ডা. মোদাচ্ছের আলী : বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণে রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে

আগের সংবাদ

বাজারের আগুনে রোজার আঁচ

পরের সংবাদ

বিজয়ী এবং পরাজিতের ইতিহাস ভিন্নতরই হয়ে থাকে

প্রকাশিত: মার্চ ১২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমরা ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টের তথাকথিত দেশভাগের পূর্ব পর্যন্ত ছিলাম অখণ্ড ভারতবর্ষেরই অংশ। বর্তমান ভারতের উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মানুষের মধ্যকার পরস্পরের বৈরী সম্পর্ক এবং বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছিল ভারত ভ্রমণে। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলো প্রধানত হিন্দিভাষী। হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতি উত্তর-ভারতে বিরাজমান। অপরদিকে দক্ষিণের চার রাজ্যে চার পৃথক ভাষা এবং সংস্কৃতি। কারো সঙ্গে কারো মিল নেই। তামিলনাড়–তে তামিল, কর্নাটকে কন্নড়, অন্ধ্রে তেলেগু এবং কেরালায় মালায়ালম ভাষা। দক্ষিণের চার জাতিসত্তার মানুষ নিজ নিজ ভাষা-সংস্কৃতি প্রশ্নে গভীর জাতীয়তাবোধের পরিচয় দিয়ে এসেছে। নিজ নিজ ভাষার প্রতি তাদের চরম জাতীয়তার দৃঢ়তা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। দক্ষিণ ভারত সরকারি হিন্দি ভাষাকে কেবল অগ্রহণই করেনি। ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই দক্ষিণ ভারতের ওই চার রাজ্যে হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেনি। বৃহৎ ভারতে দক্ষিণ যেমনি ব্যতিক্রম, তেমনি স্বাতন্ত্র্য। এবং অনিবার্যরূপে হিন্দি বিদ্বেষী। মজার ব্যাপার হচ্ছে দক্ষিণ ভারতে রাবণের মন্দির দেখেছি। দেখেছি অসুর রাবণ পূজাও।
উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মানুষের মধ্যকার বর্ণের ভিন্নতাই প্রমাণ করে উত্তর আর্য-উত্তরাধিকারী এবং দক্ষিণ অনার্য। এই আর্য-অনার্য বিরোধকে কেন্দ্র করেই উত্তর-দক্ষিণের দ্ব›দ্ব-বিবাদ, বৈষম্য। শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণ বিভাজন উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যকার পরস্পরের বিচ্ছিন্নতা নির্ধারণ করে দিয়েছে। বহিরাগত আর্যরা ভারতবর্ষ দখলে নিলেও তারা দক্ষিণ ভারতের অভিমুখে অগ্রসর হয়নি। তাই দক্ষিণ ভারতে আর্য আগমন না ঘটার ফলে অনার্যদের প্রাধান্য রয়ে গেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদ সেখানে বিস্তার লাভ করেনি। ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষণ-নিপীড়নের শিকার না হলেও তাদের অস্পৃশ্য শূদ্র জ্ঞানে মানুষ বলেই বিবেচনা করত না আর্যরা যেমন, আজো উত্তর ভারতে তেমনি তাদের অনার্য এবং নিম্নবর্গের অচ্ছুৎ হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে।
আর্য-অনার্য যুদ্ধ-বিগ্রহে বহিরাগত আর্যরা স্থানীয় অনার্যদের পরাস্ত করেছিল। আর্য বিজয়ের কাহিনি নিয়ে আর্য বাল্মীকি রচনা করেছিলেন ‘রামায়ণ’। পরে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ভারতীয় প্রাচীন উপাখ্যান ‘রামায়ণকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণের ফলে ভারতবর্ষের অপরাপর ধর্মাবলম্বীরা ‘রামায়ণ’ পাঠ ত্যাগ করেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কারণেই এই গ্রন্থটি পাঠ থেকে অন্যরা বঞ্চিত হয়েছে। জয়ী আর্যদের বিজয়ী