খালেদা জিয়া হাসপাতালে ভর্তি

আগের সংবাদ

শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা উধাও

পরের সংবাদ

সাদী মহম্মদের স্বেচ্ছামৃত্যু, আমাদের দায় ও সামাজিক দায়বদ্ধতা

প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কিছু কিছু মৃত্যু আছে, যা আমাদের চরমভাবে ভারাক্রান্ত করে; স্বজন হারানোর বেদনায় আবেগ-আপ্লুত করে; প্রিয়জন হারানোর যাতনায় আমাদের উদ্বেলিত করে। কিছু কিছু মৃত্যু আছে, যা আমাদের ‘মৃত্যু’ সম্পর্কিত দর্শনকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায়। কিছু কিছু মৃত্যু আমাদের মানতে খুব কষ্ট হয়, যা আমাদের অপরাধী করে দেয়। এসব মৃত্যু আমাদের সম্মিলিত দায়িত্বশীলতার এবং সামাজিক দায়িত্বহীনতার মাপকাঠিতে মাপার জন্য নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। এই কথাগুলো ভূমিকা হিসেবে বলছি যখন বাংলাদেশের বরেণ্য ও কিংবদন্তি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদী মহম্মদের স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে লিখতে বসেছি। কেন সাদী মহম্মদের মতো মানুষ স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বেছে নেন? কেন সাদী মহম্মদের মতো মানুষ জীবনকে পিঠ দিয়ে মৃত্যুকে বুকে আলিঙ্গন করে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি। এটা কি কেবলই ব্যক্তি সাদী মহম্মদের একার সিদ্ধান্ত? নাকি পরিবার, সমাজ এবং পারিপার্শ্বিকতার এমন একটি আবহ তৈরি করেছে, যা সাদী মহম্মদকে ভাবতে শেখায় যে ‘জীবনের চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়’ বা ‘জীবনের কাছ থেকে পালিয়ে মৃত্যুর কাছে আশ্রয় নেয়াটাই শ্রেয়’? যে সমাজ ‘জীবনের চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয়’ ভাবতে শেখায়, সে সমাজকে কেন আমরা কাঠগড়ায় দাঁড় করাব না?
আমরা নিয়মিতভাবে সংবাদমাধ্যমে স্বেচ্ছামৃত্যুর সংবাদ পেয়ে থাকি এবং এই ক্রমবর্ধমান স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনা সমাজে বিস্তার লাভ করলেও বিকারহীন সমাজের নির্বিকার অনুভূতি নিয়ে আমরা ক্রমবর্ধমান অনুভূতিহীন মানুষগুলো অনেকটা ‘মেনে নেয়ার সংস্কৃতিতে’ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। ফলে স্বেচ্ছামৃত্যুর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০২৩ সালে প্রায় ৫১৩ জন শিক্ষার্থী স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেঁচে নিয়েছে। আর স্বেচ্ছামৃত্যুর সংখ্যা বছরে প্রায় সহস্রাধিক। কিন্তু কেন? এখানে মনে রাখা জরুরি, ৫১৩ শুধু একটি সংখ্যা নয়, ৫১৩টি জীবন। স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনাকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা কেবল ব্যক্তিকে নানা শব্দপুঞ্জ দিয়ে দায়ী করতে শিখেছি: এটা করা একদম ঠিক হয়নি; এরকম ছোট কারণে কেন আত্মহত্যা করবে? কেন এরকম পথ বেছে নেবে? এরকম অবুঝের মতো কাজ কেন করল? তার কাছ থেকে এটা আশা করি নাই প্রভৃতি। এই জাতীয় শব্দপুঞ্জ ও বাক্যবিন্যাস নিয়ে আমরা স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণকারীদের দিকে আঙুল তুলি, যাকে একাডেমিক ভাষায় বলা হয় ‘ব্লেইমিং দ্য ভিকটিমস’। কিন্তু যেসব কারণে এসব স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনা ঘটে, তার মূলের দিকে আমাদের নজর ততটা মজবুত ও টেকসই নয়। ফলে সমাজে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সমাজদেহে একটা অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাক্সিক্ষত প্রবণতার ক্রমবিস্তার ঘটছে কিন্তু এর লক্ষণগুলো কী, এর উপসর্গগুলো কী এবং এর মূল কারণগুলো কী, সেটা দূরীকরণের কোনো ব্যবস্থা সমাজদেহে, সামাজিক ব্যবস্থাপনায়, সমাজ মনস্তত্ত্বে এবং সমাজনীতিতে আমরা খুব একটা লক্ষ করি না। যার ফলে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে। সাদী মহম্মদের স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনা অতীতে এরকম অনেক ঘটনার পোস্টমর্টেম করবার একটা মওকা আমাদের দিয়েছে এবং আমরা এর সমাজমনস্তত্ত্ব এবং সমাজের দায়বদ্ধতার বিষয়টি সামনে এনে একটা বিশ্লেষণ দাঁড় করাতে পারি, যাতে করে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর মতো ঘটনার সংবাদ আমাদের আর না দেখতে হয়।