রোগী মৃত্যুর ঘটনায় হাইকোর্টের তদন্ত কমিটি গঠন : ল্যাবএইড হাসপাতাল

আগের সংবাদ

জলদস্যুদের সাড়ার অপেক্ষা : জাহাজে খাবার আছে ২০-২৫ দিনের > অতীত অভিজ্ঞতায় জিম্মিদশা থেকে মুক্তির আশা

পরের সংবাদ

বাঙালির মনস্তাত্ত্বিকের সামাজিক প্রভাব

প্রকাশিত: মার্চ ১৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে- বাঙালি প্রতিটি ক্ষেত্রে যতটা আবেগময়, প্রত্যক্ষ কর্মদর্শনে ততটা বিপরীতমুখী। বাঙালি মনস্তত্ত্বের স্বরূপ অন্বেষণ দুঃসাধ্য। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না, আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না।’ এমনই বিপরীতমুখী স্বরূপ বৈশিষ্ট্যে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠনই ছিল বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। যেখানে সময়ের দাবিতে ত্যাগের প্রবলতা ছিল, তবে বিশ্বাসে ঘাটতি ছিল কিনা, সেটা মূল্যায়নের যথেষ্ট দাবি রাখে। নিত্য আবেগ ও অনুকরণে প্রলুব্ধ বাঙালি চেতনা বা বিশ্বাসের গভীরে প্রবেশে অনিচ্ছুক। জাতিসত্তার প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে আমরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। তবে তার গভীরতা সর্বদা উপেক্ষিত হচ্ছে কিনা, সেই ব্যাপারে উদাসীন। অমর একুশে, স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসে শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার জায়গাটা যখন দখল করে নেয় গণমাধ্যম কাভারেজ দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে নিলর্জ্জভাবে ব্যানার প্রদর্শনের মহড়া চলে, আধিপত্য রক্ষায় অনভিপ্রেত ঘটনার সূত্রপাত হয়, তখন আমাদের চেতনাবোধের জায়গাটা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক নয় কী? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অনুকরণীয় নেতাদের আদর্শ চর্চার ঢামাঢোলে প্রকৃত অর্থে আদর্শিক ও ত্যাগের বিষয়টি কতটা ভেতর থেকে চর্চা হচ্ছে, সেটি মূল্যায়নের সময় এসেছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলে চেতনা বা নীতিদর্শনের বৈচিত্র্যতায় আমাদের সুবিধাবাদী চরিত্রের সাক্ষাৎ মিলে। স্বাধীন জাতিসত্তার পিতা বঙ্গবন্ধু তার স্বজাত অভিজ্ঞতা থেকেই অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে যথার্থই লিখেছেন, ‘… বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে।’
সমসাময়িক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ যেভাবে সর্বত্র চর্চা হচ্ছে, সভা-সেমিনারের বক্তৃতায় যেভাবে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত হচ্ছে, হৃদয় থেকে সেটি কতটা নিঃস্বরিত হয়! সেটি ভাবনার বিষয়। কেননা, হৃদয় থেকে এ ভাবাদর্শ চর্চা হলে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ব্যক্তিস্বার্থ অত্যন্ত গৌণ হওয়ার কথা। কেন জানি জাতিসত্তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য এই আদর্শিক শব্দগুলো এখন ব্যক্তি সিঁড়ি ডিঙ্গানোর হাতিয়ারে রূপ নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়ে, শিক্ষাঙ্গনে দলবাজি চলে, দখলদারিত্ব মহড়া শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে, জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ লুণ্ঠন হয়ে যায়, পেশাজীবীরা পেশার মানোন্নয়ন ও সেবার মনোবৃত্তির চেয়ে পদ-পদবি দখলে এই পবিত্র শব্দগুলোকে ব্যবহার করছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা পাড়া-মহল্লার পাতি মাস্তানগুলো তাদের দখলবাজি ও চাঁদাবাজিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চর্চাকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। পিছিয়ে