দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

স্মার্ট বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্য

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আজ বলতেই পারি পরম সৌভাগ্য আমাদের, জাতি হিসেবে আমরা গৌরব করার মতো পার্থিব অনেক কিছু পেয়েছি। আমাদের আছে মুক্তিযুদ্ধ, আছে জাতির পিতা। আমাদের আছে ভাষা এবং ভাষার জন্য রক্তক্ষয়ী আন্দোলন। পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি যারা বুকের রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষা রক্ষা করেছি, আমরাই সমবেত কণ্ঠে গাইতে পারি, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। আমরাই একুশের সকালে শহীদ স্মরণে সারি সারি উপস্থিত হই শহীদ বেদিতে, ফুল দিয়ে সম্মান জানাই ভাষা শহীদের। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের ভাষা এবং আমাদের ভাষা দিবসই পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এখন এটি বিশ্বব্যাপী সম্মানিত একটি দিবস।
আমাদের জন্য আরো আনন্দের বিষয় হলো, আমাদের সরকারের প্রচেষ্টা ও ঐকান্তিকতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তেমন একটি প্যারিসেও আছে, যেখানে সারা বিশ্বের বিভিন্ন মাতৃভাষার গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে। এটিও আমাদের একটি অনন্য অর্জন। আমাদের গৌরবের মাস ফেব্রুয়ারিতে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক। সময় এগিয়ে যায় বহতা নদীর স্রোতের মতো, আর এই বহমানতা নিয়ে আসে নানা পরিবর্তন। তেমনি একটি অনন্য পরিবর্তনের নাম ডিজিটাল বাংলাদেশ। আমরা জানি, কোনো পরিবর্তনই থেমে থাকার জন্য নয়, সব পরিবর্তন আসে আরো গভীর প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। আমাদের এই এগিয়ে যাওয়াটি হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে। সেই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ মূলত বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রæতি ও স্লোগান যা ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তরের পরিকল্পনা। এর অর্থ হলো প্রযুক্তিনির্ভর জীবন পরিকল্পনা, আধুনিক অর্থভাবনা, যেখানে প্রতিটি নাগরিক পাবে নাগরিক নিশ্চয়তা এবং চমৎকারভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের অপূর্ব সুযোগ।
বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করার কথা ভাবা হয়েছে চারটি ভিত্তিস্তম্ভের ওপর নির্ভর করে, এই ভিত্তিস্তম্ভগুলো হলো স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ। আমরা জানি, স্মার্ট নাগরিকের সঙ্গে স্মার্ট সরকারের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান, আবার স্মার্ট সমাজের সঙ্গে স্মার্ট অর্থনীতির সম্পর্কটিও চমৎকার। তবে কোথাও উল্লেখ না হলেও স্মার্ট নাগরিক গড়ে তোলার জন্য সবার আগে চর্চা করতে হবে অসা¤প্রদায়িক নাগরিক চেতনা। কারণ সব সমস্যার মূলে থাকে ভেদাভেদ, থাকে দ্ব›দ্ব এবং সা¤প্রদায়িকতা। আমরা জানি কোনো সা¤প্রদায়িক নাগরিক কখনো স্মার্ট হতে পারে না। এজন্য সবার আগে আমাদের সংস্কৃতি বিকাশ ও প্রসার ঘটাতে হবে। সংস্কৃতি উন্নত না হলে কোনো জাতি উন্নত হতে পারে না, কোনো জাতিই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, আসে না মনের প্রসারতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংস্কৃতিভাবনা অনেক উঁচুমানের ছিল, এটি আমাদের জন্য পরম আশীর্বাদ, এবং সেজন্যই আজকের বাংলাদেশ শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চায় অগ্রগামী হতে পেরেছে। তিনি সব সময়ই চেয়েছেন একটি অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশ।
এ কথা মানতেই হবে মানুষ যখন শুদ্ধ মনে সমৃদ্ধ চেতনায় সুস্থ সাহিত্যের দিকে ধাবিত হতে পারে তখনই দেশ এগিয়ে যেতে পারে আধুনিকতার দিকে। জানামতে আধুনিক সাহিত্য হলো প্রতিদিনের জীবননির্ভর সাহিত্য। এই মর্মে যদি প্রশ্ন করা হয় সাহিত্য কী? বলতেই হয়, মানুষ যা করে, যা ভাবে, যা দেখে এবং যা বলতে চায় তাই ই সাহিত্য, যদি তাতে সামান্য রঙের তুলি বুলিয়ে দেয়া যায় তাহলে তা হয়ে ওঠে অনন্য ও অসাধারণ। সাধারণ মানুষের মনের কথা যখন ছাপার হরফে ওঠে আসে তখনই তা সাহিত্য হয়ে ওঠে, ছাপার হরফেই তা ফিরে যায় সেসব মানুষের কাছে, যার মধ্যে তাদের অবস্থান। এমতাবস্থায় যদি প্রশ্ন করা হয় সাহিত্যের অবস্থান কোথায়? উত্তর আসতেই পারে, সাহিত্য ঘুমিয়ে আছে প্রতিদিনের জীবন চলায়, সাহিত্য লুকিয়ে আছে প্রতিদিনের ভাবনে প্রতিদিনের যাপনে, এ যেন বেলাভূমির গভীরে লুকানো স্রোত। একটু ছুঁয়ে দিলেই বের হয়ে আসে। আধুনিক সাহিত্য সে তো লজ্জাবতী লতা, শিশুকালে খেলার ছলে ছুঁয়ে দেয়া। সাহিত্য মানব মনের ফল্গুধারা, লুকানো ত্রিবেণী সঙ্গম, যার মধ্যে ডুব সাঁতারে মেলে পূর্ণতা।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকে কথামালা ছেনে এনে রং-তুলির আঁচড়ে সাজিয়ে পরিবেশন করার নাম হতে পারে আধুনিক সাহিত্য, তবে একথাও ঠিক যে আধুনিক সাহিত্যের নামান্তর স্মার্ট সাহিত্য নয়। আবার এটিও মানতে হবে যে, স্মার্ট সাহিত্য হওয়ার জন্য এই সময়ের জীবননির্ভর সাহিত্য হতে হবে এমনটি নয়। যে সাহিত্য চিরন্তন তাও আধুনিক হতে পারে। তবে তা হতে হবে জীবনধর্মী ও জীবনঘনিষ্ঠ। যে সাহিত্য মানুষের চেতনাকে নাড়া দেয়, যে সাহিত্য মানুষের ভাবনাতে ঠাঁই করে নেয়, যে সাহিত্য মানুষকে চলতে শেখায়, বুঝতে শেখায় আবার নতুন কিছু সৃষ্টি করতে প্রাণিত করে তাই-ই হতে পারে স্মার্ট সাহিত্য।
