দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

প্রত্যাশার ভোরের কাগজ : বর্ষপূর্তিতে অভিবাদন

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সময়ের বিবর্তন আর প্রযুক্তির উদ্ভাবনে পরিপার্শ্বের দৃশ্যপট বদলে যায়। বদলে যাওয়া দৃশ্যপটে দাঁড়িয়ে উত্থাপিত হয় নানান প্রশ্ন; যত প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, আমাদের উদ্বেগ ততটাই বাড়ে; কিন্তু যে কোনো প্রশ্ন থেকে মুক্তি পেতে আমরা কতটা আন্তরিক এবং উদ্যমী তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমরা না পড়িয়া পণ্ডিত, আমরা না লড়িয়া বীর, আমরা ভান করিয়া সভ্য, আমরা ফাঁকি দিয়া পেট্রিয়ট। আমরা ভারি ভদ্র, ভারি বুদ্ধিমান, কোন বিষয়ে পাগলামি নেই। আমরা পাস করিব, রোজগার করিব ও তামাক খাইব। আমরা এগোবইনা, অনুসরণ করিব, কাজ করিব না পরামর্শ দিব…!!’ বাণীটির কথা মনে পড়ে, তখন বুঝতে পারি, বাঙালির ভবিষ্যৎ দুর্দশার কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন! সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তির বিকাশ এবং মিডিয়ার দৌরাত্ম্যে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে প্রিন্টমিডিয়ার অস্তিত্ব নিয়ে; কিন্তু আমাদের অপরিণামদর্শিতা এবং কাণ্ডজ্ঞানহীতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে চাইছেন না সহজে। বড় বড় মিডিয়া হাউস তাদের শ্রী হারাচ্ছে। কেন এমনটি ঘটছে, তার কার্যকারণ কি আমরা তলিয়ে দেখছি? মিডিয়া হাউসগুলোতে কি সেরকম কোনো গবেষণা সেল আছে, যারা যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় দিকনির্দেশনা দিতে পারে?
কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, বই পড়া জীবনের অস্তিত্ব আর ক’দিন? তাদের কথায়- আচরণে মনে হয় বাঙালির জীবন থেকে পড়ার অভ্যাস উঠে গেলেই একটা উৎসবের আয়োজন করা যায়। খোঁজ নিয়ে দেখুন, যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগেই তার পরাজিত হতে অপেক্ষায় আছে। করপোরেট বিশ্বের মোড়লেরা যেভাবে আমাদের পদদলিত করে রাখতে চায়; তাদের সেই প্রক্রিয়ায়, প্রাগ্রসর-প্রগতির লেবাসধারী তথাকথিত অতি আধুনিক প্রবঞ্চকরা লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের পতাকাকে ভূলুণ্ঠিত করার গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকে বাঙালিকে মেধা শূন্য করার কাজে নিয়োজিত আছে। লক্ষ করলেই দেখা যাবে আমাদের জীবন থেকে শুভ প্রবণতার অনুষঙ্গগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে তাদের যত তৎপরতা। অনুসন্ধান করে দেখুন, দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে কূট ষড়যন্ত্রে কিছু কিছু প্রগতিশীল লেবাসে অনৈতিক সাংবাদিক-খল বুদ্ধিজীবী জড়িত আছে; সময়-সুযোগে তারা একে অপরের পৃষ্ঠকুণ্ডলনে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। মানুষ যখন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, রাতারাতি তারা নিজেদের পোশাক পাল্টে মিশে যাচ্ছে বারবার। পাকিস্তানি আমলে যেমন, স্বাধীন বাংলাদেশেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