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, সাদী মহম্মদ একজন অত্যন্ত গুণি শিল্পী। মানুষ হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক। একজন সংগীত সাধক হিসেবে ছিলেন অনুকরণীয়। আমাদের প্রজন্মের অনেকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয়, সখ্য এবং ভাব ও ভালোবাসা হয়েছে সাদী মহম্মদের সরেলা, মায়াবী এবং অপূর্ব কণ্ঠে গান শুনে। সাদী মহম্মদ এবং তার কণ্ঠের সুরেলা রবীন্দ্রসংগীত আমাদের অনেকের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। সাদী মহম্মদ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রবীন্দ্রসংগীতে তার মূল পরিচিতি গড়ে উঠলেও আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গানেও তিনি দেশব্যাপী সমান সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ছিলেন। এ পর্যন্ত তার পঞ্চাধিক গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠন রবিরাগ প্রতিষ্ঠা করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। চ্যানেল আই ২০১২ সালে তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করে। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার। সে সাদী মহম্মদের এভাবে চলে যাওয়া খুব সহজে মেনে নেয়া যায় না। কেন সাদী মহম্মদ স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিলেন? এর পারিবারিক ব্যাখ্যা আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি। ক্লিনিক্যাল ব্যাখ্যাও জেনেছি। কিন্তু এর সামাজিক ব্যাখ্যা কী?
শিল্পীর পারিবারিক বন্ধু নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নিপা মিডিয়াকে জানিয়েছেন, ‘তার মা জেবুন্নেছা মারা যাওয়ার পর থেকেই তিনি এক ধরনের ট্রমার মধ্যে চলে যান। মানসিকভাবে ঠিক স্বাভাবিক ছিলেন না। মা হারানোর বেদনা সম্ভবত তিনি নিতে পারেননি। এভাবেই চলছিল। বুধবার দ্বিতীয় রোজা রাখলেন। ইফতারও করলেন। এরপরই তিনি নীরবে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে করছি।’ সাদী মহম্মদের ভাই নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ সাংবাদিকদের জানান, ‘বুধবার সন্ধ্যার পর হঠাৎ দেখা যায় তার ঘরের দরজা বন্ধ। কিছুক্ষণ পর দরজা ভেঙে তাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। গত বছরের ৮ জুলাই মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ মারা যান। এরপর থেকে মানসিকভাবে স্বাভাবিক ছিলেন না। মা হারানোর বেদনা সম্ভবত তিনি নিতে পারেননি’। এখানে উল্লেখ্য, একাত্তরের ২৩ মার্চ তাজমহল রোডে অবস্থিত তাদের বাড়িতে সাদী মহম্মদের আঁকা বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান তার বাবা সলিম উল্লাহ, সেই পতাকা সেলাই করে দিয়েছিলেন সাদী মহম্মদের মা জেবুন্নেছা সলিম উল্লাহ। সেই পতাকা ওড়ানোর সূত্র ধরে একাত্তরের পুড়িয়ে দেয়া হয় সলিম উল্লাহর পুরো বাড়ি; গুলি করে মারা হয় সলিম উল্লাহকে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে সলিম উল্লাহ রোড সাদী মহম্মদের বাবা শহীদ সলিম উল্লাহর নামে। এরকম একটি পরিবারের সন্তান সাদী মহম্মদ আজ স্বেচ্ছামৃত্যুকে বরণ করে ‘না ফেরার দেশে’। ২০২৩ সালের ৮ জুলাই ৯৬ বছর বয়সে সাদী মহম্মদের মা জেবুন্নেছা সলিম উল্লাহর মৃত্যু হয়। জেবুন্নেছা প্রায় ১৫ বছর ধরে চলনশক্তিহীন ছিলেন, চলাফেরা করতেন হুইল চেয়ারে। মায়ের এই শারীরিক অক্ষমতা তাকে ভীষণ পীড়া দিত। তিনি বিভিন্ন সময় এ কথা আত্মীয়-পরিজনকে এবং মিডিয়ায়ও