রোগী মৃত্যুর ঘটনায় হাইকোর্টের তদন্ত কমিটি গঠন : ল্যাবএইড হাসপাতাল

আগের সংবাদ

জলদস্যুদের সাড়ার অপেক্ষা : জাহাজে খাবার আছে ২০-২৫ দিনের > অতীত অভিজ্ঞতায় জিম্মিদশা থেকে মুক্তির আশা

পরের সংবাদ

শয়তানের বন্দিত্বের রমজান ১১ মাস চুরি ১ মাস ডাকাতি!

প্রকাশিত: মার্চ ১৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

যথারীতি আবার শুরু হলো আরবি বর্ষপঞ্জির নবম মাস রমজান। রমজানের শেষ দশকে শবেকদরের রাতে নাজিল হয় পবিত্র আল কুরআন। এ মাসে মুমিন-মুসলমানরা গুনাহ মাফ, আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় সব পাপকর্ম থেকে বিরত থাকেন। রোজা মানুষের দৈহিক-মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ। ইসলামে রোজা পালনের বিধান এসেছে নামাজের পর দ্বিতীয় হিজরির ১০ শাবান মদিনায়। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের তৃতীয়টি সাওম বা রমজান। সাওম আরবি শব্দ, এর বহুবচন সিয়াম ফারসি প্রতিশব্দ রোজা। আর রোজার আভিধানিক অর্থ, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা, আত্মসংযম, কঠোর সাধনা ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিয়তের সঙ্গে যাবতীয় পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকার নাম সাওম বা রোজা। অন্য অর্থে ‘রমদ, ধাতুর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, দহন, প্রজ্বলন, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে-ভস্ম করে ফেলা’। রমজানে মানুষের যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি, নফসের দাসত্ব, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। রোজা লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ-ক্ষোভ, অত্যাচার থেকে বিরত এবং স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি দয়া প্রদর্শনের রিহার্সালও। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নারী-পুরুষের ওপর এর ট্রায়াল ফরজ। বয়ানে বলা হয়, আল্লাহ নিজ হাতে এর সওয়াব (প্রতিদান) দেবেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদের (সা.) জবানিতে আছে, সাওম বা রোজা মুমিনের ‘জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের ঢালস্বরূপ’ (বুখারি ও মুসলিম)।
রমজান মাসে শয়তানকে বন্দি করে রাখা হয় বলে পবিত্র কুরআন, হাদিসের উদ্ধৃতিসহ নানা বয়ান আছে। কোনো কোনো বয়ানে আছে, এ মাসে শয়তানের পায়ে জিঞ্জির পরিয়ে দেয়া হয়। এর অর্থও বন্দিত্বই। বাংলা পরিভাষায় বলা যায়, অকর্মণ্য করে দেয়া হয়। ধর্মপ্রাণরা তা বিশ্বাস করেন। এর বিপরীতে প্রশ্ন, তাহলে এ মাসে শয়তানিকাণ্ড তাহলে বেশি কেন? কে করে বা করায় অপকর্মগুলো? সুরা ইব্রাহীমের-২২ নম্বর আয়াতে শয়তানের সক্ষমতা নিয়ে কিছু কথা আছে। কুরআনের আরেক জায়গায় বলা হয়েছে শয়তানের কৌশল দুর্বল! মানুষকে গুনাহ করাতে বাধ্য করার সরাসরি শক্তি নেই তার। শয়তান শুধু মানুষকে উসকানি বা ইন্ধন (ওয়াসওয়াসা) দেয়! (সুরা নিসা-৭৬)। বন্দি থাকা অবস্থায়ও তার উসকানির তীব্রতা-ব্যাপকতার প্রসঙ্গটি আসে কিছু ব্যক্তি বা মহলের মাসটিকে ঘিরে কয়েকগুণ বেশি অপকর্মের কারণে। স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধিতে এর জবাব মেলে না।
