পুরান ঢাকায় প্রেসে আগুন

আগের সংবাদ

মৌসুমের আগেই ঊর্ধ্বমুখী ডেঙ্গু

পরের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৭, ২০২৪ , ১২:১০ পূর্বাহ্ণ

জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রীর মহান দূত তাকাশী হায়াকাওয়া (১৯১৭-১৯৮২), যিনি জাপানে ‘মি. বাংলাদেশ’ নামে খ্যাত ছিলেন, দুদেশের সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। তিনি একটানা ৪০ বছর জাপানের জাতীয় সংসদ ‘ডায়েট’-এ নির্বাচিত সদস্য ছিলেন এবং ‘ফাদার অব দ্য ডায়েট’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি তিন দফায় মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।
১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতির সংবাদে এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণ তাকাশী হায়াকাওয়ার চিন্তাচেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। জাপানের ডায়েটে প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে হায়াকাওয়া বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি জাপানি জনগণ ও সরকারের সমর্থন সম্প্রসারণের নেপথ্যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমেরিকা বলয়ের দেশ হওয়া সত্ত্বেও উন্নত বিশ্বের শিল্প সমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে জাপানই প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় হায়াকাওয়ারই প্রচেষ্টায় ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। স্বীকৃতিদানের এক মাসের মধ্যে ঢাকায় জাপানি দূতাবাসের কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৩-১৪ মার্চ হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের জাপানি সংসদীয় প্রতিনিধি দল প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসেন।
ব্রিটিশ রাজনৈতিক ইতিহাসের একজন বিদগ্ধ পাঠক ও গবেষক হিসেবে খ্যাত তাকাশী হায়াকাওয়া বাংলাদেশের মানুষের জীবন সংগ্রামের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং এ দেশের মানুষের জীবন ও মূল্যবোধে মুগ্ধ হন। যতবার তিনি বাংলাদেশ সফরে এসেছেন, এখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েছেন। তার ব্যক্তিগত এলবামে বাংলার সাধারণ মানুষের আটপৌরে ও জীবিকা অনুসন্ধানী সংগ্রামী জীবনের ছবিই বেশি। হায়াকাওয়া বাংলাদেশ সম্পর্কে তার স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ ‘Banguradesu to no Deai-Minzoku to Kokkyo wo Koette’ বা Encounter with Bangladesh -Transcending Racial and Territorial Boundaries রচনা করেন। টোকিও থেকে ১৯৮২ সালে তার জীবদ্দশাতেই এটি মূল জাপানি ভাষায় প্রকাশিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হলে তাকাশী হায়াকাওয়া অবর্ণনীয় শোকে ও বেদনায় মুহ্যমান হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ১১ দিনের মাথায় ২৬ আগস্ট টোকিওতে জাপান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন এক শোকসভার আয়োজন করে। অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সভাপতি তাকাশী হায়াকাওয়া বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেটি উপরোল্লিখিত স্মৃতিগ্রন্থে সংযোজিত হয়। মূল জাপানি ভাষা থেকে টোকিও দূতাবাসের দোভাষী মি ইসামু শিরাই ইংরেজিতে ভাষণটির যে অনুবাদ করেন তার উল্লেখযোগ্য অংশের বাংলা অনুবাদ নিচে উৎকলিত হলো:
‘আমার অন্তরঙ্গ ও অত্যন্ত সম্মানিত বন্ধু রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ছিলেন জাতির পিতা এবং জনগণ যাকে আন্তরিকভাবে বঙ্গবন্ধু বলে সম্বোধন করত, গত ১৫ আগস্ট কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা কর্তৃক সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানে, ৫৬ বছর বয়সে, সপরিবারে নিহত হয়েছেন। এই হৃদয়বিদারক সংবাদটি যখন আমি পাই তখন এক অবর্ণনীয় শোকে ও বেদনায় আমি মুহ্যমান হয়ে পড়ি।
শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল মূলত জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জন এর জন্য উৎসর্গীকৃত। তিনি নিজের জীবনকে পাখির পালকের মতো হালকা মনে করতেন। তিনি জীবনে আটবার গ্রেপ্তার হন, কারাগারে কাটান সাড়ে ১০ বছর, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর সহযোগীদের পরিবর্তে তিনি নিজেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন, সেখানে ফাঁসিতে ঝোলার দুই ঘণ্টা আগে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান, তিনি এভাবেই জাতীয় বীর হিসেবে এক সগৌরব জীবনের অধিকারী হয়ে জাতির পিতার সম্মানে সমাসীন হন।
মেধা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করে দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে ঢাকায় লক্ষ জনতার সামনে তিনি এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তার সেই বক্তৃতার ভাষা আমাকে আপ্লুত করে। এখনো তা আমার স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। তিনি বলেছিলেন, ‘যে মুহূর্তে আমি বুঝব জনগণের স্নেহ ও ভালোবাসা আমার ওপর নেই সে মুহূর্তেই আমি পদত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকব। তবে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই বাংলাদেশের সব মানুষের মুখে হাসি না ফোটানো পর্যন্ত আমি আমার জীবন উৎসর্গ করে যাব।’