বলেছেন। মার সঙ্গে তার সখ্য ছিল নিবিড়। তাই মায়ের মৃত্যুর পর তিনি আরো মুষড়ে পড়েন এবং ভেঙে পড়েন। একটা ট্রমার ভেতর জীবন-যাপন করছিলেন সাদী মহম্মদ। ফলে তার স্বেচ্ছামৃত্যুর পারিবারিক ব্যাখ্যা আমরা পেয়েছি। সাদী মহম্মদের ‘না ফেরার দেশে যাওয়ার’ ক্লিনিক্যাল ব্যাখ্যা হচ্ছে, যা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চিকিৎসক সাগতিক লোহানি মিডিয়াকে জানিয়েছেন, ‘তার গলায় দাগ পাওয়া গেছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে নিজ কক্ষ থেকে তাকে উদ্ধার করেন পরিবারের সদস্যরা। রাত সাড়ে ৯টার দিকে হাসপাতালে আনা হলে আমরা তাকে মৃত পাই। প্রাথমিক সিদ্ধান্তে আমরা এটাকে আত্মহত্যা হিসেবে মনে করছি’। ক্লিনিক্যাল ব্যাখ্যাও পারিবারিক ব্যাখ্যাকেই সমর্থন করে। কিন্তু এর সামাজিক ব্যাখ্যা কী?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সাদী মহম্মদের মতো মানুষ যখন ডিপ্রেশনে চলে যান, সাদী মহম্মদের মতো মানুষ যখন একাকিত্ব ভোগ করেন, সাদী মহম্মদের মতো মানুষ যখন নিঃসঙ্গতা নিয়ে জীবনযাপন করেন, তখন আমাদের কী কোনো দায় নেই একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে, একজন শিল্পীকে এবং একজন বিরল কণ্ঠের প্রতিভাকে ডিপ্রেশন থেকে বের করে আনার? সমাজের কি কোনো দায়-দায়িত্ব নেই, তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর? রাষ্ট্রের কি কোনো দায়-দায়িত্ব নেই একজন শিল্পীর বেঁচে থাকার উপাদানের জোগান দেয়ার? সাদী মহম্মদের ডিপ্রেশন, একাকিত্ব এবং নিঃসঙ্গতা দূর করার কোনো উদ্যোগ কি আমরা সামাজিকভাবে নিয়েছি? সাদী মহম্মদের গান আমাদের কত শত মানুষের একাকিত্বের সঙ্গী হয়েছে, নিঃসঙ্গতাকে দূর করেছে কিন্তু সাদী মহম্মদের একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা এবং ডিপ্রেশানকে কী আমরা দূর করতে পেরেছি? সমাজের কি কোনো দায় নেই একজন শিল্পীর ডিপ্রেশন থেকে তাকে তুলে এনে একটা স্বাভাবিক জীবন দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করার? সমাজের কি কোনো দায় নেই স্বেচ্ছামৃত্যু-প্রবণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, যাতে ‘মৃত্যু নয় জীবনই মানুষের বেঁচে থাকার সুন্দর ঠিকানা’ এটা বোঝানোর? সমাজের কি কোনো দায় নেই, স্বেচ্ছায় মৃত্যুপ্রবণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং বোঝানো যে ‘অস্তিত্বের আনন্দ, বেঁচে থাকার গুরুত্ব এবং জীবনের মাহাত্ম্য যা মৃত্যুর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ও উন্নততর’?
তাই আমি মনে করি, কোনো মানুষ যখন ‘জীবনের চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে’ তার জন্য সে মানুষ একা দায়ী নয়, তার জন্য অনেকাংশে দায়ী সমাজের বিদ্যমান ব্যবস্থা, সমাজের অসামাজিক মানসিকতা এবং ডিপ্রেশনে যাওয়া মানুষের পাশে না দাঁড়াতে পারার অক্ষমতা। স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনাকে ব্যক্তিগত কারণের ব্যাখ্যায় ফেলে জায়েজ করার মানসিকতা আমাদের সম্মিলিত সামাজিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার লক্ষণ। সামাজিক দায়িত্বশীলতার অনুপস্থিতিই মানুষকে স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। যার ফলে সমাজে স্বেচ্ছামৃত্যুর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। যার কারণে আমরা আজকে সাদী মহম্মদকে হারিয়েছি কিন্তু আমরা আর কাউকে হারাতে চাই না। আমরা সবাইকে নিয়ে সুস্থভাবে সমাজে বাঁচতে চাই এবং স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। আর একটি সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগ, সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং সামাজিক দায়িত্বশীলতাই সমাজের মানুষকে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিতে পারে।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়