দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

উন্নয়নে রাজনীতি : রাজনীতির অগ্রগমন

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দেশ-বিদেশের নানান ষড়যন্ত্র-শঙ্কার মাঝেও সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল দেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। পরাশক্তিধর দেশগুলোর একচোখা নীতি এবং কয়েকটি সমমনা রাজনৈতিক দল হরতাল, অবরোধ, বাস-ট্রেন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও পুড়িয়ে মানুষ হত্যার মধ্যেও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন ছিল অনেক চ্যালেঞ্জের। তা সত্ত্বেও ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে দলগতভাবে নৌকা ২৬৬, জাতীয় পার্টি ২৬৫, তৃণমূল বিএনপি ১৩৫, স্বতন্ত্র ৪৩৬, অন্যান্য ৭৬৮, নৃ-গোষ্ঠী ৭৯, নারী ৯৭ ও তৃতীয় লিঙ্গের ১ জন প্রার্থীসহ সর্বমোট ১৯৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন। নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, নিবন্ধিত ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন ভোটারের মধ্যে ৪ কোটি ৯৯ লাখ ৫৫ হাজার ৮৪৮ জন ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন, যা শতকরা হারে ৪১ দশমিক ৮০ শতাংশ। চূড়ান্ত নির্বাচনী ফলাফলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২২৩টি, স্বতন্ত্র ৬২টি, জাতীয় পার্টি ১১টি, জাসদ ১টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটি ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় কল্যাণ পার্টি ১টি আসনে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীদের মধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নৌকার প্রার্থীদের বিপক্ষে নির্বাচনী লড়াই করেছেন। যা নির্বাচনী আমেজে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। চূড়ান্ত বিচারে নির্বাচনী লড়াইয়ে ব্যাপকসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ের মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয় যে, প্রকৃত জনসম্পৃক্ত প্রার্থীকে হয়তো মনোনীত করা হয়নি। অবশ্যই, আওয়ামী লীগ প্রধান স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, নৌকা দিলাম, কিন্তু জিতে আসার দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। একই সঙ্গে তিনি এও বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে অনেক যোগ্য প্রার্থী রয়েছেন, কিন্তু আসন ৩০০টি। তাই আপনাদের যদি নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস থাকে, তবে স্বতন্ত্র নির্বাচন করুন। জননেত্রী শেখ হাসিনার এই গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে তাদের পছন্দ মতো একজনকে নির্বাচিত করেছেন। যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দেশে-বিদেশে নির্বাচন ও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রধানের এই বিজ্ঞচিত সিদ্ধান্ত দলীয় কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে।
গত ১৫ বছরে সরকারের ধারাবাহিকতায় দেশে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, জ্বালানি, যাতায়াতসহ অবকাঠামোগতভাবে যে উন্নয়ন হয়েছে, সেটি স্বাধীন বাংলাদেশের ৫ দশক সময়কালের যে কোনো সময়ের সঙ্গে অতুলনীয়। বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন অগ্রযাত্রা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সুদৃঢ় করেছে। যে কৃতিত্ব বহুলাংশে জননেত্রী শেখ হাসিনার। রাজনীতিতে যদি দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের কল্যাণ সাধনের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রæতি থাকে, তাহলে সে রাজনীতিকে উন্নয়নের রাজনীতি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত ১০/১৫ বছরের রাজনীতি দেশ ও দেশের জনগণের সামগ্রিক উন্নয়নে নিবেদিত থাকায়, উন্নয়ন-অগ্রগমন স্থিতিশীলতার কারণেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে আগামীতে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ : উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ অঙ্গীকারে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে ১১টি বিষয় বাস্তবায়নের প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। বিষয়গুলো হলো (১) দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, (২) কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, (৩) আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা, (৪) লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃৃদ্ধি, (৫) দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো, (৬) ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, (৭) নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা, (৮) সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা, (৯) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, (১০) সাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা, (১১) সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো। যা