পত্র-পত্রিকা এবং মিডিয়া বিকাশের ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা উচিত, সময় থাকতেই সে সংকট সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে। সংবাদপত্র যখন সংবাদ নির্ভর শিল্প, তখন এর পাঠক কারা হবেন, তা চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি কেন একজন মানুষ পত্রিকা পাঠে আগ্রহী হবেন, তা-ও অবিষ্কার করতে হবে। এখানে আরো একবার রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হতে চাই। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘জ্ঞানের কথা একবার শুনিলেই জানা হইয়া যায়; দ্বিতীয়বার কেহ তাহা শুনাইতে আসিলে ধৈর্য রক্ষা করা কঠিন হইয়া পড়ে; কিন্তু ভাবের কথা একবার শুনিলেই শেষ হইয়া যায় না! বারবার তাহা শুনিতে মন চায়।’ সংবাদ যখন তথ্য, সে তথ্য তো একবার জানলেই চলে, দ্বিতীয়বার কেন আমি তা খুঁজতে যাব! তথ্য-প্রযুক্তির এ সময়ে বাতাস, আলো, শব্দ আর বিদ্যুতের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বার্তা (সংবাদ) ছড়িয়ে যায় দিক-দিগন্তে; পৃথিবীর যাবতীয় বার্তা প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে আমাদের সূর্যোদয়ের অপেক্ষা করতে হয়; প্রযুক্তির বদৌলতে রাতেই আমরা অনলাইনে জেনে যাচ্ছি, আগামী সকালে পত্রিকার পাতায় কী থাকছে, তার সমস্ত তথ্য। নতুন নতুন তথ্যের জন্য আমরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় পৃথিবীর আপডেট পেয়ে যেতে পারি লেটেস্ট এডিশনে; এমন বাস্তবতায় কেন মানুষ বার্তার জন্য সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করবে! কেন প্রিন্ট মিডিয়া প্রতিযোগিতায় টিকবে অনলাইন মিডিয়ার সঙ্গে। আমার বিশ্বাস এমন বাস্তবতায় প্রিন্ট মিডিয়াকেই উদ্ভাবনী কৌশলে জেনে নিতে হবে লড়াইয়ের মন্ত্র। আমি যখন আমার প্রতিটি বর্ণ-অক্ষর আর পঙ্ক্তিকে স্থায়িত্ব দিতে চাইব, তখন আমাকেই ওয়ান টাইম সংস্কৃতির ডামাডোল থেকে আবিষ্কার করতে হবে স্থায়িত্বের কলা। ওয়ানটাইম সংস্কৃতির প্রসঙ্গটি মাথায় আসতেই মনে পড়ে গেল, সোনার ডিম দেয়া গল্পের সেই হাঁস আর কৃষকের কথা। না, সোনার ডিম দেয়া হাঁসের গল্প বলার মতো বোকা আমি নই; আমি জানি সে গল্প সবার জানা। আমি কেবল ‘ওয়ানটাইম সংস্কৃতি’র মোহে পড়ে লোভী কৃষকের ভাগ্যে ফলাফলটা কী ঘটেছিল তাই স্মরণ করতে বলব সবাইকে। দুঃখের বিষয়, কিছুদিন যাবৎ লক্ষ করছি আমাদের কৃষি-প্রকৌশল-শিক্ষা-রাজনীতি-শিল্প-সাহিত্য-বাজার-পণ্য, মায় প্রেম ও সংসার; সর্বত্র ‘ওয়ানটাইম সংস্কৃতি’ বেশ জেঁকে বসেছে। একসময় আমরা দেখেছি ক্ষমতাসীনদের কৃপা কুড়ানো একটি গোষ্ঠী এত পরিমাণ লুটপাটে নিয়োজিত রেখেছে নিজেদের, যেন জীবনে আর তাদের ক্ষমতায় আসার প্রয়োজন নেই। তার ফলও তারা ভোগ করেছে, দিনের পর দিন তাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, দেশান্তরী হতে হয়েছে; তবুও তাদের ‘ওয়ানটাইম সংস্কৃতি’র ওপর আস্থা কমেনি। কারণ তারা জানে, এ দেশের মানুষ ‘ওয়ানটাইম সংস্কৃতি’ ভালোবাসে এবং মানুষ তাদের কার্যকলাপের কথা বিস্মৃত হয়ে আবার তাদেরই ক্ষমতাসীন করতে চাইবে। তাই তো একেকজন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে আস্ফালন করে যাচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। আমাদের কৃষকের সঞ্চয়ে একসময় ছিল ধানের বিচিত্র সম্ভার, মাঠে মাঠে ফলত নানান প্রজাতির ধান; কিন্তু ‘ওয়ানটাইম সংস্কৃতি’ কেড়ে নিল বাংলার ধানের বৈচিত্র্য। বিশ্ববাজার অর্থনীতি আর করপোরেট শ্রেণির চাপে আমাদের কৃষি ‘ওয়ানটাইম সংস্কৃতি’র কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হলো। একসময় বিষয়টি নিয়ে কারো কারো সামান্য মাথাব্যথা লক্ষ করেছিলাম বটে, কিন্তু সে ব্যথা আজো অবশিষ্ট আছে মনে হয় না। সবার নিশ্চয়ই মনে আছে, ‘হাইব্রিড’ ধানের নামে কৃষকের সামনে আনা হলো উচ্চফলনশীল ধানের বীজ, যে বীজ থেকে ফলন বাড়ল বটে, কিন্তু উৎপাদিত ধান থেকে বীজ সংগ্রহের সুযোগ থাকল না; সুতরাং পরবর্তী সময় আবাদের জন্য তাকে বীজের জন্য পরমুখাপেক্ষী হয়ে পড়তে হলো। আজ আমরা ধান বলতে ‘টোয়েন্টি নাইন’ আর ‘টোয়েন্টি এইট’ শুনেই খুশি। ধানের ফলন বেড়ে খাদ্যে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা এলো বটে, কিন্তু হারিয়ে গেল বাংলাদেশের কৃষকের ধানবৈচিত্র্যের গৌরব। অত্যাবশকীয় প্রয়োজনেই আমরা নিজেদের অহংকারের এ গৌরবটি হারিয়েছি।
