দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

নয়া মাধ্যম ও সংস্কৃতিভাবনার খসড়া

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়। মুহূর্তেই বিশ্বের সর্বত্র আমরা আমাদের নজর বোলাতে পারি। মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘বিশ্বগ্রাম’ তত্ত্ব (গেøাবাল ভিলেজ থিয়োরি) ইতোমধ্যে আমাদের অনুরূপ গ্রামের বাসিন্দাই বানিয়ে ফেলেছে! বার্তা বা তথ্য উৎপাদন ও সরবরাহের জন্য ঘটছে নিত্যনতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব। গতকালের প্রযুক্তিকে টেক্কা দিয়ে আজকে জন্ম নিচ্ছে নতুন প্রযুক্তি, আগামীকালেরটা হবে ততোধিক নতুন, গতিসম্পন্ন ও প্রভাব বিস্তারকারী! বিশ্বগ্রামের কোথায় কখন কী ঘটছে নিমেষেই জানতে পারছি, দেখতে পারছি এবং প্রভাবিত হচ্ছি। এরূপ প্রভাবিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের হাজার বছরের জীবনযাপন, কর্মোদ্যোগ ও সংস্কার-সংস্কৃতি আজ নবতর প্রতিযোগিতার মুখোমুখি। এই প্রতিযোগিতা আমাদের জীবনসংগ্রামেরও অংশ হয়ে পড়েছে। ফলে বাঙালির শাশ্বত সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত আত্মরক্ষার সংগ্রামে সক্রিয়। প্রশ্ন হচ্ছে এই সংগ্রামের শেষ কোথায়, পরিণতিই বা কী? পরিণতি নিয়ে ভাববার আগে বাঙালি সংস্কৃতির পূর্বাপর সম্পর্কে বলা জরুরি। সংস্কৃতি এক ব্যাপক বিষয়। স্বল্প-পরিসরে এ বিষয়ে সূ²াতিসূ² বিশ্লেষণ অসম্ভব। তাই মোটাদাগে সংস্কৃতি বিষয়ক কয়েকটি কথা এভাবে বলা যাক।
আমাদের সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে পরিচিত। সংস্কৃতির ব্যাপক পরিধির মধ্যে যে বিষয়গুলো সাধারণত বিবেচিত তার মধ্যে মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন, শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, ক্রীড়া প্রভৃতি অন্যতম। নৃতাত্ত্বিক বিচারে এই ধারণা জটিলতর হলেও সংস্কৃতির সঙ্গে আরো যুক্ত হয় মানুষের, জ্ঞান-বিজ্ঞান, আচার-আচরণ, চিরায়ত প্রথা, সামষ্টিক মনোভাব ও বিশ্বাসবোধ প্রভৃতি। বঙ্গীয় জনপদে নানা জাতি-গোষ্ঠীর হাজার বছরের নানা নৃবৈশিষ্ট্য, নানা শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণের মিলন, পারস্পরিক বোঝাপড়াসহ পারস্পারিক বিরোধী মনোভাব সত্ত্বেও সহ-অবস্থানের মধ্য দিয়ে বৈশিষ্ট্যসূচক যে সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে তাই বঙ্গীয় সংস্কৃতি, বাংলা ভাষাভাষীদের সংস্কৃতি এমনকি বাঙালি সংস্কৃতিরূপে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘বঙ্গীয় সংস্কৃতি যেহেতু বাংলাদেশ এবং বাংলাভাষীদের সংস্কৃতি, সে কারণে ‘বাঙ্গালা’ নামে একটি স্বতন্ত্র অঞ্চল গড়ে ওঠার আগে অথবা বাংলা ভাষা পুরোপুরি বঙ্গীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করার আগেকার আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে বাঙালি সংস্কৃতি বলে অন্তত তত্ত্বগতভাবে আখ্যায়িত করা যায় না। আবার এও স্বীকার্য, সুলতানি আমলের বাঙ্গালা রাজ্য অথবা বাংলা ভাষা গড়ে ওঠার মুহূর্ত থেকে বাঙালি সংস্কৃতির জন্ম হয়নি। বঙ্গীয় সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে উঠেছিল আরো অনেক আগে থেকে।’
