দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

বইমেলা ও সাংস্কৃতিক জাগরণ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চিরাচরিত প্রথা অনুসারে ১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ২১তম বারের মতো মাসব্যাপী ‘অমর একুশে বইমেলা’ উদ্বোধন করে রেকর্ড গড়েছেন। বাংলা একাডেমি আয়োজিত ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের বইমেলার প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘পড়ো বই, গড়ো দেশ : বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। বইমেলায় ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৯৩৭টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমি মাঠে ১২০টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৩টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৫১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৬৪টি স্টল বরাদ্দ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ বছর মোট ৩৭টি প্যাভিলিয়ন। গত বছর ৬০১টি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মোট ৯০১টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। বইমেলা বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণের অন্যতম স্তম্ভ। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে আবারো বিশ্ববাসীর কাছে চমক দেখিয়েছে। এ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিশ্ববাসীর কাছে আজ ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু এ দেশ এখন ভাষা ও সাহিত্যের দিক থেকে বিশ্বব্যাপী মর্যাদার আসন অলঙ্কৃত করেছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ যেমন স্বীকৃতি পেয়েছে বিশ্বসভ্যতার অমূল্য সম্পদ হিসেবে, তেমনি বাংলা সংস্কৃতির অনেক উপকরণ আজ পৃথিবীর মানুষের কাছে বিস্ময় নিয়ে উপস্থাপিত হচ্ছে। কেবল বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রা কিংবা বাউল সংগীত নয়, এ দেশের ইলিশও স্বীকৃতি অর্জন করেছে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার অসামান্য নেতৃত্বের কারণে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের শাসনামলে শেখ হাসিনার সদিচ্ছায় অমর একুশ বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ রূপে উদযাপন সূচনা হয়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বাঙালির যা কিছু মহৎ সৃষ্টি তাকে বিশ্বসভায় পরিচয় করিয়ে দিয়েছে তার গঠিত সরকারই। আর সাংস্কৃতিক জাগরণের ঢেউ দেশের রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়ার কৃতিত্বও লেখক শেখ হাসিনার। বইমেলা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জাগরণের কথা বলতে গেলে তার রাজনৈতিক আদর্শের কথাও বলতে হবে।

দুই.
আসলে পিতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ, আন্দোলন-সংগ্রাম-কারাবন্দি জীবন সবই শেখ হাসিনা শৈশব-কৈশোর থেকেই দেখেছেন। এই অভিজ্ঞতা তাকে পিতার আদর্শ উত্তরাধিকারী হিসেবে গড়ে তোলে। তিনি যখন আজিমপুর গার্লস স্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, তখন তিনি নেতৃত্ব দিয়ে ছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেন। এ সময় পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করেছিল। এরপর ঢাকার উচ্চ মাধ্যমিক মহিলা কলেজের ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে সহসভাপতি নির্বাচিত হয়ে কলেজের ছাত্রীদের সমস্যা সমাধান ও সাংস্কৃতির কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন। কলেজে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের কথা লেখা আছে শেখ হাসিনার নিজের রচনায়। ‘আমাদের দেশে ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্য ছিল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আন্দোলন করার জন্য। ছাত্র রাজনীতির এই ঐতিহ্য নষ্ট করার জন্য এবং আইয়ুব খানের আমলেই ছাত্র রাজনীতিতে অস্ত্রধারীদের মহড়া শুরু হয়। মেধাবী গরিব ছাত্রদের অর্থ দিয়ে ছাত্র রাজনীতি ধ্বংসের এই চক্রান্ত আজও বিদ্যমান।’ (স্কুল জীবনের কিছু স্মৃতিকথা, সাদা কালো) বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতার রাজনৈতিক জীবনকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়েছিল বলেই তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো বাংলার মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে বলেছেন, ‘আমার একমাত্র দায়িত্ব পিতার অধরা স্বপ্ন সফল করা।’ শেখ হাসিনা বলে থাকেন, ‘জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই আমার রাজনীতি।’ শিশুদের মধ্যে ভবিষ্যৎ দেখতে ভালোবাসেন, ‘শিশুরা আমাদের দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করে তাদের ভবিষ্যৎকে আনন্দ, উজ্জ্বল, স্বস্তি ও শান্তিময় করে তুলতে হবে।’ শেখ হাসিনা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন ও সংগ্রাম, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সাহসী যোদ্ধা, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার প্রবক্তা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শীতার কারণে তাকে বিশেষভাবে শান্তি পুরস্কার ও সম্মানীয় ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। সেগুলো হচ্ছে : ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক শান্তি পদক-২০০৯, কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির ইন্দিরা গান্ধি স্বর্ণপদক-২০০৯, ইউনেস্কো হুফে বোয়েগনি শান্তি পুরস্কার-১৯৯৯, ফিলিপিন পার্লামেন্টের ‘কংগ্রেশনাল মেডেল অব এচিভমেন্ট-২০০৫। সম্মানীয় ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৭), জাপানের ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৭), যুক্তরাজ্যের আবিরডিন ড্যান্ডি বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৭), ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৯), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৯), বেলজিয়ামের ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় (২০০০), যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিজপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয় (২০০০), অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (২০০০), মস্কো প্যাট্রিস লুমুম্বা পিপলিস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি (২০০৫)। যে কোনো সংকট মুহূর্তে কিংবা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৮২ থেকে আজ পর্যন্ত অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তিনি প্রচণ্ড দৃঢ়তার সঙ্গে নিয়েছেন। প্রতিকূল পরিবেশ, সহকর্মীদের শত বাধা এবং সুশীল সমাজ কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চিন্তা-চেতনা সম্পূর্ণরূপে তার বিপক্ষে থাকার পরও তিনি এগিয়ে গিয়েছেন। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে এবং পরবর্তী সময়ে আবার সংসদ থেকে বের হয়ে আসা একটি বিশাল ব্যাপার ছিল। ১৯৯১ সালের পর বিএনপিবিরোধী আন্দোলনে সফলতা, ১৯৯৬ সালের সরকারপ্রধান হিসেবে সাফল্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, তেমনি ১/১১’র প্রেক্ষাপটে অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনন্যসাধারণ। সব শেষে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি তিনি করেছিলেন দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে- বিরোধী পক্ষসহ তাবৎ দুনিয়ার ক্ষমতাবান রাষ্ট্রশক্তির হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে কেবলমাত্র নিজের দলের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে। এজন্য তার উপলব্ধি তাৎপর্যবহ- ‘বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করে উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাদের ভালোবাসার প্রতিদান আমাকে দিতেই হবে। জনগণের জন্য একটা সুন্দর, উন্নত জীবন উপহার দেব, এই আমার প্রতিজ্ঞা।’ (সবুজ মাঠ পেরিয়ে)

তিন.
‘জনগণের জন্য একটা সুন্দর, উন্নত জীবন উপহার দেব’- এই প্রত্যয় কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং জনগণের চেতনা বিস্তারে তিনি কাজ করে চলেছেন সাংস্কৃতিক জগৎ বিনির্মাণে। গত ১৫ বছর (২০০৯-২০২৩) একটানা বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘একুশে আমাদের আনন্দের এবং গৌরবের দিনও বটে। জাতীয় সীমানা পেরিয়ে এ দিনটি আজ বিশ্বজনীন মানব সভ্যতার অংশ। আপনারা জানেন, ইতোপূর্বে আমরা সরকারে থাকতে বাংলা একাডেমিতে ১৯৯৮ সালে ২১তলা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলাম। বাংলা একাডেমি-সোহরাওয়ার্দী উদ্যান-শিল্পকলাকে কেন্দ্র করে ‘সোনার বাংলা সাংস্কৃতিক বলয়’ তৈরির কাজও আমরা শুরু করেছিলাম। ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মরণে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রকল্প’ গ্রহণ করেছিলাম।… আজ দুঃখের সাথে বলতে হয়, পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেই এসব প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। জাতি দেখেছে কীভাবে দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নের পরিবর্তে দলীয় রাজনীতি ও প্রতিহিংসাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। আপনারা জানেন, এবার আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করেছি, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করব। আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা ও সৃজনশীল সকল কাজ রক্ষা ও উন্নয়নে কার্যকর উদ্যোগ নেব। আমাদের সরকার ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।’
অর্থাৎ ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা তার অভীষ্ট কার্যক্রম শুরু করেন। এজন্য তিনি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাস্তবায়নে উদ্যোগী হন। কিন্তু ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়ত জোট সরকার তার সব শুভ প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেয়। সৃষ্টি হয় সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য। আমরা জানি, ভাষা, সংস্কৃতি ও সৃষ্টিশীলতা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এ দেশে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা বিস্তারের অন্যতম অনুঘটক। অথচ বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে ইতিহাস বিকৃত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। সে সময় বাংলা একাডেমি পরিণত হয়েছিল মূর্খদের আস্তাবলে, অপশক্তির কব্জায় ছিল আবদ্ধ। বর্তমান সরকার ভিশন ২০৪১ সালকে সামনে রেখে ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন করেছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। এর মধ্যে জাতির পিতার জন্মশত বর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পর বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ, আধুনিক ও কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি। মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন ও দিনবদলের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন হয়েছে। আগামীতে আরো অগ্রসর হবে এ দেশ। শেখ হাসিনা নিজে জানেন অমর একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই লেখা, প্রকাশনা ও বিপণনে জোয়ার আসে। একুশে বইমেলা থেকে প্রতি বছর সর্বাধিক সংখ্যক বই প্রকাশ ও বিক্রি হয়ে থাকে। তবে এখন দরকার বই-এর মূল্য হ্রাস এবং মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করা। বিশেষ করে ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, বিশ্বমানের সাহিত্যের প্রকাশনার দিক থেকে আমাদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না। অন্যদিকে উচ্চমান সম্পন্ন লেখা- তা গল্প-উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ বা গবেষণা অভিসন্দর্ভ; যা-ই হোক পেতে হলে লেখকদের উপযুক্ত সম্মানী ও প্রণোদনা না দিলে ভালো কিছু আশা করা যাবে না। শেখ হাসিনার মতে, একটি বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিসম্পন্ন সংস্কৃতিবান সমাজ গড়ে তুলতে যেমন বই-এর ভূমিকা অপরিসীম, তেমনি লেখক-প্রকাশক-পাঠক সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যতিরেকে আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব না। তিনি বলেছেন, ‘বই মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। মানুষের নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব দূর করতে বই পালন করে থাকে এক অসামান্য ভূমিকা। আমি নিজে তার প্রমাণ। জেলখানার নিঃসঙ্গ দিনগুলোতে বই ছিল আমার একমাত্র সঙ্গী। বই ছাড়া সেই নিঃসঙ্গতা কাটানোর কোনো বিকল্পই আমি চিন্তা করতে পারিনি।’ তিনি চিন্তা করেছেন আমাদের দেশের শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী মানুষের ভাষা নিয়ে। ‘ইশারা ভাষা’র উন্নয়নে কাজ করার নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি।

চার.
অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় চটের ওপর ৩২টি বই সাজিয়ে বিক্রি শুরু করেন শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা। তিনিই এই বইমেলার সূচনাকারী। তার আনা ৩২টি বই ছিল তার নিজ প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী সাহিত্যিকদের লেখা বই। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি বইমেলা উপলক্ষে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। বাংলা একাডেমির পাশাপাশি মুক্তধারা প্রকাশনী, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং আরো কয়েকজন বাংলা একাডেমির মাঠে নিজেদের প্রকাশিত বই বিক্রি শুরু করে। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি তার নিজস্ব প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। তখন একাডেমি প্রাঙ্গণ সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য কিছুটা জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয় বাংলা একাডেমি। সেই নির্দিষ্ট স্থানে প্রকাশকরা যে যার মতো স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এই আয়োজনের কোনো স্বীকৃতি দেয়নি বাংলা একাডেমি। এমনকি কোনো নামও দেয়নি। তবে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। তারপর ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। একাডেমি এবং বইমেলার নামকরণ ‘একুশে গ্রন্থমেলা’ করে ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ‘একুশে গ্রন্থমেলা’ পালিত হয়। আবার ১৯৮১ সালে ‘একুশে গ্রন্থমেলায় পরিবর্তন আনে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র মেয়াদ কমিয়ে ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন ধার্য করে বাংলা একাডেমি। কিন্তু প্রকাশকরা বাংলা একাডেমির এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। তারা বাংলা একাডেমির এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের দাবি তুলে ধরেন। প্রকাশকদের এ দাবির মুখে ১৯৮২ সালে ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র মেয়াদ পুনরায় বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়ে পুনরায় মেলার মেয়াদ করা হয় ২১ দিন করে এবং মেলার উদ্যোক্তা হিসেবে বাংলা একাডেমি সে মেলার আয়োজন করে। ১৯৮২ সালের ওই মেলায় সহযোগী হিসেবে ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি।

১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন কবি মনজুরে মওলা। তিনি বিশেষ কারণে সহযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাংলা একাডেমি থেকে বাদ দিয়ে দেন। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি আবার ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র পুনঃআয়োজন করে। সে সময় প্রকাশকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে স্টলের সংখ্যা বাড়ানো হয়, সেই সঙ্গে মেলার পরিসরও বাড়তে থাকে। ‘অমর একুশে’ বইমেলা চলাকালীন প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা, কবিতা পাঠের আসর, লেখক আড্ডাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজন করে থাকে বাংলা একাডেমি। সন্ধ্যার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভাষার চেতনাকে গৌরবান্বিত করা হয়। বর্তমান মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার আমলে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বই প্রকাশিত হয়েছে বাংলা একাডেমি থেকে। শেখ হাসিনার উৎসাহে মহাপরিচালক প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধুর ‘রচনা সমগ্র’ গ্রন্থটি। পাঠকমহলে গ্রন্থটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

পাঁচ.
বইমেলা এখন ঐতিহ্যবাহী অসাম্প্রদায়িক জ্ঞান-উৎসবের নাম- বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালের মতো একই দিন অর্থাৎ ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে তিনি অমর একুশে বইমেলা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ দেশের সাংস্কৃতিক জাগরণের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। বইমেলাকে তিনি বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী বৃহত্তম মেলা হিসেবে চিহ্নিত করে তার স্বীকৃতি পাওয়াকে সম্মানের বলেছেন। এই বইমেলা এখন আর শুধু বই কেনাবেচার কেন্দ্র নয়, একই সঙ্গে তা বাঙালির এক ঐতিহ্যবাহী অসাম্প্রদায়িক জ্ঞান-উৎসবের নাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বসভা জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ প্রদান করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ ভাষার গৌরব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমরা দেখতে পাই শেখ হাসিনাও একই কাজ করেছেন ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসীন হয়ে। ২০২৪ সালে তিনি বলেছেন, ‘সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে আমি নিজেও নিয়মিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে নিয়মিত বাংলায় ভাষণ দিয়ে আসছি। আপনাদের সবার প্রচেষ্টায় আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করতে পারব।’
মূলত তিনি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্যের কথা তুলে ধরেছেন। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতায় আমাদের জামদানি এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ এখন এক অফুরন্ত সম্ভাবনার নাম। আমরা স্বল্পতম সময়ে দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূলে সক্ষম হয়েছি। এসবই সাংস্কৃতিক জাগরণের অন্যতম কাজ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে এখন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন হয়, আসেন বিশ্বসেরা ব্যক্তিত্বরা। তার নির্দেশনায় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা বেগবান হয়েছে। অচিরে দেখতে পাব তরুণ প্রজন্ম কেউ আর ধর্মীয় মৌলবাদে দীক্ষা নিচ্ছে না। বরং রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছে তারা। তারা বই পড়ছে। ইন্টারনেটের সুবিধা কাজে লাগিয়ে ই-বুকও ডাউনলোড করছে। বস্তুত তরুণদের সাংস্কৃতিক জাগরণের মূল মন্ত্রটি হাতে তুলে দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়