ঢাবি ছাত্র রহিম হত্যা মামলা : চব্বিশ বছর পর সাত জনের যাবজ্জীবন

আগের সংবাদ

ঈদযাত্রায় এবার স্বস্তির আশা

পরের সংবাদ

মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি সেক্টর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৬, ২০২৪ , ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের পর প্রবাসী সরকার কাজ শুরু করে। ১৯ এপ্রিল এই সরকারের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে আব্দুল মান্নানকে মন্ত্রী পদমর্যাদায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ২৪ মে দুটি রেকর্ডার মেশিন এবং মাত্র ১টি মাইক্রোফোন দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে কলকাতার ২৫ মাইল দূরে ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রে কুরআন তেলাওয়াত ও বক্তৃতার মাত্র ১০ মিনিটের প্রচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতারের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। মিডিয়াম ওয়েভ ৩৬১.৪৪ মিটার ব্যান্ডে সেকেন্ড প্রতি ৮৩০ কিলোসাইকেলে প্রতিধ্বনিত হয় এটি। শুরুতে কেন্দ্রটিকে বেশ সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অত্যধিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘চরমপত্র’। এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের গান, যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ, রণাঙ্গনের সাফল্য কাহিনি, সংবাদ বুলেটিন, ধর্মীয় কথিকা, বজ্রকণ্ঠ, নাটক, সাহিত্য আসরসহ আরো কিছু অনুষ্ঠান পরিধি বাড়তে বাড়তে দৈনিক ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত নিয়মিত প্রচার হতো। আর এই বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠ সৈনিক ছিলাম আমি। যার জন্য আজ নিজেকে গর্বিত মনে করি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যতগুলো সেক্টর যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, তার মধ্যে আরেকটি সেক্টর ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। কারণ এই বেতার কেন্দ্রটি যদিও কোনো সেক্টরের আওতায় ছিল না, তবুও কেন্দ্রটি একটি সেক্টরের মতই কাজ করেছে। যুদ্ধ কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে পাক হানাদারকে পর্যুদস্ত করছে, কোন ব্রিজ বা কালভার্ট উড়িয়ে দিচ্ছে, কোন এলাকা দখল হয়েছে- তার সবই জানা সম্ভব ছিল এই বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে। শুধু যে এসব খবর তারা পেত তা নয়, একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কর্মীদের, গেরিলাদের ও আপামর জনসাধারণকে আশার আলো দেখিয়ে যাচ্ছিল এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।
এই বেতার কেন্দ্রে তখন প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যথার্থ না থাকলেও কেন্দ্রে প্রত্যেকের উদ্যমতা ছিল। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটির দোতলার ছোট কক্ষটিতে (যেখানে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থাকতেন) দুটি ভাঙা টেপরেকর্ডার, সীমিতসংখ্যক বাদ্যযন্ত্র, কতিপয় যন্ত্রশিল্পী, চাদর টানানো রেকর্ডিং রুমেই চলে রেকর্ডিং কাজ। দুটি কক্ষে গাদাগাদি করে প্রায় ৭০ জন রাতযাপন করতাম। এই বেতার কেন্দ্রই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।
৯ মাস সম্মুখ মুক্তিযুদ্ধে দেশের অজস্র বীর সন্তান জীবন অকাতরে করেছেন দান। অবিস্মরণীয় তাদের এ অবদান। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতায় জীবনকে তুচ্ছ ভেবে শত্রæর মোকাবিলায় তারা অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। এমনও কিছু মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা অস্ত্র হাতে তুলে নেননি; কিন্তু তাদের কণ্ঠ, তাদের আওয়াজ মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের মুক্তি সেনানীদের, আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় জনগণকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সফলতায় ভূমিকা রেখেছেন। দেশকে স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন তারা হলেন- স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা।
বাংলার পবিত্র মাটি থেকে পাকিস্তানি জল্লাদবাহিনী বিতাড়িত করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি যে যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সাহস জুগিয়েছে; জুগিয়েছে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিকে অনুপ্রেরণা এবং হানাদার বাহিনীকে সর্বক্ষণ রেখেছে ভীতসন্ত্রস্ত তা হলো ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’। আর এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনা করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে পাক সরকারের দখলকৃত এলাকার ৬টি বেতার কেন্দ্র থেকে অবিরাম প্রচণ্ডভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে ভয়াবহভাবে মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জবাব দেয়া হয়েছে একমাত্র বেতার কেন্দ্র থেকে। মুক্তিযুদ্ধ বিরুদ্ধ অপপ্রচারের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল শক্তিশালী একটি প্ল্যাটফর্ম। প্রয়াত কামাল লোহানী বলেন, ‘আমাদের জন্য বেতার ছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধক্ষেত্র, যার মাধ্যমে আমরা জনগণের সাহস বাড়াতে সহায়তা করেছিলাম।’
