ঢাবি ছাত্র রহিম হত্যা মামলা : চব্বিশ বছর পর সাত জনের যাবজ্জীবন

আগের সংবাদ

ঈদযাত্রায় এবার স্বস্তির আশা

পরের সংবাদ

স্বাধীন বাংলা বেতার এবং দুঃসাহসের সীমা

প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

যে কেউ বলবেন একাত্তরের যুদ্ধের অনেক বৈশিষ্ট্যের ভেতর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল দুটি- স্বতঃস্ফূর্ততা এবং দুঃসাহসিকতা। এই দুটি গুণই দেখতে পাওয়া যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যারা গড়ে তুলেছিলেন, সেই তরুণদের ভেতরে। তরুণরা দুঃসাহসী হয়, হতে পারে; তাদের ভেতর স্বতঃস্ফূর্ততাও থাকে। কিন্তু যে ১০ জন তরুণ একত্র হয়েছিলেন বেতার কেন্দ্রটি গড়ে তুলতে, তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা ও দুঃসাহসের উৎস ছিল অভিন্ন, সেটা হলো দেশপ্রেম।
উদ্যোগটা প্রথমে নিয়েছিলেন তিনজন। পরস্পরের পরিচিত বন্ধুই বলা চলে, বেতারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনজনই। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে। একাত্তরের ২৬ মার্চের বিধ্বস্ত ও ভয়ংকর সকালবেলাতে তারা ভাবছিলেন কী করা যায়। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রকে ব্যবহার করে স্বাধীনতার কথা প্রচার করা যায় কিনা- এ চিন্তা তাদের মাথায় এসেছিল। কিন্তু কেন্দ্রটি শহরের একেবারে ভেতরে। পাকিস্তানি হানাদাররা সহজেই আক্রমণ করতে পারবে এই বিবেচনা থেকে শহরের বাইরে কালুরঘাটে গিয়ে সেখানকার ট্রান্সমিটারটি ব্যবহার করবেন বলে ঠিক করেন। কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। ছিল অত্যন্ত কঠিন ও ভয়ংকর দুঃসাহসিক। কী ঘটতে যাচ্ছে, তা জানা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ তখন শুরুই হয়নি। কোথাও বিদ্রোহের কোনো ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা ছিল না। সবটাই ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিভ্রান্তিকর। এরই ভেতর তারা নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে বেতার কেন্দ্র চালু করবেন। অন্য কয়েকজন এসে যোগ দিয়েছিলেন; কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল দশ। তবে তারা যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করতে যাচ্ছেন, সেটা তারা জানতেন।
কী প্রচার করবেন, সে বিষয়ে মোটেই পরিষ্কার ছিলেন না তারা। সবটাই ছিল অগোছালো। আসলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের গোটা ব্যাপারটাই ছিল অত্যন্ত অগোছালো। পূর্বপরিকল্পনা ছিল না, প্রস্তুতিও ছিল না। প্রতিরোধ যা ঘটেছে, তার সবটাই স্বতঃস্ফূর্ত ও পরস্পরবিচ্ছিন্ন। লোকে ব্যারিকেড তৈরি করেছে, অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছে, ক্যান্টনমেন্ট কাছে থাকলে সেদিকে ছুটে গেছে, গ্রামের মানুষ শহরত্যাগী মানুষদের সাহায্য করেছে এবং কেউই ভেবে পায়নি ঠিক কী করতে হবে। ব্যর্থতা ছিল নেতৃত্বের। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে কোনো প্রকার কর্তব্যনির্দেশ ছিল না। স্থানীয় নেতারা ছিলেন বিভ্রান্ত, তারা অনেক কিছু করবেন ভেবেছেন; কিন্তু কীভাবে করবেন, কোনটা আগে কোনটা পরে, কাকে দিয়ে কোন কাজ হবে- এসব ঠিক করতে পারেননি। ৭ মার্চের পর থেকে বেতারের কর্মীরা ‘রেডিও পাকিস্তান’ নামটি ফেলে দিয়ে স্থানীয় বেতার কেন্দ্র বলে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিলেন। নির্দেশ পেলে তারা হয়তো আরো এগোতেন; কিন্তু নির্দেশ আসেনি।