একটি দল ও সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রæতির অকাট্য দলিল। এ প্রতিশ্রæতিগুলো কতটা বাস্তবায়ন হবে, তা নির্ভর করবে সরকারের সুশাসন ও জনদায়বদ্ধতার ওপর, যেটির সঙ্গে রাজনীতির দিকদর্শন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে নির্দেশনা প্রদান করেছেন দেখে সমাজসচেতন জনগণ আশান্বিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে রাজনীতি সম্পর্কে জনগণ বিরূপ ধারণা পোষণ করত। তবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিশেষ করে বিগত ১৫/২০ বছর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের আমলে দেশের উন্নয়ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হওয়ায় জনগণের মাঝে রাজনীতি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। এখন জনগণ বিশ্বাস করে রাজনীতির ধারাবাহিকতার জন্যই দেশের উন্নয়ন হয়েছে ও হচ্ছে।
বলাবাহুল্য, রাজনীতি একটি জটিল ও বহুমুখী ধারণা, যেটি বিভিন্ন আঙ্গিকে চিন্তাবিদদের দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়েছে। অ্যারিস্টটল রাজনীতিকে ‘মাস্টার বিজ্ঞান’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে বলেছেন, রাজনীতি সমাজের সংগঠন ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করে। তিনি সাধারণের ভালোর বা কল্যাণের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে বলেন, রাজনীতি হলো সেই মাধ্যম, যার মাধ্যমে একটি সম্প্রদায় তার সম্মিলিত লক্ষ্য অর্জন করে। দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুশো বলেছেন, রাজনৈতিক নেতাদের কাজ হলো গণতান্ত্রিক চিন্তার ভিত্তি স্থাপন করা। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার রাজনীতিকে ক্ষমতার অংশীদারত্বের জন্য প্রচেষ্টা বা ক্ষমতার বণ্টনের ওপর প্রভাব প্রয়োগ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব, বৈধতা ও রাষ্ট্রের ভূমিকা তুলে ধরেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড ইস্টন রাজনীতিকে সমাজের মধ্যে মূল্যবোধের প্রামাণিক বরাদ্দ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং এর পরিবেশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতার ওপর জোর দেন। রাজনৈতিক দার্শনিক জন লক রাজনীতিতে সরকার এবং শাসিতদের মধ্যে একটি চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক জড়িত উল্লেখ করে বলেন, যেখানে সরকারের বৈধতা, শাসিতদের সম্মতি থেকে উদ্ভূত হয়। মানবতাবাদী রাজনৈতিক মাউজিনাগ বলেছেন, রাজনীতি হলো রক্তপাত ছাড়া যুদ্ধ, আর যুদ্ধ হলো রক্তপাতের রাজনীতি। অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল সব মানুষকে রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত উল্লেখ করে বলেছেন, মানুষ স্বভাবতই একটি রাজনৈতিক প্রাণী। তাই রাজনীতি ও উন্নয়ন বা প্রগতির সম্পর্ক জটিল ও বহুমুখী। উন্নয়ন উদ্যোগের দিকনির্দেশনা ও ফলাফল গঠনে রাজনীতিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়- দেশপ্রেমমূলক রাজনীতি ও উন্নয়নের মধ্যে নিবিড় অন্তর্নিহিত সম্পর্ক রয়েছে। জনকল্যাণ ও উন্নয়নে যেসব বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তার মধ্যে (১) রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং নীতিগুলো একটি দেশের উন্নয়নের গতিপথকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামো এবং সামাজিক কল্যাণ সম্পর্কিত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সবই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। (২) টেকসই উন্নয়নের জন্য শাসনের মান এবং প্রতিষ্ঠানের শক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্র্ণ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন এবং কার্যকর প্রতিষ্ঠান অগ্রগতির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। দুর্নীতি ও দুর্বল প্রশাসন উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। (৩) রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বাজেট বরাদ্দ এবং বৈদেশিক সাহায্য বিতরণ করা হয়। রাজনৈতিক নেতাদের অগ্রাধিকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়ন ও বাস্তবায়নকে প্রভাবিত করে। (৪) বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য চুক্তি, বৈদেশিক সাহায্য এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে উন্নয়নকে প্রভাবিত করতে পারে। বৈশ্বিক রাজনীতি পৃথক দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি গঠনে ভূমিকা পালন করে। (৫) রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং বিশ্বাস সামাজিক নীতিতে গঠন করতে পারে, যা