বিটিএসের টানে ১৮ ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে ঘর ছাড়ল কিশোরী : নারায়ণগঞ্জ

আগের সংবাদ

শান্তর শুরু, সাকিবের শেষ!

পরের সংবাদ

ইফতারপণ্যের বাজারে আগুন : সরবরাহ পর্যাপ্ত, শুল্ক ছাড় দিয়েও লাগম টানা যাচ্ছে না, সিন্ডিকেট সক্রিয়

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : রমজান কেন্দ্রিক পণ্য নিয়ে ইতোমধ্যেই তৎপর হয়ে উঠেছে অসাধু সিন্ডিকেট। ইফতারের অন্যতম অনুসঙ্গ খেজুর। খেজুরের দাম এখনই আকাশছোঁয়া। এছাড়া ছোলা, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, আদা, রসুন ও পেঁয়াজের দামও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সরকার বলছে, পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত আছে। তাই সরবরাহ নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। তবে নানা অজুহাতে এসব পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই। সরবরাহ ঘটতির অজুহাতে প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। তিন-চার দিনের ব্যবধানে রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ২০-৩০ টাকা।
যদিও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। অপরদিকে, আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কহারসহ আরো কিছু কারণে দাম বেড়েছে। টাকার বিপরীতে ডলারের বাড়তি দাম, এলসি খোলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা এর অন্যতম কারণ। ক্রেতারা বলছেন, রমজানকে সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীচক্র পুরনো ছক কাজে লাগাচ্ছে। রমজান নির্ভর পণ্যের দাম তারা আগেই বাড়িয়ে নিচ্ছে; যাতে রমজানে নতুন করে দাম বাড়ানোর দায় নিতে না হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সরকারের বেঁধে দেয়া দামকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে সিন্ডিকেট ও করপোরেট ব্যবসায়ীরা। অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশিষ্টজনরা বলছেন, বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ৫ থেকে ৬টি করপোরেট কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্য মজুত ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। আদতে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রথম কাজ বিকল্প সরবরাহ নিশ্চিত করা। বাজার দিয়ে বাজারের মোকাবিলা করা। একইসঙ্গে কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে যে বিধান রয়েছে তার মাধ্যমে অপরাধীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া। এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এ অসাধু চক্রকে বাজার কারসাজিতে নিরুৎসাহিত করতে হবে বলে মনে করেন তারা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাজারে ইতোমধ্যে বাড়তে শুরু করেছে ডাল-ছোলা, মসলা, চিনি, ভোজ্যতেল, খেজুর, মাংস-ডিম, আটা-ময়দার দাম। আর কয়েক মাস আগে থেকে ঊর্ধ্বমুখী চাল, মাছ ও সবজির বাজার। দাম নিয়ন্ত্রণে চাল, চিনি, ভোজ্যতেল ও খেজুরের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। খেজুরের আমদানি শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ শতাংশ, যা আগে ছিল ২৫ শতাংশ। অপরিশোধিত প্রতি টন চিনির ওপর এতদিন আমদানি শুল্ক ছিল ৩ হাজার টাকা। সেটি কমিয়ে এক হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া চালের ওপর আমদানি শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ শতাংশ, যা এতদিন ছিল ২৫ শতাংশ। পাম অয়েলের আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ছিল ১৫ শতাংশ, সেটি কমিয়ে পাঁচ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি আসন্ন রোজায় আট ধরনের খাদ্যপণ্য আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে ন্যূনতম পর্যায়ে নগদ মার্জিন রাখতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি এবং খেজুর আমদানির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে। দেশের বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমদানি ঋণপত্র স্থাপনে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্যও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে শুল্ক কমানোর সুফল ভোক্তা পর্যায়ে পেতে আরো সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। শুক্রবার তেজগাঁওয়ে এফডিসিতে দ্রব্যমূল্য নিয়ে এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানান তিনি।
বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েকদিন আগেও দেশি পেঁয়াজ ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। সেই পেঁয়াজ এখন ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অপরদিকে, ভারতীয় পেঁয়াজের দাম ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১৩০ টাকায় পৌঁছেছে। ৯০ টাকা কেজি থেকে বেড়ে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। শত করার হিসেবে দাম বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে সয়াবিন তেল ১০ টাকা বেড়েছে। বোতলজাত প্রতি লিটার ১৬০ টাকা থেকে বেড়ে ১৭০ টাকা ও প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকায়। আর আমদানি শুল্ক অর্ধেক কমানোর পরও বাজারে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে চিনি। প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়। আর প্যাকেটজাত চিনি তো বাজার থেকেই উধাও। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সুমাইয়া স্টোরের বিক্রেতা রমজান আলী জানান, রোজাকে কেন্দ্র করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে মিল মালিকরা। সরকার তাদের প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় না। মিলগুলোতে অভিযান চালালে পণ্যের দাম এমনিতেই কমে যাবে। আর খুচরা বিক্রেতা আবদুস সালাম জানান, পণ্যের দাম খুচরা বিক্রেতাদের হাতে নেই। বাড়তি দামে কেনায়, বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