কালুরঘাটে তারা বেতার কেন্দ্র চালু করেছিলেন, কারো কাছ থেকে কোনো নির্দেশ বা পরামর্শ পাননি; ঘরসংসার আত্মীয়স্বজন ছেড়ে দিয়ে তারা চলে এসেছিলেন ভেতরের তাড়নাতে। স্বতঃস্ফূর্ততার ভেতর যে অগোছালোপনা থাকে, সেটা তাদের কাজের মধ্যে ছিল। তবে তাদের ওপরে যে কর্তৃত্ব করবার মতো কেউ ছিল না, সেটার সবটাই যে ছিল অসুবিধার ব্যাপার তাও কিন্তু নয়, তার একটা ভালো দিকও ছিল। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছেন। পরবর্তী সময়ে তাদের এই স্বাধীনতাটা খর্ব হয়েছে। প্রথমে খর্ব করেছেন কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত সরকারি কর্তৃপক্ষ, পরে সরাসরি না হলেও চোখ রেখেছে ভারত সরকার।
আওয়ামী লীগের হস্তক্ষেপটা ছিল আরো স্পষ্ট। চট্টগ্রামে থাকতে তাদের এক নেতা নিজের কণ্ঠে স্বাধীন বাংলা বেতারে ঘোষণা প্রচার করে গেছেন। কিন্তু বেতারের কর্মীরা কোথায় থাকবেন, কীভাবে থাকবেন সে নিয়ে কোনো প্রকার আগ্রহ প্রকাশ করেননি। পরে অবশ্য তিনি কৃতিত্ব দাবি করেছেন যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নাকি তার উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যুদ্ধটাকে জাতীয় যুদ্ধ হিসেবে না দেখিয়ে আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধ হিসেবে প্রচারের কথা বলা হয়েছিল। বেতার কর্মীদের আপত্তির দরুন সেটা করা সম্ভব হয়নি। কথিকা প্রচারকদের তালিকা এবং কথিকার পাণ্ডুলিপি পূর্ব-অনুমোদনের প্রথাটা অবশ্য চালু করা সম্ভব হয়েছিল। যুদ্ধটা ছিল প্রকৃত অর্থেই জনযুদ্ধ। কিন্তু জনযুদ্ধ শব্দটির ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। অজুহাত এই যে শব্দটি মাও সে তুং ব্যবহার করতেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ নামে একটি সিগনেচার টিউন ব্যবহার করা হতো। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সেটা এসেছিল। নভেম্বরের দিকে, যুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পরিণতির অভিমুখে এগোচ্ছে তখন, সেটা বাদ দিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ ব্যবহার করার নির্দেশ এসেছিল। আগের গানের আপত্তির কারণ ছিল এই, ওর শেষ পঙক্তি ক’টি ছিল এই রকমের- ‘ভুখা আর বেকারের মিছিলটা যে ঐ/ দিন দিন শুধু বেড়েই যাবে/ রোদে পুড়ে জলে ভেসে অসহায় হয়ে/ ফুটপাথে তারা ঠাঁই পাবে।’ দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে এসময়ে এসব অলুক্ষণে কথা কেন, তাও আবার স্বাধীন বাংলা বেতারে? চলবে না, চলেনি।
চরিত্রগতভাবে যুদ্ধটা জনযুদ্ধ হলেও এতে সবার অংশগ্রহণের কিন্তু সুযোগ ছিল না। যে ১০ জন দুঃসাহসী তরুণ যোদ্ধা বেতার কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাদের কারোই কোনো দলীয় পরিচয় ছিল না। তারা আওয়ামী লীগের ছিলেন না, বামপন্থি দলগুলোর কোনোটির সঙ্গেই তাদের সংশ্রব ছিল না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগ না থাকাটা তবু যা হোক সহনীয় ছিল, বামপন্থার দিকে ঝোঁক যদি কারো ব্যাপারে সত্য হতো তবে তিনি অসুবিধায় পড়তেন। অন্ততপক্ষে তাকে সরে দাঁড়াতে হতো, যেমন হয়েছিল মোজাফ্ফর ন্যাপের কর্মীদের। তাদের ৫০০ কর্মী আগরতলায় অপেক্ষায় ছিলেন, প্রশিক্ষণ নেবেন এবং যুদ্ধে যাবেন এ আশায়। কিন্তু প্রশিক্ষণের জন্য তারা গৃহীত হননি। পরে তাদের স্বতন্ত্র ক্যাম্পে থাকতে দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ যেটুকু পান তাও স্বতন্ত্রভাবে। আর সেটাও সম্ভব হয়েছে সিপিআইর সহযোগিতার কারণে; সিপিআইর পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল। তারা আরও ব্যাপক উদ্দীপনা ও আশা-ভরসা সৃষ্টি করতে সমর্থ হতো। দুর্ভাগ্যক্রমে তেমনটা ঘটেনি। কেন যে ঘটল না, তার একটি উল্লেখ বেলাল মোহাম্মদের বই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’তে পাওয়া যাচ্ছে। উল্লেখ্য, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যারা সক্রিয় ছিলেন, তাদের ভেতর বেলাল মোহাম্মদই ছিলেন সবচেয়ে এগিয়ে। তার বইতে বলা হচ্ছে, বামপন্থি নেতাদের একাংশ চেষ্টা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় ঐক্য গড়বার পথে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বামপন্থিরা সবাইকে একটি ঐক্য ফ্রন্টে মিলিত করতে। কিন্তু জানা গেছে, চীনপন্থিদের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট গড়তে মণি সিংহ রাজি হননি। ‘কারণ তাতে দেবীর সায় নেই।’ বোঝাই যাচ্ছে দেবী হচ্ছেন ইন্দিরা গান্ধী।