প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র সংগঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম বেতারের দশজন নিবেদিত কর্মী (দুজন বেতার কর্মী ছিলেন না), স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, জনগণ এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহযোগিতায়। এই বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ১০ জন সার্বক্ষণিক সংগঠক ছিলেন সর্বজনাব বেলাল মোহাম্মদ (উক্ত বেতারের তৎকালীন নিজস্ব শিল্পী), আব্দুল কাশেম স›দ্বীপ (ফটিকছড়ি কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল), সৈয়দ আব্দুল শাকের (চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন বেতার প্রকৌশলী), আব্দুল্লাহ আল ফারুক (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), মোস্তফা আনোয়ার (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), রাশেদুর হোসেন (তৎকালীন টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট), আমিনুর রহমান (তৎকালীন টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট), শারফজ্জামান (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর), রেজাউল করিম চৌধুরী (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর) এবং কাজী হাবিব উদ্দিন (ইনি বেতার কর্মী ছিলেন না) স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুনে উদ্বুদ্ধ হয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যুদ্ধে যাব। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান করব। ২৫ মার্চের কালরাতের পর থেকেই চেষ্টা করছিলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য, প্রতিদিনই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। ইতোমধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন শুরু হয়েছে। ১৯৭১ সালের জুন মাস মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তখনই কোনো এক ভোররাত, ঘুম থেকে উঠলাম। ঘরে মা, বাবা, ভাই-বোন, খাটে মশারি টাঙানো। পরনের কাপড়েই বেরিয়ে গেলাম, ঘরের কাউকে কিছু না বলে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এবং সেখানে রেকর্ডকৃত বেশিরভাগ গানেই আমার কণ্ঠ আছে। এই সময় পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, নোঙর তোলো তোলো, ও আমার দেশের মাটি, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ইত্যাদি দেশের গান গাওয়া হতো দল বেঁধে। কলকাতায় ক্যাম্পে প্রখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে আমরা গান গাইতাম। স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী হরলাল রায় আমাকে দিয়ে একটি দ্বৈত সংগীত গাওয়ালেন নাসরিন আহম্মদ শীলু আপার সঙ্গে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি, তখন তিনি ইংরেজি সংবাদ পাঠ করতেন)। গানটির কথা ছিল- ‘জ্বলছে জ্বলছে প্রাণ আমার দেশ আমার’। গানটি লিখেছিলেন গীতিকার শহিদুল ইসলাম। এই গানটি ছিল আমার গাওয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রথম দ্বৈত সংগীত। গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারের দিন প্রথম বারের মতো আমার নাম ঘোষণা করা হয়। দিনটি ছিল ২১ অক্টোবর ১৯৭১, দ্বিতীয় অধিবেশনে গানটি প্রচার হয় এবং সেই দিনই আমার বাবা-মা বাংলাদেশে থেকে জানতে পারেন আমি জীবিত আছি, এটা আমার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করেছে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি যখন পাক-হানাদার বাহিনীর আক্রমণে দিশাহারা, শোকাতুর, কামানের গোলায় পুলিশ লাইন ভস্মীভূত এবং যখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআরের কিছু বঙ্গশার্দুল সম্পূর্ণ অন্ধভাবে স্ব স্ব দায়িত্বে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন, অন্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রতিরোধ সংগ্রামে, ঠিক তখনই জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। এই বেতার কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান শোনামাত্র বহু বাঙালি অশ্রæ সংবরণ করতে পারেননি। সে অশ্রæ ছিল আনন্দের, স্বস্তির, গৌরবের। বাঙালি আবার উঠে দাঁড়াল গভীর আত্মবিশ্বাসে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা পেলেন শত্রæর ওপর আঘাত হানার নতুন প্রেরণা।