বাংলা ভাষার সাহিত্যকে স্মার্ট করার জন্য আরো কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। ভাষা ও সাহিত্যকে স্মার্ট করার জন্য প্রযুক্তিকে আরো বেশি আপন করে নিতে হবে। আমরা জানি, ডিজিটাল বাংলাদেশের পর সরকারের লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ এবং এটি ২০৪১ এর মধ্যে সম্পন্ন করা হবে। সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, তাই ভাষা, সাহিত্যসহ সবকিছুই স্মার্ট হতে হবে। যদিও আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করছি, কিন্তু আমরা কাগুজে গ্রন্থ থেকে মুক্ত হইনি, হবোও না। কারণ গ্রন্থ পাঠের আনন্দ চিরন্তন, এ থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন। একসময় সবাই-ই কাগজে ছাপানো গ্রন্থ পাঠ করত, কিন্তু এখন অনেকেই অর্থাৎ প্রযুক্তি শিক্ষিত ও প্রযুক্তিনির্ভর মানুষরা ট্যাবে কিংবা ল্যাপটপে গ্রন্থ পাঠ করে থাকে। একথা অনস্বীকার্য যে, সাহিত্য সব সময় পাঠকনির্ভর। সব ধরনের পাঠকের কাছে পৌঁছানোই সাহিত্য চর্চার উল্লেখযোগ্য লক্ষ্যগুলোর একটি। তাই কাগুজে বই কিংবা প্রযুক্তিগত পাঠ, যেটিই হোক না কেন পঠন প্রক্রিয়ার সবটাই শিরোধার্য। আমরা জানি, সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে হবে এবং সাহিত্যকে ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বের দরবারে। এজন্য যা যা করা দরকার এবং যা যা করা সম্ভব তাই-ই করতে হবে।
এজন্য প্রথমেই অনুবাদের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে এবং তা হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে। অনুবাদের মাধ্যমে বাংলাসাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিতে হবে বহির্বিশ্বে। মানুষের হাতে তুলে দিতে হবে আমাদের সাহিত্য, আমাদের সৃষ্টি। জানাতে হবে আমাদের সাহিত্য কতটা সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারের সুমিষ্ট রসাস্বদনের সুযোগ করে দিতে হবে বিশ্বের সাহিত্যমোদীদের। একইভাবে বিদেশের সুসাহিত্যকে সঠিকভাবে অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের কাছে নিয়ে আসতে হবে। এভাবেই হতে হবে সংস্কৃতি বিনিময় এবং সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সমৃদ্ধির জন্য এ বিনিময় অপরিহার্য। নিজেদের সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ন রেখে আমরাও ছড়িয়ে পড়তে পারি দেশ থেকে দেশান্তরে, জ্ঞানের অন্বেষণে।
শুধু অনুদিত হলেই হবে না, আমাদের দেশের লাইব্রেরিগুলো অনুবাদ সাহিত্য এবং মূল সাহিত্যের অডিও ভার্সনও থাকতে হবে। তাহলে আমাদের সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে বহির্বিশ্বের সাহিত্যকে অনেক বেশি মানুষ জানতে পারবে, শুনতে পারবে। সাহিত্যকে অনেকের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য অডিও ভার্সনের বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। এখন এটি বিশেষভাবে দরকার। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, তবে হবে এগিয়ে যাওয়া, তবেই সাহিত্য হবে আধুনিক, সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী। ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের ভাষা আন্দোলনের মাস। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির সত্তা জাগ্রত হয়েছে। এই পথ বেয়েই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এই মাসের আন্দোলনের মাধ্যমেই আমরা বাংলায় কথা বলার অধিকার অর্জন করেছি, তবে এটি অর্জন করতে আমাদের অনেক ত্যাগ করতে হয়েছে। এটিও একটি সৌভাগ্য এবং অর্জন। এ মাসের সাহিত্য সেবার জন্য মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এজন্য সবার আগে দরকার আধুনিক প্রযুক্তিকে রপ্ত করা। প্রযুক্তিকে আপন করে নিলে দেশ বিদেশের সাহিত্যের সব ধারায় ভ্রমণ করা সহজ হবে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ সফল করার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আজ এবং এখন থেকেই শুরু হোক আমাদের সেই মহান কর্মযজ্ঞ।

শেলী সেনগুপ্তা
কবি ও কথাসাহিত্যিক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়