সুপ্রচীনকাল থেকে ইতিহাসের নানা বাঁকে আর্য, তুর্কি, মুসলিম, আফগান, মুঘল, ইংরেজরা বঙ্গ দখল এবং শাসন-শোষণ করে। আর ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা পূর্ববর্তী উপনিবেশ পত্তনকারীদের মতোই বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে প্রবলভাবে সক্রিয় হয়। বাঙালির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সংস্কৃতির ভেতর পাকিস্তানি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটাতে চেষ্টা করে। কিন্তু বাঙালি তার দীর্ঘ ঐতিহ্যের শক্তিশালী সংস্কৃতির ¯্রােতধারায় এমনি বিকশিত যে অপরাপর সংস্কৃতিকে গ্রাহ্য করেনি। বাঙালি নিজের মতো করে যেটুকু সমন্বয়ের প্রয়োজন তা করেছে। এ শুধু পাকিস্তানের ক্ষেত্রেই নয়, আর্যদের আগমনকাল থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে যত আগ্রাসন ঘটেছে, তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাঙালির স্বতন্ত্র^ সংস্কৃতি-স্বভাব স্পষ্ট হয়েছে।
শুধু সংস্কৃতিই নয়, ধর্মচর্চার ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। অর্থাৎ বাইরে থেকে আসা সব ধর্ম দর্শনকেও বাঙালি তার নিজের মতো করে আত্মস্থ ও আত্তীকরণ করেছে। এ কথা প্রাচীনকালের বহু ধর্মাদর্শের মতো ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ সনাতন, জৈন, বৌদ্ধ এমনকি ইসলাম ধর্মও স্ব স্ব উৎপত্তি-স্থান থেকে বাংলায় এসে স্বতন্ত্র রূপ ধারণের মাধ্যমে মানুষের দ্বারা গৃহীত ও চর্চিত হয়েছে। এককথায় বাঙালির সংস্কৃতি-স্বভাবের স্বতঃস্ফূর্ততায় গ্রহণ-বর্জন আর রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘দেবো আর নেবো, মেলাবো মিলিবো’- এই আদর্শ মেনে নিজস্ব ও শক্তিশালী এক ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি বিনির্মাণ করেছে। সংস্কৃতির এই বিনির্মাণ এক চলমান প্রক্রিয়া। আমাদের লক্ষ বা অলক্ষে প্রতিনিয়ত আমরা সংস্কৃতির বিনির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হই। পৃথিবীর অন্য সব জাতিগোষ্ঠীর মতো বাঙালি তথা বাংলাদেশও নিরন্তর এক সাংস্কৃতিক প্রবাহের মধ্যে লগ্ন ও সংলগ্ন এ কথা নতুন করে উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না।
যদি আলোচনার মূলে ফিরে আসি তবে বাঙালির সংস্কৃতি বলতে মূলত তার আচার-আচরণ, খাদ্যাভাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার, কৃত্য-ধর্ম, চিকিৎসা, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, বিনোদন, পরিবেশনা-শিল্প প্রভৃতির উল্লেখ জরুরি। আলোচনাকে আরো কেন্দ্রিভূত করলে দেখতে পাবো, আমাদের সাংস্কৃতিক সব অনুষঙ্গের প্রকাশ ও বিকাশ ঘটে শিল্প-সাহিত্য তথা কৃত্য ও বিনোদনমূলক বিভিন্ন পরিবেশনা সামগ্রীর মধ্য দিয়ে। সে বিবেচনায় আমরা অনুভব করতে পারি, প্রাচীনকাল থেকে উদ্ভূত ও বিকশিত আমাদের কৃত্যাচার ও বিনোদন সামগ্রীর অন্যতম উপাদানগুলো ‘কাব্য’ হিসেবেই বেশি পরিচিতি- প্রকৃতপক্ষে সেসবের অধিকাংশই ছিল পরিবেশনা-শিল্পের প্রধান অবলম্বন।