বাজারে চৈনিক পণ্যে ছেয়ে গেল, সবই ‘ওয়ানটাইম’, একবার নষ্ট হলে সংস্কারের সুযোগ নেই। ‘ওয়ানটাইম সংস্কৃতি’র প্রভাবে নিত্য বদলে যাচ্ছে আমাদের রুচি, প্রতিদিন নতুন নতুন মডেল চলে আসছে বাজারে; ঘন ঘন আমরা বদলে ফেলছি আমাদের নিত্য ব্যবহার্য সব সামগ্রী। ব্যবহার্য সামগ্রীর মডেল বদলে ফেলাই যেন হাল-আমলের ফ্যাশান। বলা যায়, জাতীয় জীবনের এই পরিবর্তনকে মেনেই নিয়েছি আমরা; শিশু থেকে কিশোর, তরুণ থেকে বৃদ্ধ সবাই আজ ‘ওয়ানটাইম সংস্কৃতি’র সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। সবাই যাকে নিজেদের জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে, তখন সে বিষয় নিয়ে কথা বলা কতটা যৌক্তিক ভেবে দেখার বিষয় বটে! ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’ কথাটা আজ যেন অচল হয়ে পড়েছে। সবার নিত্যনতুন সামগ্রী চাই। পুরনো মানেই যেন পরিত্যজ্য। বহু বছর ব্যবহৃত আমার পুরনো পিরানের কোমল স্পর্শ আজ আর আমার ভালো লাগে না; আমার চাই চকমকে জামায় নতুন ডিজাইন।
আজকের বাস্তবতায় টিকে থাকার সংগ্রামে তাৎক্ষণিকতাকে যেমন বিবেচনায় নিতে হবে, নিত্যতা এবং প্রাত্যহিকতাকেও তেমনি গুরুত্ব দিতে হবে। কোন বিবেচনায় আমাদের দৈনিক কাগজগুলো শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পায় জানি না। শুনতে পাই প্রচার সংখ্যা দিয়ে না কি পত্রিকার শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপিত হয়; অন্যদিকে শুনি- ‘পত্রিকার প্রচার সংখ্যা আর নারীর বয়স জিজ্ঞাসা করা না-কি সমীচীন নয়- ওসব গোপন বিষয়।’ কোনো পত্রিকার প্রচার সংখ্যা নিশ্চিতকরণের জন্য কে প্রতিদিন নদীর ঢেউ গণনা করতে যান? তাছাড়া পাঠক সংখ্যা বিচারে পত্রিকার শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপের সুযোগ কোথায়? ব্যক্তিগতভাবে আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ক্রেতা কোন কাগজ কেন কিনছেন এবং পড়ছেন, তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা তার কাছে নেই। অনেক সময়ই প্রোপাগাণ্ডায় যে এগিয়ে থাকে, তাকেই সেরা বলে মনে হয়; আর যারা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে অভ্যস্ত, যাঁরা হুজুগে শামিল হয়ে ভাবেন, সঠিক পথে আছি; তাদের ভিড় দেখে পত্রিকার শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের পক্ষে আমি নই। শঙ্খ ঘোষের কবিতা মনে পড়ছে-

একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্যে গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
একটা দুটো সহজ কথা
বলব ভাবি চোখের আড়ে
জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে
বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।

কে কাকে ঠিক কেমন দেখে
বুঝতে পারা শক্ত খুবই
হা রে আমার বাড়িয়ে বলা
হা রে আমার জন্ম ভূমি।
বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সাথে ওতপ্রোত
নিয়ন আলোয় পণ্য হলো
যা কিছু আজ ব্যক্তিগত।

মুখের কথা একলা হয়ে
রইলো পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।
(মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে \ শঙ্খ ঘোষ)

