গাজীপুরে ৪ ঘণ্টার চেষ্টায় কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে

আগের সংবাদ

রোডম্যাপ বাস্তবায়নে সংশয়

পরের সংবাদ

শরীফার গল্প ও পাঠ্যপুস্তক সংস্কারের যৌক্তিক পদ্ধতি

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের একটি অধ্যায়ে আছে ‘শরীফার গল্প’। এই গল্পটি এখন সংবাদ। গল্পের বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তা গল্পটিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে দিয়েছে। এই গল্পের দৃশ্যমান উদ্দেশ্য ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ভালো ও সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা। আমাদের সমাজে এখনো ‘হিজড়া’ শব্দ এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যেন তারা সমাজবহির্ভূত জাত। সেই জায়গা থেকে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আবশ্যক। সেই চিন্তা থেকে মাইনরিটি সম্প্রদায় বা তৃতীয় লিঙ্গ তথা ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার প্রয়াস হিসেবে এ ধরনের শিক্ষামূলক গল্পের প্রয়োজন থাকাই স্বাভাবিক।
সমস্যা তখনই দৃষ্টিগোচর হয়, যখন এই গল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তীব্র হয়, আর প্রতিবাদের প্রকৃতি হিসেবে পাঠ্যবইয়ের পাতা ছেঁড়ার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক খণ্ডকালীন শিক্ষক আয়োজিত এক শিক্ষক ফোরামে এই গল্পের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন, তাকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় বহিষ্কার করার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনের বেগ বৃদ্ধি পায়। পাঠ্যবইয়ের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে ভার্চুয়াল প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। এখন দেখতে হবে এই গল্পে কী আছে, আর গল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণ কী? এবং প্রতিবাদের প্রকৃতি কেমন হতে পারত?
গল্পের স্বরূপ : গল্পের শুরুতে বলা আছে- শরীফাকে সবাই ছেলে মনে করলেও সে নিজেকে মেয়ে মনে করত। শরীফা বলছে, ‘আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে’। সে জন্য সে লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েদের মতো সাজতে চাইত… কিন্তু সে পারিবারিকভাবে কোনো সহযোগিতা পায়নি। উল্টো সে কারো সঙ্গে খেলতে পারত না, মেয়েরা খেলায় নিত না ছেলে বলে; আর ছেলেরা খেলায় নিত না মেয়েলি ভাবের জন্য। শরীফা নিজেকে একা ও নিঃসঙ্গ ভাবতে থাকে। একসময় শরীফার সঙ্গে একজনের দেখা। যার সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাকে সবাই মেয়ে মনে করত… কিন্তু সে নিজেকে মনে মনে ছেলে ভাবত। এক পর্যায়ে দুজনই নিজেদের সমপ্রকৃতির মনে করে এমন এক জায়গায় যায়, যেখানে ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠী বসবাস করে। তারা বিভিন্ন কৌশলে আয় রোজগার করতে থাকে, তবে ছেড়ে আসা নিজ পরিবারের জন্য তাদেরও মন খারাপ হয়, তাই মাঝে মাঝে বাড়িতে যায়। গল্পের শেষে তাদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার ব্যক্ত করা হয়েছে।
গল্পের কথায় বোঝা যায়, এখানে তৃতীয় লিঙ্গ বা ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠী নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। কিন্তু হিজড়া ধারণাকে ভুলভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। গল্পের শুরুতে বলা হয়েছে- শরীফা ছেলে হলেও মনে মনে মেয়ে বা আগন্তুক একজন মেয়ে হলেও মনে মনে ভাবত সে ছেলে। এই রকম মনে করাকে বলা হয় জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া। একে জেন্ডার আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডারও বলা হয়। কেননা মানসিক প্রকৃতিতে অসামঞ্জস্যতা হলো মানসিক ডিসঅর্ডার। শারীরিকভাবে ছেলে হলে সে যদি মানসিকভাবে মেয়ে ভাবতে থাকে, এটাকে বলে ট্রান্স ফিমেল (ঞৎধহংভবসধষব), মেয়ে হয়ে ছেলে ভাবলে হবে ট্রান্সমেল (ঞৎধহংসধষব)। এর মানে জন্মগতভাবে জেন্ডারের প্রকৃতি যদি ছেলে হয় অথচ মানসিক ডিসঅর্ডারের কারণে জেন্ডার অনুভূতি যদি মেয়ে হয়- সেটাকে বলে ট্রান্সজেন্ডার। এই সব বৈশিষ্ট্য গল্পে উল্লেখিত ‘হিজড়া’ পরিচয়ের সঙ্গে মিলে না। কেননা তৃতীয় লিঙ্গ বা ‘হিজড়া’ তারাই, যারা জন্মগতভাবে পরিপূর্ণ ছেলে বা মেয়ের বৈশিষ্ট্য পায়নি। শারীরিকভাবে ক্রোমোজোমের বিন্যাসে অসামঞ্জস্যতা থাকায় ভিন্ন প্রকৃতির মানুষের জন্ম হয়। এই প্রকৃতির মানুষদের তৃতীয় লিঙ্গ বা ‘হিজড়া’ বলা হয়।