উন্নয়নকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, সামাজিক সেবা প্রদানে রাষ্ট্রের ভূমিকা, করের মাত্রা এবং নিয়ন্ত্রণের পরিধি নিয়ে বিতর্ক সবই উন্নয়নের জন্য প্রভাব ফেলে। (৬) গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা নাগরিকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় একটি কণ্ঠস্বর প্রদান করে। অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক শাসন আরও টেকসই এবং ন্যায়সঙ্গত উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। (৭) রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংঘাত উন্নয়নের জন্য মারাত্মক পরিণতি ঘটাতে পারে। অভ্যন্তরীণ দ্ব›েদ্বর সম্মুখীন দেশগুলো প্রায়ই শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করতে লড়াই করে, যা অগ্রগতিতে বাধা দেয়। (৮) পরিবেশগত বিধিবিধান এবং সংরক্ষণ প্রচেষ্টা সংক্রান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখা একটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। (৯) রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সমাজের মধ্যে সম্পদ ও সম্পদের বণ্টনকে প্রভাবিত করে। আয়ের বৈষম্য, বৈষম্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করার নীতিগুলো একটি জাতির সামগ্রিক অগ্রগতি এবং মঙ্গলকে প্রভাবিত করতে পারে। (১০) গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারি নীতি, প্রবিধান এবং বিনিয়োগ প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে উৎসাহিত বা বাধা দিতে পারে, যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। এসব মূল বিষয়ের প্রেক্ষাপটে উন্নয়নের জন্য রাজনীতি সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা যায়, রাজনীতি ও উন্নয়ন পরস্পর সংযুক্ত এবং রাজনীতি একটি জাতির অগ্রগতির গতিপথকে প্রভাবিত করে। কার্যকর ও দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের বৈশিষ্ট্যযুক্ত একটি রাজনৈতিক পরিবেশ টেকসই এবং সামগ্রিক উন্নয়নের ভিত্তি। অন্যদিকে দেশপ্রেম বিবর্জিত রাজনীতি দুর্নীতি, দুর্বল শাসন, উন্নয়ন অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যাস্টিক ও সামষ্টিক পুঁজিলগ্নির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুঁজির ক্রমবিকাশ ব্যতীত রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়কালে দেশে সুশাসনের ভিত্তি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নানাভাবে পুঁজির বিকাশ হয়েছে। নানা অনিয়মের মাধ্যমে পুঁজির বিকাশ সমাজে চরম বৈষম্য উস্কে দিয়েছে। জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে পুঁজির বিকাশ না হওয়ায় নানা পন্থার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থের সামগ্রিক প্রভাব দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরূপভাবে পড়েছে। দেশে যে ধরনের ন্যায়ভিত্তিক পুঁজির বিকাশ হওয়ার কথা ছিল, সেটি অনুপস্থিত। ফলে গণতান্ত্রিক চর্চায় রাজনীতিতে কালো টাকার প্রভাব মূলত রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে ভোটারদের মননজগত নাগরিক দায়বদ্ধতার চেয়ে ব্যক্তি প্রাপ্তির আকাক্সক্ষায় প্রবল হয়ে ওঠে। এমন বাস্তবতায় প্রকৃত রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিন্ন অর্থবিত্তশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হয়। দুঃখজনকভাবে লক্ষ করা যায়- এই অসম প্রতিযোগিতায় নব্য পুঁজিপতি রাজনীতিবিদরা অধিকসংখ্যক হারে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে আইনপ্রণেতা থেকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাসহ সব পর্যায়ে নিজেদের আধিপত্য নিশ্চিত করছে। বাস্তবতা বিবেচনায় দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে রাজনীতিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে বা নব্য পুঁজিপতি রাজনীতিবিদদের কদর ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য হুমকি এবং চূড়ান্ত বিবেচনায় রাজনীতি প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে ছিটকে পড়ছে। তৎপ্রেক্ষিতে লক্ষণীয়, জাতীয় সংসদের ২৬৭ জন সংসদের প্রত্যেকের সম্পদের পরিমাণ কোটি কোটি টাকা। ২৫ লাখ টাকার কম সম্পদের মালিক কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য হতে পারেননি।