বাণিজ্যিক কৌশল, নৈপুণ্য আর ছলনা কখনো শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হতে পারে না। তাহলে পত্রিকার শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি কোনটি? আমি বিশ্বাস করি শ্রেষ্ঠত্বের ভিন্ন মাপকাঠি থাকাই সঙ্গত। একটি পত্রিকার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে, সেই পত্রিকায় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ছাপ কতটা উপস্থিত তার ওপর; পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই পরিকল্পনায় যদি ষড়যন্ত্র থাকে; সেই পরিকল্পনায় যদি রাষ্ট্রদ্রোহিতা থাকে; তাকেও কী প্রশংসিত করতে হবে! রাজনৈতিক প্রভাববলয়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, বিজ্ঞাপনের চমক বা চলতি হাওয়ার পন্থি হয়ে নয়; আমি বরং চোখ-কান খোলা রেখে, যাচাই-বাছাই করে একটি কাগজকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করে তার পক্ষে অবস্থান নিতে চাই। কোনো পত্রিকার নাম উচ্চারণ না করেই আমি বলতে চাই- সেই পত্রিকাই শ্রেষ্ঠ, যে পত্রিকায় উপস্থাপিত বিষয় শ্রেষ্ঠ; যে পত্রিকার লেখার মান শ্রেষ্ঠ; যেখানে উপস্থাপিত লেখাগুলো বিষয় বৈচিত্র্যে শ্রেষ্ঠ; যে পত্রিকা মুদ্রণ সৌকর্যে শ্রেষ্ঠ; যে পত্রিকা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ বিবেচনায় প্রতিদিন যথানিয়মে প্রকাশিত হয়; যে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ এমন মনোভাব প্রকাশ করে না, যে আপনার-আমার মনে হবে, চিন্তা-চেতনা এবং মনন-মনীষায় তারাই সর্বোচ্চে অবস্থান করে; তাদের কথাই শেষ কথা; যেখানে ভিন্নমত-ভিন্নচিন্তা প্রকাশের মুক্ত আঙিনা আছে; যেখানে সংখ্যা গুরু মানুষের মনোভাব বিবৃত হতে দেখি; আবার বঞ্চিত-নিপীড়িত এবং সুবিধাবঞ্চিতদের পক্ষে অপ্রিয় সত্য উচ্চারণে যে কাগজের আছে দুরন্ত সাহস; আমি সেই পত্রিকার সঙ্গে থাকার পক্ষপাতী। পক্ষপাতী থাকতে চাই স্পর্ধা নিয়ে। কারণ আজকের সংকটে আমরা যারা ইতিহাস-ঐতিহ্যের সংগ্রামে ব্রতী হতে চাই, তাদের উচিত নিজের পছন্দের কাগজটির পক্ষে থাকা। সংকট মোকাবিলা করে বন্ধুর পথে লক্ষ্যে পৌঁছার অঙ্গীকারে এগিয়ে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করা।
স্বঘোষিত অনেক শ্রেষ্ঠ কাগজের তুলনায় নানান বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ কোনো কোনো কাগজ পেছনের সারিতে পড়ে থাকছে; সে সত্যটি উচ্চারণও এ দুর্বৃত্ত সময়ে কখনো জরুরি হয়ে যায়। বাঙালির শৌর্য-বীর্য-ঐতিহ্য আর সংগ্রাম-প্রগতির ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্তিতে যখন আমি প্রত্যাশা করেছি, আধুনিক বাংলা গদ্যভাষার ঈশ্বর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বিশেষ আয়োজন হোক, সে সময় একটি কাগজ আমার প্রত্যাশা পূরণ করেছে; নারীমুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার প্রয়াণের ৯০ বছরপূর্তিতে যখন প্রত্যাশা করেছি বিশেষ আয়োজন, সে সময় যে কাগজ আমার প্রত্যাশা পূরণ করেছে; জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জন্ম শতবর্ষ, বাঙালির বিজয়ের অর্ধ শতাব্দী পূর্তি স্মরণে নানান আয়োজন; মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্তিতে যে কাগজ আমার প্রত্যাশায় হাত বাড়ায়, মৈমনসিংহ-গীতিকা প্রকাশের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে যে পত্রিকা বিশ্বে বাঙালির গৌরবদীপ্ত প্রথম পরিচিতির স্মৃতিকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করে, শতবর্ষ পূর্বে এই মৈমনসিংহ-গীতিকা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিল বঙ্গ জনপদের ঐতিহ্য আর গৌরব; আমাদের ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল প্রতিটি অধ্যায়কে বিশেষ আয়োজনে মহিমান্বিত করার পাশাপাশি জাতির নতুন প্রজন্মকে মৃত্তিকালগ্ন রাখতে যে কাগজ আন্তরিক; সেই কাগজকে শ্রেষ্ঠ পত্রিকার শিরোপা দিতে আমার দ্বিধা কেন থাকবে!