গল্পের বিষয়বস্তুতে অসামঞ্জস্যতা। এই গল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষ্য ছিল, গল্পটি নাকি সমকামিতাকে উস্কে দিয়েছিল। কীভাবে উস্কে দিয়েছিল তার ব্যাখ্যা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি। কেননা গল্পটি ছিল হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান ও তাদের অধিকার সম্পর্কে। গল্পের কথায় ‘সমকামী’ হওয়ার বাসনা ছিল না।
প্রতিবাদের পদ্ধতি পর্যালোচনা : এবার আসি গল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পদ্ধতি নিয়ে। ‘গল্পটি সমকামিতাকে উস্কে দিচ্ছে’- এমন দাবি তুলে প্রতিবাদের পদ্ধতি হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে ‘বইয়ের পাতা ছেঁড়া’। বক্তব্যে প্রতিবাদী শিক্ষক বলেন, ‘আপনারা বাজার থেকে বইটি কিনবেন আর সেই বই থেকে শরীফার গল্পের পাতা দুটি ছিঁড়ে ফেলবেন’। হতে পারে এটা ভিন্ন এক পদ্ধতি! এর প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকে ‘বইয়ের পাতা ছেঁড়া’ একের পর এক চলতে থাকে, আর ফেসবুকে ভাইরাল হতে থাকে। ‘পাঠ্যবইয়ের পাতা ছেঁড়া’ কর্মসূচিকে কারো কারো কাছে গ্রহণযোগ্য প্রতিবাদ মনে হলেও আমি মনে করি এই পদ্ধতিতে আন্দোলন রুচিসম্মত নয়। আন্দোলন হতে পারে মিছিল করে, লেখনী দিয়ে, পোস্টার লিখে, বক্তব্য দিয়ে।
তাছাড়া, পাতা ছেঁড়ার পদ্ধতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করা হতো ধর্মের বিরুদ্ধে, যেমনটি পবিত্র কুরআনের পাতা ছিঁড়ে করা হতো। আমরা এই পদ্ধতিকে নিন্দা জানাতাম, কেননা এ ধরনের প্রতিবাদে ক্ষোভ প্রকাশ পায় কিন্তু জ্ঞান ও প্রজ্ঞার গুরুত্ব হারিয়ে যায়। সেই পদ্ধতির অনুসরণ করে পাঠ্যপুস্তকের পাতা ছেঁড়া মানে অসুন্দর ভঙ্গিতে প্রতিবাদ করা। যার সঙ্গে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রকাশ থাকে না, ক্ষোভের প্রকাশ থাকে। শুধু তাই নয়, পাতা ছেঁড়া কালচার জাতির মধ্যে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে বাধা হয়ে থাকবে। কারণ অসুন্দর সংস্কৃতি সংক্রামক। এ ধরনের কালচার বিস্তার লাভ করলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।শিক্ষার উদ্দেশ্য যেখানে মানুষের মধ্যে বিচার বিবেচনাশক্তি জাগ্রত করা, সুস্থ মননশীলতার বিকাশ, উন্নত সংস্কৃতির চর্চা এবং মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ববোধ ও মমতার অনুশীলন; সেখানে পাতা ছেঁড়া আন্দোলন শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করবে। যে কোনো আন্দোলনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সমস্যার সঠিক দিক উপলব্ধি ও সমস্যা সমাধানের উপায় চিহ্নিতকরণ। এই জায়গায় ভুল করলে আন্দোলনের নিজস্ব অর্থ হারিয়ে যায়।
অনেকে হয়তো আন্দোলনের যৌক্তিকতা দেখাতে পারেন এই অভিযোগ করে, ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীর নামে ট্রান্সজেন্ডার চালু করার অপপ্রয়াস চলছে; আর এ ধরনের ‘ধর্মবিরোধী’ (?) কাজকে উৎসাহিত করতে এই গল্প পাঠ্যপুস্তকে নিয়ে আসা হয়েছে। এমন অভিযোগ গল্পের বর্ণনার সঙ্গে মিলছে না। কেননা ট্রান্সজেন্ডার আর ট্রান্সসেক্সজুয়াল এক নয়। তবে এই প্রশ্ন হতে পারে, ‘কেউ ছেলে হয়েও নিজেকে নারী মনে করল’ আর এটাকে যদি সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, তাহলে অনেকে স্বীকৃতির সুযোগের অপব্যবহার করতে পারে।
মূলত, পাঠ্যপুস্তকের ‘শরীফা’ গল্পের অসঙ্গতি হলো জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া/ট্রান্সজেন্ডার এবং ‘হিজড়া’ বা তৃতীয় লিঙ্গ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রকাশপূর্বক গল্প লেখা। এই অস্পষ্টতা দূরকরণের নিমিত্তে আন্দোলন হলে তবু সে আন্দোলনের যৌক্তিকতা থাকে। জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া/ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কিত ধারণা একটু জটিল বা ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে, সেই জায়গা থেকে সপ্তম শ্রেণিতে এমন গল্প না আনলেও হতো। তবে শুধু ‘হিজড়া’ বা তৃতীয় লিঙ্গ সম্পর্কে সচেতনতামূলক গল্প আনা প্রাসঙ্গিক।
আমি মনে করি, চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘শরীফা’ গল্পের সংস্কার বা সংশোধনের নিমিত্তে সরকারের পক্ষ থেকে যে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে, সেই কমিটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারবে। সেই সঙ্গে আমরা চাই যে কোনো আন্দোলনে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সুস্থ সংস্কৃতির সংমিশ্রণ।

ড. আশেক মাহমুদ : সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়