বীর হিসেবে উপস্থাপনের পাশাপাশি অনার্য বীর রাবণকে চরম ঘৃণ্য রূপে উপস্থাপন করে ভারতবর্ষের লড়াকু বীর রাবণকে চরম অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। তাই রাবণ খল চরিত্রের একজন ঘৃণিত চরিত্র হিসেবে ভারতীয়দের মনোজগতে স্থায়ী হয়ে আছে। বাল্মীকির রামায়ণে রাবণ একজন রাক্ষস। রাবণের দশটি মুখ, বিশটি হাত। সীতাকে অপহরণ ও বন্দি করে রাবণ নিজেকে দূরাচারীরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অথচ রাবণের বোনের নাক ল²ণ কেটে নেয়ার ফলেই প্রতিশোধ গ্রহণে রাবণ সীতাকে অপহরণ করেছিল। দেবর ল²ণের এঁকে দেয়া বৃত্তের বাইরে না যাওয়ার নির্দেশ অমান্য করে ভিক্ষুক ছদ্মবেশী রাবণের কাছাকাছি পৌঁছানো মাত্র সীতা অপহৃত হয়। রাবণ সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় নিজ রাজ্যে। বাল্মীকির রামায়ণে রাবণ চরিত্রকে খল চরিত্রের অধিকারী হিসেবে উত্থাপন করা হয়েছে। ফলে রাবণের প্রতি ঘৃণা ও ধিক্কার যুগ-যুগান্তর থেকে মানুষ পোষণ করে এসেছে। রাবণ নেতিবাচক চরিত্ররূপে সবার কাছে প্রতিষ্ঠিত। অথচ এই রাবণের মহানুভবতা মানবকুলকে পর্যন্ত হার মানিয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই রাবণকেই বীর আখ্যায়িত করেছেন। পাশাপাশি পৌরাণিকের ইতিবাচক চরিত্র রামকে ভিক্ষুক এবং ল²ণকে তস্কর রূপে দাঁড় করিয়েছেন। আর্য-অনার্যের বিরোধকে কেন্দ্র করেই আর্য কবি বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করেছেন। বাল্মীকি আর্য বলেই অনার্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। লঙ্কাকে রাক্ষসপুরী রূপে চিত্রিত করেছেন। রাক্ষসরা ভয়ংকররূপী কিন্তু নরমাংসভোজী নয়। অনার্য রাক্ষসদের ভেতর উচ্চস্তরের মনুষ্যত্ব রয়েছে, সেটা মধুসূদন দত্ত তার ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে উল্লেখ করেছেন। মধুসূদন অনার্য রাবণকে বীররূপে প্রতিষ্ঠিত করলেও ব্রাহ্মণ্যবাদী তৎপরতায় রাবণের প্রতি মানুষমাত্রই ক্ষুব্ধ। সীতাকে অপহরণ করে রাবণ নিজের চরিত্রে কালিমা লেপন করেছে। রাবণের মহানুভবতায়ও ব্রাহ্মণবাদীদের তীব্র প্রচারণায় তার প্রতি মানুষ কিন্তু সদয় হতে পারেনি। ঘৃণা করছে অকাতরে। অসুর রাবণ অপহৃত সীতাকে প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল, সীতার সম্মতি ব্যতিরেকে সীতাকে সে স্পর্শ করবে না। সীতার সম্মতিতেই সীতাকে ভোগ করবে, তার পূর্বে নয়।
পূর্বের স্বীয় অপকীর্তির জন্য রাবণের প্রতি জনৈকা নির্যাতিতা অভিসম্পাত দিয়েছিল এই বলে, কারো সম্মতি ব্যতিরেকে ভোগে মত্ত হওয়ামাত্র রাবণ তৎক্ষণাৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। এই অভিসম্পাতের ভয়ে তবে কি বীর রাবণ সীতাকে তার অনুমতি ব্যতিরেকে স্পর্শ করেনি! বীর অসুর রাবণ তুচ্ছ সেই অভিসম্পাতের ভয়ে যদি ভীত হয়ে যায়, তাহলে বাল্মীকি তার রচনায় রাবণকে মহাশক্তিধর রূপে চিত্রিত করেছিল কোন অভিপ্রায়ে? সেই অভিসম্পাত মাথায় নিয়ে রাবণ সীতাকে অপহরণ করেছিল কিসের অভিলাষে? কেবলই ভগ্নির নাক কর্তনের প্রতিশোধ গ্রহণে! সীতা রাবণের কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে, তেমন প্রত্যাশা রাবণের থাকার কথা নয়। মনুষ্যরূপী এক সাধারণ নারীর অভিসম্পাতে যদি বীর রাবণের পতনই ঘটে, তাহলে রাবণকে মহাশক্তিধররূপে চিত্রিত করার প্রয়োজন ছিল কি? সীতার সতীত্ব রক্ষায় বাল্মীকি অযাচিত কাহিনিটি যুক্ত করে রাবণের