স্বাধীনতা পেলে উদ্ভাবনীশক্তি কেমন বিকশিত হতে পারে, সেটা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মীদের কাজের ভেতর সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে। নিজেদের কর্মস্পৃহার বাইরে তাদের জন্য কোনো বস্তুগত সমর্থন ছিল না। বেতারের ব্যাপারে তাদের যে অভিজ্ঞতা সেটাও ছিল পাকিস্তানি বেতার কেন্দ্রে কাজ করারই। তারা অভ্যস্ত ছিলেন পাকিস্তানি চিন্তাধারার প্রচারে। হঠাৎ করেই তাদের অবস্থান নিতে হয়েছিল সম্পূর্ণ উল্টো। এরই মধ্যে তারা দ্রুতগতিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সেসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছেন। যেমন নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে হবে। কোথা থেকে প্রচার হচ্ছে শত্রæপক্ষ সেটা যেন না জানতে পারে তার ব্যবস্থা করা দরকার হবে। শুরুতে একজন মহিলা ঘোষিকা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিতে চেয়েছিলেন তাদের সঙ্গে। তাকে তারা সঙ্গে নিতে পারেননি; পাছে রক্ষণশীল শ্রোতারা বিরূপ হয়। সম্প্রচার কেন্দ্রটি ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। রক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য ২৭ তারিখেই তারা পটিয়াতে জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে সহায়তা চেয়েছিলেন। জিয়া ইতোমধ্যেই তাদের অনুষ্ঠান শুনেছেন; তাই তাদের পেয়ে অত্যন্ত উৎসাহিত হয়েছিলেন। নিজ বাহিনীর কিছু সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে চলে এসেছেন কালুরঘাটে। ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছে, পাহারার ব্যবস্থাও করা গেছে। বেলাল মোহাম্মদ দেখলেন যুদ্ধটা যেহেতু সশস্ত্র তাই সেনাবাহিনীর কাউকে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করলে ভালো হয়। জিয়াকে তিনি বলেছিলেন, আমরা তো সবাই মাইনর, মেজর হিসেবে আপনিই বরঞ্চ স্বকণ্ঠে কিছু বলুন। তার বলার ভেতর কিছুটা কৌতুক ছিল, জিয়া কথাটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে নিজের হাতে লিখে, নিজের পরিচয় দিয়ে, স্বকণ্ঠে স্বাধীনতার একটি ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। কথাগুলো তিনি ইংরেজিতে লিখেছিলেন এবং নিজের নামেই ঘোষণা দিতে চেয়েছিলেন। বেলাল মোহাম্মদের পরামর্শে ড়হ নবযধষভ ড়ভ ড়ঁৎ মৎবধঃ হধঃরড়হধষ ষবধফবৎ ইধহমধনধহফযঁ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ যোগ করে দিলেন। সেটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সংশোধন। পরে বক্তব্যটি বাংলা অনুবাদ প্রচার করা হয়েছে। সংবাদ বুলেটিনেও কাভারেজ দেয়া হয়েছে জিয়াউর রহমানের বিবৃতি হিসেবে। ওই বিবৃতি ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী। প্রতিক্রিয়া ঘটেছে বৈদ্যুতিক। সবাই যে শুনতে পেয়েছে তা নয়, কিন্তু যারা শুনেছে তাদের কাছ থেকে অন্যরা শুনেছে। জনে জনে ছড়িয়ে দিয়েছে। বিদেশি বেতারেও সেটি প্রচার পেয়েছে। বিদেশে বাঙালিরাও জানতে পেরেছে। বিলেতে মেজর জিয়াকে কেউ কেউ মেজর জিয়া খান বলেও মনে করেছে। সর্বত্র আশার সঞ্চার হয়েছে। প্রতিরোধ জোরদার হয়ে উঠেছে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়