নেই মজুতদার বা খুচরা ব্যবসায়ীরাও। ফলাফলে পিষ্ঠ হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ তেল-গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির যে কৌশল নিয়েছে, সেটি একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য বাস্তবমুখী ছিল না। সরকারের সেই কৌশল অনুসরণ করতে গিয়ে এখন ব্যবসায়ী মহলও বেপোয়ারা। সবার অভিন্ন লক্ষ্য, সাধারণকে ফকির বানাও। বস্তুত সমাজ রাষ্ট্রের কোথাও শৃঙ্খলা নেই। যে যার মতো করে পারছে সাধারণ মানুষের রক্ত শোষণের কৌশল নিয়েছে। বাড়ছে সামাজিক বৈষম্য। বাঙালির এ ধরনের আত্মঘাতী স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজতজয়ন্তীতে সভাপতির ভাষণে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘… মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য-ঋণ-অভাব; অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে। এ অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম।’ ব্রিটিশ ভারতে জাতিকে উদ্ধারে কবি নজরুলের মহীরূপে প্রতিবাদী কণ্ঠ উচ্চারিত হয়েছে, যা ব্রিটিশ শাসকদের মসনদ নড়বড়ে করেছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনুষত্ব উদ্ধারে জাতির আলোকবর্তিকা হয়ে সেই কণ্ঠ কোথায় থেকে উচ্চারিত হবে- সেটাই জিজ্ঞাসা।
ধর্মচর্চায় মানবিকতার গুরুত্ব থাকলে জাতিসত্তা চর্চার ন্যায় ধর্মীয় চর্চাবোধেও বাঙালি বিশ্বাস ও জীবন চর্চায় ব্যাপক ফারাক লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় বিশেষ দিবসগুলোকে কেন্দ্র করে নিত্যপণ্যের মূল্য ছাড়করণের প্রতিযোগিতা ও মানবতার সেবার মাধ্যমে ¯্রষ্টার সন্তুষ্টির পথ অনুসরণ করা হয়, সেখানে বাহ্যিকভাবে ধার্মিক বাঙালি রমজান, ঈদ ও পূঁজা পার্বণে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়, জনজীবনে নাভিশ্বাস সৃষ্টি করে। শোষণ ও ধর্মচর্চার প্রতিযোগিতা এখানে ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক সুবিধাগোষ্ঠীকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। মোটাদাগে বলা যায়, বাঙালি সমাজে অনুকরণের যে রীতি প্রচলিত, এখানে প্রান্তিক থেকে উৎপাদক কোনো ব্যবসায়ীই পিছিয়ে নেই মুনাফা অর্জনে।
নিত্যপণ্যের লাগামহীন দর বৃদ্ধিকে বৈশ্বিক সংকট হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও বাস্তবে বাজারে চাহিদা ও জোগানে কোনো সমস্যা নেই। প্রতিটি বাজার দোকানপাটে যথেষ্ট পণ্য উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। বিষয়টি নিয়ে সরজমিন বিক্রেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বোঝা যায়, সবার লক্ষ্য একটাই রাতারাতি ধনী হওয়া। রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পাড়া-মহল্লায় ক্ষমতাকেন্দ্রিক চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ। ফুটপাতে যে হকার সবজি, ফল বা মাছ বিক্রি করে তার সাথে সখ্যতা গড়ে জিজ্ঞেস করলে পণ্যের প্রকৃত মূল্য ও বিক্রয় মূল্যের যথেষ্ট পার্থক্য পাওয়া যায়। যা রীতিমতো কপালে ভাঁজ ফেলবে। অজুহাত চাঁদাবাজি। কখনো কখনো ব্যঙ্গ স্বরে বলেন, সরকার যেভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, তেলের দাম বাড়িয়েছে, আমরা কেন সরকারের সেই নীতি অনুসরণ করব না। বেলা শেষে সব অভিযোগের দায়ভার গিয়ে পড়ে বেচারা ভোক্তার ওপর। এ ধরনের মানসিক দুর্বৃত্তায়নের লাগাম টেনে ধরা সময়ের দাবি। জাতীয় সম্পদ তৈরি হয় সঠিক মানসিকতা গড়ে তোলার মাধ্যমে। আমাদের লুণ্ঠন মানসিকতা জাতীয় চরিত্রকে সে দিকে ধাবিত হতে