‘জ্ঞান যেখানে সীমিত, বুদ্ধি সেখানে আড়স্ট, আর মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলনের পুরোধা ‘শিখা গোষ্ঠীর মুখপত্র’ শিখা পত্রিকার প্রচ্ছদে নিয়মিত উৎকলিত এ কথায় জ্ঞান আর বুদ্ধির মধ্যে সূ² পার্থক্যের যে ইঙ্গিত দেখা যায় সে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে চাই, জ্ঞানের গভীরতার দিকটি। এ অনুষঙ্গটি চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে আলোচ্য বিষয়টির সামান্য বিস্তৃতি ঘটাতে চেষ্টা করব।
কবিতায় ‘যথাশব্দ’ ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা জানি। যথাশব্দ ব্যবহারের গুরুত্ব প্রসঙ্গে দুটি কথা বলি, তার আগে উচ্চারণ করি কবিতার ক’টি চরণ-
আমাদের অভিসারে প্রকৃতির কত যে বিরোধ
মধু-পূর্ণিমার আলোর বিপক্ষে যেমন মেঘের অবরোধ;
মিলনের মায়াবী প্রহরে যদি পাখি গান গায়
বৃষ্টির আগাম বার্তা ছুটে আসে ঈষাণের হাওয়ায় হাওয়ায়।
যখন চিবুকে জাগে শিহরণ জেগে ওঠে তৃষিত শরীর
ঈর্ষাতুর পরিপার্শ্ব কেন ভাঙে মন শবরীর?
স্পর্শের বিভায় যখন জীবনানন্দ পায় মন
অভব্য সামাজিকতা বিপক্ষে তখন অচলায়তন।
আত্মার পবিত্রতায় যদি মৃত্তিকা আমার কেউ
পৃথিবীর প্রতিরোধ ভেঙে জাগবেই সমুদ্রে ঢেউ।
(প্রতিরোধ ভাঙার স্বপ্ন \ ফরিদ আহমদ দুলাল)

উপরোক্ত কবিতায় ‘শবরীর’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যদি শবরীর পরিবর্তে ‘শর্বরীর’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো, কী হতো তাহলে? ‘শর্বরীর’ দিলে কবিতার প্রবহমানতায় সামান্য হোঁচট খেত; মনে মনে একবার উচ্চারণ করে দেখুন। আবার কবিতার এক চরণে ‘ঈষাণের’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যদি অন্য কোনো দিকের কথা বলা হতো, সমস্যা কী ছিল? এখানে প্রকৃতির এক বিশেষ চারিত্র্যের কথা আছে, এখানে যদি অন্য কোনো দিকের কথা বলা হতো তাহলে প্রকৃতিনিষ্ঠ না-ও হতে পারত। অভিজ্ঞতায় বলে ঈষাণকোণে মেঘ দেখা দিলে বৃষ্টি অনিবার্য, তাই বলি, কবিতার প্রতিটি শব্দ তুলাদণ্ডে মেপে ব্যবহার করতে হয়। একজন যোগ্য কবি তাই করে থাকেন এবং কবির এ যোগ্যতা অর্জনের জন্য তার শব্দ পরিমাপযন্ত্রের প্রস্তুতি আবশ্যক। কবির পরিমাপযন্ত্রটি যতই সংবেদনশীল হবে, ততই তিনি দ্রুততার সঙ্গে খুঁজে পাবেন যথাশব্দটি। একজন কবিকে তাই সংবেদনশীলতার সন্ধান করতে হয়, সে সন্ধান পৃথিবীর অরণ্যে-পাহাড়ে নয়; সে সন্ধান সমুদ্রে-লোকালয়ে নয়; সে সন্ধান চলে কবির নিজের বুকের ভেতর। কবি যখন নিজের গভীরে আবিষ্কার করে ফেলেন সংবেদনশীলতাকে; তখন তাকে আর অভিধান ঘেঁটে শব্দের সন্ধান করতে হয় না; শব্দই এসে কড়া নাড়ে কবির দুয়ারে। কারণ মানুষের বুকের মধ্যেই তো আছে পৃথিবীর সমস্ত শব্দঐশ্বর্যরাশি। কেউ যদি বলেন, তার মধ্যে