শক্তিমত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সীতার সতীত্ব রক্ষার এই কৌশলটি রাবণের চরিত্রের সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সীতার অসম্মতির কারণে সীতাকে রাবণ স্পর্শ করেনি। এটাই রাবণ চরিত্রের অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। অসুর রাবণের এই মহানুভবতার কাছে পরাস্ত সভ্য আর্যরা। বিশেষ করে রাম-ল²ণ তো বটেই, আজকের পৃথিবীর সভ্য মানুষের কাছেও অমন মনুষ্যত্বের দৃষ্টান্ত পাওয়া দুর্লভ। সীতার উদ্দেশ্যে রাবণের প্রতিশ্রæতি-অঙ্গীকার রাবণ শতভাগ রক্ষা করেছিল। রাবণের এই মহানুভবতা মানুষের মধ্যে খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য, সন্দেহ নেই। সীতাকে সতীরূপে প্রমাণে এছাড়া বিকল্প উপায় ছিল না বলেই সেই পথের ফাঁকে অসুর রাবণ ইতিবাচক চরিত্র হয়ে উঠেছে। আর্য বাল্মীকির রচনার অত্যন্ত দুর্বলতা এতে স্পষ্ট হয়েছে। অর্থাৎ সীতাকে সতী সাব্যস্ত করতেই অসুর রাবণ হয়ে উঠেছে মহানুভব। রাবণ চরিত্রের এই অসামান্য দিকটি পৌরাণিকে সঙ্গতিপূর্ণ যে নয় তা নিশ্চয় বলার অপেক্ষা রাখে না। তারপরও আর্যরা রাবণকে ক্ষমা করতে পারেনি। রাবণের প্রতি প্রবল ঘৃণা-ধিক্কার অতীতের ন্যায় আজো ক্রিয়াশীল রয়েছে।
রাম তার অতি প্রিয় স্ত্রী সীতার সতীত্ব নিয়ে বার বার সন্দেহে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। নিজ রাজ্যে ফিরে গিয়েও সীতাকে সতীত্ব প্রমাণে বাধ্য করেছিল রাম। এতে অতিষ্ঠ হয়ে সীতা সতীত্ব পরীক্ষা শেষে রামের প্রতি তীব্র ঘৃণায় বনে চলে চায় এবং মাটি ফাঁক করে পাতালে নিজেকে বিসর্জন দেয়। সীতার এই আত্মহননের জন্য রামকে তিরস্কার করে মধুসূদন দত্ত তার মেঘনাধ বধ কাব্যে লিখেছেন সবিস্তারে। শূদ্রদের প্রতি রামের ঘৃণার উদাহরণ হিসেবে বর্ণিত আছে শূদ্র নারীর জিহ্বা রাম কর্তৃক কর্তনের ঘটনাও। রামায়ণ ইতিহাস নয়, রচয়িতা কখনো সেটা বলেননি। এটা উপন্যাস বা প্রাচীন ভারতীয় উপাখ্যান। কিন্তু বহিরাগত ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্যরা রামায়ণকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করার ফলে ঔপনিবেশিক রাম দেবতা হয়ে যায়। আর ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা স্বদেশি বীর বারণ হয়ে যায় দানব।
রাম এবং রাবণের যুদ্ধে রাবণ একা লড়েছিল। অপরদিকে রামের পক্ষে প্রায় সব দেবদেবী একাট্টা হয়ে লড়েছিল রাবণের বিরুদ্ধে। রামকে দেবদেবীরা অস্ত্র, সমর্থন ও সাহস সরবরাহের পাশাপাশি যুদ্ধে রাবণের হাতে রাম বাঁধা পড়ামাত্র দেবদেবীরা রামকে রক্ষা করেছে, অস্ত্র সরবরাহ করেছে। দেবদেবীরা অনিবার্য রূপে সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। অসম এই যুদ্ধে রাবণের পরাজয় অনিবার্য ছিল। কেননা বহিরাগত আর্যরা অনার্যদের ওপর ঔপনিবেশিক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। রামায়ণের কাহিনি আর্যদের বিজয়গাথা। পরাজিত অনার্যদের বিরুদ্ধে আর্য বাল্মীকি রচনা করেছেন আর্যদের বীরত্বপূর্ণ গৌরবগাথা। বিজয়ীদের রচিত ইতিহাসে পরাজিতদের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপের নজির নতুন কিছু নয়। বিজয়ীরা নিজেদের রচিত ইতিহাসে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণ করে থাকে পরাজিতের সম্পর্কে নেতিবাচক বাক্যবাণে। ইতিহাসে তাই বিজয়ী এবং পরাজিতের ইতিহাস ভিন্নতরই হয়ে থাকে।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়