প্রকৃত রাজনীতিবিদরা সমাজ পরিবর্তনে নাগরিক দায়বদ্ধতার প্রতি যতটা সচেষ্ট থাকেন, পুঁজিপতি রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে সেটি হওয়ার কথা নয়। তারা রাজনীতিতে অর্থলগ্নি করেন লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষে। নির্বাচনে যা বিনিয়োগ করেন, নির্বাচিত হয়ে সেটি সুদাসলে তুলতে গিয়ে নানা অনিয়মের আশ্রয় নেয়। ফলে উন্নয়ন বরাদ্দ উন্নয়নের বা জনকল্যাণে ব্যবহারে নয়ছয় হয়। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অর্থ লুণ্ঠন হয়। ব্যাংক বীমা লুণ্ঠিত হয়। পণ্য সিন্ডিকেশন জোরদার হয়ে নাগরিক জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। সুশাসনের প্রত্যশা অধরাই থেকে যায়। এমন বাস্তবতায় ভোট উৎসব মূলত কালো টাকা নির্ভর ভোট বেচাকেনার উৎসবে রূপ নেয়াটাই স্বাভাবিক। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এর ব্যতিক্রম হয়নি। অনেক জনবান্ধব ও পরীক্ষিত রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও নির্বাচনে কালো টাকার প্রতিযোগিতার কাছে হার মানতে হয়েছে। রাজনীতির এই অন্ধগলির বিচরণ সামাজিক মূল্যবোধ ধ্বংস করতে উদ্বত। রাজনীতি আদর্শিক চর্চার গণ্ডি থেকে ছিটকে পড়ায় পুঁজিপতি রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থে তরুণ প্রজন্মকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করতেও দ্বিধা করছে না। জ্ঞানভিত্তিক তরুণ প্রজন্ম গড়ে তোলার পরিবর্তে তাদের হাতে মাদকসহ অবৈধ অস্ত্র তুলে দেয়। দখলবাজি, চাঁদাবাজিই এখন তরুণ প্রজন্মের অনেকের রাজনৈতিক আদর্শ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনও এই দুর্বৃত্তায়ন থেকে মুক্ত নন। যা টেকসই স্থিতিশীল উন্নয়নের অন্তরায়।
স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পাকিস্তানে যখন দেশের সম্পদের অধিকাংশের মালিকানা কতিপয় ব্যক্তি এবং দেশের ২ অংশের মধ্যে ক্ষমতা ও সম্পদের পরিমাণ ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়, তখনই রাজনীতিতে পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়। তৎপ্রেক্ষিতে সীমাহীন বৈষম্যের শিকার বাংলার গণমানুষের শোষণ বঞ্চনামুক্ত অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সীমাহীন ত্যাগ ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জন করে স্বাধীনতা। বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটায়। প্রশ্ন হতে পারে- সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের যে আকাক্সক্ষায় পরিবর্তন সংগঠিত হয়েছিল, তার কতটুকু অর্জিত হয়েছে? প্রসঙ্গত বলা যায় ’৭৫-র কলঙ্কজনক অধ্যায়ের পর স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং দেশের সংবিধানে স্বীকৃত সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক অধিকারের মূলনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনে। রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয় উচ্চ বর্ণবাদী করপোরেট কালচার।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহু পূর্বেই উল্লেখিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যথার্থভাবে উপলব্ধি করেছিলেন- স্বাধীনতাবিরোধী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র আবারো বাংলাদেশের রাজনীতিকে সম্রাজ্যবাদী পাকিস্তান ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র বা চক্রান্ত করতে পারে। সেই আশঙ্কা থেকেই বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত স্বপ্ন বাংলার মানুষের দারিদ্র্যমুক্তি। তিনি বলেছিলেন, বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত- শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। গণমানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তির অভিপ্রায়ই ছিল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিল্পবের মূল লক্ষ্য। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের আশঙ্কা থেকেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় এক জনসভার বক্তব্যে ঘুণেধরা সমাজব্যবস্থা পাল্টানোর কথা বলেছিলেন। উচ্চ বর্ণবাদী ধনিক বণিকদের তথাকথিত গণতন্ত্রের পরিবর্তে গণমানুষের ক্ষমতায়নে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্যই তিনি কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠনের কথা বলেছিলেন। সদ্য স্বাধীন দেশের সামগ্রিক প্রশাসনিক অবকাঠামোর দুর্বলতার সুযোগে সাম্রাজ্যবাদীরা যাতে কোনো ষড়যন্ত্র চক্রান্তের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে না পারে এবং দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা আনয়নে বঙ্গবন্ধু সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে এগোতে চেয়েছিলেন। বাকশাল গঠন প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল গ্রামে গ্রামে বহুমুখী সমবায় প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রের অর্থে ভূমিহীন কৃষক জমিতে আবাদ করবে। উৎপাদিত ফসল তিন ভাগে ভাগ হবে। শিল্প কারখানা পরিচালনায় শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব রেখে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এ ছাড়া, গণতন্ত্র বিকেন্দ্রীকরণও ছিল বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য। তিনি চেয়েছিলেন