রোজার ধর্মীয় গুরুত্বের সঙ্গে সামাজিক ও মানবিক অনেক গুরুত্ব জড়িত। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এসব দেশ রমজান উপলক্ষে বড় বড় চেইনশপ থেকে শুরু করে ছোট দোকানে দেয় বিশাল বিশাল ছাড়। ক্রেতাদের কে কত বেশি মূল্য ছাড় দিতে পারে সেটা নিয়ে চলে রীতিমতো প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় ছাড়ের মাত্রা কখনো কখনো ৫০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। মূলত রোজাদারের অর্থকষ্ট লাঘবের পাশাপাশি অধিক সওয়াবের আশায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসে এমন ছাড় দেন বিক্রেতারা। ক্রয়ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নাগালে রাখতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানোর ঘোষণা এবং সেগুলোর মূল্য তালিকা দোকানের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
এই সংস্কৃতি কেবল মুসলিম নয়, অন্যান্য ধর্ম অধ্যুষিত দেশেও। অন্য সব ধর্মের লোকেরা রমজান মাসকে শ্রদ্ধা-সমীহ করে। নৈতিক-অনৈতিক বাছ বিচার করে। অনাহারি-অভাবী প্রতিবেশীদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে। অতি মুনাফার মোহ সংবরণ করে। বিভিন্ন দেশ তাদের ধর্মীয় উপলক্ষ কিংবা উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম কমানোর ঘোষণা দেয়। এসব উৎসব ঘিরে ইউরোপ-আমেরিকায় ছাড়ের হিড়িক পড়ে। মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয় উৎসব। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ না হয়েও রমজান উপলক্ষে অনেক দেশে পণ্যসামগ্রীর দাম কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়। অমুসলিম দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় কোনো ধর্মীয় উৎসবের সময় দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ে না, রমজানে দেয়া হয় আরো বেশি ছাড়। রমজানের শুরুতে পণ্যে ছাড় দেয়া ইউরোপের দেশগুলোতে রীতিতে পরিণত হয়েছে। জার্মানিতে চলে অভাবনীয় মূল্য ছাড়। তা ফ্রান্সেও। আমাদের কাছের দেশ থাইল্যান্ডেও রমজান মাস উপলক্ষে মুসলমানসহ সবার জন্য পণ্যে বিশেষ ছাড়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। রমজান উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা তাদের আগের মুনাফা থেকে ছাড় দিয়ে ব্যবসা করেন। পণ্যের দাম না বাড়িয়ে সেখানে কমিয়ে দেন। আবার অনেক ব্যবসায়ী লাভবিহীন পণ্য বিক্রি করেন মাসজুড়ে। সম্প্রীতি-বন্ধন ও সহনশীলতা বাড়াতে তারা এমন উদ্যোগ নেন। এর ঠিক উল্টা চিত্র বাংলাদেশে। রমজান মুসলমানদের ত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মাস বলা হলেও মুসলিমপ্রধান এ দেশটির বাস্তবটা বড় নিষ্ঠুর। অনৈতিকভাবে প্রতি বছর রমজান মাসে বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তা অনেকটা স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হয়েছে।
শয়তানিকাণ্ডের প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। তবে কি মাসটিতে শয়তান এখানে মুক্ত বিহঙ্গ? নাকি সে বন্দি থাকলেও তার এখানে বেশুমার সাগরেদ। এই শিষ্যদের এক্সপার্টিজম বা পারফরম্যান্স গুরু শয়তানের চেয়েও জুতসই-টেকসই? সরকারের এত চেষ্টা-ধমক-অভিযানের পরও শয়তান বা তার অনুসারীদের কারসাজি কেন বেশি টেকসই বাংলাদেশে? বছরের বাকি ১১ মাস কোপ মারলেও রমজানের এক মাসে তারা একেবারে জবাই করে ছাড়ছে। কেউ তাদের রুখতে পারে না। রোজার আগ থেকেই কোমর বেঁধে নামে তারা। পণ্যের দাম বাড়ানোর যাবতীয় ছলাকলা, কৌশল, যুক্তিসহ যাবতীয় পরিবেশ তারা নিশ্চিত করে ছেড়েছে এবারো। কিছু পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত থাকলেও কৃত্রিম সংকট তৈরির বন্দোবস্ত তারা আগেই করে রেখেছে। বাজারে পণ্যের সংকট তৈরি করেছে দক্ষতার সঙ্গে। বড় থেকে ছোট, মহল্লার মুদি দোকানেও শয়তানিকাণ্ড চলছে হরদম। অনেকের মাথায় আবার টুপিও থাকছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে পবিত্র মাসে এমন শয়তানি কর্মের ফের একেবারে অবুঝের বিষয় নয়। অন্য ধর্মের চতুর লোকদেরও দায়ী করার সুযোগ নেই। দেশে ব্যবসায়ীদের ৯০ ভাগেরও বেশি মুসলমান, মুসলমান হয়েও পুণ্যের মাসে অপুণ্যের এমন কাজ তারা করছেন। করে আসছেন। এবার আরেকটু বেশি করছেন। বাকি ১১ মাসেও এই চর্চায় তারা কমতি দেবেন? অথচ রমজানের ১ মাস বাকি ১১ মাসের নৈতিকতা ও সংযম চর্চার রিহার্সাল টাইম। বাস্তবে কী রিহার্সাল শুরু হয়েছে মাসটিতে?