শব্দ সন্ধানের সামর্থ্য নাই; আমি বলব, ‘নাই’ কথাটি ভুল; অবশ্যই আছে। সবার বুকের গহীন থেকে সেই ঐশ্বর্যের সন্ধান করা যায়। সন্ধান না করেই যদি কেউ হাল ছেড়ে দেন, তাকে আমি পরামর্শ দিয়ে বলব, হাল ছেড়ে দিও না বন্ধু, নিজের গহীনে প্রবেশ করো, নিশ্চয়ই পাবে অরূপের সন্ধান। কবিতায় যথাশব্দের ব্যবহার কিন্তু বুদ্ধির খেলা নয়, সেটা অনুভবের বিষয়, প্রজ্ঞা-মনন এবং মনীষার বিষয়; আত্মোপলব্ধি আর অন্তরাবিষ্কারের বিষয়।
আমার প্রত্যাশা কল্যাণের পক্ষে, শুদ্ধতা ও সুন্দরের পক্ষে; মানবজীবনের গূঢ় সত্যের উন্মোচনে সাহিত্যের যে লক্ষ্য, সে গূঢ় সত্য উন্মোচনের মাধ্যমে পাঠকের নানাবিধ প্রত্যাশা পূরণের পাশাপাশি মানবহিতের বিষয়টিকে নিশ্চিত করার কাজে ব্রতী যেন হতে পারি। সত্যের সঙ্গে জ্ঞানের মিথষ্ক্রিয়ায় অধপাতিতদের বোধোদয় হোক; আমাদের কল্পনার গভীরে তন্দ্রাচ্ছন্ন সৃষ্টিপ্রবণ শক্তির মুক্তি ঘটুক; গঠনমূলক সমালোচনায় সোচ্চার হোক বিদগ্ধ প্রাজ্ঞজনেরা; বিজ্ঞানমনষ্ক আধুনিক আবহে কূপমণ্ডূকতা-ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তি পাক সুশীল সমাজ। প্রতিটি কবিতা যেমন প্রত্যেক কবির স্বপ্নের সমান বিস্তৃত; তেমনি সমাজমনষ্ক প্রতিটি দেশপ্রেমিক সাংবাদিক ও সংস্কৃতি কর্মীর প্রত্যাশা, বিজ্ঞানমনষ্ক প্রতিটি মানুষ মানুষের কল্যাণচিন্তায় সংঘবদ্ধ হবেন এবং দুষ্টের দমনে মুখোশধারী ষড়যন্ত্রীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। আমার বিশ্বাস সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে সংস্কৃতিকর্মী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঋদ্ধ পত্রিকাগুলো যূথবদ্ধভাবে বাঙালির মনন-মনীষা বিকাশে কাজ করবে।
বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন দেখতে পাই কোনো কোনো পত্রিকায়; তাদের অন্যতম দৈনিক ভোরের কাগজ। বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষা স্বপ্ন পূরণে আরো কোনো কোনো কাগজ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছে; তাদের অবদানের প্রতিও আমি নিশ্চিত সম্মান প্রদর্শন করি; কিন্তু যারা প্রগতির মুখোশ পরে প্রতিক্রিয়াশীলতাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করে, তাদের প্রতিহত করতেই হবে! ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমি তাই কিছু শুভকামনার বার্তা নিশ্চয়ই জানাতে চাই। বাঙালির বিজয় আর আত্মত্যাগের মহিমার কথা স্মরণ করে বাঙালি সংস্কৃতির সতীর্থ সহযোদ্ধা দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার জন্য অভিবাদন জানাতে চাই এবং আগামীর অনিবার্য প্রতিরোধ সংগ্রামে সহযোদ্ধা হিসেবে পাশে চাই।

ফরিদ আহমদ দুলাল
কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়