দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

বাংলাদেশ এগিয়ে যাক সমান গতিতে

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঢাকায় দিনের পর দিন গণপরিবহন বৃদ্ধির কারণে যানজটে পড়ছে নগরবাসী। এতে তাদের ভোগান্তি বাড়ছে; স্বল্প দূরত্বের জায়গায় যেতেও সীমাহীন দুর্ভোগ এবং সময়ের অপচয় হচ্ছে। যানজটের কারণে অর্থনীতিরও একটি বড় ক্ষতি হচ্ছে। মেট্রোরেলের জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় যেন সবকিছু বদলে গেল। গবেষণা বলছে, রাজধানীতে যানজটের কবলে প্রতি বছর গড়ে ৩৬ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। উত্তরা থেকে মতিঝিল- মেট্রোরেল যেন ঢাকা শহরকে রীতিমতো পাল্টে দিয়েছে। ২০১৩ সালে জনবহুল ঢাকার যানবাহন সমস্যা ও দুঃসহ যানজট কমিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এর অধীনে প্রথমবারের মতো ঢাকায় মেট্রোরেল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। মেট্রোরেল হচ্ছে জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) একটি সরকারি প্রকল্প। এটি পরিচালনা করছে ‘ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড’ (ডিএমটিসিএল)। ঢাকায় ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ থেকে মেট্রোরেলের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয়।
মেট্রোরেল আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি নতুন যুগে আবদ্ধ করবে। একটি জরিপে দেখা যায়, প্রতিদিন মেট্রোরেল পরিচালনা করতে প্রায় ২ দশমিক ৩৩ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। সুতরাং প্রতিদিন ৪ লাখ ৮৩ হাজার জন যাত্রী যদি মেট্রোরেলে ভ্রমণ করে, তবে সহজেই এ টাকা ওঠে আসবে। মেট্রোরেল বিশ্বের অনেক বড় শহরে গণপরিবহনের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। ১৮৬৩ সালে লন্ডনে প্রথম দ্রুত ট্রানজিট সিস্টেম চালু করা হয়েছিল, যা এখন ‘লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর একটি অংশ। ১৮৬৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এনওয়াইতে তার প্রথম দ্রুত ট্রানজিট রেলব্যবস্থা চালু করে। ১৯০৪ সালে নিউইয়র্ক সিটি সাবওয়ে প্রথমবারের জন্য খোলা হয়। এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে জাপান হলো প্রথম দেশ, যা ১৯২৭ সালে একটি পাতাল রেলব্যবস্থা তৈরি করে। ভারত ১৯৭২ সালে কলকাতায় তার মেট্রোসিস্টেম নির্মাণ শুরু করে। এরপর ভারত অন্যান্য শহরেও মেট্রোরেল ব্যবস্থা তৈরি করে। ঢাকার রাস্তায় সব যানবাহন জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর করে, যা পরিবেশ দূষণে বিরাট ভূমিকা রাখে। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় রয়েছে ঢাকা। মেট্রোরেল রাজধানীর পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ঢাকার বায়ুদূষণ অন্যান্য মেগাসিটির তুলনায় অনেক বেশি তীব্র। যেহেতু মেট্রোরেল বিদ্যুৎচালিত এবং প্রতি ঘণ্টায় বেশি যাত্রী বহন করতে পারে, তাই ঢাকায় বাস ও অন্যান্য পরিবহনের মাধ্যমে যাতায়াতের প্রবণতা কমে যাবে। সহজেই বলা যায়, মেট্রোরেল সহজেই ঢাকা শহরকে বর্তমান অবস্থা থেকে আধুনিক শহরে রূপান্তর করবে।
ঢাকার যানজট কমাতে ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ চালু করা হয় আরেকটি স্বপ্নের প্রকল্প উড়াল সড়ক। জনগণের বহুল কাক্সিক্ষত এই উড়াল সড়কটির দৈর্ঘ্য মোট ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। পুরো উড়ালসড়কে ৩১টি স্থান দিয়ে যানবাহন ওঠা-নামা বা র‌্যাম্প করার ব্যবস্থা রয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। বিমানবন্দর থেকে সাভার ইপিজেড পর্যন্ত প্রায় ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি উড়াল সড়ক নির্মাণ করার পরিকল্পনা করেছে সেতু বিভাগ। আগামী ২০২৬ সালে সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অর্থায়ন করবে চীন। এর নাম দেয়া হবে ঢাকা-আশুলিয়া উড়াল সড়ক। উড়াল সড়কে অটোরিকশা, সাইকেল এবং মোটরসাইকেল চলতে পারবে না। পথচারীদের হাঁটারও কোনো ব্যবস্থা নেই। যানজট এড়িয়ে ঢাকার উত্তর-দক্ষিণমুখী যানবাহনের যাতায়াত নিশ্চিত করতেই চালু হলো দ্রুতগতির এই উড়াল সড়ক। ঢাকা-আশুলিয়া উড়াল সড়ক চালু হলে ইপিজেড ও উত্তরবঙ্গের যানবাহন যানজট এড়িয়ে যেতে পারবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পথে। এতে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল ও পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ না করে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবেশ করতে পারবে। একইভাবে উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলো ঢাকাকে বাইপাস করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি যাতায়াত করতে পারবে। এতে সহজেই নিচে সড়কের চাপ কমবে এবং যানজট থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রাজধানীতে শুধু ঢাকার যানজটের কারণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে মোট জিডিপির ২ দশমিক ৯ ভাগ। অর্থনীতিবিদদের মতে, ঢাকার যানজটে প্রতি মাসে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। উড়াল