ইথারে ভেসে আসা শব্দ যে বুলেটের চেয়েও শক্তি নিয়ে শত্রæর বিরুদ্ধে আঘাত হানতে পারে তার প্রমাণ হচ্ছে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’, ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে টিক্কা-নিয়াজী- ফরমান আলীর পাক-পশুরা সেদিন বুলেট-বেয়নেট দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হাতিয়ারের চেয়ে শক্তিশালী আঘাত হেনেছে নরপশুদের বিরুদ্ধে। মুজিবনগর সরকার নিজস্ব পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্রের গুরুত্ব অনুধাবন করে ভারত সরকারের সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে। প্রাপ্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ১৯৭১ সালের ২৫ মে মুজিবনগর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যক্রম শুরু করে, যা ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই অবদানের কথা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি এই বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী কলা-কুশলীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি ও যুদ্ধে তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয় ও সব পর্যায়ে সমাদৃত।
১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে মুক্তিয্দ্ধু ব্যাপক আকার ধারণ করতে শুরু করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ও প্রচার-প্রচারণাও বাড়তে থাকে দুর্বার গতিতে। এর মধ্যে কিছু কিছু অনুষ্ঠান বাঙালিদের মনে একটা জাগরণ সৃষ্টি করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নেতৃবৃন্দের ভাষণ ৭ কোটি বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনে আশার আলো সঞ্চার করেছিল। এই বেতার কেন্দ্র দীর্ঘ ৯ মাস অমিত তেজ ও তেজস্বিনী ভাষা আর দৃপ্তকণ্ঠে দুর্বার অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে বাংলা ও বাঙ্গালীর অতন্দ্রপ্রহরী ‘মুক্তিযোদ্ধাদের’ সার্বক্ষণিত অনুপ্রেরণা, শক্তি ও সাহস দিয়ে দিশেহারা মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষের ওপর নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে। এদিন তারা প্রথমেই গ্রেফতার করে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি গ্রেপ্তারের আগ মুহূর্তে বাংলার স্বাধীনতাকে ঘোষণা করেন। তার ঘোষণার পর দেশে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধে যোগদান এবং বর্বর খুনিদের হাত থেকে রক্ষার জন্য অসংখ্য মানুষ দেশ ত্যাগ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাই আমিও বসে থাকতে পারিনি। যোগাযোগ করতে থাকি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জনের সঙ্গে। ইতোমধ্যে সংবাদ পেলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। সংবাদ পেয়ে কলকাতা চলে যাই আগরতলা থেকে। সেখানে গিয়ে খোঁজ পেলাম জব্বার ভাই, আপেল ভাই, সমর দা, রবিন, লতা প্রমুখের। এদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা আমাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করতে উৎসাহিত করে। কারণ আমরা তখন এক সঙ্গেই গান-বাজনা করতাম এবং আমাদের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক ছিল। আমিও বহু কষ্ট করে কুমিল্লার দাউদকান্দি-আড়িখোলা হয়ে সীমান্ত পারি দিয়ে ভারতের আগরতলা পৌঁছাই। সেখানে গিয়েই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ি। তখন মাত্র ১৮ বছর বয়সের তারুণ্য উদ্দীপ্ত যুবক ঢাকা ডেন্টাল কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। এই বয়সে নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াটাই স্বাভাবিক।
বর্তমান বাংলাদেশ সরকার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শব্দসৈনিককে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মাননা ও স্বীকৃতিই দিয়েছেন, তাদের জন্য ভাতাও বরাদ্দ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে জানাই আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া অনেক গৌরবের ও বীরত্বের। এই বীরত্ব দেশমাতৃকার অস্তিত্বের লড়াইয়ে একজন সৈনিক হিসেবে।
বস্তুতপক্ষে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটির মূল পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধু আগেই ভেবে রেখেছিলেন। কারণ ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নুরুল উল্লাহকে ডেকে নেন এবং তাকে গোপনে একটি বেতার যন্ত্র তৈরি করার নির্দেশনা দেন। উদ্দেশ্য ছিল ঐ বেতার যন্ত্র দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করা। পরবর্তীতে সত্যি সত্যিই এইরকম বেতার যন্ত্র থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতারের সৃষ্টি হলো, যা ৭ কোটি মানুষকে যুদ্ধের ৯টি মাস উৎসাহ, উদ্দীপনাই শুধু নয়, যুদ্ধকেও বেগবান করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে এর জয় সুনিশ্চিত করেছে। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাস মুছে যাবে না। এর ইতিহাস সংরক্ষণ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আজকের দিনে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ব্যবহৃত সব যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রসংগীতে ব্যবহৃত সব বাদ্যযন্ত্র সংরক্ষণের সঙ্গে সব শিল্পী কলাকুশলী ও ইঞ্জিনিয়ারদের যথাযথ মূল্যায়ন হবে এবং তাদের স্মৃতিসহ সব দলিল জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত হবে।

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়