নৌপথ ও বন্দরগুলো ঠিক আছে কিনা তা লক্ষ্য রাখতে হবে : নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী

আগের সংবাদ

গুরু পাপের লঘুদণ্ড!

পরের সংবাদ

ভারতের নির্বাচনে মুসলমান সমাজ কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে?

প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ঘোষণা হয়ে গেল। ৭ দফায় এই নির্বাচন হবে। ১৯ এপ্রিল শুরু, ১ জুন শেষ। ৪৭ দিন সময় লাগবে এই নির্বাচন সম্পূর্ণ করতে। এ বারে লোকসভা ভোটে ‘মিশন ৪০০’ লক্ষ্য নিয়ে লড়তে নেমেছে বিজেপি শিবির। তাদের সেøাগান, ‘অব কি বার, ৪০০ পার’। প্রধানমন্ত্রী মোদি সংসদে দাবি করেছেন লোকসভার ৫৪৩ আসনের ভোটে বিজেপি একাই ৩৭০টি আসনে জিতবে। তার দাবি, এনডিএ শরিকদের নিয়ে সেই সংখ্যা ৪০০ পেরোবে। ওদিকে মোদিকে ঠেকাতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ‘ইন্ডি’ জোট তৈরি করেছিল বিরোধীরা। ইতোমধ্যেই তারা ছত্রভঙ্গ। কংগ্রেস বলেছিল এবারের লোকসভা নির্বাচন হবে ‘মতাদর্শের যুদ্ধ’। ইতোমধ্যে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ‘ইন্ডি’ ব্লক থেকে বেরিয়ে এসেছেন এবং পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন যে, লোকসভা নির্বাচনে টিএমসি একা লড়বে। বিজেপি তাদের গত নির্বাচনে দেয়া সব নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি পাকন করেছেন। সে তিন তালাক বিল হোক, রাম মন্দির নির্মাণ হোক বা নাগরিক সংশোধনী বিল লাগু করা হোক। বিরোধীরা আদৌ কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। বিজেপি সফলভাবে একটার পর একটা জনস্বার্থ প্রকল্প চালু করে পৌঁছে গেছে আম নাগরিকের ঘরের অন্দরে। সেখানে কংগ্রেস রাহুল গান্ধীকে মুখ করে জনসংযোগ যাত্রা করেছে, যার নিটফল কিছুই হয়নি। বিরোধী দলগুলো এই ‘ইন্ডি’ জোট কেন গঠন করেছিল? তাদের হিসাব ছিল সরল পাটিগণিতের। তাদের বক্তব্য ছিল, বিজেপি গত লোকসভা নির্বাচনে সারাদেশে গড়ে ৩৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে বিরোধীদের ভোট বেশি। কিন্তু সরল ঐকিক নিয়মে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ভোট হয় না। যেমন কেরালায় গত নির্বাচনে বিজেপি ভোট পেয়েছিল মাত্র ১৫ শতাংশ, তামিলনাড়ুতে ২, অন্ধ্র প্রদেশে ২ শতাংশ। এর ফলে সব প্রাক নির্বাচনী সমীক্ষায় প্রকাশিত হয়েছে বিজেপির বিপুল জয়ের ভবিষ্যদ্বাণী। পোলস্ট্রাট ও পিপলস ইনসাইডে, ইন্ডিয়া টিভি-সিএনএক্স, সি ভোটার- প্রত্যেকেই জানিয়েছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের আসল প্রাপ্তির সম্ভাবনা ৩৭০-এর মতো। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি গত নির্বাচনের চেয়ে ভালো ফল করবে। গত নির্বাচনে পেয়েছিল ১৮টি আসন, ২২টি আসনে জিতেছিল তৃণমূল, বাকি ২টিতে কংগ্রেস। এবার ২৩ থেকে ২৫টি আসন পাবে। কিন্তু ২০২১ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয় পায় তৃণমূল। সেখানে ফলের নিরিখে দেখা যায়, বিজেপি মাত্র ৯টি লোকসভা আসনে তৃণমূল থেকে এগিয়ে রয়েছে। আর তৃণমূল এগিয়ে রয়েছে ৩৩টি লোকসভা আসনে। তাহলে মাত্র ৩ বছরে কী এমন ঘটল যে বিজেপি এতগুলো আসনে জিতবে! ফ্যালাসিটা এখানেই। তৃণমূল কংগ্রেসের একের পর এক প্রবল দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে গত তিন বছরে। জেলবাসী হয়ে দিন কাটাচ্ছে একগাদা মন্ত্রী, নেতা ও কর্মীরা। ক্রমাগত তাদের জুটছে আদালতের ভর্ৎসনা। রাজ্যের শাসকবিরোধী বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে তুমুল কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বারবার পশ্চিমবঙ্গে এসে প্রচারের মাত্রা কয়েকশ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। এদিকে বামপন্থিরা এবং পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস তাদের হতশ্রী চেহারা প্রকাশ করেছে সমঝোতা হওয়ার