বহুবিধ ব্যস্ততায় রমজানে সরকারের শাসন-অভিযান, আলেম-ওলেমাদের নসিয়ত শোনার সময়ও হয় না তাদের। তারপরই না শিকলে আবদ্ধ হওয়া বা পায়ে ডান্ডাবেড়ি লাগানো। হাদিস বিশারদরা বলে থাকেন, শয়তান শিকলে আবদ্ধ থাকার অর্থ আক্ষরিক ও রূপক উভয় অর্থেই হতে পারে। রূপক অর্থে রমজানে শয়তানের ধোঁকা-প্রবঞ্চনার হার কমে যায়, অন্যায় কাজ কম হয় এবং মানুষের মধ্যে আল্লাহর বিধান পালনের প্রতি আগ্রহ প্রবল থাকে। আর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে, মানুষ পাপ করে দুই কারণে। একটি তার কুপ্রবৃত্তি ও বদ-অভ্যাস। আর দ্বিতীয়টি শয়তানের প্ররোচনায়। রমজানে শয়তান বন্দি থাকলেও কুপ্রবৃত্তির কারণে মানুষ পাপ করে থাকে। আমাদের সামগ্রিক বাস্তবতা কুরআন, হাদিস, বয়ান, নৈতিকতা কোনো কিছুরই ধার ধারে না। এ কারণে হয়তো ১১ মাসের চর্চা ১ মাসে থমকে না। কামাই-রোজগারের ভর মৌসুমে তা হয়তো আরো গতি পায়। শানিত হয়। শয়তানের বন্দি থাকা আর মুক্ত থাকায় তা ম্যাটার করে না। এ নিয়েও ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থে কিছু কথা আছে। কারো কারো মতে, রমজানে বন্দি থাকার কারণে শয়তানের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ বন্ধ থাকলেও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ বন্ধ থাকে না। তাই মানুষ পাপ করে। কোনো কোনো হাদিস ব্যাখ্যাকারী বলেছেন, রমজানে সব শয়তানকে বন্দি করা হয় না, অতিরিক্ত দুষ্ট শয়তানকে বন্দি করা হয়। তাই অন্য শয়তানদের প্ররোচনায় মানুষ পাপ করে। (ফাতহুল বারি : ৪/১১৪)।
রমজান সংযম-কৃচ্ছ্রসাধনেরও রিহার্সাল আওয়ার। তা খাওয়া-দাওয়া, কেনাকাটা, ভরণ-পোষণেও প্রযোজ্য। দিনভর না খেয়ে ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত মনিচ্ছা মতো খাওয়া সংযমের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ জন্য নিজেকে উহ্য রেখে শয়তানকে দায়ী করলে তা একতরফা হয়ে যায়। দিনে টেপ খালি রেখে এক রোজা দাবি করে দুপুর থেকে কারো কারো রন্ধনশালায় যে কর্মব্যস্ততা চলে তাও সংযমের সঙ্গে যায় না। পানাহার থেকে বিরত থাকার সময় বাদেও যে খাবারের প্রতি সংযম থাকা দরকার আমরা বেশির ভাগ মানুষই তা ভুলে যাই। দীর্ঘ সময় পানাহার থেকে বিরত থাকার পর, শারীরিক ও মানসিক অবস্থা এমন হয় যে, ‘যা পাই তাই খাই’ এবং ‘যত পাই তত খাই’। বিষয়টি ধর্মীয় দিক দিয়ে তো বটেই, স্বাস্থ্যবিজ্ঞানও তা অনুমোদন করে না। দীর্ঘক্ষণ পানাহার থেকে বিরত থাকার পর টেবিলে খাবারের পসরা সাজানো সংযম নয়। এ থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করাও রমজানের শিক্ষা। ইসলাম ধর্মে এ সংক্রান্ত কিছু নির্দেশনাও আছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি পেট ভর্তি করে খাবার খায় তার পেট (আল্লাহর কাছে) একটি নিকৃষ্ট পাত্র, (তিরমিজি)। সুন্নাত হলো পেটের তিন ভাগের একভাগ খাবার খাবে, একভাগ পানি পান করবে। বাকি এক ভাগ খালি রেখে দেবে, (তিরমিজি)। কেউ ধর্মীয় এসব নির্দেশনা মানতে চাইলে নিশ্চয়ই শয়তান তা রুখে দিতে পারবে না। রোজা-সেহরিতে যত ইচ্ছা খাওয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়- এ ধরনের কিছু মাসআলা দেয়ার লোক আছে। নিজেকে নির্দোষ রেখে সবকিছুতে শয়তানের দোহাই বা অজুহাত খোঁজাও অবশ্যই আরেক শয়তানি।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়