সড়ক চালু হওয়ার পর চিরচেনা ঢাকার চেহারা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। মানুষের সময় বাঁচছে এবং দেশের অর্থনীতিতেও বিরাট অবদান রাখছে। ঢাকার যানজট এবং যাতায়াতের খরচ অনেকাংশ কমিয়ে দিয়েছে। উড়াল সড়ক নির্মাণকাজের ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ বহন করছে থাইল্যান্ড ও চীনের তিনটি প্রতিষ্ঠান। বাকি ২৭ শতাংশ বহন করছে বাংলাদেশ। মূল নির্মাণকাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার বহন করছে এবং বাকিটা বহন করছে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। আমরা মনে করি, উড়ালসড়ক যোগাযোগব্যবস্থার সহজীকরণ ও আধুনিকতার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। জনগণের বহুল কাক্সিক্ষত স্বপ্নের উড়াল সড়ক একদিকে যেমন যানজট কমাবে, তেমনি অন্যদিকে সময়ও বাঁচবে অনেক। পাশাপাশি আমাদের দেশের অর্থনীতিতে রাখবে উন্নয়নের বিরাট অবদান। বাংলাদেশের উন্নয়ন বর্তমানে যেভাবে দিন দিন বাড়ছে, তাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশটাকে তুলনা করলে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না।
দেশের সড়ক যোগাযোগে নতুন এক যুগের সূচনা করেছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম বহুলেন সড়ক টানেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ অক্টোবর ২০২৩ টানেলটি উদ্বোধন করেন। এর নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ বা সংক্ষেপে ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’। দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশ দিয়ে যানবাহন চলাচলকারী প্রথম টানেল এটি। প্রকল্পটিতে চীন ও বাংলাদেশ যৌথভাবে অর্থায়ন করেছে। দেশে সা¤প্রতিককালে অনেকগুলো বৃহৎ অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে যে কোনো প্রকল্পের ভিড়ে নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। নদীর তলদেশ থেকে টানেলের সর্বোচ্চ গভীরতা ৩১ মিটার। টানেলে আছে বিপরীতমুখী দুটি টিউব। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেইন আছে। ২০১৬ সালের অক্টোবর টানেলটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি। ২০২০ সালের নভেম্বরে উদ্বোধনের কথা থাকলেও কোভিড-১৯ মহামারিসহ কয়েক দফায় তা পিছিয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে যেটি সাড়ে ৮ হাজার কোটির কিছুটা কম ছিল, তা বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যয় করছে ৪ হাজার ৬১৯ কোটি ৭০ লাখ এবং চীনের ঋণ ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে নতুন সড়ক যোগাযোগের কাজে আসবে এ টানেল। এটি বিদ্যমান কর্ণফুলী নদীর ওপরের দুই সেতুতে চাপ কমাতেও সাহায্য করবে। ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন হবে টানেলের মধ্য দিয়ে। টানেল নির্মাণের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো চট্টগ্রাম শহরকে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ অর্থাৎ ‘এক নগর দুই শহর’-এর মডেলে গড়ে তোলা। যোগাযোগ ব্যবস্থা চালুর পর শহরের স¤প্রসারণ ও বিদ্যমান শিল্প নগরীর আরো শিল্পায়ন হওয়ার চিন্তা থেকেই এমনটা বলা হচ্ছে। কর্ণফুলী নদীর পূর্বদিকের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকায় যেমন উন্নয়নের দিক আছে, তেমনি পশ্চিম দিকের শহর-বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া নদীর পূর্ব প্রান্তে ভবিষ্যতে শিল্পায়নের দিক ছাড়াও পর্যটন শিল্পের রয়েছে উজ্জ্বল সম্ভাবনা। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে কাজ করেছে চীনের ‘চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কো¤পানি’। টানেলটি খুবই ‘সংবেদনশীল’ এবং রক্ষণাবেক্ষণ খুব সহজ হবে না বলে মত দিয়েছেন অনেকেই। এখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি প্রতিদিন কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ করে অক্সিজেন প্রবেশ করাতে হবে। এছাড়া টানেলে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তবে সেটিকে উদ্ধারের খরচটিও মাথায় রাখতে হবে। টানেলের প্রকল্পের ভেতরেই থাকছে ‘সার্ভিস এরিয়া’। সেখানে থাকবে ৩০টি বাংলো, একটি ভিআইপি বাংলো, মোটেল মেস, হেলথ সেন্টার, মাঠ, টেনিস কোর্ট, কনভেনশন সেন্টার, জাদুঘর, সুইমিং পুল, মসজিদ, হেলিপ্যাডসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা। অভিজ্ঞ মহল মনে করে, দেশের জন্য এ টানেলটি নিঃসন্দেহে একটি বিরাট ভূমিকা রাখবে।
প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন- দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশ যেন আর কোনোভাবেই পিছিয়ে না পড়ে, দেশকে নিয়ে যেন কেউ নিচু গলায় কথা বলতে না পারে, বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাক সমান গতিতে- বিশ্ব দরবারে দাঁড়াক মাথা উঁচু করে। আর যেন কেউ কোনোদিন বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলতে না পারে- এটাই আমরা দেখতে চাই। আমরা যেন বুক উঁচিয়ে বলতে পারি- এ আমার দেশ, স্বপ্নের বাংলাদেশ।

প্রদীপ সাহা
কবি ও লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়