দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

গণমাধ্যমের সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ব্যক্তিগতভাবে আমি সংবাদপত্রের পরিবেশিত সংবাদের ওপর নির্ভর করি। তার সুনির্দিষ্ট কারণও রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণটি স্বাধীনতা। টিভি মাধ্যমে সেই স্বাধীনতা দর্শকদের নেই। দেশে প্রচুর সংবাদপত্রের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যাও অধিক। প্রতিটি টিভি চ্যানেল নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন করে। এমনকি প্রতি ঘণ্টায়ও। বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা-দুর্ঘটনার সংবাদ তাৎক্ষণিক জানা যায় একমাত্র টিভি মিডিয়াতেই। রেডিও শোনার সংস্কৃতি দেশে আর অবশিষ্ট নেই। অথচ এই প্রচার যন্ত্রটি এক সময়ে ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয় মাধ্যম। রেডিও শোনার শ্রোতা এখন আর খুঁজেও পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা-পরিধি ব্যাপক হারে বিস্তৃত হয়েছে। গণমাধ্যম কর্মীর সংখ্যাও কম নয়। ক্যাবল টিভির প্রসারও বেগবান গতিতে। টিভি চ্যানেলের সংবাদ ব্যক্তিগতভাবে আমাকে তেমন আকর্ষণ করে না। ১০ মিনিটের সংবাদকে বিজ্ঞাপন বিরতিতে ৩০ মিনিট দীর্ঘ করার প্রবণতার কারণে দর্শকদের ধৈর্যচ্যুতি যেমন ঘটে, তেমনি সংবাদ শোনার স্বাধীনতা পর্যন্ত এতে হরণ করা হয়। প্রতিটি টিভি চ্যানেলের সংবাদ নিয়ে মুনাফার বাণিজ্যের তোপে দর্শকদের চরমভাবে ভোগান্তি পোহাতে হয়। প্রতি সংবাদে শিরোনাম সংবাদ, বাণিজ্য সংবাদ, বিনোদন সংবাদ, সংস্কৃতি সংবাদ, কৃষি সংবাদ, অর্থনীতি সংবাদ, আন্তর্জাতিক সংবাদ, খেলাধুলার সংবাদ ইত্যাদি নামকরণে বিভক্ত করে প্রতিটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্পন্সরে পরিবেশিত হয়। সংবাদকে বাণিজ্যিক উপাদানে পরিণত করার যেন সীমা-পরিসীমা নেই। এছাড়া রয়েছে ক্লান্তিকর দীর্ঘ বিজ্ঞাপন বিরতি। মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচারের হিড়িকে সঙ্গত কারণে সংবাদ দেখার ধৈর্য দর্শকের আর থাকে না। এবং থাকার কথাও নয়। বাণিজ্যের অভিপ্রায়ে টিভি চ্যানেলগুলোর স্বেচ্ছাচারিতায় দর্শকদের ভারাক্রান্ত হতে হয়। এসব যৌক্তিক কারণে আমার কাছে সংবাদপত্রের সংবাদ পাঠই সর্বাধিক প্রিয়। কোন সংবাদ আগে বা পরে, কোনটি পড়ব-না পড়ব এই স্বাধীনতা সংবাদপত্রের পাঠকমাত্রেরই রয়েছে। যেটি টিভি দর্শকদের ক্ষেত্রে অসম্ভব।
গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পরিবেশনের মাঝে মুনাফার উছিলায় অসহ্য বিজ্ঞাপন বিরতি দর্শকদের ভারাক্রান্ত করে তোলে। দর্শকের মনোনিবেশে এমন নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপ ঘটে যে, মুহূর্তে সংবাদ উধাও হয়ে বিজ্ঞাপন চিত্র হাজির হয়। পণ্য প্রচারের জন্য সংবাদকে বেছে নেয়ার কারণটি হচ্ছে প্রায় সব দর্শকের কাছে সংবাদপ্রিয়তা। অন্যান্য অনুষ্ঠান দেখার ক্ষেত্রে দর্শকদের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে। কেউ নাটক, গান, সিরিয়াল, চলচ্চিত্র, টকশো ইত্যাদি অনুষ্ঠান নিজস্ব রুচি অনুযায়ী দেখে থাকে। একমাত্র সংবাদই সবার কাছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। এ কারণে সংবাদ পরিবেশনে মুনাফার বাণিজ্যের যথেচ্ছ সুযোগ গ্রহণ করে যেমন চ্যানেল কর্তৃপক্ষ, তেমনি বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। সব অনুষ্ঠান সম্প্রচারে বিজ্ঞাপন বিরতি যে নেই, তা নয়। বিজ্ঞাপনের হিড়িকে নাটক, চলচ্চিত্র, সিরিয়াল, গান, টকশো কোনোটি নির্বিঘেœ দেখা সম্ভব হয় না। দর্শকও চ্যানেল পাল্টে অবিরাম বিজ্ঞাপনের কবল থেকে মুক্তি লাভ করে। দৈনিক