বাংলা শিল্প-সাহিত্যের প্রাচীন নমুনা ‘চর্যাপদ’। চর্যার অধিকাংশ পদই নৃত্য, গীত, তাল ও লয়ের সমন্বয়ে পরিবেশনযোগ্য। অনেক পদের ওপরে রাগের নামও পাওয়া যায়। অর্থাৎ সেগুলো সংগীত। সংগীত যে পরিবেশনার মাধ্যমে উপস্থাপনার বিষয় তা তো বলারই প্রয়োজন নেই। জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কিংবা বড়–চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ প্রসঙ্গে বলা যায়, এ দুটি ‘কাব্য’ নামে পরিচিত হলেও উভয়ের মধ্যেই নাট্যগুণ প্রবল। উভয়ই পরিবেশনামূলক আখ্যান। আধুনিক সংজ্ঞানুযায়ী এদের গায়ে ‘নাটক’ অভিধা বসালেও কোনো হানি হয় না। আবার মঙ্গলকাব্যের ভণিতায় কবি নিজেই বলেন, ‘বিশ্রাম দিবস আট/ শুনহ গীত দেখ নাট’। অর্থাৎ এও নাটক বা নাটগীত। বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগ প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় সকল কাব্যই ছিল জনসমক্ষে গেয় বা পরিবেশনার জন্য রচিত। এতদসঙ্গে এ কথাও বলে রাখা ভালো, লিখিত এসব সাহিত্যের সমান্তরালে বিভিন্ন জনপদে মৌখিকরীতির কাব্য, আখ্যান, নাট্য তথা সাহিত্যের একটি প্রবল ও শক্তিশালী ধারা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষ ও সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে প্রবহমান ছিল। মৌখিকরীতির এসব পরিবেশনার অনেক আঙ্গিকের সাথে ধর্মীয় কৃত্যাচারেরও নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আবার কোনো কোনো আঙ্গিক ছিল একেবারেই বিনোদন-সর্বস্ব। উল্লেখ্য, সমাজ, গোষ্ঠী, বর্ণ বা ধর্মকেন্দ্রিকতা থাকলেও বাঙালি সংস্কৃতির মূলশক্তি ছিল এর অসাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্ব ও এতে সামাজিকগণের নিঃশর্ত অংশগ্রহণ।
পুণ্যার্থ কিংবা বিনোদনার্থে পরিবেশিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মানুষের দলগত চর্চা এবং অংশগ্রহণও বাঙালি সংস্কৃতির আরেকটি উত্তরাধিকারিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই ভূখণ্ডের মন্দির, মঠ, চণ্ডীমণ্ডপ, দরগা এবং আসরে আসরে সাংস্কৃতিক পরিবেশনাগুলো একদিকে যেমন ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনাপুষ্ট তেমনি ছিল ধর্মশিক্ষার ভক্তিবাদী প্রসার। সেই সঙ্গে ছিল সামাজিক শিক্ষারও প্রবল আকাক্সক্ষা। স্ব স্ব জনপদ ও অঞ্চলের মানুষের মানস গঠনে উপরিউক্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপক ভূমিকাও রাখে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বংশ-পরম্পরায় সেসব পরিপুষ্ট সাংস্কৃতিক আবহ চিত্তে ধারণ করেই সমগ্র বাংলার মানুষ বিকাশমানতার পথে ধাবমান। আর এই ধাবমানতার পথেই বাঙালির জাতিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হতে হতে একসময় তা জাতীয় সত্তায়ও পরিণত প্রাপ্ত হয়। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বা শাসকগোষ্ঠীর নানা বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হলে বাঙালি তার সংস্কৃতির অভ্যন্তরীণ শক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করেছে। শুধু তাই নয়, সংস্কৃতির বর্ণিত সব মৌল উপাদান এবং অন্তর্গত শক্তি ও সৌন্দর্যের সমন্বয়ে কালক্রমে বাঙালি তার নিজস্ব এক জাতীয়তাবাদী মানস গঠন করে নেয়। এই জাতীয়তাবাদী মানস গঠনে বাঙালির সমবেত ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণাই প্রবল ছিল। অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধ ও দলগত আবহই বাঙালির সংস্কৃতি প্রকাশের ধারাকে হাজার বছর সমুন্নত রেখেছে। এতক্ষণ যে সংস্কৃতির প্রসঙ্গ অবতারণা করা হলো রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তা অনেকটা যেন ‘মাটি থেকে মনের দিকে তুলে নেয়া যায়’।
উপরের আলোচনায় আমরা বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির ওপর ‘একনজরে’ এবং সংক্ষিপ্ত চোখ বুলিয়ে নিলাম মাত্র। সংস্কৃতি বিষয়টি অতিশয় ব্যাপক ও বিস্তৃত। অল্প পরিসরে যার ভূমিকালাপও অসম্ভব। ম্যাকলুহানের বিশ্বগ্রাম তত্ত্ব বাস্তবে পরিণত হওয়ায় অর্থাৎ হাতের মুঠোয় পৃথিবী চলে আসায় আমাদের ঐতিহ্যিক ও গণমানুষের দলগত সংস্কৃতি আজ বিপন্ন, অনেকটাই দিশাহারা! গ্রামীণ আসর থেকে, চণ্ডীমণ্ডপ থেকে, মঠ, মন্দির, দরগার প্রাঙ্গণ থেকে বিলুপ্তির মাধ্যমে মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যাওয়ায় বাঙালির সংস্কৃতি আজ তার দলগত রূপ হারিয়ে যেতে বসেছে। নয়া মাধ্যম যত প্রবল হচ্ছে দলগত সংস্কৃতিচর্চার চেহারাও তত পাল্টে যাচ্ছে। এ সংস্কৃতি রবীন্দ্রভাষ্যের ‘মাটি থেকে মনের দিকে তুলে নেয়া যায়’- এরূপ নয়। অনেকেই এর নাম দিয়েছেন ‘আকাশ-সংস্কৃতি’। এর উৎপত্তি আকাশে, আর বিকাশও বাতাসে বাতাসেই! এ সংস্কৃতি ভূমিজাত না হলেও বিশ্বব্যাপ্ত! নয়া মাধ্যমের প্রয়োজন নয়া সংস্কৃতির নয়া নয়া ঢঙ ও ভঙ্গি। নয়া ঢঙ বা নয়া ভঙ্গির সংস্কৃতি দ্রুত বিশ্বগামীতার বৈশিষ্ট্যগুণে আস্তে আস্তে আমাদের স্বভাবের ওপর তীব্র প্রভাব ফেলছে। আমাদের দলগত সংস্কৃতিচর্চাকে সংকুচিত করে ফেলছে। নয়া মাধ্যমের হা করা মুখ ব্যক্তির সত্তাকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করছে! সে দীর্ঘতর হা করা মুখের আহার জুটাতেই সবাই ব্যস্ত! তামাম বিশ্ব অনায়াসে হাতের মুঠোয় চলে আসায় ব্যক্তি মানুষ প্রত্যেকেই আলাদা হয়ে যাচ্ছে, সে যারপরনাই একা ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ফলে সামাজিক মূল্যবোধ সম্পন্ন প্রজন্ম তৈরির সংকটও দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে।