দেয়নি। শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে গিয়ে ঠেকেছে, সেটিকে পুরোপুরি বাণিজ্য নির্ভর বলা যায়। গুণগতমানের বিষয়টি না হয় আলোচনার ঊর্ধ্বে রাখা হলো। যে কোনো উন্নত জাতি তাদের নাগরিক মানসিক বিকাশের জন্য শিক্ষা ও আত্ম-উন্নয়নে বিনিয়োগ করে। জ্ঞান দক্ষতা অর্জনে মনোযোগ দেয়। শিক্ষার গাণিতিক হার বাড়লেও বস্তুত দক্ষতা ও জ্ঞাননির্ভর শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেনি। আর্থিক অনিয়মের চেয়েও মানসিক দুর্নীতি যে কোনো জাতি রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বয়ে আনে। শিক্ষাকে বাণিজ্যে রূপ দিতে গিয়ে আমরা মানবিক ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি করতে পারছি না। অভিভাবকরা শিক্ষায় যে বিনিয়োগ করেন, সেটিকে তারা চক্রবৃদ্ধি হারে তুলে আনার জন্য সন্তানদের মানসিকভাবে প্রলুব্ধ করে। নীতি নৈতিকতার সর্বত্র হাহাকারের সকল যোগসূত্র এখানে গ্রোথিত।
উন্নত বিশ্বে ক্ষমতাবানরা সর্বদা সাধারণ হয়ে থাকেন। সৃজনশীলরাই অসাধারণ হন। সবাই সৃজনশীলদের অনুকরণের চেষ্টা করে। দুর্ভাগ্য, আমাদের জাতিসত্তা সেভাবে বিকশিত হয়নি। এখানে ক্ষমতাবান ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরাই সর্বদা অসাধারণ থাকেন। সৃজনশীলরা থাকেন উপেক্ষিত, অবহেলিত। তাই এখন সবাই নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ড ভুলে গিয়ে ক্ষমতার মোহে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এই প্রবণতা শিক্ষার্থীদের মাঝে মাস্তানিতন্ত্রের উদ্ভব ঘটিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু না হয়ে বিসিএস তৈরির কারখানায় রূপ নিয়েছে। রাজনৈতিক বড় ভাইদের হাত ধরে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা উদীয়মান তরুণদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। বাস্তবে এখানে কোনো গবেষণা কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। তরুণ মেধাবীদের মাঝে বিদেশ ফাঁড়ি দেয়ার মানসিকতা প্রবল আকার ধারণ করেছে।
ফলশ্রæতিতে মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হচ্ছি আমরা। বাঙালি চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে আহমদ ছফা যথার্থই বলেছেন, ‘… যে জাতি উন্নত বিজ্ঞান, দর্শন এবং সংস্কৃতির ¯্রষ্টা হতে পারে না অথবা সেগুলোকে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না, তাকে দিয়ে উন্নত রাষ্ট্র সৃষ্টিও সম্ভব নয়। যে নিজের বিষয় নিজে চিন্তা করতে জানে না, নিজের ভালো-মন্দ নিরূপণ করতে অক্ষম, অপরের পরামর্শ এবং শোনা কথায় যার সব কাজ-কারবার চলে, তাকে খোলা থেকে আগুনে, কিংবা আগুন থেকে খোলায়, এইভাবে পর্যায়ক্রমে লাফ দিতেই হয়। সুবিধার কথা হলো নিজের পঙ্গুত্বের জন্য সব সময়ই দায় করবার মতো কাউকে না কাউকে পেয়ে যায়। কিন্তু নিজের আসল দুর্বলতার উৎসটির দিকে একবারও দৃষ্টিপাত করে না।’
আমাদের এগিয়ে যেতে হলে গদবাধা চেতনা ও আদর্শিক চর্চার অনুকরণের প্রবণতার লাগাম টেনে ধরতে হবে। যে অনুকরণ নষ্টামিকে প্রলুব্ধ করে, সেটি আদর্শের ভিত্তি হতে পারে না। জাতীয় মনস্তাত্ত্বিকের আসল দুর্বলতার উৎস খুঁজে বের করে তা নিরসনে মনোযোগ বাড়াতে হবে। একটি জাতিরাষ্ট্র নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডির দায়বোধ থেকে পরিচালিত হয় না, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের হাত ধরে জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে টিকে থাকে, আমাদের সেই জাতীয়তাবোধ জাগরণের দায়িত্ব নিতে হবে।

ইফতেখার নাজিম : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়