মির্জা আব্বাস : আন্দোলন চলবে সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত

আগের সংবাদ

রমজানে ভোগাবে তিন সমস্যা

পরের সংবাদ

রামরাজ্য আর হিন্দুরাষ্ট্রই কি ভারতের শেষ কথা?

প্রকাশিত: মার্চ ১১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পাঁচশ বছরের অপেক্ষার অবসান। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যে সংগ্রাম চলে আসছে, তার পরিপূর্ণতার দিন ছিল ২২ জানুয়ারি ২০২৪। এসব আবেগপ্রবণ প্রচার অধুনা ভারতের হিন্দুত্বের প্রধান যজমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং হিন্দুত্বের অন্যতম পোস্টার ম্যান, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথদের। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ভিন্নভাবে। পাঁচশ বছর আগে সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি সত্যিই কোনো হিন্দুমন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিনা, তার কোনো বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ মেলেনি কখনো। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে যে মামলার নি®পত্তি হয়েছে, তা ছিল জমির মালিকানা-সংক্রান্ত বিষয়। সংশ্লিষ্ট ২ দশমিক ৭৭ একর পরিমাণ ভূসম্পত্তির অধিকার কোন পক্ষের হাতে থাকবে, সেই সম্পর্কিত বিবাদের মীমাংসা করেছিল ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। রায়টি হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে গিয়েছিল এবং বিপরীতে মুসলিমপক্ষকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সমপরিমাণ জমি দেয়ার কথা নির্দেশে উল্লেখ ছিল। সুতরাং বাবরি মসজিদ রামজন্মভূমি বা জন্মস্থান মন্দির ভাঙার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল কিনা, সে বিষয়ের কোনো নি®পত্তি আজ পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় হিন্দুত্ববাদী শাসক দল ও তাদের সমর্থক দল তাই প্রচার করে বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর সেই কাল্পনিক ঘটনার প্রতিশোধ নিতে বাবরি মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মিত হলো। ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি সেখানেই নরেন্দ্র মোদি রামমন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাদের ভাষায় আন্দোলনের চরম পরিণতি ঘটালেন। ইতিহাস বলে, বিতর্কিত বাবরি মসজিদ চত্বরের বিপরীতে ছিল কোট রামচন্দ্র উপাসনা স্থল। সেই অংশেই ছিল রামজন্মভূমি মন্দির, যার প্রতিষ্ঠা আজ থেকে প্রায় তিনশ বছরেরও বেশি সময় আগে। সে সময়ে মুসলমান জমিদার মীর মৌসম আলী কোট রামচন্দ্র এলাকার মহন্ত রামদাসকে রামজন্মভূমি মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য এক একর পরিমাণ জমি বরাদ্দ করেন। ১৮৬৭-৬৮ সালে প্রকাশিত ফৈজাবাদ তহশিল এলাকার সরকারি দলিলে এ জমি বরাদ্দের উল্লেখ রয়েছে। এ জমিতেই গড়ে ওঠে রাম জন্মস্থান-মন্দির এবং ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এ মন্দিরে ভক্তবৃন্দের যাতায়াত অক্ষুণ্ন ছিল। এছাড়া কোট রামচন্দ্র এলাকায় (যার নাম রামকোট) গড়ে উঠেছিল একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাসনাস্থল। যেমন কনক ভবন, দশরথ মহল, রাম খাজানা, রতন সিংহাসন, রঙ মহল, সীতা রাসই ও রাম চবুতরা ইত্যাদি। এর মধ্যে রাম চবুতরা ও সীতা রাসইর উপস্থিতি ছিল বাবরি মসজিদ চত্বরের ভেতরে, কিন্তু মূল মসজিদের বাইরে। এটাও মনে রাখা উচিত, ১৭৭৪ সালে অযোধ্যার তৎকালীন নবাব সুজা-উদ-দৌল্লার তরফে প্রদত্ত ৫২ বিঘা জমিতে গড়ে উঠেছিল হনুমানগড়ির দেবস্থান। এ মন্দিরের চত্বরেই হিন্দু পুরোহিতদের তরফে সম্রাটের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ একটি মসজিদও নির্মিত হয়েছিল। আজ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের নিদর্শন হিসেবেই হনুমানগড়ি মন্দির এবং মসজিদ পাশাপাশি অবস্থান করছে। ২০১৭ সালে অযোধ্যা প্রশাসন মসজিদ ভাঙার পরামর্শ দিলেও মন্দির কর্তৃপক্ষ সেই পরামর্শ অগ্রাহ্য করে। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির সেই অযোধ্যাতেই এবার বাবরি মসজিদ ভেঙে গড়া হয়ে গেল রামমন্দির।
