্রদায়িক দাঙ্গায় রক্তাক্তও করেছে। কিন্তু এই পাকিস্তান ধারণাটি কেমন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ভবিষ্যতে রূপ লাভ করবে তার ন্যূনতম ধারণাই কারো ছিল না।
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আগে থেকে পূর্ব বাংলার জনগণের রায়কে ধূলিসাৎ করে দেয়ার জন্য অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যা সংঘটিত করার নীলনকশা প্রস্তুত করতে থাকে। সেভাবেই পূর্ব বাংলার সামরিক ও প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে যে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল সেটিকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য সামরিক অস্ত্রশস্ত্র এবং সামরিক বাহিনীকে গোপনে সুসজ্জিত করে। পাকিস্তানের শাসক ও রাজনৈতিক দলের নেতারা ঢাকায় এসে যে প্রদর্শনী দেখিয়ে গিয়েছিলেন তা ছিল কেবলই পাকিস্তান রক্ষার শেষ চেষ্টা। কিন্তু পাকিস্তান রক্ষার মূল চাবিকাঠি নির্ভর করেছিল ফেডারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নেয়ার ওপর। পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকে এটি গ্রহণ করেনি। ফলে ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া অপারেশন সার্চলাইটের নির্দেশনা দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন, ভুট্টো ছাড়া অন্য নেতাদের পাকিস্তানে ফিরে যান। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাসহ সব সেনা নিবাস থেকে অপারেশন সার্চ লাইট শহরগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ স্টেশন, পিলখানা ইপিআর কেন্দ্রসহ সর্বত্র আক্রমণ করা হয়। অন্য শহরগুলোতেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্বিচারে মানুষ মারতে থাকে। ঢাকা শহরে সেই রাতে আনুমানিক ৫০ হাজার মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। অবশেষে রাত দেড়টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘেরাও করে, বঙ্গবন্ধু এর আগেই স্বাধীনতার একটি ঘোষণা ইপিআরের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে দেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরও কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা শুনতে পায়। বঙ্গবন্ধু তার সহযোগীদের সন্ধ্যার পরই যা করার তা সম্পর্কে জানিয়ে দেন। এর ফলে মূল নেতৃত্ব বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। সেখানে তারা একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করার জন্য প্রথমে সরকার গঠন, মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা, প্রশাসন, প্রচার, কূটনীতি ইত্যাদিকে সুপরিকল্পিতভাবে সংঘটিত করার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে থাকেন। দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, সরকার গঠন এবং মুক্তিবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্তের খবর জানতে পেরে দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে থাকে। ভারতে পাড়ি দিয়ে সেখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে দেশে ফিরে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে লিপ্ত হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া, নারী ধর্ষণ, রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্টসহ অনেক স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। তারা পোড়া মাটি নীতি অনুসরণ করে- যা কোনো ঔপনিবেশিক শক্তিও তাদের উপনিবেশে প্রদর্শন করেনি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বর্বরতার সর্বোচ্চ নজির স্থাপন করেছিল, কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। ভারতসহ গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সব ধরনের সহযোগিতা করেছিল। ফলে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী; যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে।
বাংলাদেশকে স্বাধীনতার জন্য ২৩ লাখ মানুষের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। পাকিস্তানিরা এই গণহত্যাসহ সব অপরাধের জন্য দায়ী ছিল। তাদের এই অপরাধের অংশীদার ছিল জামায়াত, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, নেজামী ইসলাম, শান্তি কমিটিসহ বেশকিছু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকা লোকজন। ১৯৭১ সালে আমরা যদি স্বাধীনতা লাভ করতে না পারতাম তাহলে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো থেকে বের হওয়া আমাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হতো কিনা বলা মুশকিল। তবে পাকিস্তানে থাকার অর্থ হতো দারিদ্র্যের কশাঘাতে নির্মমভাবে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুবরণ করা কিংবা অর্ধাহারে-নামে মাত্র বেঁচে থাকা। আজ স্বাধীনতা দিবসে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবতে হবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আমরা কেন ১৯৪৭ সালে আবির্ভূত হতে পারিনি, আমাদের কেনো পাকিস্তানের মতো একটি পশ্চাৎপদ রাষ্ট্রের অধীনে ২৩ বছর থাকতে হলো? ১৯৭১ সালে কেন আমরা স্বাধীনতার জন্য এত রক্ত দিয়েছিলাম। আমাদের সেই সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে দূরদর্শিতা, দেশপ্রেম এবং জাতি রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ বিনির্মাণের হাল ধরেছিলেন তারাই পারতেন দেশটাকে অনেক আগেই উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি রাষ্ট্র গঠন করতে। স্বাধীনতা দিবস পালন তখনই সফল হবে যখন আমরা বিকৃত নয় স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জেনে বর্তমান সময়ে রাষ্ট্র বিনির্মাণে নিজেদের মেধা দক্ষতা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ইত্যাদিকে কাজে লাগাতে নিজেরা সচেষ্ট হব এবং নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করব।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়