একসময় সংস্কৃতিগত মূল্যবোধ অথবা সামাজিক ও ধর্মীয় সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের রক্ষণশীল প্রভাবের কারণে মানুষের মধ্যে ‘স্থান-কাল-পাত্র’জ্ঞান ছিল। রক্ষণশীল হলেও তার একটা সামাজিক সৌন্দর্য ছিল। নয়া মাধ্যমে আমরা যা উপভোগ করি তার মধ্যে ‘স্থান-কাল-পাত্র’ বা ‘যথাদেশঃ যদাচারঃ’ দেখি না। আবার নয়া মাধ্যমের এমনই পরাক্রমী প্রভাব যে, বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার ও চিন্তাকে যারা বয়কট করতেন, ‘মহাপাপ’ বলে যারা ফতোয়া দিতেন তারাই এই মাধ্যমটিকে লুফে নিয়েছেন! ব্যক্তিগত প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ইউটিউব, ফেসবুকে ওয়াজের সিনেমা (!) বানিয়ে প্রচার করছেন। ‘ভাইরাল’ হওয়ার চেষ্টায় এখন অনেকেই উন্মাদপ্রায়! বড় বড় হুজুর থেকে ছোট ছোট দিনমজুর সবাই কেবল ভাইরাল হওয়ার নেশায় অস্থির! ফলে, তথ্যের চেয়ে অপতথ্যেই নয়া মাধ্যমসমূহ সয়লাব।
ভাইরাল হওয়ার প্রবণতায় ওপরে ব্যক্ত স্থান-কাল-পাত্র-জ্ঞানের সংকট যে মারাত্মক রূপ নিয়েছে তা নয়া মাধ্যমের দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়। যেসব মাওলানারা একসময় সভা-সমাবেশে ভাস্কর্যবিরোধী ওয়াজের মাধ্যমে এ দেশের অল্পশিক্ষিত সরলমতি মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন তারাও ভাস্কর্যেরই অনুরূপ ‘প্রতিকৃতি’, ‘প্রতিচ্ছবি’, ‘প্রতিরূপ’, ‘প্রতিচ্ছায়া’, ‘প্রতিবিম্ব’, ‘ইমেজ’ (চলচ্চিত্রের অভিনতা-অভিনেত্রীদের মতো) হয়ে উঠছেন! উল্লেখ্য, চলচ্চিত্রশাস্ত্রের সংজ্ঞানুযায়ী এসব ওয়াজ ‘ডিজিটাল সিনেমা’ বলে! সিনেমায় যেমন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করেন তেমনি ওয়াজের বক্তারাও নানা অঙ্গভঙ্গিসহ অভিনয়ই করেন! একেক জনের ওয়াজ একেক ধরনের রসে টইটুম্বুর! আলেমরা মানুষের ফটোগ্রাফ বা ছবি তোলার বিষয়েও নেতিবাচক বক্তব্য দিতেন। একদা নেতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন মাইক্রোফোন ব্যবহারেও। কিন্তু ইউটিউবের বিপক্ষে তাদের কিছু বলার নেই। কারণ, এই মাধ্যমটির সাহায্যে তাদের অন্য উদ্দেশ্যের মতো রাজনৈতিক (!) উদ্দেশ্যও হাসিল হচ্ছে! দেখা যাচ্ছে নয়া মাধ্যমের নিত্যনতুন কৌশল তারাই বেশি ব্যবহার করছেন।
একটু চিন্তা করলে মনে হয় নয়া মাধ্যমের নয়া কৌশলের মারপ্যাঁচে পড়ে গেছে বাঙালির শাশ্বত সংস্কৃতি! মাটি ও মানুষের সংস্কৃতি আজ উন্মূল! বৃষ্টির অঝোর ধারা মতো আকাশ-সংস্কৃতির সর্বব্যাপী বিস্তার মাটি ও মানুষের সংস্কৃতিকে বাঙালির মনের দিকে নিয়ে যেতে পারছে না। এ বিষয়ে ভাববারই বা অবকাশ কার তা কে জানে! কোনোকালেই বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও প্রযুক্তিকে মানুষ অবজ্ঞা করতে পারেনি। আবার প্রযুক্তিকে আকণ্ঠ গ্রহণ করলেই শাশ্বত সংস্কৃতি অবহেলা করতে হবে এমনও নয়। নয়া মাধ্যমের নয়া প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতিকে মাটি থেকে মানুষর মনের অনুবর্তী করে তোলার প্রয়াস নিতে হবে। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনাকে সব ধরনের বিভ্রান্তি ঘোচানোর স্পর্ধা অর্জন করতে হবে।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়