ও প্রার্থী তালিকা ঘোষণার প্রশ্নে। ফলে তাদের নিজস্ব ভোটব্যাংক আজ দোদুল্যমান। পশ্চিমবঙ্গে যুদ্ধটা দাঁড়িয়ে গেছে মূলত বিজেপি বনাম তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে ভারতে নির্বাচনে জাতপাতের অঙ্ক ও ধর্মীয় মেরুকরণ চিরকালই একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে এবং যতদিন গেছে তা বেড়েছে। সমাজবিজ্ঞানী এমএন শ্রীনিবাস ১৯৫০-এর দশকে প্রথমবার ‘ভোটব্যাংক’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। শব্দটি এমন ঘটনাকে বোঝায় যেখানে স্থানীয়ভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা তাদের বর্ণ বা সম্প্রদায়ের ভোটারদের সংগঠিত করার জন্য রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বোঝাপড়া করেন। সত্তরের দশকে ইন্দিরা গান্ধীর অধীনে কংগ্রেস, পালাক্রমে, ‘ভোটব্যাঙ্ক’ হিসেবে কংগ্রেসপন্থি মুসলিম ধর্মযাজকদের কাছে যেতে শুরু করে। ক্রমে বাকিরা। এই রাজনীতির মুখ হয়ে ওঠেন দিল্লির শাহী ইমাম আবদুল্লাহ বুখারি। মুঘল শাসক শাহজাহানের সময়, জামে মসজিদের ইমামকে ইমাম-উল-সুলতান (সম্রাটের ইমাম) বা সাম্রাজ্যের শাহী ইমাম হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল, যার ফলে মসজিদের বিশাল ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব ছিল। স্বাধীনতার পরও শাহী ইমামের অতীত গৌরবের জন্য নস্টালজিয়া চলতে থাকে। ১৯৭০-এর দশক থেকে বুখারি নিয়মিতভাবে মুসলমান ধর্মের ভোটারদের কাছে ফতোয়া দিতে শুরু করেন এবং একটি বা অন্য দলের পক্ষে প্রচারণা চালাতে শুরু করেন। হিলাল হামেদের বই ‘সিয়াসি মুসলিমস’ অনুসারে, বুখারিকে ১৯৭৪ সালে কংগ্রেস তাদের বিতর্কিত পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে সমর্থন করার জন্য প্রথম যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি এর পক্ষে ফতোয়া জারি করে বাধ্য হন। ‘বাধ্য হন’ বলছি এই জন্য যে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি তাদের ধর্ম বিরোধী ছিল। কিন্তু তারপরে মুসলমানরা প্রতিবাদী হতেই সেই বছরেই তিনি ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতা শুরু করেন এবং জরুরি অবস্থার সময় গ্রেপ্তার হন। সেই রাগে ১৯৭৭ সালে তিনি জনতা পার্টির পক্ষে ফতোয়া জারি করেন। জনতা পার্টি ক্ষমতায় এলে তার প্রতিপত্তি বাড়ে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে জনতা পার্টির অন্তঃকলহ দেখে তিনি পালটি খান এবং ইন্দিরা কংগ্রেসের পক্ষে প্রচার করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি রাজীব গান্ধীকে সমর্থন করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনি আবার জনতা দলকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পরে চিত্র বদলাতে শুরু করে। ফতোয়া দেয়া বন্ধ হয়।
কিন্তু মুসলিম উলামারা বিভিন্ন রাজ্যেও মুসলমান ভোট প্রভাবিত করার খেলায় নিবিষ্ট হন। কিন্তু সত্যি কি তারা ‘মুসলিম ভোট’কে প্রভাবিত করতে পারেন? ২০১৫ সালে সালে ‘ধর্মীয় মনোভাব, আচরণ এবং অনুশীলন’ সম্পর্কিত একটি সমীক্ষায় বলা হয় যে ‘ওলামারা ঐতিহ্যগতভাবে অশিক্ষিত, দরিদ্র মুসলমানদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। যখন একজন দরিদ্র মুসলমান কোনো ব্যক্তিগত বা ধর্মীয় বিষয়ে স্থানীয় মৌলভীর কাছে যায়, তখন তারাও তাকে বলে দেন কাকে ভোট দেবেন। আরো প্রভাবশালী ওলামারা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার ওপর ভিত্তি করে বা তার নিজের স্বার্থ অনুযায়ী মৌলভীরা উত্তর দেবেন; কিন্তু এই কানাঘুষা প্রচার কিছু দলকে সাহায্য করে।’ উত্তর প্রদেশের মাওলানা সিদ্দিক বলেছিলেন ‘২০২২ সালে সালের উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে, আমরা সমাজবাদী পার্টির পক্ষে প্রচার করেছি, কিন্তু তারা জিততে পারেনি কারণ উত্তর প্রদেশে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার স্তর বৃদ্ধি ঘটেছে এবং ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে পরিচিতি হ্রাস পেয়েছে।’