দেশ ও জাতির প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ও তাঁর মন অনুধাবন করার জন্য অনেক কিছু বিচার বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে, উপর্যুপরি বন্যা, মূল্যস্ফীতি ও আরো কিছু সমস্যা, যার সঙ্গে যোগ হয় কিছু শ্রেণির রাজনৈতিক নেতার দুর্নীতি, এসব কারণে সবার মুখে হাসি ফোটানোর সেই প্রতিশ্রæতি-প্রত্যয় পূরণ না করেই স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাত্র চার বছরের মাথায় তাকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো, যদিও অনেক কিছুই এখনো স্পষ্ট নয়।
শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য লাভ ও তাঁর সঙ্গে আমার নিবিড় বন্ধুত্বের সূত্রপাত চার বছর আগে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমার ব্যক্তিগত সমর্থন-সহানুভূতি থাকায়, দেশটির স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে জাপান সরকারের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে আমি ১৯৭২ সালের ১৪ মার্চ বাংলাদেশ সফরে যাই। সেবারই আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম দর্শন লাভ করি তাঁর কার্যালয়ে। সে মুহূর্তে তিনি আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী বীর হিসেবে প্রতিভাত হননি, হয়েছিলেন একজন অতি মহান উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হিসেবে। একটা আনন্দঘন অনুপম পরিবেশে আমি তাঁর ব্যক্তিগত ঔদার্য ও মহত্ত্বে মুগ্ধ হয়েছিলাম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সে অনুরোধে যথাযোগ্য সাড়া দিতে দেশে ফিরেই আমি জাপান-বাংলাদেশ সমিতি গঠন করি এবং তাৎক্ষণিকভাবে জাপান সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশের জন্য ২ লাখ টন চালসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক সহায়তার সংস্থ’ান করি। বলার অপেক্ষা রাখে না প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এতে বিশেষ খুশি হন। আর তার প্রিয় প্রকল্প যমুনা সেতুর ব্যাপারে জাপানি কারিগরি বিশেষজ্ঞের একটি দল দুবছর ধরে সমীক্ষার কাজে নিয়োজিত আছে। এসব কারণ ও উপলক্ষে আমাদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব নিবিড় থেকে নিবিড়তর হচ্ছিল।
শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রীয় সফরে জাপানে আসেন। তাঁকে স্বাগত জানিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মি. তানাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘তিনি যেন আমাদের হিরোভূমি ইতো (হিরোভূমি ইতো জাপানের গৌরবোজ্জ্বল মেইজি যুগের প্রধান জাতীয় নেতা ছিলেন)’। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাপান চেম্ব^ার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট মি. শিগেও নাগানো তৎক্ষণাৎ বলেন, ‘না, তিনি বরং একাধারে হিরোভূমি ইতো এবং তাকামোরি সাইগো’ (তাকামোরি সাইগো ছিলেন মেইজী জাপানের আরেক অবিসংবাদিত স্থপতি)। অধিকন্তু বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে যেখানেই আমি গিয়েছি উৎফুল্ল জনতা অনাবিল উষ্ণতায় ও প্রগাঢ় ভক্তি শ্রদ্ধায় ‘বাংলাদেশের আসল বন্ধু’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আমাকে অভিবাদন জানিয়েছে। সব জায়গাতেই তারা অজস্র ফুল দিয়ে আমাকে বরণ করত, ফুলের মালায় আমার চিবুক পর্যন্ত ঢেকে যেত। আমি নিশ্চিত যে আমার প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তরিক আগ্রহ ও বিবেচনার কারণেই সর্বত্র আমার এই সম্মান ও সমাদর।
আমার মন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি কখনো মুছে যাওয়ার নয়। সারাক্ষণ তাঁর কথা আমার মনের আঙিনায় ঘোরাফেরা করে। এই মহান জননায়কের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যদিও স্বল্পকালের, মাত্র চার বছরের, এই মুহূর্তে আমি তাঁর সেই পবিত্র স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই এবং তাঁর ও তাঁর পরিবারের নিহত সদস্যদের বিদেহী আত্মার মঙ্গল কামনা করি, তাঁদের জন্য স্বর্গবাস প্রার্থনা করি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য, যাদের শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত ভালোবাসতেন, এই প্রার্থনা ও প্রত্যাশা করি তারা যেন এই দুঃখজনক মর্মান্তিক ঘটনায় দিশাহারা হয়ে অন্ধকার ভবিষ্যতের পথে না গিয়ে, তাদের দেশকে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা মতো সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে নিজের পায়ে দাঁড়াবার শক্তি ও সাহস পায়।’

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সরকারের সাবেক সচিব
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়