রাজধানীর বাজারে দেখা যায়, প্রতি কেজি দাবাস খেজুর ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকা, জিহাদি খেজুর ২৪০ টাকা, আজওয়া খেজুর ৯০০ টাকা, বড়ই খেজুর ৪০০ টাকা, মরিয়ম খেজুর ৯০০ টাকা ও মেডজুল খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। বিক্রেতারা বলছেন, বিলাসী পণ্যের মতো শুল্ক আরোপ করা হয়েছে খেজুরে। গত এক বছরের ব্যবধানে খেজুর আমদানি খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। পাশপাশি আসন্ন রমজানকে কেন্দ্র করে বাড়ছে খেজুরের চাহিদা। এতে বাড়ছে দামও।
অস্থির মসলার বাজার : দাম বাড়ানোর প্রভাব পড়েছে মসলার বাজারেও। গত এক মাসের ব্যবধানে এলাচ-লবঙ্গের দাম কেজিতে বেড়েছে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। গোলমরিচ, দারুচিনির দামও বাড়তি। এর কারণ জানেন না বিক্রেতারাও। তাদের দাবি, আমদানিকারকদের কারসাজিতেই বাড়ছে দাম।
প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায়। এছাড়া প্রতি কেজি লবঙ্গ ১ হাজার ৮০০ টাকা, গোল মরিচ ৮০০ টাকা, এলাচ ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা ও দারুচিনি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫২০ টাকা। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি দেশি রসুন ২৬০ টাকায় এবং আমদানি করা রসুন ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর আড়ত পর্যায়ে প্রতি কেজি দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকায়। আর আমদানি করা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায়। এছাড়া মানভেদে প্রতি কেজি আদা বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৪০ টাকায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়ছে আদা-রসুনের।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া দরকার। এক, পণ্য উৎপাদন, মজুত ও চাহিদার যথাযথ তথ্য সরবরাহ ও বিশ্লেষণ। দুই, চাহিদা অনুযায়ী জোগান ঠিক আছে কিনা। ঘাটতি থাকলে সেটি কীভাবে পূরণ করা যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা নেয়া। তিন, পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার পেছনে যাদের হাত থাকে; দক্ষ ও যোগ্য লোক দিয়ে তদন্ত করে সঠিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করা। সেইসঙ্গে প্রতিবেদনে যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হবে, তারা প্রভাবশালী হলেও আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
এদিকে, দায়িত্ব নেয়ার পরই নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন। আর খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কথা বলেছেন। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, দেশে কোনো সিন্ডিকেট থাকতে পারবে না। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা অর্থ, খাদ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ শুরু করেছি। আশা করি, বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হব। রোজার আগে বাজার সামলাতে ও ভোক্তাদের স্বস্তি নিশ্চিত করতে সম্মিলিতভাবে বাণিজ্য, খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী আন্তঃমন্ত্রণালয় সভাও করেছেন। সভায় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, আমরা একযোগে বাজার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে চাচ্ছি। ভোক্তা থেকে উৎপাদক পর্যায়ে কারসাজি ঠেকাতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া হবে। স¤প্রতি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী জানান, এবার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে স্বাভাবিক আইন প্রয়োগ করেই বাজার মনিটরিং জোরদার করা হবে। প্রয়োজন হলে জরুরি আইন প্রয়োগ করা হবে।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। বাজার নিয়ন্ত্রণে আশাবাদী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। মূলত রোজায় বাজার শান্ত করতেই সরকার চিনি, ভোজ্যতেল, খেজুরসহ চার পণ্যে আমদানি শুল্ক ছাড় দিয়েছে। তবে শুল্ক ছাড়ের পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রয়েছে কিনা, সেদিকে নজর দেয়ার পরামর্শ ক্যাব সভাপতির। তিনি বলেন, আমদানিকৃত ও দেশে উৎপাদিত পণ্য ঠিক মতো বাজারে পৌঁছাচ্ছে কিনা সেদিকেও নজর রাখতে হবে সরকারকে। সরবরাহ ঠিক থাকলে, কমে আসবে পণ্যের দাম। স্বস্তি পাবে ভোক্তা।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যারা সিন্ডিকেট করেন; তাদের সরকার চেনে ও জানে। কাজেই তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে সরকারি যেসব নীতিসহায়তা আছে, সেগুলো কমিয়ে দিতে পারেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়