নির্বাচনী ফলাফল কোথাও কোথাও পূর্ব নির্ধারিত ছিল : সংসদে জি এম কাদের

আগের সংবাদ

দ্রুত কার্যকরে মিলবে সুফল

পরের সংবাদ

একগুচ্ছ নির্দেশনা নিয়ে ফিরলেন ডিসিরা : হয়রানিমুক্ত মাঠ প্রশাসনের বার্তা

প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : হয়রানিমুক্ত মাঠ প্রশাসন গড়ার বার্তাসহ চার দিনের সম্মেলন শেষে একরাশ নির্দেশনা নিয়ে ফিরছেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি সেবামূলক কাজ, কর্মসংস্থান বাড়ানো, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং নতুন সরকারের পলিসি বাস্তবায়নের বার্তা পেয়েছেন তারা। গত রবিবার থেকে শুরু হয়ে গতকাল বুধবার সম্মেলন শেষ হয় প্রশাসনের সবচেয়ে বড় আয়োজন জেলা প্রশাসক সম্মেলন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বড় কোনো নির্দেশনা না থাকলেও সরকার গঠনের দুই মাসের মাথায় এবারের জেলা প্রশাসক সম্মেলন অনেকটা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কারণ নতুন সরকারের নীতি-কৌশলগুলো আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। আর এসব বিষয় সরকারের যাত্রার শুরুতেই সম্মেলনের কারণে একসঙ্গে সব জেলা প্রশাসকদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন মাঠে ফিরে জেলা প্রশাসকরা বিষয়গুলো বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। এবারের সম্মেলনে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিবদের অংশগ্রহণে একটি অধিবেশন ছিল। সেখানে অন্তত তিনজন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব অংশ নিয়েছিলেন। সাবেক সচিবরা তাদের অভিজ্ঞতা ভাগ করেছেন এই প্রজন্মের জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে।
জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইঞা ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারের অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্প মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়। সেগুলো বাস্তবায়ন করতে কোথায় কী সমস্যা হচ্ছে তা ডিসিদের মাধ্যমে জেনে সমাধান করার পথ খোলে। এছাড়া সম্মেলনে সব ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের সামনে সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রীরা বিভিন্ন বার্তা দেন। সরাসরি এসব বার্তা ডিসিদের মাধ্যমে দেশের তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এই বার্তা সরকারের অনেক সুফল বয়ে আনে।
সম্মেলন নিয়ে জেলা প্রশাসকরাও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তাদের কারো মতে, এই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। ডিসি না হলে এই সুযোগ পাওয়া যেত না। এতে ব্যক্তি ও সমষ্টিপর্যায়ে প্রভাব পড়ে। এর ফলে সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সরকার এবং মাঠ প্রশাসনের মধ্যে বোঝাপড়া সহজ হয়। তবে দুঃখজনক যে, আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। আবার কোনো কোনো প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডিসি হতাশা ব্যক্ত করে প্রায় অভিন্ন সুরে বলেন, ডিসি সম্মেলনে মাঠ প্রশাসনের সমস্যাগুলো তুলে ধরেছি। আশা করি এগুলোর সমাধানও হবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। সমস্যা সমাধানের কথা বলা হলেও শুধু আশ্বাস মেলে। ডিসিদের ফৌজদারি কার্যবিধির আওতা বাড়ানো, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস পদ্ধতি চালু, ভূমি অফিসের নিরাপত্তা বাড়ানো, ঝুঁকিভাতা চালুসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে একই প্রস্তাব প্রতিবছর নানারূপে ঘুরেফিরে আসে। প্রতিবছরই ডিসি সম্মেলনও হয়।
এবারের জেলা প্রশাসক সম্মেলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে জনপ্রশাসনমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, নির্বাচনের পর প্রথম জেলা প্রশাসক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের খুব চমৎকারভাবে বার্তা দিয়েছেন। মানসম্মত সেবা নিশ্চিতের বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। জেলা প্রশাসকদের আমরা বলেছি- আপনি একজন অভিভাবক, প্রশিক্ষক, মেন্টর হিসেবে কাজ করছেন। যারা সেবা নিতে আসবে তাদের যথেষ্ট মর্যাদা দেবেন।

মাঠ প্রশাসন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাঠ প্রশাসনের শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের বিভাগীয় কমিশনাররা নিবিড়ভাবে জেলাগুলোকে দেখেন। সেক্ষেত্রে যদি আমাদের মাঠ প্রশাসনের বিভাগীয় জায়গায় আরো জনবল বাড়াতে হয়, অর্গানোগ্রাম পরিবর্তন হয়, সেটা ভবিষ্যতে করব। আমরা সতর্কও করে দিয়েছি, ছোট ভুলের জন্য সারাদেশে কর্মকর্তারা যেন বিব্রত না হন।
নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, চার দিনের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ৩০টি অধিবেশন হয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি কার্য অধিবেশন ছিল। এই সম্মেলনকে ঘিরে ৬৪ জেলা প্রশাসক প্রায় হাজারখানেক প্রস্তাব পাঠিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে ৩৫৬টি প্রস্তাব আলোচনার জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছিল। জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের সমন্বয়ক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আমিন উল আহসান গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, ডিসিদের লিখিত প্রস্তাবের বাইরেও সস্মেলনে আরো প্রস্তাব নেয়া হয়েছে। সম্মেলনে ডিসিদের বলা হয়েছে, মাঠ প্রশাসনকে হয়রানিমুক্ত করতে হবে। সেবামূলক কাজ এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর বার্তা দেয়া হয়েছে। দ্রব্যমূল্যে লাগাম পড়াতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার কথা বলা হয়েছে ডিসিদের।
উত্তরাঞ্চলে কর্মরত একজন জেলা প্রশাসক জানান, তিন দিনের এ অধিবেশনে সব প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়। প্রতিটি অধিবেশনের সময় একেবারে সংক্ষিপ্ত। মন্ত্রীর বক্তব্যের পর প্রস্তাব নিয়ে তেমন আলোচনার সুযোগ থাকে না। একটা শেষ না হতেই আরেকটা শুরুর জন্য তোড়জোড় চলে। দক্ষিণাঞ্চলের একজন জেলা প্রশাসক বলেনন, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আমাদের কতটুকু আছে তা অনেকই জানেন না। একজন ডিসিকে একটি জেলার হাজারো দায়িত্বের মধ্যে গুরুত্ব বিবেচনায় কার্যক্রম হাতে নিতে হয়। আরেকজন ডিসি জানান, মন্ত্রীদের প্রটোকল ডিসিদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর একসঙ্গে যখন অনেক ভিভিআইপি জেলা সফর করেন- তখন একটু অবহেলা দেখলেই কথা শুনতে হয়। তবে এবারের ডিসি সম্মেলনে যে বিষয়টি আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তা হলো, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা এবং নতুন সরকারের নতুন পলিসি বাস্তবায়ন করা। আমরা অবশ্যই তা করব।
এর আগে গতকাল সম্মেলন শেষ হওয়ার আগে উল্লেখযোগ্য অধিবেশন ছিল ভূমি মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীক। সেখানেও ডিসিদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বাস্তবায়ন করার কথা জানিয়ে ভূমিমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করতে জেলা প্রশাসকদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। ভূমিমন্ত্রী জেলা প্রশাসকদের বলেন, ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইনের বিধিমালার খসড়া প্রণয়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এক মাসের মধ্যে বিধিমালা জারি হবে। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইতোমধ্যে বিধিমালা ছাড়াই বিচারিক আদালতের এখতিয়ার অনুযায়ী ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইনে মামলা গৃহীত হয়েছে। ভূমিমন্ত্রী বিধিমালা জারির সঙ্গে সঙ্গে এই আইনের মাধ্যমে ভুক্তভোগী ও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিকারে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেন। এ সময় ভূমি সচিব খলিলুর রহমান জেলা প্রশাসকদের জানান, নতুন তিনটি ভূমিসংশ্লিষ্ট আইনের বিধিমালা তৈরির কাজ চলমান। এছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ে শূন্য পদে নিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় পদ সৃজনে কাজ করে যাচ্ছে। ইউনিয়ন ভূমি অফিসে নৈশপ্রহরী নিয়োগের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এ সময় তিনি জেলা প্রশাসকদের ভূমি মন্ত্রণালয়ের ১৮০ দিনের কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন।
এর আগে জেলা প্রশাসকরা বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামতে নতুন আইনের বিধিমালা, খাস জমি, নামজারি, হাট ও বাজার, ভূমি অফিস নির্মাণ, জলমহাল, পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা, কোর্ট অব ওয়ার্ডস, ভূমিসংশ্লিষ্ট জনবল ও প্রশিক্ষণ, ডিজিটালাইজেশন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় উদ্ভাবনসহ ভূমিসংশ্লিষ্ট নানা বিষয় উঠে আসে কার্য অধিবেশনের আলোচনায়।
উল্লেখ্য, ভূমি রেজিস্ট্রেশন ও ভূমি জরিপ ব্যতীত, ভূমি রাজস্ব ও ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ ভূমিসংক্রান্ত অন্যান্য সব সেবা দানে কালেক্টর হিসেবে জেলা পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক। তাদের বক্তব্যের জবাবে ভূমিমন্ত্রী বলেন, কোনো জমির খতিয়ানে, দাগের আংশিক অর্পিত সম্পত্তির অংশ এবং আংশিক ব্যক্তি মালিকানাধীন হলে, অর্পিত সম্পদের অংশ বাদ দিয়ে বাকি অংশের যতটুকু ব্যক্তি মালিকানাধীন তা নামজারি করে দেয়া হবে এবং নিয়মিত ভূমি উন্নয়ন কর নেয়া হবে। এ বিষয়ে এরই মধ্যে একটি পরিপত্র জারি করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। আরেক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী জানান, বাতিলকৃত ‘খ’ তফসিলভুক্ত সম্পত্তির মধ্যে যেসবের মালিকানা আবেদনকারীর পক্ষে আদালত কর্তৃক নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণিত হয়েছে কিংবা আবেদনকারীর বৈধ প্রমাণ ও দলিল আছে, সেসব সম্পত্তির রেকর্ড সংশোধন করে মালিকানা হস্তান্তর করা হবে। এছাড়া, বাতিলকৃত ‘খ’ তফসিলভুক্ত সম্পত্তির মধ্যে যেসবের মালিকানার কোনো দাবিদার নেই সেসব সম্পদ খাসকরণের ব্যবস্থা নেয়া হবে। এসব বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট আরেকটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে।
নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, কোনো জমির একাধিক উত্তরাধিকারি থাকলে এবং তাদের মধ্যে কেউ আলাদাভাবে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে চাইলে, তার নিজ অংশ ‘জমাভাগ’ এর মাধ্যমে নামজারি করতে হবে। অন্য অংশীদার এতে আপত্তি জানালে প্রয়োজনে দেওয়ানি আদালতের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। মন্ত্রী বলেন, নামজারি ছাড়া আংশিক ভূমি উন্নয়ন কর আদায় বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ বাস্তবায়ন এবং দেশব্যাপী রেজিস্ট্রেশন-মিউটেশন আন্তঃসংযোগ স্থাপন করা সম্পন্ন হলে ভূমিসংক্রান্ত সমস্যা ও হয়রানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়