সংবাদপত্র পাঠকের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সর্বোপরি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না বলেই; পাঠক তার ইচ্ছানুযায়ী সংবাদপত্র পড়তে পারে। তবে সংবাদপত্রও কিন্তু বিজ্ঞাপনের তোপ মুক্ত নয়। প্রথম থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত সংবাদের গুরুত্ব সংকুচিত হয়ে পড়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশের হিড়িকে। সংবাদপত্র দেখলে উপায় থাকে না কর্তৃপক্ষের নিকট কোনটি অধিক বিবেচ্য। সংবাদ-না বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন প্রকাশে অর্থ আসে। সেতো আকর্ষণ করবেই। তবে এক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা আছে বলে জানা নেই। সে কারণে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার সিংহভাগ অংশ বিজ্ঞাপনের দখলদারিত্বে আমরা দেখে থাকি। আমাদের দেশে বিদ্যমান ব্যবস্থাটি পুঁজিতান্ত্রিক বলেই পুঁজির কারসাজি সর্বক্ষেত্রে বিদ্যমান। প্রচারেই প্রসার। যত প্রচার ততই ভোক্তা বৃদ্ধি এবং পণ্যের কাটতি। সেতো আকৃষ্ট করবেই। যেমন পণ্যের উৎপাদক, আমদানিকারককে, তেমনি গণমাধ্যমের মালিকদেরও।
আমাদের অনেক বিজ্ঞজন প্রায়ই বলে থাকেন অমুক অমুক উন্নত দেশে সংবাদপত্র মুদ্রিত আকারে প্রকাশ হয় না। এবং প্রয়োজনও পড়ে না। দেশসুদ্ধ সবাই ইন্টারনেটে সংবাদ মুহূর্তে জেনে যায় এবং পড়ে নেয়। আমাদের দেশেও মুদ্রিত সংবাদপত্রের যুগের অবসান সময়ের ব্যাপার। আমাদের দেশীয় প্রেক্ষিতে কথাগুলো মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। আমাদের ন্যায় উন্নয়নশীল (অনুন্নত এখন মান রক্ষায় বলা হয় না) দেশের সঙ্গে উন্নত দেশের তুলনা কোনোভাবেই করা যাবে না। যেসব (হাতে গোনা দু-চারটি) দেশে মুদ্রিত সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় না। তাদের সঙ্গে আমাদের দেশের কোনো ক্ষেত্রেই তুলনা চলে না। আমাদের মোট জনসমষ্টির কত ভাগ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে? কত ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত? কতভাগ মানুষ শিক্ষাবঞ্চিত, নিরক্ষর? কত ভাগ মানুষকে একটি দিনের উপার্জনের ওপর ওই দিনটি অতিবাহিত করতে হয় খেয়ে কিংবা না খেয়ে। এমনকি আমাদের সমাজের সংখ্যালঘু সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বঞ্চনার শিকার শ্রেণির সঙ্গে কোনো ক্ষেত্রেই মেলানো যাবে না। একই দেশের নাগরিক হয়েও সবার অধিকার-সুযোগের ভিন্নতা মোটা দাগে স্পষ্ট। সংস্কৃতিগত পার্থক্যটা আরো অধিকভাবে দৃশ্যমান। শিক্ষার হার বেড়েছে বলা হয়, কিন্তু মান বেড়েছে কী? শিক্ষার প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত অতিক্রম না করে ঝরে পড়ার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। শহরের বিত্তবান, মধ্যবিত্তদের জীবনাচারের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবনাচার আকাশ-পাতাল ব্যবধান তুল্য। কাজেই বিদগ্ধ কতিপয়ের বক্তব্য সমষ্টিগতদের ক্ষেত্রে বাস্তববর্জিত বলেই মান্য করা যায়। আমাদের দেশে সংবাদপত্র পাঠের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সহজে মøান হবে না। দেশে ক্রমাগত সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। এই মুহূর্তে দেশের দৈনিক সংবাদপত্রের সংখ্যা কত? কারো পক্ষে নির্ভুলভাবে বলাও সম্ভব নয়। সংবাদপত্রের যদি পাঠকপ্রিয়তা না-ই থাকবে, তাহলে এত সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে কীভাবে? সব সংবাদপত্রের পাঠকপ্রিয়তা নিশ্চয় এক নয়। কম-বেশি রয়েছে। সংবাদপত্রের পাঠকপ্রিয়তার মানদণ্ড বিচারে ভিন্নতা অতীতেও ছিল। আজো আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। এটা বাস্তবতা। তার মানে এই নয় যে, সংবাদপত্র শিল্প বিলুপ্তির পথ ধরেছে। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের মানুষের ভাষা, রুচি, সংস্কৃতির ভিন্নতা রয়েছে। অর্থনৈতিক কারণে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন ঘটে সত্য। তবে সেটা আঙ্গিকগত বা উপরিকাঠামোগত। ভেতরগত সংস্কৃতির খুব একটা পরিবর্তন ঘটে না। আর এটাতো সত্য বিজ্ঞান প্রযুক্তির এই যন্ত্রযুগে সাবেকী ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ব্যতীত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটবে না। আর এটাও সত্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতিই একটি দেশ বা জাতির সংস্কৃতি রূপে স্বীকৃত। কতিপয় সুবিধাভোগীর সংস্কৃতি পুরো জাতির সংস্কৃতি কিন্তু বলা যাবে না। সংবাদপত্র পাঠ আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সহজে সেটা পরিত্যক্ত হওয়ার নয়। যেদিন আমরা শতভাগ শিক্ষিত, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভে পরিপূর্ণ হব। সেদিন বিজ্ঞজনদের বক্তব্য সঠিক না মিথ্যা প্রমাণিত হবে। এর পূর্বে নয়।
দেশে প্রকাশিত প্রতিটি দৈনিকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। থাকাটা স্বাভাবিক। যার দৃশ্যমান প্রমাণ সংবাদপত্রের শিরোনাম এবং সংবাদ প্রকাশে গুরুত্ব কিংবা অগুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি প্রতিফলিত হয়। তাই সব সংবাদের গুরুত্ব একইভাবে সব পত্রিকায় দেখা যায় না। সংবাদপত্রের মৌলিক বিষয়টি সংবাদ। সে সংবাদও বিজ্ঞাপনের দাপটে ম্রিয়মাণ। বাংলাদেশের গণমাধ্যমমাত্রই এখন বিজ্ঞাপননির্ভর। বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরতা ছাড়া উপায়ও নেই। তবে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে বিজ্ঞাপনের তোপে যেন সংবাদ হারিয়ে না যায়। তাহলে সংবাদপত্রের চাহিদা ও গুরুত্ব কোনোটিই আর অবশিষ্ট থাকবে না। এক্ষেত্রে সংবাদপত্রকে অধিক সচেতন হতে হবে, নয়তো সংবাদপত্রের টিকে থাকাও কঠিন হয়ে পড়বে। সংবাদের গুরুত্ব সব পাঠকের কাছেই গ্রহণযোগ্য। মানুষ সংবাদ জানতে আগ্রহী। এই আগ্রহের সুযোগটি গ্রহণ করে মুনাফার মওকা হাতিয়ে নিচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলো। সংবাদপত্র সেই পথ অন্ধ অনুসরণে ঝুঁকে পড়লে সংবাদপত্র শিল্পে নেতির প্রভাব পড়বে। টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপনের আধিক্যে মানুষ চ্যানেল পাল্টে নিজেদের ইচ্ছার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও পত্রিকা পরিবর্তনের স্বাধীনতা নিশ্চয় পাঠকদের রয়েছে। কাজেই সংবাদপত্রসমূহকে এটি গভীরভাবে বিবেচনায় নিতে হবে।
সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক বিষয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সেটি হচ্ছে পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশ আমলে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক সংকট, হরতাল, সান্ধ্য আইন, সহিংস অবরোধকালে জনজীবনের স্বাভাবিকতা ব্যাহত হওয়ার অজস্র ঘটনা-দুর্ঘটনার ইতিহাস রয়েছে। সেই ক্রান্তিকালে মানুষ গৃহবন্দিত্বে বাধ্য হয়েছে। অচল হয়েছে জীবন-জীবিকা। অথচ সব ক্রান্তিকালে সংবাদপত্র প্রতি সকালে তার পাঠকের কাছে পৌঁছে গেছে। সংবাদকর্মীরা সব ঝুঁকি উপেক্ষা করে পাঠকের হাতে প্রতিদিনকার সংবাদপত্র তুলে দেয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে এসেছে। সংবাদকর্মীদের জীবিকা কখনো ঝুঁকিমুক্ত ছিল না। আজো নেই। জীবনের বাজি ধরে সংবাদ সংগ্রহ করে পাঠকদের কাছে তুলে ধরার অঙ্গীকার শতভাগ পালন করে এসেছে আমাদের সংবাদকর্মীরা। তাদের পেশা কেবল জীবিকায় সীমাবদ্ধ নয়। সামাজিক অঙ্গীকারেরও অংশ। যেটি তারা বিপদ-ভয় উপেক্ষা করে পালন করে থাকে। সাংবাদিকতা পেশা যেমন চ্যালেঞ্জের, তেমনি সামাজিক অঙ্গীকারেরও বটে। আমাদের সমাজে আজো দুটি পেশা অতীব সম্মানজনক হিসেবে বিবেচিত। এক শিক্ষকতা। দুই সাংবাদিকতা। এই দুই পেশা জীবিকার ছকে আটকে কখনো ছিল না। আজো নেই। ব্যতিক্রম ব্যক্তি বিশেষে থাকতেই পারে। অপরাপর পেশাজীবীর ন্যায় মেরুদণ্ডহীন অনুগত সাংবাদিকের দেশে আকাল পড়েনি। তেমন বহু দৃষ্টান্ত আমরা হরহামেশা প্রত্যক্ষ করি। পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক দলে সাংবাদিকদের ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যাওয়াও অস্বীকার করা যাবে না। তারপরও সামগ্রিক বিবেচনায় এই দুই পেশাকে অর্থ-বিত্তের মাপকাঠিতে বিবেচনা করা যাবে না। মহৎ পেশা বলতে আমরা যা বুঝি তার সবই এই দুই পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যায়।
এখন আমাদের দেশে একটি দৈনিক পত্রিকাও সামাজিক উদ্যোগে-ব্যবস্থাপনায় নেই। সমস্ত সংবাদপত্রই বিভিন্ন শিল্প-বাণিজ্যিক গ্রুপের মালিকানাধীন। অতীতে ব্যক্তিগত এবং যৌথ মালিকানার সংবাদপত্র থাকলেও কালের গর্ভে সেগুলো বিলীন হয়ে গেছে। সংখ্যার ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের যে প্রসার আমরা দেখেছি, তার পেছনে উদ্দেশ্যমূলক নানা অভিপ্রায় রয়েছে। সংবাদপত্র এখন ক্ষমতা এবং অর্থ লাভের দাবার ঘুঁটিতে পর্যন্ত পরিণত। ব্যবসায়ী মতলব হাসিলে নিজেদের মালিকানার সংবাদপত্রকে ব্যবহারের নানা দৃষ্টান্ত রয়েছে। পত্রিকা দেখেও আঁচ করা যায়, কী উদ্দেশে এটি প্রকাশিত হচ্ছে। সংবাদপত্রের মালিকানা দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর করতলগত। খুব কমই বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের নিজস্ব পত্রিকা নেই। ব্যবসায়ীদের কায়েমি স্বার্থেও সংবাদপত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। এই মালিকরা আমাদের মোট জনসমষ্টির এক শতাংশ। রাষ্ট্রের ক্ষমতাও এই শাসকশ্রেণির করতলগত। অর্থাৎ শাসকশ্রেণির বৃত্তেই আমাদের গণমাধ্যমগুলো আটকে রয়েছে। পুঁজি বিনিয়োগ করার সামর্থ্য থাকলেও পত্রিকা চালানোর যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তাই সংবাদকর্মীদের পাশাপাশি নিয়োগ দিতে হয় সম্পাদককে। সম্পাদকও অপরাপর সংবাদকর্মীর ন্যায় চাকরি রক্ষায় মালিকের নির্দেশিত সীমানা অতিক্রম করার ধৃষ্টতা রাখে না। মালিকের দেয়া স্বাধীনতাটুকুই তারা ভোগ করতে পারেন। এর অতিরিক্ত নয়। চূড়ান্ত বিচারে সংবাদপত্রের মালিকপক্ষই সংবাদপত্রের নেপথ্যের নিয়ন্ত্রক। পত্রিকার কাটতি-হ্রাসের এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার তাগিদে ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশে ছাড় প্রদানে মালিকপক্ষ বাধ্য হয়। সংবাদপত্র মালিকদের সামাজিক দায়-অঙ্গীকার বলে বাস্তবে কিছু নেই। তারা ক্ষমতা এবং ব্যবসায়িক স্বার্থেই পত্রিকায় পুঁজি বিনিয়োগ করে। তাই স্বীয় স্বার্থরক্ষায় তারা তৎপর থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। দেশ-জাতি, জনগণের স্বার্থরক্ষাকে তারা দায়িত্ব-কর্তব্যের আওতায় সঙ্গত কারণেই বিবেচনা করে না। ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিজ মালিকানার সংবাদপত্রকে যথেচ্ছ ব্যবহারের দৃষ্টান্তও দেশের সংবাদপত্র শিল্পে রয়েছে। মোট জনসমষ্টির এই এক শতাংশের করতলগত দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হতে গণমাধ্যম পর্যন্ত। কাজেই সংবাদপত্র শিল্প নিয়ে অতি উচ্চাশার সুযোগ নেই বললে ভুল হবে না।