গণপ্রশাসন। সে জন্য তিনি নির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়ে গভর্নরের নেতৃত্বে কাউন্সিল করেছিলেন। কাউন্সিলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট বলেছিলেন, কোনো দেশের মন্ত্রটন্ত্র আমি আমদানি করব না। বঙ্গবন্ধু সামগ্রিক দারিদ্র্যবিমোচনে সম্পদের সুষম বণ্টনে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। যেটির লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শ্রেণি-বৈষম্য হ্রাস ও শোষণের শৃঙ্খলা থেকে গণমানুষকে মুক্ত করা। তিনি জানতেন এ কঠিন পথ পাড়ি দিতে জ্ঞান ও দক্ষতাভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামোর বিকল্প নেই। যেটির জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। তার ভাবনায় সেটি নিছক গতানুগতিক শিক্ষা ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন ‘আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান’ শিক্ষাদর্শনের বাস্তবায়ন। এ লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতের ৭ ভাগ অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কোনো সরকারই তার কাছাকাছিও যেতে পারেননি।
জাতীয় সব ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নে রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টেকসই উন্নয়ন হলো সামাজিক অগ্রগতির একটি সামগ্রিক এবং দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি; যার লক্ষ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটাতে সক্ষমতার সঙ্গে আপস না করে বর্তমানের চাহিদা মেটানো। গণমুখী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, নীতি এবং শাসন কাঠামো উল্লেখযোগ্যভাবে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতাই একটি জাতির উন্নয়নের গতিপথকে প্রভাবিত করে। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সুনিপুণ নীতিমালা, যা সামাজিক ন্যায্যতা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে অর্থনৈতিক বৃৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখা। প্রয়োজন বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা বিবেচনায় সম্পদের ন্যায়সঙ্গত সুষম ব্যবহার। রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্যই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যা স্বল্পমেয়াদি লাভের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বকে অগ্রাধিকার দেয়। টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশের ক্ষতি বা সম্প্রদায়ের শোষণকারী কার্যকলাপকে নিরুৎসাহিত করার জন্য শক্তিশালী আইনি কাঠামোর দিকে রাজনীতিবিদদের মনোযোগ বাড়াতে হবে। রাষ্ট্রীয় অপরিহার্য প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তি ও কার্যকারিতায় রাজনীতি প্রভাব প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে অস্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নড়বড়ে করে দেয়। যা অগ্রগমনের অন্তরায়। টেকসই উন্নয়নকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নীতি ও কর্মসূচির সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য সক্ষম ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা উচিত। জাতীয় উন্নয়নে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক ন্যায্যতা এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতার মধ্যে ভারসাম্য অর্জনের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর নীতি এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের সামগ্রিক অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে রাজনীতি ও রাজনৈতিক নীতিদর্শনের ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। ৪র্থ-৫ম শিল্পবিপ্লবের যুগে এসেও যদি আদি যুগের বা ১ম শিল্পবিপ্লবের ধ্যান-ধারণায় রাজনীতি নীতিদর্শন অব্যাহত থাকে, তাহলে প্রত্যাশিত উন্নয়ন-অগ্রগমন সম্ভব নয়। বিকাশহীন নিরুদ্যম রাজনৈতিক দিকদর্শন দেশ ও জনগণের উন্নয়ন সমৃদ্ধির পথনির্দেশনাকে শুধু ব্যাহতই করবে না বরং জাতির ক্ষতির কারণও হতে পারে। তাই জাতির সামগ্রিক অগ্রগমনে রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় নতুনত্ব ও গতিময়তার কোনো বিকল্প নেই। বিজ্ঞান প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় জাতীয় অস্তিত্ব টিকে রাখার তাগাদা থেকে বহু দেশ রাজনীতিতে গতানুগতিকতা পরিহার করে প্রযুক্তি ভাবনাযুক্ত রাজনীতি দর্শনে এগিয়ে যাচ্ছে। বলাবাহুল্য, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রার্থী মনোনয়ন ও নির্বাচনী ফলাফলে চলমান শতাব্দীর অগ্রসরমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রাজনৈতিক কৌশল ও পদ্ধতির প্রতিফলন ঘটেছে। ৪র্থ-৫ম শিল্পবিপ্লবের ক্রমবর্ধমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যখন মানুষের চিন্তা-চেতনা জীবনাচরণে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে, তখন রাজনীতি দৃষ্টিভঙ্গি ও দিকদর্শন সামান্যতম পশ্চাতে রাখার সুযোগ নেই। কেননা সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথ ধরে এগিয়েছে। মোদ্দাকথায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর অগ্রযাত্রার ইতিহাসই মানবসভ্যতার পরিবর্তনের ইতিহাস। তাই যারা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে রাজনীতি চর্চা করেন, তাদের চলমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা, ব্লক চেইন, কাগজী মুদ্রার পরিবর্তে বিট কয়েন, চালকবিহীন যানবাহনসহ নব নব প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে। এর ব্যত্যয় জাতিকে উন্নত বিশ্বের তুলনায় পশ্চাতে ঠেলে দেব। ডিজিটাল বাংলাদেশের পথ ধরে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকেও প্রযুক্তি ভাবনাযুক্ত রাজনীতির অংশ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শোষণহীন মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচার অনুসৃত হোক- সেটাই গণমানুষের প্রত্যাশা। দেশের ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক’টি দল ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয় এই মূলনীতি ধারণ করেন, সেটি প্রশ্নবোধক থেকে যায়! এই প্রশ্নের উত্তর ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বকে স্পষ্ট করতে হবে। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নীতিদর্শন, জাতীয় সংগীত ও জাতির পিতার বিষয়ে বিভ্রান্তিকর নেতিবাচকতা আমাদের রাজনৈতিক দৈন্যদশার পরিচয় বহন করে। মুক্তিযুদ্ধকালে স্বল্পসংখ্যক স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রজন্মের সংখ্যা আজ ২০/২৫ ভাগে উন্নীত হয়েছে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের এ প্রজন্ম কেন দিকভ্রান্ত হলো, কেন মোট জনগোষ্ঠীর এক-চতুর্থাংশকে স্বাধীনতাবিরোধী প্রজন্ম হিসেবে গণ্য করতে হচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তর আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুঁজে বের করতে হবে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব আমরা বাতিল করতে পারব না। এদেরকে সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন দেশোপযোগী নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিতে হবে। সুশাসনের রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত রেখে পথভ্রষ্ট এই প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কর্মপ্রয়াস চালাতে হবে।
আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী মহল দেশীয় পথভ্রষ্টদের ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে এদেশে পাকিস্তানি ভাবধারার যে রাজনীতি চালুর অপপ্রয়াস নিয়েছিল, সেটি এখনো চলমান। এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে স্বাধীন দেশের প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারে গড়ে তুলতে হবে, যার জন্য রাষ্ট্রীয় জন্মচেতনা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। এ কাজে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের কঠোর আত্মত্যাগের মানসিকতায় এগিয়ে আসতে হবে। সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। আদর্শিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার দিয়ে পরাজিত শক্তির পরাজয় নিশ্চিত করতে হবে। লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মূল্যবোধকে ধারণ করার জন্য আমাদের ত্যাগের সর্বোচ্চটা দিতে হবে। স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অপশক্তির রাজনীতি চলতে পারে না। তাদেরকে রাজনীতি চর্চার বাইরে রাখতে হলে আমাদের দেশপ্রেমের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এই পরীক্ষায় আত্মভোগের ধারণা পরিহার করে জাতিকে সর্বোচ্চটা দেয়া হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি সুবিচার। অতীতে আমাদের রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে রাজনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই মানবতাবাদী সংগ্রামী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ভাষায় বলব- জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরব বারবার পড়ে যাওয়ার পরও উঠে দাঁড়ানো। হালুয়া রুটির ভাগাভাগির রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিহার করে উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের ন্যায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ২ বা ৩টি রাজনৈতিক দলে রাজনীতিকে সীমাবদ্ধ করতে হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশবাসী সে পথকে সুগম বা সহজ করে দিয়েছে। এখন নির্বাচিত সংসদ সদস্যদেরই সেই রাজনৈতিক অগ্রগমনের নৈতিক দায়িত্বটি পালন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে একক রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।

এ কে এম এ হামিদ, উন্নয়ন গবেষক ও কলাম লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়