২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার সময় পুরো মুসলমান সমাজ মোদি তথা বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু মোদি মুসলমানদের শিক্ষাসহ বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্পে শামিল করায় তাদের মোদি তথা বিজেপিভীতি ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে। উত্তর প্রদেশের মাওলানা সিদ্দিক বলেন, ‘এতদিন ধর্মীয় নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখার পর, মুসলমানরা এখন তাদের অবস্থার জন্যও তাদের দোষ দিতে শুরু করেছে।’ মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকের কাছে, মোদির ১০ বছরের শাসন শুধু এটা স্পষ্ট করেছে যে ভারতের মুসলমানরা নেতৃত্বহীন। বিজেপির পাসমান্ডা অর্থাৎ পিছিয়ে পড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ ধীরে ধীরে এর সুফল দিচ্ছে, এই বক্তব্য প্রায় সব মুসলিম নেতাদের। যার ফলে ২০২২ সালে উত্তর প্রদেশের বিধানসভার ১৩ শতাংশ মুসলিম ভোট বিজেপির ঝুলিতে এসেছিল যেখানে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এসেছিল ৯ এবং এবারে তাদের লক্ষ্য ১৮ শতাংশ।
পশ্চিমবঙ্গ যতই উদারতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি কপচাক না কেন, পশ্চিমবঙ্গে ভোটে ধর্ম ও জাতপাত বিরাট ভূমিকা নেয় এবং সেটা চিরকালের গল্প। কিন্তু এখন হিন্দু সংঘবদ্ধতা বেড়েছে বলে তা অনেকের কাছে দৃষ্টিকটু বলে মনে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে ৪২টা আসনের মধ্যে ১৩টি লোকসভা আসন মুসলমানদের ভোটারদের প্রভাব আছে। যদি শতাংশের হিসাব ধরি তাহলে দেখা যাক কোনো আসনে মুসলমানরা কত শতাংশ আছেন। বহরমপুর ৬৪ শতাংশ, জঙ্গিপুর ৬০, মুর্শিদাবাদ ৫৯, রায়গঞ্জ ৫৬, বসিরহাট ৪৪, মালদা উত্তর ৫০, মালদা দক্ষিণ ৫৩.৫৬, যাদবপুর ৩৩.০৪, মথুরাপুর ৩২.০৩, বীরভূম ৩৬, কৃষ্ণনগর ৩৩, ডায়মন্ড হারবার ৩৩ ও জয়নগর ৩০ শতাংশ। এর মধ্যে ভোট কাটাকাটির কারণে ২০১৯ সালে রায়গঞ্জ আসন বিজেপি পেলেও অন্য কোনো আসন তারা পায়নি। মুসলমান ভোট তাদের পক্ষে একেবারেই যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের ভোটার সংখ্যা ৭ কোটি। তার মধ্যে ২ কোটি মুসলমান ভোটার। বাকি ভোটারদের মধ্যে মতুয়া ও রাজবংশী ভোটার, মোট ভোটারের ২৩ শতাংশ অর্থাৎ ১ কোটি ৬১ লাখ। এই ভোটের বেশিরভাগই বিজেপির ঝুলিতে যায়। বিজেপি গত নির্বাচনে পেয়েছিল ৪০ শতাংশ ভোট অর্থাৎ ২ কোটি ৮০ লাখের মতো।
বিজেপির এবারের সম্ভাবনা এখানেই। বিজেপি এবারে লড়ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিয়ে, জনকল্যাণমূলক কেন্দ্রীয় প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গে চালু করার প্রতিশ্রæতিতে, দেশের প্রগতি ও উন্নয়নের ইস্যুতে। ইতোমধ্যে নাগরিকত্ব বিল চালু করে মতুয়া সমাজের অধিকাংশকে নিজেদের পক্ষে তারা এনেছেন। অনন্ত মহারাজকে রাজ্যসভায় পাঠিয়ে রাজবংশী ভোট পক্ষে এনেছেন। বাম-কংগ্রেস প্রায় রণে ভঙ্গ দেয়ায় বর্ণহিন্দুদের ৩ কোটি ৪০ লাখ ভোটকেই পাখির চোখ করবে বিজেপি। চারিত্রিকভাবে এরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও উন্নয়নকামী। এই ভোটারদের থেকে ৮০ লাখ ভোট যদি বিজেপি টানতে পারে তাহলে তাদের আসন সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে ২৫ ছাড়িয়ে অনেকটা দূরই যাবে। মুসলমান মহিলা ভোট অনেকটাই এবারে বিজেপির পক্ষে আসার সম্ভাবনা যথেষ্ট। কারণ তিন তালাক বিল লাগু হওয়া। এবার দেখার বিষয় প্রচার ও পাল্টা প্রচারের নির্যাস ভোটাররা কীভাবে নিচ্ছে। তবে সমর্থনের সুপবন এখন বিজেপির পালেই বইছে।

অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়