দেশে গণতন্ত্রের আকালের এই ক্রান্তিকালে সংবাদপত্রকে সরকারের আদেশ-নির্দেশের বেষ্টনীর বৃত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে। ব্যতিক্রম ঘটলেই রাষ্ট্রীয় খড়গ নেমে আসে। গণমাধ্যমের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ সব ক্ষমতাসীন সরকারের শাসনামলে প্রত্যক্ষের অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেউ নয়। অনুগত এবং অবনত থাকার সুফল তো আছেই। আমাদের শাসন প্রক্রিয়ার এখন কে কত অনুগত-অজ্ঞাবহ তার প্রবল প্রতিযোগিতা দেখা যায়। ব্যতিক্রম হলে অবশ্যম্ভাবী বিপদ। বিপদ এড়াতে আত্মসমর্পণের হিড়িক চলছে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং সমাজজুড়ে। আমাদের সমাজে যে যত আনুগত্য প্রদর্শন করতে পারবে তারই ভাগ্যে ঘটবে নানা প্রাপ্তির সুযোগ। বর্তমান সরকারের গুণকীর্তন করে বহুজন রাষ্ট্রীয় সুবিধা আদায় করেছে, পেয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। সেই তালিকাও কম দীর্ঘ নয়। আনুগত্যের এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের পরিত্রাণ কবে ঘটবে? কিংবা আদৌ ঘটবে কিনা জানি না।
সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের ভূমিকা নতুন কিছু নয়। ঔপনিবেশিক আমল থেকে আজ অবধি রাষ্ট্রযন্ত্র সংবাদপত্রের ওপর হস্তক্ষেপে নানা কালাকানুন আরোপ করে এসেছে। সম্পাদক, সাংবাদিক, লেখক, কবি অনেকের জেল, জুলুম এবং সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধের নানা ঘটনা সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে আজো বলবৎ রয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলের পরিসমাপ্তিতে আজাদ পাকিস্তানে রাষ্ট্রের পরিবর্তন যেমন ঘটেনি। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও পরাধীন দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র অক্ষুণ্ন রয়েছে। রাষ্ট্রের বদল না ঘটার কারণে স্বাধীন দেশের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কৃতি, শাসক চরিত্রেরও বদল হয়নি। অতীতের ভিনদেশী শাসকের সঙ্গে স্বদেশী শাসকদের কোনো অমিল নেই। বাইরে কেবল সাদা আর কালো। ভেতরে সবার সমান রাঙা।
আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। বিদ্যমান রাষ্ট্র ও শাসকদের কর্মকাণ্ড সূ²ভাবে বিচার করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। তাই বিদ্যমান ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রসঙ্গটি বারংবার এসে যায়। পরাধীন দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র স্বাধীন দেশে পুরো মাত্রায় সচল এবং সক্রিয়। আমরা নিজেদের স্বাধীন রূপে বিবেচনা করি নিশ্চয়। কিন্তু প্রকৃতই দেশের সমষ্টিগত মানুষ কি স্বাধীন? না, মোটেও না। দেশের স্বাধীনতা ওই এক শতাংশের স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধ। ক্ষুদ্র ওই এক শতাংশকে পরাভূত না করা অবধি আমাদের স্বাধীনতা অলীক। সব মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও অনিবার্যভাবে নিশ্চিত হবে। নয়তো ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটবে সত্য কিন্তু আমাদের পরিবর্তন ঘটবে না। একই বৃত্তে আমাদের ঘুরপাক খেতে হবে। যেমনটি গত বায়ান্ন বছরব্যাপী ঘুরপাক করছি, ঠিক তেমনি। তাই ব্যবস্থার আমূল বদল ব্যতীত আমাদের সামনে অন্য কোনো বিকল্প নেই।
দৈনিক ভোরের কাগজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পত্রিকা সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই। পাশাপাশি পত্রিকার অগণিত পাঠককেও জানাই শুভেচ্ছা।

মযহারুল ইসলাম বাবলা
নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়