রামমন্দির প্রতিষ্ঠা কি নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের হ্যাটট্রিক গড়ার ট্রাম্পকার্ড হিসেবে দেখা দেবে? এটা সময়ই বলে দেবে। তবে নরেন্দ্র মোদির রামমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা যে ধর্মীয় ভাবমূর্তির চেয়েও রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে, তা বোঝা যায় অসম্পূর্ণ মন্দির উদ্বোধনের সময় নির্ধারণের মধ্য দিয়ে। প্রভাবশালী চারজন শংকরাচার্য অসম্পূর্ণ রামমন্দির উদ্বোধনের বিরোধিতা করে অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন। কিন্তু মোদির হাতে যে সময় নেই; সামনেই জাতীয় নির্বাচন। রামমন্দির উদ্বোধন এখনই যে করতে হবে। রামভক্তদের একত্রিত করার যে সময় বয়ে যাচ্ছে। তাইতো উদ্বোধন করতে মোদির স্পষ্ট কথা- মন্দির সেখানেই হয়েছে, যেখানে বানাতে চেয়েছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী যোগী বললেন, ‘আজ সব রামভক্তের হৃদয় প্রসন্ন। মনে হচ্ছে, ত্রেতা যুগে চলে এসেছি। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণাও করলাম।’
সরযু নদীর তীরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে উদ্বোধন হলো রামমন্দিরের। প্রধান যজমান হিসেবে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠাও করেছেন তিনি। হাতে পূজার ডালা নিয়ে ধীরে ধীরে গর্ভগৃহের দিকে এগিয়ে যান মোদি। সঙ্গে ছিলেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, উত্তর প্রদেশের রাজ্যপাল এবং সাধু-সন্তরা। নানা আচার-অনুষ্ঠান শেষে পঞ্চপ্রদীপে রামলালার আরতি করেন মোদি। সবশেষে রামলালাকে প্রদক্ষিণ করে ষষ্টাঙ্গে প্রণাম করেন। এদিনই রামমন্দির চত্বরে চরণামৃত খেয়ে ১১ দিনের উপবাস ভঙ্গ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। উদ্বোধনের পর তিনি রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা শোনালেন তার দেশকে। তার এ রামরাজ্য যে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারই ভাবনা থেকে উৎসারিত, তা নিয়ে সংশয় করার সুযোগ নেই। তার ১০ বছরের শাসনামলে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা খর্ব করে সংবিধানের ৩৭০ ধারা লোপ পেয়েছে, নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন হয়েছে, দেওয়ানি বিধির পাইলট প্রকল্প শুরু হয়ে গেছে এবং সবশেষে বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দিরের উদ্বোধন হয়ে গেল। ভারতকে একটি হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যে কোনো অলীক স্বপ্ন নয়, মোদি কি সে বার্তাটাই দিয়ে দিল তার প্রধানমন্ত্রিত্বের হ্যাটট্রিক করার আগে? মোদি বললেন, রাম সমাধান, রামই নীতি। রাম শুধু বর্তমান নয়, রাম অনন্তকালের। মোদির এ আগামী ভারতের কল্পনায় কি কোথাও কেউ উদার ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে? এ ভারতেই জওহরলাল নেহরু রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগে বড় পরিকাঠামো ও ভারী শিল্প নির্মাণের সময় বলেছিলেন, এগুলোই দেশের মন্দির। কিন্তু আজকের মোদির ভারত আর সে জায়গায় নেই। তৃতীয়বার ক্ষমতায় এলে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি ওঠে যাবে না তো?
অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা এবং বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা যে এক নয়, তা যেমন সাধারণ মানুষ এমনকি রামভক্তরা বুঝতে পারলেও মোদির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি কি বুঝতে পারবে? নিজেদের ভাবাবেগকে চাঙ্গা করতে গিয়ে অন্যের ভাবাবেগকে জখম করার কৌশল কি রামদর্শন, না রাম রাজনীতি? এতদিন জানতাম, লাল কার্পেটে ষষ্টাঙ্গে শুয়ে ভক্তির প্রকাশ হয় না, রাজনীতি হয়। আর ধর্ম কোনো রাজনীতির আধার হতে পারে না। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, ধর্মই রাজনীতি হয়ে যাচ্ছে। আজ বুঝতে পারছি, বাংলার ওই বিশ্বকবি রবিঠাকুর কেন লিখেছিলেন- ‘আপনায় স্থাপিয়াছ, জগতের দেবতারে নহে।’ শ্রীরাম সেখানে উপলক্ষ মাত্র। বাবরি মসজিদ যদি অযোধ্যায় না থেকে বৃন্দাবনে থাকত, তাহলে ভারতের এই ধর্মের রাজনীতি হয়তো লেখা হতো শ্রীকৃষ্ণকে ঘিরে। তখন হয়তো শ্রীরাম আর প্রজাপালক, নরপতি, পতিতপাবন কিংবা করুণাময় আখ্যায় ভূষিত হতেন না। আদর্শ রাজ্যের নাম তখন রামরাজ্য না হয়ে যেত কৃষ্ণরাজ্য।
ভারতের রাজনীতিতে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। সেখানকার মানুষ তা বুঝে নেবে। কিন্তু মোদির ভারত যে দীর্ঘদিনের চেনা ভারতের চেহারাটাই বদলে দিচ্ছে, বিশ্বের মানবতাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মানুষের মর্মবেদনাটা সেখানেই। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকা উচিত নয় বলে যে বিধান ভারতের সংবিধান ও শীর্ষ আদালত এতদিন ধারণা করে আসছিল, মোদির রামরাজ্যের সংজ্ঞা কি সেখানেই কুঠারাঘাত করে ভারতকে একটি হিন্দুরাষ্ট্রের দোড়গোড়ায় নিয়ে যাবে- সে ভাবনাটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মোদির এই রামরাজ্যে মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষার বেহাল অবস্থা, দারিদ্র্য, অসাম্য কিছুই আর ইস্যু নয়। ইস্যু শুধু একটাই- হিন্দুত্ব। হিন্দুরাষ্ট্র, রাম ও রামায়ণের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান খোঁজার এক ভয়াবহ বিপজ্জনক জায়গায় ভারতকে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতাই লক্ষ্য করছে অনেকে। ভারতের জনগণ ইতোমধ্যেই ১৯৯৯, ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মহাত্মা গান্ধী হত্যায় অভিযুক্ত যে সংগঠন, তাদেরই সদস্য-সমর্থক-পৃষ্ঠপোষকদের নির্বাচিত করে দেশ শাসনের অধিকার দিয়েছে। ২০২৪ সালে এসেও সেই বাজনাই বাজছে। রামমন্দিরের এত আয়োজন তাকে ঘিরেই। বস্তুত রামমন্দির উদ্বোধন ভবিষ্যৎ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রের অভিমুখে এক বড় ধরনের পদক্ষেপ বৈকি অন্য কিছুই নয়! ভারত থেকে তার চিরলালিত গান্ধী আদর্শ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সহিষ্ণুতা অথবা সমদর্শী মনোভাব মুছে দেয়ার কাজ পাকাপোক্তভাবেই করে যাচ্ছে মোদির বিজেপি। কাল্পনিক হিংসার গুজবের বিপরীতে পাল্টা হিংসার তত্ত্বকে মুক্ত কণ্ঠে স্বীকৃতি দিয়ে এই আগ্রাসী মতবাদকে ধারালো করছে মোদির বিজেপি রাজনীতি। যেখানে নেই রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের সম্প্রীতি শিক্ষা, বিবেকানন্দের ভ্রাতৃত্ববোধ, ঠাকুর রামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয়তা। ভারতীয় এই সম্প্রীতির বন্ধনকে কি উগ্রবাদী রাজনীতির হুলিখেলার মাধ্যমে উপড়ে ফেলা সম্ভব? আগামী দিনের ভারত একদিন হয়তো তার জবাব দেবে। অপেক্ষায় থাকলাম, অন্যদিন অন্য একটি লেখার জন্য- যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের গুণগান লিখব অথবা হিন্দুরাষ্ট্র ভারতের বিভেদের বিবরণ লিখব।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়